প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / একসাথে ছয় তালাক দিলে কোন তালাকই পতিত হয় না?

একসাথে ছয় তালাক দিলে কোন তালাকই পতিত হয় না?

প্রশ্ন

আসসালামু আলাইকুম, আমি (নামটি গোপন রাখা হল) বরিশাল শহরের বাসিন্দা।

২০০৪ সালে (নামটি গোপন রাখা হল) নামের একজনের সাথে আমার বিবাহ হয়। বিবাহের পর থেকে আমার স্বামীর নিকট থেকে বিভিন্ন সময়ে শারিরীক ও মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে থকি। বর্তমানে আমার বাবা-মা ভাই-বোন সবাই  ইংল্যান্ডে সে দেশের নাগরিক হিসেবে বসবাস করছেন।

বর্তমানে আমার দুই মেয়ে এবং এক ছেলে রয়েছে। গত জুন মাসে আমি আবার চতুর্থ সন্তানের মা হিসেবে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ি। কিন্তু আমার স্বামী,আমার চতুর্থ সন্তান জন্ম হোক এটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। তাই শুরু থেকেই আমার গর্ভের সন্তান নষ্ট করার জন্য আমাকে নানাভাবে নির্যাতন করতে থাকে।

কিন্তু আমি কোন ভাবেই তা মানতে নারাজ। আমি চাই আমার চতুর্থ সন্তান সুস্থভাবে দুনিয়াতে আগমন করুক। কিন্তু আমার স্বামীর অত্যচারের মাত্রা ক্রমেই বাড়তে থাকে।

আমার গর্ভের সন্তানের বয়স যখন ৮ সপ্তাহ তখন,এক পর্যায়ে আমার শাশুড়ী,ননদ,এবং আমার বাচ্চাদের সামনে সে আমাকে বলে “আমি তোকে তালাক দিলাম “এবং এই কথাটি সে পর পর ছয় বার উচ্চারণ করে।

আমি পরদিন সকালে আমার পাসপোর্ট নিয়ে বের হয়ে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় চলে যাই। এবং পরের দিন আমার দাদুর বাড়ি চলে যাই।

দীর্ঘ দেড় মাস আমি আমার দাদির সাথে অবস্থান করে অবশেষে আমি আমার মা-বাবার কাছে ইংল্যান্ডে চলে আসি।

সে যখন জানতে পারে আমি ইংল্যান্ডে চলে এসেছি তার পর থেকে সে আমার মা বাবা কে ফোন করতে থাকে যে তার ভুল হয়ে গেছে,সে আসলে তালাক দিতে চায়নি। অনিচ্ছাকৃত তার মুখ থেকে তালাক শব্দ বের হয়ে গেছে।

গত কয়েকদিন আগে সে আহলে হাদিসের এক শায়েখ এর থেকে একটা ফতোয়া আমার বাবার কাছে পাঠায় যে এক সঙ্গে তিন অথবা ছয় তালাক দিলে ও নাকি তালাক হবে না। আর আমার বাবাও সে ফতোয়া বিশ্বাস করে আমাকে আবার আমার স্বামীর কাছে ফিরে যাবার জন্য চাপ দিচ্ছে।

এহেন পরিস্থিতিতে আমার কী করনীয়?

মেহেরবানী করে আমাকে জানিয়ে বাধিত করবেন।

ছয়বার তালাক দেয়ার পরও কি আমার ওপর তালাক পতিত হয়নি ? আমি কি আমার স্বামীর কাছে আবার ফিরে যেতে পারব?

Azimul Alam,

Muhammad motors,

Barishal

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

সংক্ষিপ্ত ফাতওয়া

উপরোক্ত বিবরণ অনুপাতে স্ত্রীর উপর তিন তালাক হয়ে স্ত্রী স্বামীর জন্য হারাম হয়ে গেছে।

যেহেতু তালাকের উদ্দত ও শেষ হয়ে গেছে। তাই এমতাবস্থায় উক্ত মহিলার যদি অন্যত্র বিয়ে হয়, সেখানে স্বাভাবিক ঘরসংসার করে। তারপর কোন কারণে সেখান থেকে তালাকপ্রাপ্তা হয়, বা স্বামী মারা যায়, তাহলে

তালাক বা স্বামীমৃত্যুর ইদ্দত শেষ হবার পর প্রথম স্বামী আবার বিয়ে করতে পারবেন। এছাড়া প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে যাবার আর কোন সুযোগ নেই।

কারণ, তালাক ই্চ্ছা ও অনিচ্ছায় সর্বাবস্থায় স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললে পতিত হয়ে যায়। আর একসাথে তিন তালাক দিলেও পতিত হয়ে যায়। তিনের অধিক তালাক একসাথে প্রদান করলে তিন তালাক পতিত হয়, আর বাকি তালাকগুলো অহেতুক হিসেবে সাব্যস্ত হয়।

তাই স্ত্রীর উচিত প্রথম স্বামীর কাছে কোনভাবেই ফিরে যাবে না। যাওয়া সম্পূর্ণরূপে হারাম। গেলে যিনা-ব্যভিচারের গোনাহ হবে।

বিস্তারিত ফাতওয়া

তালাক অনেক স্পর্শকাতর বিষয়। এটা ইচ্ছেকৃত দিলেও হয়, আবার অনিচ্ছায় বা ঠাট্টাচ্ছলে দিলেও হয়ে যায়। তাই তালাক বিষয়ে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরী।

হাদীসে আসছে যে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ” ثَلَاثٌ جِدُّهُنَّ جِدٌّ وَهَزْلُهُنَّ جِدٌّ: الطَّلَاقُ، وَالنِّكَاحُ، وَالرَّجْعَةُ

হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তিন বিষয় এমন,যা ইচ্ছেকৃত করলে ইচ্ছেকৃত এবং ঠাট্টা করে করলেও ইচ্ছেকৃত বলে ধর্তব্য হয়। তা হল,তালাক,বিবাহ এবং তালাকে রেজয়ীপ্রাপ্তা স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। {সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-২০৩৯, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২১৯৪}

সুতরাং ‘তালাক দেবার ইচ্ছায় তালাক দেয়নি’ বলার দ্বারা তালাক পতিত হবার বিষয়ে কোন প্রভাব সৃষ্টি করবে না। অর্থাৎ তালাক পতিত হয়ে গেছে।

দ্বিতীয় বিষয় হল, একসাথে একাধিক তালাক প্রদান করা।

একসাথে একের অধিক তালাক দেয়া জায়েজ নয়। এটি হারাম কাজ। কিন্তু দিলে তা পতিত হয়ে যায়।

যেমন মদ খাওয়া হারাম কাজ। কিন্তু খেলে মাতাল হয়ে যায়। চুরি করা হারাম কাজ। কিন্তু করলে চুরির শাস্তি প্রযোজ্য হয়।

তেমনি এক সাথে তিন বা ততোধিক তালাক প্রদান করা নাজায়েজ ও হারাম কাজ। কিন্তু দিলে তা প্রয়োগ হয়ে যায়।

কুরআনের আয়াত ও হাদীসের পরিস্কার ভাষ্য দ্বারা তা প্রমাণিত।

যারা এর উল্টো কথা বলেন, তারা কুরআন ও হাদীস বিরোধী বক্তব্য প্রদান করে থাকেন।

যেমন-

فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِن بَعْدُ حَتَّىٰ تَنكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ ۗ فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَن يَتَرَاجَعَا إِن ظَنَّا أَن يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ ۗ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ [٢:٢٣٠]

তারপর যদি সে স্ত্রীকে (তৃতীয়বার) তালাক দেয়,তবে সে স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অপর কোন স্বামীর সাথে বিয়ে করে না নেবে,তার জন্য হালাল নয়। অতঃপর যদি দ্বিতীয় স্বামী তালাক দিয়ে দেয়,তাহলে তাদের উভয়ের জন্যই পরস্পরকে পুনরায় বিয়ে করাতে কোন পাপ নেই। যদি আল্লাহর হুকুম বজায় রাখার ইচ্ছা থাকে। আর এই হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা; যারা উপলব্ধি করে তাদের জন্য এসব বর্ণনা করা হয়। {সূরা বাকারা-২৩০}

পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াতের দ্বারা পরিস্কার প্রমাণিত হয় যে, তিন তালাক প্রদান করলে তিন তালাকই পতিত হবে। এক তালাক নয়।

তিন তালাক বললে এক তালাক পতিত হবার কথা একটি অজ্ঞতাসূচক বক্তব্য ছাড়া আর কিছু নয়। যা পরিস্কার আয়াতের খেলাফ। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এমন কোন হাদীস বর্ণিত হয়নি যে,কোন ব্যক্তি তিন তালাক প্রদান করছে,আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন যে,এক্ষেত্রে তিন তালাক হয়নি বরং এক তালাক হয়েছে। এমন কোন ঘটনা না রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে পাওয়া যায়,না সাহাবীদের থেকে পাওয়া যায়।

তিন বা ততোধিক তালাক একসাথে দিলে ‘কোন তালাক পতিত হয় না’ বলা, বা ‘এক তালাক হয়েছে’ বলা সম্পূর্ণ মনগড়া কথা।

সাহাবায়ে কিরাম,তাবেয়ীগণ,মুজতাহিদ ৪ ইমামগণ ও অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম,সেই সাথে ‎বর্তমান সৌদি আরবের নির্ভরযোগ্য সকল উলামায়ে কিরামগণ এক মজলিসে তিন তালাক দিলে ‎তিন তালাকই পতিত হয়, এক তালাক নয় মর্মে ফতোয়া দিয়েছেন। এ বিষয়ে ইসলামের ইতিহাসে কোন ‎গ্রহণযোগ্য আলেম দ্বিমত পোষণ করেননি। কেবল মাত্র আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যা রহঃ ও ‎তার শিষ্য আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ ব্যতিত। কিন্তু সকল উম্মতের বিপরীত (যেখানে ‎ইমাম চতুষ্টয়- ইমাম আবু হানীফা রহঃ,ইমাম শাফেয়ী রহঃ,ইমাম মালেক রহঃ,ইমাম ‎আহমদ ইবনে হাম্বল রহঃ অন্তর্ভূক্ত) এই দুই জনের সিদ্ধান্ত কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে ‎না। যা কুরআনের আয়াত ও অগণিত হাদিস এবং সাহাবায়ে কিরামের আমল দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। নিম্নে কয়েকটি হাদীস পেশ করা হল। ‎

(১) ‎

وقال الليث عن نافع كان ابن عمر إذا سئل عمن طلق ثلاثا قال لو طلقت مرة أو مرتين فأن النبي صلى الله عليه و سلم أمرني بهذا فإن طلقتها ثلاثا حرمت حتى تنكح زوجا غيرك

হযরত নাফে রহ. বলেন,যখন হযরত ইবনে উমর রাঃ এর কাছে ‘এক সাথে তিন তালাক দিলে ‎তিন তালাক পতিত হওয়া না হওয়া’ (রুজু‘করা যাবে কিনা) বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলো,‎তখন তিনি বলেন-“যদি তুমি এক বা দুই তালাক দিয়ে থাকো তাহলে ‘রুজু’ [তথা স্ত্রীকে বিবাহ করা ছাড়াই ফিরিয়ে আনা] করতে পার। ‎কারণ,রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এরকম অবস্থায় ‘রুজু’ করার আদেশ দিয়েছিলেন। ‎যদি তিন তালাক দিয়ে দাও তাহলে স্ত্রী হারাম হয়ে যাবে, সে তোমাকে ছাড়া অন্য স্বামী গ্রহণ করা পর্যন্ত। {সহীহ বুখারী-২/৭৯২, ২/৮০৩}

(২)

عن مجاهد قال كنت عند ابن عباس فجاء رجل فقال إنه طلق امرأته ثلاثا. قال فسكت حتى ظننت أنه رادها إليه ثم قال ينطلق أحدكم فيركب الحموقة ثم يقول يا ابن عباس يا ابن عباس وإن الله قال (وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا) وإنك لم تتق الله فلم أجد لك مخرجا عصيت ربك وبانت منك امرأتك

অর্থ: হযরত মুজাহিদ রহঃ. বলেন,আমি ইবনে আব্বাস রাঃ-এর পাশে ছিলাম। সে সময় এক ব্যক্তি ‎এসে বলেন-‘সে তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ চুপ করে রইলেন। আমি ‎মনে মনে ভাবছিলাম-হয়ত তিনি তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার কথা বলবেন (রুজু করার হুকুম দিবেন)। কিছুক্ষণ ‎পর ইবনে আব্বাস রা. বলেন,তোমাদের অনেকে নির্বোধের মত কাজ কর;[তিন তালাক দিয়ে দাও!] তারপর ‘ইবনে ‎আব্বাস! ইবনে আব্বাস! বলে চিৎকার করতে থাক। শুনে রাখ আল্লাহ তা‘য়ালা বাণী-“যে ‎ব্যক্তি আল্লাহ তা‘য়ালাকে ভয় করে আল্লাহ তা‘য়ালা তার জন্য পথকে খুলে দেন। তুমিতো স্বীয় রবের নাফরমানী করেছো [তিন তালাক দিয়ে]। এ কারণে তোমার স্ত্রী তোমার থেকে পৃথক হয়ে গেছে। {সুনানে আবু দাউদ-১/২৯৯, হাদীস নং-২১৯৯,সুনানুল কুবরা লিলবায়হাকী,হাদীস নং-১৪৭২০,সুনানে দারা কুতনী,হাদীস নং-১৪৩}

(৩) 

عن مالك أنه بلغه أن رجلا قال لعبد الله بن عباس إني طلقت امرأتي مائة تطليقة فماذا ترى علي فقال له ابن عباس طلقت منك لثلاث وسبع وتسعون اتخذت بها آيات الله هزوا

অর্থ: হযরত ইমাম মালেক রহঃ এর কাছে এ বর্ণনা পৌঁছেছে যে, এক ব্যক্তি হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ এর ‎কাছে জিজ্ঞাসা করল-“আমি আমার স্ত্রীকে একশত তালাক দিয়েছি,এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি? ‎তখন ইবনে আব্বাস রা. বলেন,তুমি যা দিয়েছ তা থেকে তিন তালাক তোমার স্ত্রীর উপর ‎পতিত হয়েছে,আর সাতানব্বই তালাকের মাধ্যমে তুমি আল্লাহ তা‘য়ালার সাথে উপহাস ‎করেছ। [মুয়াত্তা মালেক;১৯৯, হাদীস নং-২০২১]। ‎

(৪) ‎

عن مالك أنه بلغه أن رجلا جاء إلى عبد الله بن مسعود فقال إني طلقت امرأتي ثماني تطليقات فقال ابن مسعود فماذا قيل لك قال قيل لي إنها قد بانت مني فقال ابن مسعود صدقوا

অর্থ: হযরত ইমাম মালেক রহঃ এর কাছে এ বর্ণনা পৌঁছেছে যে,এক ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ‎মাসউদ রাঃ এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বলেন,আমি আমার স্ত্রীকে আট তালাক দিয়েছি। ‎হযরত ইবনে মাসউদ রাঃ বলেন,লোকেরা তোমাকে কি বলেছে? সে উত্তর দিল,তারা বলল ‎‘‘তোমার স্ত্রী ‘বায়ানা’ তালাক প্রাপ্ত হয়ে গেছে’’ তখন হযরত ইবনে মাসউদ রাঃ বলেন,তারা সত্য বলেছে। অর্থাৎ তিন তালাক পতিত হয়েছে। (মুয়াত্তা মালিক; পৃঃ-১৯৯, হাদীস নং-২০২২]‎

(৫)

نا علي بن محمد بن عبيد الحافظ نا محمد بن شاذان الجوهري نا معلى بن منصور نا شعيب بن رزيق أن عطاء الخراساني حدثهم عن الحسن قال نا عبد الله بن عمر أنه طلق امرأته تطليقة وهي حائض ثم أراد أن يتبعها بتطليقتين أخراوين عند القرئين فبلغ ذلك رسول الله صلى الله عليه و سلم فقال : يا بن عمر ما هكذا أمرك الله إنك قد أخطأت السنة والسنة أن تستقبل الطهر فيطلق لكل قروء قال فأمرني رسول الله صلى الله عليه و سلم فراجعتها ثم قال إذا هي طهرت فطلق عند ذلك أو أمسك فقلت يا رسول الله رأيت لو أني طلقتها ثلاثا أكان يحل لي أن أراجعها قال لا كانت تبين منك وتكون معصية

অর্থ: হযরত হাসান রাঃ বলেন,হযরত ইবনে উমর রাঃ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে,তিনি আপন স্ত্রীকে ‎হায়য অবস্থায় এক তালাক দিয়েছিলেন, অতঃপর ইচ্ছা করলেন যে, দুই তুহুরে [হায়য থেকে ‎পবিত্র অবস্থায়] অবশিষ্ট দুই তালাক দিয়ে দিবেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ‎বিষয়ে অবগত হওয়ার পর বলেন-ইবনে ওমর! এভাবে আল্লাহ তা‘য়ালা তোমাকে হুকুম ‎‎দেননি। তুমি সুন্নাতের বিপরীত কাজ করেছ [হায়য অবস্থায় তালাক দিয়েছ]।

তালাকের ‎শরিয়ত সমর্থিত পদ্ধতি হল,‘তুহুর’ পবিত্র হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা। প্রত্যেক ‘তুহুরে’ এক ‎তালাক দেয়া। তার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘রুজু’ করার নির্দেশ ‎দিলেন। এ জন্য আমি ‘রুজু’ করে নিয়েছি। অতঃপর তিনি বললেন,সে পবিত্র হওয়ার পর ‎‎তোমার এখতিয়ার থাকবে। চাইলে তুমি তালাকও দিতে পারবে,বা তাকে নিজের কাছে রাখতে পারবে।

হযরত ইবনে উমর রাঃ বলেন-তারপর আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ‎ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম-ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি যদি তিন তালাক দেই তখনও কি ‎‘রুজু’ করার অধিকার থাকবে? হুজুর সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- না। তখন স্ত্রী ‎‎তোমার কাছ থেকে পৃথক হয়ে যাবে। এবং তোমার এই কাজ (এক সাথে তিন তালাক ‎‎দেয়া) গুনাহের কাজ সাব্যস্ত হবে। {সুনানে দারা কুতনী-২/৪৩৮, হাদীস নং-৮৪, যাদুল মাআদ-২/২৫৭, সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং-১৪৭৩২}

লক্ষ্য করুন উল্লেখিত হাদীস সমূহে তিন তালাক দ্বারা তিন তালাকই পতিত হওয়ার ‎নির্দেশ রয়েছে। এ ছাড়াও আরো অনেক হাদীস সুস্পষ্টভাবে এ বিষয়ের উপর প্রমাণ বহন করে যে,তিন তালাক ‎দ্বারা তিন তালাকই পতিত হবে এক তালাক নয়। ‎

সৌদী উলামাদের সর্বসম্মত ফাতওয়া 

সৌদী আরবের গ্রহণযোগ্য গবেষক আলেমগণ গবেষণা করে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে,তিন তালাকে তিন তালাকই পতিত হবে। সৌদী ওলামাদের নির্ধারিত সিদ্ধান্তের বক্তব্য নিম্নরূপ-

بعد الاطلاع على البحث المقدم من الأمانة العامة لهيئة كبار العلماء والمعد من قبل اللجنة الدائمة للبحوث والإفتاء في موضوع ( الطلاق الثلاث بلفظ واحد ) .

وبعد دراسة المسألة ، وتداول الرأي ، واستعراض الأقوال التي قيلت فيها ، ومناقشة ما على كل قول من إيراد – توصل المجلس بأكثريته إلى اختيار القول بوقوع الطلاق الثلاث بلفظ واحد ثلاثا ___الخ (مجلة البحوث الإسلامية، المجلة الأول، العدد الثالث، سنة 1397 ه

লাজনাতুত দায়িমা লিল বুহুস ওয়াল ইফতা পরিষদ সৌদী আরব কর্তৃক নির্বাচিত ‘এক শব্দে তিন তালাক’ ‎বিষয়ে গবেষণা কর্মে দায়িত্বরত শীর্ষ উলামাগণের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত গবেষণাপত্র ও ‎এ বিষয়ে গভীর অধ্যয়ন, বাছ বিচার ও তার পক্ষে-বিপক্ষে উপস্থাপিত সকল ‎প্রশ্নের উত্তর উত্থাপিত হওয়ার পর অধিকাংশ উলামায়ে কিরামের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিষদ ‎এই সিদ্ধান্তে উপনিত হয় যে,এক শব্দে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই পতিত হবে। ‎‎(মাজাল্লাতুল বুহুসিল ইসলামিয়্যা, প্রথম খন্ড, তৃতীয় সংখ্যা, ১৩৯৭ হিজরী)‎

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা আশা করি এ বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেছে যে, কুরআন ও হাদীস ও উম্মতের ইজমায়ী সিদ্ধান্ত হল, তিন তালাক এক বাক্যে প্রদান করুক,এক বৈঠকে প্রদান করুক,বা একদিন প্রদান করুক,বা এক মাসে প্রদান করুক, যেভাবেই তিন তালাক প্রদান করুক,তিন তালাকই পতিত হবে। এক তালাক নয়। যা কুরআন ও হাদীস ও উম্মতের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত।

একটি সন্দেহের অপনোদন

আহলে হাদীস নামধারী বা লা মাযহাবী বন্ধুরা তিন তালাক একসাথে প্রদান করলে এক তালাক হবে মর্মে যে ফাতওয়া প্রদান করেন, সেটির স্বপক্ষে একটি হাদীস পেশ করে থাকেন। যা সহীহ মুসলিমে বর্ণিত।

মূলত উক্ত হাদীসটির যথার্থ অর্থ না বুঝার কারণে তারা এ হাদীস দিয়ে দলীল পেশ করে থাকেন।

হাদীসটি হল,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ كَانَ الطَّلاَقُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- وَأَبِى بَكْرٍ وَسَنَتَيْنِ مِنْ خِلاَفَةِ عُمَرَ طَلاَقُ الثَّلاَثِ وَاحِدَةً فَقَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ إِنَّ النَّاسَ قَدِ اسْتَعْجَلُوا فِى أَمْرٍ قَدْ كَانَتْ لَهُمْ فِيهِ أَنَاةٌ فَلَوْ أَمْضَيْنَاهُ عَلَيْهِمْ. فَأَمْضَاهُ عَلَيْهِمْ.

হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, এবং আবু বকর সিদ্দীক রাঃ এবং হযরত উমর রাঃ এর খিলাফতের প্রথম দুই বছর তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হতো। তারপর উমর বিন খাত্তাব রাঃ বললেন, লোকেরা ঐ বিষয়ে দ্রুততা করছে, যার ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ ছিল। যদি আমি তাদের উপর উপরোক্ত বিষয়টি নির্ধারণ করে দেই? তারপর তিনি তা নির্দিষ্ট করে দিলেন। {সহীহ মুসলিম। হাদীস নং-৩৭৪৬}

এ হাদীসে ‘নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগ ও আবুবকর রাঃ ও উমর রাঃ এর যুগের প্রথম দুই বছর তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হতো’ মর্মের কথাটি সঠিক মর্মার্থ উদ্ধারে যারা অক্ষম তারা বাহ্যিক তরজমা হিসেবে বলে যে, আগে তিন তালাক বললে এক তালাক ছিল, আর উমর রাঃ এসে তিন তালাক বললে তিন তালাক হবার ফাতাওয়া জারী করেছেন।

কিন্তু আসল বিষয় তা নয়।

মূলত উক্ত হাদীসে একটি নির্দিষ্ট সূরতের একটি মাসআলার বিধান আলোচিত হয়েছে। সেটি বুঝার জন্য একটি বিষয় বুঝতে হবে। সেটি হল,

আরবীতে দু’টি শব্দ আছে। এক হল,‘তাকীদ’। আরেক হল ‘ইস্তিনাফ’।

ইস্তিনাফ হল যেমন একজন মেহমান রুমে ঢুকলে আমি বললাম, ‘মেহমান আসছে’। আবার আরেকজন মেহমান আসলো, আমি বললাম, ‘মেহমান আসছে’। আবার আরেকজন মেহমান প্রবেশ করলে আমি আবার বললাম, ‘মেহমান আসছে’।

এভাবে তিনজন মেহমান আসলে আমি তিনবারই বললাম ‘মেহমান আসছে’। এখানে যেহেতু তিনবার ‘মেহমান আসছে’ বলার দ্বারা তিনজন আলাদা মেহমান উদ্দেশ্য তাই এটাকে বলবে ‘ইস্তিনাফ’।

কিন্তু একজন বড় মেহমান আসল, তখন আমি খুশিতে তিনবার বললাম ‘মেহমান আসছে, মেহমান আসছে, মেহমান আসছে’। বললাম তিনবার। কিন্তু উদ্দেশ্য তিন মেহমান নয়। বরং একজনই। প্রথমবার বললাম ইস্তিনাফ হিসেবে। কিন্তু বাকি দুইবার নতুন কোন অর্থে বলিনি বরং প্রথম কথাটির তাকীদ হিসেবে বলেছি।

এবার মাসআলাটি বুঝুন।

তুমি তালাক, তুমি তালাক, তুমি তালাক।

কেবল উপরোক্ত শব্দে তালাক প্রদান করলে এখানে দু’টি অর্থেরই সম্ভাবনা থাকে। এক হল, ইস্তিনাফ। আরেক হল, তাকীদ।

তাকীদ ধরলে এক তালাক পতিত হয়। আর বাকি দু’টি তালাক তাকীদ হিসেবে ধর্তব্য হয়।

আর যদি ইস্তিনাফ হয়, তাহলে তিন তালাকই পতিত হয়।

এ শব্দে তালাক প্রদানকারীর নিজের নিয়তের উপর এর হুকুম প্রযোজ্য হয়।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে, এবং আবূ বকর রাঃ ও উমর রাঃ এর খিলাফতের প্রথম দুই বছর কোন মুসলমান যদি আদালতে এসে বলতো, আমি আমার স্ত্রীকে ‘তুমি তালাক, তুমি তালাক, তুমি তালাক বলে তিন তালাক প্রদান করেছি। কিন্তু প্রথমটি দ্বারা তালাক ও বাকি দু’টি দ্বারা ইস্তিনাফ নয় বরং তাকীদ উদ্দেশ্য নিয়েছি। তাহলে তার কথা মেনে নেয়া হতো।

হুকুম দেয়া হতো যে, যদিও লোকটি উপরোক্ত শব্দে তিন তালাক প্রদান করেছে। কিন্তু তাকীদ উদ্দেশ্য নেবার কারণে, তালাক তিনটি হয়নি বরং একটি হয়েছে।

কিন্তু কেউ যদি ইস্তিনাফ উদ্দেশ্য নিয়ে উপরোক্ত শব্দে তালাক প্রদান করার দাবী করতো, তাহলে এক তালাক হিসেবে গণ্য করার কোন নজীর নববী এবং সাহাবাযুগে নেই।

যেহেতু প্রথম যুগের মানুষ সবাই সত্যবাদী ছিলেন। তাই যা নিয়ত করতেন, তা’ই বলতেন।

কিন্তু হযরত উমর রাঃ এর সময় যখন পৃথিবীব্যাপী ইসলাম ছড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রায় সকল সাহাবাগণই বিভিন্ন জিহাদের উদ্দেশ্যে সফরে বেরিয়ে পড়েন। তখন মদীনায় প্রচুর নতুন মুসলমানদের আনাগোনা ও বসবাস বৃদ্ধি পায়।

যাদের অনেকের মাঝেই সাহাবাযুগের সেই তাক্বওয়া ও পরহেযগারী বিদ্যমান ছিল না।

তা’ই তাদের কেউ কেউ উপরোক্ত শব্দে তালাক দেবার সময় ইস্তিনাফ তথা তিন তালাক দ্বারা তিন তালাকই উদ্দেশ্য নিতো। কিন্তু আদালতে এসে মিথ্যা কথা বলে বলতো যে,  তিনি ইস্তিনাফ উদ্দেশ্য নিয়ে তালাক দেননি, বরং তাকীদের নিয়তে তালাক প্রদান করেছেন। এটা করতো নিজের বিবিকে তিন তালাকের বিচ্ছেদ থেকে বাঁচানোর জন্য।

তখন হযরত উমর রাঃ প্রতারণার এ পন্থা রুদ্ধ করার জন্য ঘোষণা করলেন যে, যেহেতু যে শব্দে তাকীদ ও ইস্তিনাফের সুযোগ ছিল। কিন্তু এ সুযোগের অসদ্ব্যবহার করা শুরু হয়ে গেছে। তাই তিনি আইন করলেন যে, এখন থেকে উপরোক্ত শব্দে তালাক প্রদান করলে তাকীদের নিয়তের কথা বললে তার কথা আদালতে গ্রহণ করা হবে না। বরং ইস্তিনাফ হিসেবে তিন তালাকই পতিত হয়েছে বলে ধর্তব্য হবে।

এ হাদীসে কেবল একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি তথা ‘তুমি তালাক, তুমি তালাক, তুমি তালাক’ সংক্রান্ত মাসআলা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। যেখানে তাকীদ ও ইস্তিনাফ এর অর্থের সুযোগ রয়েছে।

কিন্তু এক বাক্যে তিন তালাক প্রদান করলে, বা এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক বলে তালাক প্রদান করলে, কিংবা ইস্তিনাফের নিয়তে উপরোক্ত শব্দে তালাক দিলে এক তালাক নববী ও আবু বকর রাঃ এর যুগে গণ্য করা হতো মর্মে কোন হাদীস বর্ণিত হয়নি।

সুতরাং একটি বিশেষ মাসআলা সম্পর্কিত হাদীসকে এক বাক্যে তিন তালাক প্রদান, বা নাম্বার দিয়ে তিন তালাক কিংবা ইস্তিনাফ তথা আলাদা স্বতন্ত্র তালাকের নিয়তে তিন তালাক দেয়ার উপর প্রযোজ্য করা হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নয়।

শরহে নববীতে ইমাম নববী রহঃ উক্ত হাদীসের আলোচনায় এ বিষয়টি সুষ্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছেন। যার আরবী পাঠ হল,

أنه كان في أول الأمر إذا قال لها أنت طالق أنت طالق أنت طالق ولم ينو تأكيدا ولا استئنافا يحكم بوقوع طلقة لقلة ارادتهم الاستئناف بذلك فحمل على الغالب الذي هو ارادة التأكيد فلما كان في زمن عمر رضي الله عنه وكثر استعمال الناس بهذه الصيغة وغلب منهم ارادة الاستئناف بها حملت عند الاطلاق على الثلاث عملا بالغالب السابق الى الفهم منها في ذلك العصر

সুতরাং উক্ত হাদীসকে এক বাক্যে তিন তালাক প্রদানকে এক তালাক হবার দলীল হিসেবে পেশ করা অজ্ঞতা ছাড়া আর কী হতে পারে?

বুঝা গেল যে, লা মাযহাবী কথিত মুফতী সাহেব যে ফাতাওয়া প্রদান করেছেন তা সম্পূর্ণ ভুল ও মনগড়া।

প্রশ্নোক্ত মহিলা তিন তালাকপ্রাপ্তা হয়ে স্বামীর জন্য হারাম হয়ে গেছে। তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ, ঘর সংসার করা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও যিনা হিসেবে গণ্য হবে।

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক ও প্রধান মুফতী-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইমেইল[email protected]

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *