প্রচ্ছদ / ইসলাহী/আত্মশুদ্ধি / যিকিরের হাকীকত ও ফযীলত

যিকিরের হাকীকত ও ফযীলত

আল্লামা মনজূর নূমানী রহঃ

ইসলামী শিক্ষার মূলকথা হলো, আল্লাহর বান্দা আল্লাহর হুকুম-মতো জীবন যাপন করবে এবং সকল কাজে আল্লাহ পাকের আনুগত্য করবে। সর্বাবস্থায় বান্দার দিলে যখন আল্লাহ পাকের কথা স্মরণ থাকবে, আল্লাহ পাকের ভয় ও মুহাব্বত যখন তার অন্তরে স্থান করে নেবে, কেবল তখন সকল কাজে আল্লাহ তাআলার হুকুমের সামনে আত্মসমর্পন করা সম্ভব হবে। এই জন্য বেশি বেশি যিকির করা ইসলামের একটি বড় শিক্ষা।

যে ব্যক্তি বেশি বেশি তসবি পাঠ করে, তার অন্তরে আল্লাহ পাকের ভয়, মর্যাদা ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। এটা পরীক্ষিত সত্য। আপনি যার রূপগুণের ধ্যানে দিনরাত মশগুল থাকবেন, তার মর্যাদা ও ভালোবাসা আপনার অন্তরে অবশ্যই গেঁথে যাবে এবং শনৈ শনৈ তা বৃদ্ধি লাভ করবে।

তেমনি যারা সবসময় আল্লাহর যিকিরে মগ্ন থাকে, যাদের জিহ্বা আল্লাহ পাকের যিকিরে সতেজ থাকে, তাদের অন্তর আল্লাহর মুহাব্বত ও আজমত এবং বড়ত্ব ও ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে যায়। এশক ও ভালোবাসার চেরাগ তাদের আত্মাকে আলোকিত করে তোলে। মোটকথা, ভালোবাসা ব্যতীত আনুগত্য পূর্ণতা পায় না। সুতরাং আল্লাহ পাকের আনুগত্যশীল বান্দা হতে হলে অন্তরে তাঁর ভালোবাসা পয়দা করতে হবে। আর তা হবে বেশি বেশি যিকির করার দ্বারা। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيرًا. وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
হে মুমিনগণ! তোমরা বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করো এবং সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর নামে তসবি পাঠ করো। সূরা আহযাব ৩৩/৪১-৪২

অন্য আয়াতে বলেন,

وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করো। তাহলে তোমরা সফলকাম হবে। সূরা জুমুআ ৬২/১০

দুটি জিনিসের পিছনে পড়ে মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায়। আল্লাহ পাক সে-সম্পর্কে মুমিন বান্দাদের সতর্ক করে বলেন,

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মালদৌলত আর বিবি-বাচ্চারা যেন তোমাদেরকে আল্লাহর যিকির থেকে বেখবর করে না ফেলে। এমনটা যারা করে, আসলেই তারা ক্ষতিগ্রস্ত। সূরা মুনাফিকূন ৬৩/৯

পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ এবং নিঃসন্দেহে তা আল্লাহ পাকের যিকির, বরং উত্তম প্রকারের যিকির। কিন্তু কোনো মুসলমানের জন্য এটা সঙ্গত নয় যে, সে শুধু নামাযের যিকিরে সীমাবদ্ধ থাকবে, নামাযের বাইরে কোনো যিকির করবে না এবং আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করবে না। বরং ইসলামের নির্দেশ এই যে, তুমি যে অবস্থাতেই থাকো, আল্লাহর যিকির থেকে গাফেল হয়ো না। আল্লাহ পাক বলেন,

فَإِذَا قَضَيْتُمُ الصَّلَاةَ فَاذْكُرُوا اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِكُمْ
যখন নামায শেষ হয়ে যাবে, তখন দাড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহর যিকির করতে থাকবে। সূরা নিসা ৪/১০৩

যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করছে, তাদেরকে যুদ্ধাবস্থায়ও বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করার নিদের্শ দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে,

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
হে মুমিনগণ! যখন তোমরা কোনো শক্রবাহিনীর মুখোমুখী হও, তখন দৃঢ়পদ থাকো এবং বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করো, তাহলে তোমরা সফল হবে। সূরা আনফাল ৮/৪৫

আয়াতগুলো থেকে বোঝাগেলো, যিকিরের মাঝে মুসলমানদের সফলতার বিরাট দখল রয়েছে এবং যারা আল্লাহর যিকির থেকে গাফেল তারা ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তেমনি একটি আয়াতে এসেছে,

أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
মনে রেখো! আল্লাহর যিকিরের দ্বারাই অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। সূরা রাআদ ১৩/২৮

হাদীস শরীফে এসেছে,

أَيُّ العِبَادِ أَفْضَلُ دَرَجَةً عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ القِيَامَةِ؟ قَالَ: الذَّاكِرُونَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتُ. إسناده ضعيف
নবীজীর নিকট জানতে চাওয়া হলো, কেয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সবচে মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত কী হবে? নবীজী বললেন, আল্লাহর যিকির, যিকিরকারী চাই সে পুরুষ হোক বা নারী। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৭৬

অন্য হাদীসে নবীজী বলেন,

مَثَلُ الَّذِي يَذْكُرُ رَبَّهُ وَالَّذِي لاَ يَذْكُرُ رَبَّهُ، مَثَلُ الحَيِّ وَالمَيِّتِ
যে আল্লাহকে পাককে স্মরণ করে, আর যে করে না, তাদের দু’জনের উদাহরণ জীবিত আর মৃতের মতো। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৪০৭

অর্থাৎ যে আল্লাহ তাআলার যিকির করে না, সে হলো মৃত। একটি হাদীসে নবীজী এরশাদ করেন,

إِنَّ لِكُلِّ شَيْءٍ صِقَالَةً، وَإِنَّ صِقَالَةَ الْقُلُوبِ ذِكْرُ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَمَا مِنْ شَىْءٍ أَنْجَى مِنْ عَذَابِ اللَّهِ مِنْ ذِكْرِ اللَّهِ. إسناده ضعيف
প্রত্যেক জিনিসের জং দূর করার জন্য রেত থাকে। আত্মার জং দূর করার রেত হলো যিকির। আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচার জন্য উসিলা হিসাবে যিকিরের চে প্রভাবশালী কোনো আমল আর নেই। দাওয়াতে কাবীর বায়হাকী, হাদীস নং ১৯

যিকিরের হাকীকত

যিকিরের মূল কথা হলো, বান্দা যেন আল্লাহকে ভুলে না যায়। যে কাজে বা যে অবস্থায় বান্দা থাকুক, সে যেন আল্লাহ পাকের হুকুম বিস্মৃত না হয়। এর জন্য সর্বক্ষণ মুখে আল্লাহ পাকের নাম জপা শর্ত নয়। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, সবসময় যাদের অন্তরে আল্লাহ পাকের কথা স্মরণ থাকে, তাদের জিহ্বাও সর্বক্ষণ আল্লাহ পাকের যিকিরে সচল থাকে। আর এই অবস্থা অর্জন হয় তাদের, যারা বেশি বেশি মুখে যিকির করার মাধ্যমে দিল ও দেমাগে আল্লাহ পাকের ধ্যান ও খেয়ালের একটি বিশেষ আবহ তৈরি করে নেয় এবং আল্লাহ তাআলার সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। তাই অধিক হারে মৌখিক যিকিরও গুরুত্বপূর্ণ। অথচ কেউ কেউ বেশি বেশি মৌখিক যিকির করাকে অনর্থক কাজ মনে করে। আমাদের মতে তাদের ধারণা যথার্থ নয়। যেহেতু হাদীসে পাকে স্পষ্ট এসেছে,

يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ شَرَائِعَ الإِسْلَامِ قَدْ كَثُرَتْ عَلَيَّ، فَأَخْبِرْنِي بِشَيْءٍ أَتَشَبَّثُ بِهِ، قَالَ: لَا يَزَالُ لِسَانُكَ رَطْبًا مِنْ ذِكْرِ اللَّهِ
জনৈক সাহাবী নবীজীর নিকট আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! ইসলামে তো অনেক আমলই আছে। আমাকে আপনি একটি আমলের কথা বলেদিন, যা আমি আজীবন আঁকড়ে থাকবো। নবীজী বললেন, তোমার জিহবা যেন সবসময় আল্লাহর যিকিরে আদ্র থাকে। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৭৫

অন্য এক হাদীসে এসেছে,

أَنَا مَعَ عَبْدِي إِذَا هُوَ ذَكَرَنِي وَتَحَرَّكَتْ بِي شَفَتَاهُ.
আল্লাহ পাক বলেন, বান্দা যখন আমাকে স্মরণ করে এবং আমার যিকিরে তার ঠোঁট দুটি নড়তে থাকে, তখন আমি তার সঙ্গী হয়ে যাই। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৩৭৯২

১. নবীজীর শেখানো বিশেষ কিছু যিকির

এক:

হাদীস শরীফে এসেছে,

أَفْضَلُ الذِّكْرِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ
সর্বোত্তম যিকির হলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৮৩

অন্য হাদীসে এসেছে,

مَا قَالَ عَبْدٌ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ قَطُّ مُخْلِصًا، إِلاَّ فُتِحَتْ لَهُ أَبْوَابُ السَّمَاءِ، حَتَّى تُفْضِيَ إِلَى العَرْشِ، مَا اجْتَنَبَ الكَبَائِرَ.
যখন কোনো বান্দা পূর্ণ এখলাসের সাথে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে, তখন আসমানের সবগুলি দরজা খুলে যায় এবং এই কালিমা সরাসরি আল্লাহ পাকের আরশে পৌঁছে যায়, যদি সে বান্দা কবিরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৯০

একটি হাদীসে এসেছে, হযরত মুসা আলইহিস সালাম আল্লাহ পাকের নিকট আরজ করলেন,

يَا رَبِّ عَلِّمْنِي شَيْئًا أَذْكُرُكَ بِهِ وَأَدْعُوكَ بِهِ، قَالَ: يَا مُوسَى: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، قَالَ مُوسَى: يَا رَبِّ: كُلُّ عِبَادِكَ يَقُولُ هَذَا، قَالَ: قُلْ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، قَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ، إِنَّمَا أُرِيدُ شَيْئًا تَخُصَّنِي بِهِ، قَالَ: يَا مُوسَى، لَوْ أَنَّ السَّمَوَاتِ السَّبْعَ وَعَامِرَهُنَّ غَيْرِي، وَالْأَرَضِينَ السَّبْعَ فِي كَفَّةٍ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ فِي كَفَّةٍ مَالَتْ بِهِنَّ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ. صححه الحافظ ابن حجر في الفتح
হে আল্লাহ! আমাকে এমন কোনো কালিমা বাতলে দিন, যার দ্বারা আমি আপনার যিকির করতে পারি। উত্তর এলো, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ দ্বারা আমার যিকির করো। হযরত মুসা বললেন, এই কালিমা দ্বারা তো সবাই যিকির করে! আমি এটা ছাড়া বিশেষ কোনো কালিমা জানতে চাই। ইরশাদ হলো, হে মুসা! যদি সপ্তাকাশ ও তথাকার সমুদয় সৃষ্টি এবং সাত তবক জামিন এক পাল্লায় রাখা হয়, আর অন্য পাল্লায় এই কালিমা রাখা হয়, তবে এই কালিমার পাল্লাই অধিক ভারী হয়ে যাবে। সুনানে কুবরা নাসাঈ, হাদীস নং ১০৬০২

সত্যিই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এমনই ওজনী। কিন্তু লোকেরা একে একটি সাধারণ বাক্য বলে মনে করে। একজন আল্লাহ্র ওলী এক বিশেষ হালতে আমাকে লক্ষ্য করে বলেন,

‘কারো কাছে যদি দুনিয়ার সমস্ত সম্পদও থাকে এবং আমাকে বলে, তুমি দুনিয়ার এই সমস্ত সম্পদ নিয়ে যাও, বিনিময়ে তোমার একবারের ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আমাকে দিয়ে দাও, তবে এই ফকির তাতে রাজী হবে না।’

এটা অতিরঞ্জন নয়, সত্য। আল্লাহ্ পাকের কোনো বান্দার ঈমান ও একীন যখন এ-পর্যায়ে উন্নীত হয়, তখন সে বুঝতে পারে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর মূল্য ও মর্যাদা কতো।

দুই:

এক হাদীসে নবীজী বলেন,

أَفْضَلُ الكَلاَمِ أَرْبَعٌ: سُبْحَانَ اللَّهِ، وَالحَمْدُ لِلَّهِ، وَلاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ
সকল কথার সেরা কথা এবং সকল কালিমার শ্রেষ্ঠ কালিমা হলো চারটি: ‘সুবহানাল্লাহ্’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ‘আল্লাহু আকবার’। সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ৮৩৯

অন্য হাদীসে এসেছে,

لأَنْ أَقُولَ سُبْحَانَ اللهِ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ، وَلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ، أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا طَلَعَتْ عَلَيْهِ الشَّمْسُ.
যতদূর পৃথিবীর উপর সূর্য উদিত হয়, ততদূূর পৃথিবীর চেয়েও আমার কাছে ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘ওয়ালহামদুল্লিাহ্’ ‘ওয়াল্লাহু আকবার’ বলা অধিক প্রিয়। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬৯৫

কিছু হাদীসে ‘আলল্লাহু আকবার’ এর পর ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’-ও এসেছে। একে ‘কালিমায়ে তামজীদ’ বলে। কালিমায়ে তামজীদ আল্লাহ পাকের প্রশংসা ও স্তুতি বর্ণনার একটি পূর্ণাঙ্গ ওজিফা। আমাদের এক বুযুর্গ কালিমায়ে তামজীদের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘সুবহানাল্লাহ্’ অর্থ আল্লাহপাক সকল দোষ-ত্রুটির উর্ধ্বে এবং যা কিছু তাঁর শান-উপযোগী নয়, তা থেকে তিনি পূতপবিত্র। ‘আলহামদুলিলল্লাহ্’ অর্থ সমস্ত সৌন্দর্য, যোগ্যতা ও পূর্ণতার অধিকারী তিনি। অতএব সকল প্রশংসা তাঁর। যখন একমাত্র তিনিই সকল গুণাবলীর আধার এবং সকল দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে, তখন ইবাদতের উপযুক্তও কেবল তিনি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। আমরা তাঁর অক্ষম বান্দা। আর তিনি মহিয়ান ‘আল্লাহু আকবার’। কখনো আমরা তার ইবাদতের হক আদায় করতে পারবো না, যদি না তিনি সহায় হোন ‘লা হাওলা ওয়া লাকুয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।’

তিন:

একটি প্রসিদ্ধ হাদীসে এসেছে, নবী-কন্যা হযরত ফাতেমা রাজিয়াল্লাহু আনহা নিজ হাতে ঘরের কাজ করতেন। নিজেই পানি আনতেন, চাক্কি ঘুরিয়ে আটা পিষতেন। একবার তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরজ করলেন, এই কাজগুলো করতে আমার জন্য একটি চাকরানীর ব্যবস্থা করে দিন। তখন নবীজী কন্যা ফাতেমা ও জামাতা আলীকে বললেন,

إِذَا أَوَيْتُمَا إِلَى فِرَاشِكُمَا، أَوْ أَخَذْتُمَا مَضَاجِعَكُمَا، فَكَبِّرَا ثَلاَثًا وَثَلاَثِينَ، وَسَبِّحَا ثَلاَثًا وَثَلاَثِينَ، وَاحْمَدَا ثَلاَثًا وَثَلاَثِينَ، فَهَذَا خَيْرٌ لَكُمَا مِنْ خَادِمٍ
আমি তোমাদেরকে এর চেয়েও উত্তম জিনিস শিখিয়ে দিচ্ছি, তোমরা শোয়ার সময় তেত্রিশবার ‘আল্লাহু আকবার’ তেত্রিশবার ‘সুবহানাল্লাহ্’, এবং তেত্রিশবার ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ এবং পড়বে। এটা চাকর-বাকরেরচেও অনেক উত্তম। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৩১৮

একে ‘তাসবীহে ফাতেমী’ বলা হয়।

অন্য হাদীসে এই তাসবিহগুলির ফজীলত সম্পর্কে এসেছে,

مَنْ سَبَّحَ اللهَ فِي دُبُرِ كُلِّ صَلَاةٍ ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ، وَحَمِدَ اللهَ ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ، وَكَبَّرَ اللهَ ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ، فَتْلِكَ تِسْعَةٌ وَتِسْعُونَ، وَقَالَ: تَمَامَ الْمِائَةِ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ غُفِرَتْ خَطَايَاهُ وَإِنْ كَانَتْ مِثْلَ زَبَدِ الْبَحْرِ
যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাজের পর তেত্রিশবার ‘সুবহানাল্লাহ্’, এবং তেত্রিশবার ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ এবং চৌত্রিশবার ‘আল্লাহু আকবার’ পড়বে এবং শেষে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুওয়া আলা কুল্লি শাই ইন কদীর’ পড়বে, আল্লাহ পাক তার সমস্ত (ছগীরা) গোনাহ্ মাফ করে দিবেন, যদিও তা সমুদ্রের ফেনার সমান হয় না কেন। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৯৭

চার:

একটি হাদীসে এসেছে,

مَنْ قَالَ: حِينَ يُصْبِحُ وَحِينَ يُمْسِي: سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ، مِائَةَ مَرَّةٍ، لَمْ يَأْتِ أَحَدٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، بِأَفْضَلَ مِمَّا جَاءَ بِهِ
যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা একশবার করে ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী’ পড়বে, কেয়ামতের দিন তার চে’ অধিক সওয়াব নিয়ে কেউ উঠতে পারবে না। হ্যাঁ, যে এর সাথে অন্য আমলও করে তার কথা ভিন্ন। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬৯২

পাঁচ:

অন্য একটি হাদীসে এসেছে,

كَلِمَتَانِ خَفِيفَتَانِ عَلَى اللِّسَانِ، ثَقِيلَتَانِ فِي المِيزَانِ، حَبِيبَتَانِ إِلَى الرَّحْمَنِ، سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ، سُبْحَانَ اللَّهِ العَظِيمِ
দুটি কালিমা উচ্চারণে সহজ, কিন্তু মিযানের পাল্লায় অনেক ভারী এবং দয়াল আল্লাহ নিকট খুবই প্রিয়। ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াবি হামদিহী সুবহানাল্লাহিল আযীম। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৬৮২

উল্লিখিত যিকিরগুলির দুই একটি যিকিরও যদি কেউ নিয়মিত করতে থাকে, তবে তার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।

যিকিরের ক্ষেত্রে একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, যিকিরের দ্বারা সওয়াব লাভের বিষয়টি বিশেষ কোনো রীতি-পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল নয়। যিকিরের যে কোনো কালিমা যে কোনো সংখ্যায় কোনো বান্দা এখলাসের সঙ্গে পড়বে, ইনশাআল্লাহ সে পূর্ণ সওয়াব লাভ করবে। তবে পীর-মাশায়েখগণ যে বিশেষ পদ্ধতি ও সংখ্যায় যিকির করার তালীম দেন, তা সেভাবেই করা উচিৎ। কারণ তাদের সামনে সওয়াব ছাড়াও অতিরিক্ত কিছু উদ্দেশ্য থাকে।

যেমন, আল্লাহ পাকের মুহাব্বত বৃদ্ধি পাওয়া, অন্তর নরম হওয়া, চোখে পানি আসা, সবসময় অন্তরে আল্লাহ্র উপস্থিতি অনুভব করা, কলবের রোগ-ব্যাধি দূর হওয়া ইত্যাদি। এই উদ্দেশ্যগুলি সাধনের জন্য হক্কানী পীর ও মাশায়েখগণের শেখানো জায়েয তরীকা অনুসারে যিকির করা আবশ্যক। অন্যথায় এ উদ্দেশ্যগুলি অর্জন করা সহজ নয়। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে, যেমন কেউ শুধু সওয়াবের জন্য সুরা ইয়াসীন তেলওয়াত করছে।

তাহলে সে সকাল-সন্ধ্যা একবার একবার তেলওয়াত করবে। ফাঁকে-ফাঁকে আরও কয়েকবার তেলওয়াত করতে পারে। এতেই যথেষ্ঠ হয়ে যাবে। কিন্তু যে সুরা ইয়াসীন মুখস্ত করতে চায়, তাকে সকাল-সন্ধ্যায় বা ফাঁকে-ফাঁকে তেলওয়াত করলে হবে না, বরং বিশেষ প্রক্রিয়ায় একনাগাড়ে বহুবার তেলওয়াত করতে হবে। অন্যথায় সওয়াব পেলেও মুখস্ত হবে না।

ব্যস, সাধারণ যিকির এবং অলী-বুযুর্গদের বিশেষ পদ্ধতির যিকিরের মাঝে এই যা পার্থক্য। এই স্বাভাবিক পার্থক্য না বোঝার কারণে অনেকে বিভ্রান্ত হয়। আল্লাহপাক সকলকে বোঝার তাওফীক দান করুন, আমীন।

কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করা

আজকালের কতিপয় লোকের ধারণা, না বুঝে কোরআন তেলওয়াত করা একটি অর্থহীন কাজ। তারা কোরআন শরীফকে অন্যান্য আইনের বই কিংবা উপদেশমূলক গ্রন্থের মতোই মনে করে। সেগুলি যেমন অর্থ না বুঝে পড়া নিরর্থক, তেমনি কোরআন শরীফও না বুঝে পড়া নিরর্থক! অথচ কোরআন শরীফ অন্যান্য গ্রন্থের মত নয়, বরং তা আল্লাহ পাকের কালাম।

কেউ যদি অর্থ না বোঝে, কিন্তু ভক্তি ও ভালবাসা নিয়ে তেলাওয়াত করে, তবে তাতেও অনেক ফায়দা হয়। কেননা তেলাওয়াত ভিন্ন একটি ইবাদত। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, কোরআন নাজিলের মূল উদ্দেশ্য হলো হেদায়েত ও নসীহত। আর এই নসীহত ও হেদায়েত বুঝে বুঝে তেলাওয়াত করার দ্বারা অর্জন হয়। সুতরাং বুঝে বুঝে তেলাওয়াত করতে পারা অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয়। তাই কোরআন শরীফের অর্থ বোঝার চেষ্টা করা একান্ত কর্তব্য।

কোরআন তেলাওয়াত আল্লাহ পাকের উত্তম যিকির। হাদীস শরীফে এসেছে,

وَفَضْلُ كَلاَمِ اللهِ عَلَى سَائِرِ الكَلاَمِ كَفَضْلِ اللهِ عَلَى خَلْقِهِ. قال ابن حجر في الفتح: رجاله ثقات إلا عطية العوفي ففيه ضعف
সমস্ত মাখলুকের উপর আল্লাহ পাকের ফজীলত যেমন, সমস্ত কালামের উপর আল্লাহ তাআলার কালামের ফজীলতও তেমন। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২৯২৬

অন্য হাদীসে এসেছে,

مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لاَ أَقُولُ الم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلاَمٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ.
যে ব্যক্তি কোরআন শরীফের একটি অক্ষর পাঠ করবে, সে দশ নেকী সমান একটি নেকী পাবে। আর আমি এটা বলছি না যে, ‘আলিফ-লাম-মীম’ পুরোটা একটি হরফ। বরং ‘আলিফ’ একটি হরফ। ‘লাম’ আরেকটি হরফ এবং ‘মীম’ ভিন্ন একটি হরফ। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২৯১০

এক হাদীসে তেলাওয়াতের ফজীলত সম্পর্কে এসেছে,

اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لِأَصْحَابِهِ
হে লোক সকল! তোমরা তেলাওয়াত করো, কেয়ামতের দিন তেলাওয়াতকারীদের জন্য কোরআন শরীফ সুপারিশ করবে। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮০৪

কিছু পরামর্শ

এক.

বেশি বেশি যিকির করার কারণে যাদের অন্তরে আল্লাহর নাম জারি হয়ে গেছে এবং যিকির যাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে, তাদের জন্য সময় সংখ্যা ঠিক করে যিকির করার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য আপন আপন অবস্থা বিবেচনা করে এবং শৃঙ্খলাগত প্রয়োজনে যিকিরের সময় ও সংখ্যা ঠিক করে নেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে কোনো আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ করা ভালো। আর কোরআন তেলাওয়াতের জন্যও একটি রুটিন থাকা উচিৎ।

দুই.

যথাসম্ভব যিকির করার সময় অর্থের প্রতি লক্ষ্য করা এবং আল্লাহ পাকের বড়ত্ব ও ভালোবাসা অন্তরে জাগরুক রাখা একান্ত কাম্য । এই ধ্যান রাখাও কাম্য যে, আল্লাহ পাক আমার সঙ্গে আছেন। তিনি আমাকে দেখছেন এবং আমার যিকির শুনছেন।

তিন.

অযু ছাড়াও যিকির করা যায়। ইনশাআল্লাহ এতে সওয়াব কম হবে না। তবে অযুর সাথে যিকির করলে যিকিরের প্রভাব অধিক ভালো হয় এবং অন্তরে নূর পয়দা হয়।

চার.

কালিমায়ে তামজীদ তথা ‘সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্রাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ এই যিকিরটিকে সব যিকিরের সমষ্টি বলা যেতে পারে। প্রায় সকল ওলী-বুযুর্গরা মুরীদদেরকে এই যিকির শিখিয়ে থাকেন। সাথে এস্তেগফার ও দরুদ শরীফ পড়তে বলেন।

এস্তেগফার ও দরুদ শরীফ সম্পর্কে উনিশ ও বিশতম পাঠে আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলের কলবকে তাঁর এশক ও মুহাব্বতে পূর্ণ করে দিন। আমাদের যবানকে তার যিকিরে সচল করে দিন এবং যিকিরের নূর ও বরকত আমাদের সকলকে নসীব করুন, আমীন।

আরও জানুন

শেষ বৈঠকে দুআয়ে মাসূরা ছাড়া অন্য দুআ পড়া যাবে?

প্রশ্ন আসসালামুআলাইকুম ওয়ারহমাতউল্লাহ, আহলে হক মিডিয়ার সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য অনলাইন ভিত্তিক …