প্রশ্ন
মুফতী সাহেবের কাছে আমার প্রশ্ন হল, ইদানিংকালে ফেইসবুক ইউটিউবে এমন অনেক ভিডিও পাওয়া যায়। যাতে দেখা যায় যে, একজন আলেম আরেকজন আলেমের ব্যক্তিগত জীবন এবং পারিবারিক জীবন নিয়ে বিষোদগার করছে। নানা ব্যক্তিগত বিষয় তুলে ধরে সমালোচনা করছে। আমার প্রশ্ন হল, কারো বিষয়ে মতভেদ হলে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন তোলা, সমালোচনা করা কতটুকু শরীয়ত সম্মত?
যেমন তার স্ত্রী সন্তান, বাবা মা, পারিবারিক জীবন ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কিত দুর্বল ও দোষণীয় বিষয়াদী মানুষের সামনে তুলে ধরা।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
কারো সাথে মতভেদের কারণে তার ব্যক্তিগত জীবনকে সামনে এনে মানুষের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসিকতা খুবই ঘৃণ্য এবং গর্হিত কাজ।
এটি যেমনিভাবে শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে নিকৃষ্ট। তেমনি ভদ্রতা ও শালীনতারও খেলাফ।
অন্যের দোষচর্চা করা নিষেধ
১
তোমরা অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না। (সূরা হুজুরাত ১২ আয়াত)
২
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «أَتَدْرُونَ مَا الْغِيبَةُ؟» قَالُوا: اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: «ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ» قِيلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِي أَخِي مَا أَقُولُ؟ قَالَ: «إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ، فَقَدِ اغْتَبْتَهُ، وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ فَقَدْ بَهَتَّهُ
আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, একদা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা কি জান, গীবত কাকে বলে?” লোকেরা বলল, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অধিক জানেন।’ তিনি বললেন, “তোমার ভাই যা অপছন্দ করে, তাই তার পশ্চাতে আলোচনা করা।” বলা হল, ‘আমি যা বলি, তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তাহলে আপনার রায় কি? (সেটাও কি গীবত হবে?)’ তিনি বললেন, “তুমি যা (সমালোচনা করে) বললে, তা যদি তার মধ্যে থাকে, তাহলেই তার গীবত করলে। আর তুমি যা (সমালোচনা করে) বললে, তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তাহলে তাকে অপবাদ দিলে।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৫৮৯]
৩
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” لَمَّا عُرِجَ بِي مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمُشُونَ وُجُوهَهُمْ وَصُدُورَهُمْ، فَقُلْتُ: مَنْ هَؤُلَاءِ يَا جِبْرِيلُ، قَالَ هَؤُلَاءِ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ لُحُومَ النَّاسِ، وَيَقَعُونَ فِي أَعْرَاضِهِمْ “
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যখন আমাকে মি‘রাজে নিয়ে যাওয়া হল, সে সময় এমন ধরনের কিছু মানুষের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখ ছিল তামার, তা দিয়ে তারা নিজেদের মুখমণ্ডল খামচে ক্ষত-বিক্ষত করছিল। আমি, প্রশ্ন করলাম, ওরা কারা? হে জিবরীল! তিনি বললেন, ওরা সেই লোক, যারা মানুষের গোশত ভক্ষণ করত ও তাদের সম্ভ্রম লুটে বেড়াত।” [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৮৭৮]
৪
عَلِيًّا يَقُولُ: لَا تَكُونُوا عُجُلًا مَذَايِيعَ بُذُرًا، فَإِنْ مِنْ وَرَائِكُمْ بَلَاءً مُبَرِّحًا مُمْلِحًا، وَأُمُورًا مُتَمَاحِلَةً رُدُحًا
আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ব্যতিব্যস্ত হয়ো না এবং করে গোপন তথ্য ফাঁস করো না। কেননা তোমাদের পশ্চাতে রয়েছে কিয়ামতের) ভীষণ কষ্টদায়ক এবং দীর্ঘস্থায়ী বিপদসমূহ। [আদাবুল মুফরাদ, হাদীস নং-৩২৭]
৫
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: إِذَا أَرَدْتَ أَنْ تَذْكُرَ عُيُوبَ صَاحِبِكَ، فَاذْكُرْ عُيُوبَ نَفْسِكَ
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, তুমি যখন তোমার সঙ্গীর দোষচর্চা করতে ইচ্ছা করে তখন তোমার নিজের দোষ স্মরণ করো। [আদাবুল মুফরাদ, হাদীস নং-৩২৮]
দোষ গোপন রাখার ফযীলত
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ مَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। [ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-২৫৪৪]
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَنْ سَتَرَ عَوْرَةَ أَخِيهِ الْمُسْلِمِ، سَتَرَ اللَّهُ عَوْرَتَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ كَشَفَ عَوْرَةَ أَخِيهِ الْمُسْلِمِ، كَشَفَ اللَّهُ عَوْرَتَهُ، حَتَّى يَفْضَحَهُ بِهَا فِي بَيْتِهِ»
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন (অপরাধের) বিষয় গোপন রাখবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার গুপ্ত (অপরাধের) বিষয় গোপন রাখবেন। আর যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন বিষয় ফাঁস করে দিবে, আল্লাহ তার গোপন বিষয় ফাঁস করে দিবেন, এমনকি এই কারণে তাকে তার ঘরে পর্যন্ত অপদস্থ করবেন। [ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-২৫৪৬]
গোনাহগারকে উক্ত গোনাহের কথা জনসম্মুখে বলা অনুচিত!
عِكْرِمَةَ يَقُولُ: لَا أَدْرِي أَيُّهُمَا جَعَلَ لِصَاحِبِهِ طَعَامًا، ابْنُ عَبَّاسٍ أَوِ ابْنُ عَمِّهِ، فَبَيْنَا الْجَارِيَةُ تَعْمَلُ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ، إِذْ قَالَ أَحَدُهُمْ لَهَا: يَا زَانِيَةُ، فَقَالَ: مَهْ، إِنْ لَمْ تَحُدَّكَ فِي الدُّنْيَا تَحُدُّكَ فِي الْآخِرَةِ، قَالَ: أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ كَذَاكَ؟ قَالَ: إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْفَاحِشَ الْمُتَفَحِّشَ. ابْنُ عَبَّاسٍ الَّذِي قَالَ: إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْفَاحِشَ الْمُتَفَحِّشَ
ইকরিমা (রহঃ) বলেন, আমার মনে নেই, হয় ইবনে আব্বাস (রাঃ) অথবা তার চাচাতো ভাই একে অপরকে আহারের দাওয়াত দিলেন। এক বাঁদী তাদের সামনে (আহার পরিবেশনের) কাজ করছিল। তাদের একজন তাকে বলেন, হে যেনাকারিনী। তখন অপরজন বলেন, থামো। সে যদি দুনিয়াতে তোমাকে (এই অপবাদের) শাস্তি না দিতে পারে, তবে আখেরাতে অবশ্যই তার শাস্তি দিবে। তিনি বলেন, আপনি কি মনে করেন, ব্যাপারটি যদি তাই হয়? অপরজন বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ অশ্লীল কথক ও অশ্লীলতার বাহককে পছন্দ করেন না। ইনি ছিলেন ইবনে আব্বাস (রাঃ) যিনি বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ অশ্লীল কথক ও অশ্লীলতার বাহককে পছন্দ করেন না। [আদাবুল মুফরাদ, হাদীস নং-৩৩১]
অন্যের বিপদ দেখে খুশি হওয়া নিষেধ
عَنْ وَاثِلَةَ بْنِ الأَسْقَعِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لاَ تُظْهِرِ الشَّمَاتَةَ لأَخِيكَ فَيَرْحَمَهُ اللَّهُ وَيَبْتَلِيكَ
ওয়াসিলাহ্ ইবনুল আসক্বা‘ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তোমার ভাইয়ের বিপদে আনন্দিত হয়ো না। কেননা এতে আল্লাহ তার প্রতি করুণা করবেন এবং ঐ তোমাকে বিপদে নিমজ্জিত করবেন। [সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৫০৬]
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক ও প্রধান মুফতী-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
ইমেইল– [email protected]