প্রশ্ন
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রোগীর মেসেজ
আসসালামু আলাইকুম
মানসিক ভাবে খুবই বিপর্যস্ত। আর পারছি না নিজের সাথে যুদ্ধ করতে তাই নিরুপায় হয়ে আপনার শরণাপন্ন হলাম।
আমি একজন মহিলা। পেশায় একজন ডাক্তার। আমার পড়াশুনা যখন শেষ, লাস্ট পরীক্ষার পর ছুটিতে আমি মাস্তুরাত জামাতে যাই। আমার জীবন বদলে যায়। পুরাপুরি দ্বীনের উপর উঠার জন্য পেশা, পড়াশুনা ছেড়ে দেই আলহামদুলিল্লাহ।
আমার বিয়ে হয় সেই পরীক্ষার কিছুদিন আগেই। বিয়ের দিন থেকেই আমার ননদ আমার সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করে কোনো কারন ছাড়াই। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকেই সে অজানা কারনে এমন শুরু করে। পরবর্তীতে জানতে পারি সে এমনই। আর বাসায় সদস্য হবার পর বুঝতে পারি বাসায় ছেলে মেয়েরা সবাই কম বেশি আদবহীন। মা বাবারা সন্তানদের ভয় পান, সব সময়ই তাদের প্রসংশা করেন বাড়িয়ে বাড়িয়ে, গর্ব করেন কিন্তু শাসন করেন না। তাদের ভুল গুলো চাপা দেন। আমার সাথে ক্রমাগত দুর্ব্যবহার, বেয়াদবি হতে থাকে আমার স্বামী আর মুরুব্বিরা চুপ থাকেন। উলটা আমাকে বলেন এসব সব বাসায় হয়।
আমি দুর্ব্যবহার, অর্থনৈতিক কষ্ট সব কিছুই মেনে নেই। কিছুই বলি না। আমার স্বামী বলেন উনি তাবলিগ করেন তাই উনি চুপ থাকবেন। আর আমাকে সহ্য করতে হবে। উনি এটাও স্বীকার করেন আমি বরাবরই নির্দোষ এবং জুলুমের শিকার। আমি চাইতাম আমি সংসার করবো, বাসায় থাকবো, দ্বীন চর্চা করবো।মাদ্রাসায় ভর্তি হই কিন্তু প্রাকটিস ছেড়ে দিবো শুনে শশুড় শাশুড়িও বদলে যান। নানা কথা শুনান। শাশুড়ীর কথা এতো নামাজ পড়ি কেন, ননদের কথা এ কেমন কথা ঘর থেকে বের হই না।
এদিকে বাচ্চাও হচ্ছে না। ততদিনে ননদের বিয়ে হয়েছে, বাচ্চাও হয়েছে, আমার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেলো। আমাকে মানসিক ডাক্তার দেখানো হলো সে আমার স্বামীকে বুঝালেন অন্তত আমার শাশুড়ী যেনো আমার সামনে ননদের প্রসংশা কথা না তুলে। কিন্তু কিছুই বদলায় নাই। উলটা আমাকে জ্বিনের রুগি আমি এটা বলা হয়। চিকিৎসা শুরু হয়।আমি চুপ হয়ে যাই।
আমার স্বামীর বুদ্ধিতে আমি আবার প্রাকটিস শুরু করলাম বাসা থেকে দুরে থাকার জন্য। আমি শুরু করলেই আল্লহ কবুল করেন বাচ্চা পেটে আসে। আমি ভাবি বাচ্চা হলে সব বদলে যাবে। কিন্তু পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ। বাচ্চা বড় হচ্ছে বাচ্চাও তাদের মত হচ্ছে। কারন সারাদিন তাদের সাথেই থাকে। আমাকে বলে তুমি ক্লিনিক করো, টাকা পয়সা কামাও বাচ্চা আমরা পালবো। যে ঘর থেকে টিভি, ডাইনিং টেবিল সরিয়ে ফেলি মেহনত দ্বারা, সে ঘরে এখন আমার বাচ্চা, শশুড় শাশুড়ি একসাথে ইউটিউবে ভিডিও দেখে। মোবাইল টা তাদের আমার ননদের দেয়া।
আগে ঘরের কাজের চেষ্টা করতাম। আমার স্বামী বলতো তুমি জোড় করে করবা, মহিলারা চাইলেই দখল নিতে পারে। আমি পারিনি। রান্না ঘরে গেলে মা জিজ্ঞেস করেন কি করি সেখানে। স্বামীর কাপড় ধুইলে বলেন আমার ছেলের টা আমি বুয়াকে দিয়ে বসে থেকে না ধুয়ালে পরিষ্কার হবে না। স্বামীর সব কাগজপত্র, টাকা তার বাবার কাছে থাকে। আমি নাকি হারিয়ে ফেলবো। যেখানে আমার ইনকাম ও থাকে। বাসায় খাবারের মান খুব খারাপ। আম্মুর বাসায় গিয়ে ভালো খাবার দেখলে কেদে দেই।
আর আমি রান্না করলে আমার শাশুড়ী খেতে পারেন না, যদিও শশুর আর স্বামী খেতে পারেন। তাই রান্না করি না। বাসার কোনো জিনিষ আমি নিজের ইচ্ছায় কোথায় রাখলে আগে সরাসরি বললেও এখন বলে না কিছু, শুধু আমি সরে যাবার পর নিজেদের মতো সরিয়ে রাখে।
বাসার বুয়া শাশুড়ীর আদেশে চলে, আমি তাই এখন আর কিছু নিয়েই কিছু বলি না অনেক বছর। চুপ করে দেখি আর সরে যাই। উল্লেখ্য ননদ বেড়াতে আসলে সে তার ইচ্ছা মতো যা খুশি করে কেউ কিছু বলে না, আর বাসার অধিকাংশ সামগ্রী আমার আম্মুর দেয়া কিংবা আমার নিজের কেনা।
আমার সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করে না। কিন্তু বলে তুমি পারবে না সংসার দেখতে তাই তোমাকে দেই না। আমি যদি বাহির পারি তাহলে কেনো নিজের সংসার পারবো না? কেউ কষ্ট না পায় তাই নিরবে দূরে সরে আছি সব কাজ থেকে বাসার। যা বলে তাই করে দেই।
আমি তো একজন মেয়ে মানুষ। সবার ইচ্ছা নিজের সংসার হবে। নিজের স্বামী সন্তানের জন্য কিছু করবে৷ আর আমি বাহিরে কাজ করতে চাই না৷ বাসায় টানা ২-৩ দিন থাকলে শশুড় জিজ্ঞেস করেন কি ব্যপার বাসায় কেনো, না গেলে সব টাকা কর্মচারীরা মেরে দিবে।
আমার স্বামি বলেন ইসলাম বলেছে আলাদা ঘর দিতে, তোমাকে একটা রুম দিয়েছি। আর আবু বকর (রা) তার বাবা মার সাথে থাকতেন। স্বামীর কষ্ট হবে, একমাত্র ছেলে, সমাজের মানুশ আলাদা থাকলে খারাপ বলবে এই ভয়ে চুপ করে থাকি।
কিন্তু আমি এতোটা মানসিক ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছি যে আমি আমার ঘরেই থাকি। সব সময় হাসি খুশি থাকার খুব চেষ্টা করি, বাহিরে যাই কিন্তু শান্তি পাই না। সবচে বড় সমস্যাঃ
১/ আমি আমল করছি না কোনো, ফরয আমল ও ছুটে যাচ্ছে। ডিপ্রেশনে কিছুই ভালো লাগে না। সব কিছু অর্থহীন লাগে। আবার আমল করি না তাই শান্তিও পাই না।
২/ আমি আমল করি না এটাই সবাই দেখে, আমার ডিপ্রেশন না। আরো কথা শুনায়।এতে বেচে থাকার আগ্রহই পাচ্ছি না।
উল্লেখ্য আমাদের মেহনতে সবাই এখন তাবলিগে যায়। পর্দা করে। কিন্তু আমার স্বামী বাসার বাহিরে গেলে, সবাই আগের মতো হয়ে যায়। উপরন্তু উনি মাসের অনেকটা সময় সফরেই থাকেন তাই বুঝতেই পারছেন কি চলে বাসায়।
৩/ আমি জাহেল অবস্থায় ফিরে যাচ্ছি। পর্দা নষ্ট হচ্ছে। ঘরে বসে থাকি কাজ নাই তাই আমিও ইউটিউবে নাটক দেখি। আমি খুব খুজে খুজে এমন নাটক দেখি যেগুলো তে শুধুই আনন্দমুখর স্বামী স্ত্রীর জীবন্ন, সংসার দেখায়। মূলত আমার ডিপ্রেশন দূর করার ওষুধ বের করেছি এটা যা আমার দুনিয়া আখিরাত নষ্ট করছে।
৪/ আপনি ভাববেন আমি তো সব বুঝি নিজের সমস্যা। তাহলে কেনো এসব করি? কিন্তু আমি সত্যিই নিজেকে দ্বীনের পথে ধরে রাখতে পারছি না। আমার সমস্যা জ্বীনের না, মানসিক। আমার স্বামীকে বলেছি আলাদা বাসা নিতে আমার আখিরাত বাচাতে। কিন্তু সে নিমরাজি। তার কথা আবু বকর (রা) বাবা মার সাথেই থাকতেন। সে সব বুঝেও সমাজ আর মা বাবার মায়ায় আমাকে জাহান্নামের আগুনে ঠেলে দিচ্ছে।
৫/ আমি যখন একা থাকি, মা বাবা গ্রামে যান ৭-১০ দিন। তখন সংসারের কাজ আমি ই করি। তখন বাহিরে যাই খুব কম। আর নাজায়েজ কোনো কাজের সময় পাই না সংসারের কাজ করে।
৬/ কোনো প্রাইভেসী নেই। আমার ঘরে ঠাসটুস ঢুকে যান তারা সবাই। আমার কেনো এতো জামা এসবও বলেন। যদিও আমি বছরে দুইটা জামা বানাই।
৭/ খাবারের অবস্থা এতো খারাপ যে ৮ বছর ধরে সহ্য করছি। এখন আমার বাচ্চাও সেই কষ্ট করছে। সারাদিন জিজ্ঞেস করে আম্মু আমি কি খাবো৷ আমি নিজে ফেরার পথে কিনে আনলে তারা ব্যাগ খুলে খুলে দেখে আর বলে তুমি কেনো আনসো ভালো না এসব খাবার বা সবজি।
আশাকরি আমার আর আমার স্বামীর জন্য উপকারী কিছু নাসিহা এবং ইসলাম কি বলে এই অবস্থায় তা জানবেন।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
যেহেতু একসাথে থাকার দরূন আপনার মানসিক ও ধর্মীয় ক্ষতি হচ্ছে। তাই আপনার স্বামীর উচিত আপনার জন্য আলাদা বাসার ব্যবস্থা করে দেয়া।
শ্বশুর শ্বাশুরীর খিদমাত করা পুত্রবধুর উপর শরয়ী কোন জিম্মাদারী নয়। বরং সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি মানসিক ও ধর্মীয় ক্ষতি হয়, তাহলে তাদের খিদমাত করার যৌক্তিকতা রহিত হয়ে যায়।
সেই হিসেবে আপনার স্বামীর উচিত আপনার জন্য নিরিবিলি আলাদা থাকার ব্যবস্থা করা। যাতে আপনি আপনার ধর্মীয় জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করতে পারেন।
তবে যদি, কষ্ট হলেও সব কিছু মানিয়ে শ্বশুর শ্বাশুরীকে নিজের মায়ের মর্যাদা দিয়ে একসাথে থাকতে পারেন, তবে সেটাই হবে অতি উত্তম।
وَلَوْ أَرَادَ أَنْ يُسْكِنَهَا مَعَ ضَرَّتِهَا أَوْ مَعَ أَحْمَائِهَا كَأُمِّهِ وَأُخْتِهِ وَبِنْتِهِ فَأَبَتْ فَعَلَيْهِ أَنْ يُسْكِنَهَا فِي مَنْزِلٍ مُنْفَرِدٍ؛ لِأَنَّ إبَاءَهَا دَلِيلُ الْأَذَى وَالضَّرَرِ وَلِأَنَّهُ مُحْتَاجٌ إلَى جِمَاعِهَا وَمُعَاشَرَتِهَا فِي أَيِّ وَقْتٍ يَتَّفِقُ لَا يُمْكِنُ ذَلِكَ مَعَ ثَالِثٍ؛ حَتَّى لَوْ كَانَ فِي الدَّارِ بُيُوتٌ وَجَعَلَ لِبَيْتِهَا غَلَقًا عَلَى حِدَةٍ قَالُوا لَيْسَ لَهَا أَنْ تُطَالِبَهُ بِآخَرَ (رد المحتار-5/321، الفتاوى الهندية-1/556)
ليس للرجل أن يستخدم امراته الحرة الخ (الفتاوى التاتارخانية-4/209، رقم-6271
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক ও প্রধান মুফতী – মা’হাদুত তালীম ওয়াল বুহুসিল ইসলামিয়া ঢাকা।
ইমেইল– [email protected]