লেখক– মুনাজিরে ইসলাম মাওলানা মুহাম্মদ আমীন সফদর ওকাড়বী রহঃ
অনুবাদঃ লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে। চিন্তার বিষয় ছিল আমাকে কুরআন শরীফ কে শিখাবে? আমাদের গ্রামে একটি মসজিদ ছিল। যেখানে প্রায় প্রতি জুমআর দিন ঝগড়া হত। বেরেলবীরা চাইত যে, এখানে তাদের মতাদর্শী ইমাম নিযুক্ত হোক। আর গায়রে মুকাল্লিদরা চাইতো তাদের মদাদর্শী ইমাম নিযুক্ত হোক। আর আমাদের দেওবন্দী আক্বিদা সম্পন্ন ঘর ছিল একটা। যাকে কেউ গণনায়ও ধরতনা। কখনো সখনো ঝগড়া যখন তীব্রতা লাভ করত, তখন ছয় সাত মাস যাবত মসজিদে কোন ইমামই হতনা। কখনো দুই জামাত শুরু হয়ে যেত। আমার পিতা এই ব্যাপারে খুবই পেরেশানীতে ছিলেন। সর্বশেষে তিনি এই সীদ্ধান্ত নেন যে, বেদাতীদের তুলনায় গায়রে মুকাল্লিদরা আক্বিদা-বিশ্বাসের দিক দিয়ে ভাল, তাই তাদের কাছেই আমাকে কুরআন শিখতে পাঠালেন। অবশেষে কুরআন শরীফ শিখার জন্য আমাকে এক গায়রে মুকাল্লিদের কাছে পাঠানো হল।
শিক্ষা পদ্ধতী
যেহেতো আমি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি। অক্ষর জ্ঞানতো ছিলই। তাই প্রথম পাড়া থেকে সবক শুরু হল। উস্তাদ সাহেব দুই তিন আয়াত বলতেন আর আমি দোহরাতাম। তারপর আমাকে উস্তাদ সাহেব শোনাতেন যে, “আমি ওমুক হানাফী মুফতী সাহেবকে পরাজিত করেছি, ওমুক হানাফী আলেমকে লা-জাওয়াব করে দিয়েছি। দুনিয়ার মাঝে কোন হানাফী বা বেরলবী নাই যে আমার সামনে দাঁড়াতে পারে”। তারপর কোন একটা প্রচার পত্র নিয়ে বসে যেতেন। আর বলতেন-“দেখো! এই প্রচার পত্রটি বিশ বছর পুরনো। এতে দুনিয়াজোড়া হানাফীদের চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে যে, একটি হাদিস দেখাও নবীজী সা. এর, যাতে রফয়ে ইয়াদাইনকে বর্তমানে রহিত করা হয়েছে। একটি হাদিস দেখাও! যেখানে নবীজী সা. বলেছেন যে, আজ থেকে রফয়ে ইয়াদাইনের বিষয় রহিত করে দেয়া হয়েছে। একটি হাদিস দেখাও! যেখানে নবীজী সা. বলেছেন যে, এক শতাব্দী পর আমার দ্বীন রহিত হয়ে যাবে। আর ইমাম আবু হানীফার তাক্বলীদ আমার উম্মতের উপর ফরজ হয়ে যাবে। এই প্রচারপত্রটি দেওবন্দ পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু তারা কোন হাদিস দেখাতে পারেনি। হাজার হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণাও দেয়া হল, কিন্তু সামনে দাঁড়াতে সাহস পায়নি কেউ”।
উস্তাদের ব্যাক্ষাই আমার মত এ বিষয়ে অজ্ঞ ব্যক্তির উপর খুব প্রভাব সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু যখন তিনি একথা বলতে লাগলেন যে, “আমি একবার দিল্লী যাচ্ছিলাম। তখন দেওবন্দ নামলাম। সেটা নামাযের সময় ছিল। তখন মাদরাসার সকল উস্তাদ ও ছাত্ররা মসজিদে উপস্থিত ছিল। সে সময় আমি দাঁড়িয়ে প্রচারপত্রটি দেখিয়ে বলতে লাগলাম যে, এই প্রচারপত্রটি বিশ বছর যাবত প্রতি বছর আপনাদের মাদরাসায় পাঠানো হয়, তারপরও আপনারা কেন হাদিস দেখান না? তখন সেখানকার এক উস্তাদ লজ্জিত হয়ে নম্রতার সাথে আমাকে বলল যে, “মাওলানা সাহেব! আপনি জানেন আমরা হলাম হানাফী। আমরাতো আবু হানীফা রহ. এর ফিক্বহ পড়ি, না হাদিস পড়ি, না কখনো হাদিস দেখেছি। আপনি বারবার আমাদের কাছে হাদিস চেয়ে লজ্জা দেন কেন?””
উস্তাদের এই বাগড়ম্বতার পর আমি প্রচন্ড বিষ্মিত হয়ে যেতাম। কারণ আমি ঘরে শুনেছি যে, দেওবন্দ মাদরাসা হল পৃথিবীর মাঝে সবচে’ বড় মাদরাসা। তো আমাদের উস্তাদ যখন তাদেরই লা জাওয়াব করে আসলেন, সেখানে আর হাদিস কোত্থেকে পাওয়া যাবে?!
মতানৈক্য কি?
একদিন আমি উস্তাদজিকে জিজ্ঞেস করলাম-“উস্তাদজী! আপনি এবং আহলে সুন্নাতওলাদের মাঝে পার্থক্যটা কি?” তিনি বললেন-“বেটা! কালিমা আমরা যেমন নবীজী সা. এর টাই পড়ি, তেমনি ওরাও তাই পড়ে। আমাদের মাঝে এতটুকু একতা। কিন্তু আমরা যখন তাদের বলি যে, যার কালিমা পড়, কথাও তার মান! তখন তারা বলে-“না! আমরা কালিমা নবীজী সা. এর টাই পড়ব, কিন্তু কথা মানব ইমাম আবু হানীফা রহ. এর”।”
আমি উস্তাদজিকে জিজ্ঞেস করলাম-“ইমাম আবু হানীফা রহ. যদি মুসলমান আলেম থেকে থাকেন, তাহলে তিনি নিশ্চয় নবীজী সা. এর কথাই মানুষকে মানতে বলতেন। কেননা খাইরুল কুরুনের মানুষের ক্ষেত্রে এমনটি কল্পনাই করা যায়না যে, তারা জেনে বুঝে মানুষকে নবীজী সা. এর উল্টো কথা জানাবে”। উস্তাদজি বলেন-“ইমাম আবু হানীফা রহ. তো ভাল মানুষ ছিলেন। কিন্তু তার জমানায় হাদিস সমূহ সংকলিত হয়নি। এই জন্য ইমাম আবু হানীফা রহ. অনেক মাসআলা কিয়াস করে বলে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি সাথে সাথে এটাও বলে দিয়েছেন যে, আমার যে বক্তব্যটি হাদিসের উল্টো পাবে তা ছেড়ে দিবে। কিন্তু হানাফীরা এর উল্টো কাজটাই করে থাকে”।
সে সময় আমার এতটুকু জ্ঞান ছিলনা যে, তাকে প্রশ্ন করতাম যে, উস্তাদজি! সে সময় কি এত প্রয়োজন ছিল যে, প্রথমে ফিক্বহ সংকলন করা হয়? আর হাদিস সংকলন করা হল পরে? সিহাহ সিত্তার সকল সংকলক সুনিশ্চিত আইয়িম্মায়ে আরবাআর পর এসেছেন। কিন্তু কেউই নিজের কিতাবে না ফিক্বহে হানাফীর প্রতিরোধে কোন অধ্যায় স্থাপন করেছেন, না ফিক্বহে শাফেয়ী প্রতিরোধে কোন অধ্যায় লিখেছেন।
ইলমে হাদিস
উস্তাদজি আমাকে বলতেন-“যেমন কাপড় কাপড়ের দোকান থেকে পাওয়া যায়। চিনি চিনির দোকান থেকে পাওয়া যায়। এমনিভাবে হাদিস শুধুমাত্র আহলে হাদিস থেকেই পাওয়া যায়। আর মাদরাগুলিতেতো হাদিস পড়ানোই হয়না। তুমি সারা জীবন পা ঠুকরে ঠুকরে মরে যাবে, কিন্তু নবীজী সা. এর একটি হাদিস শোনারও সৌভাগ্য তোমার হবেনা। ওহে নবী সা. এর কথা শ্রবণকারী! নবী কারীম সা. এর হাদিস কেবল এখানেই পড়ানো হয়। অন্য কোথাও নয়”।
সে সময় আমার এত বুঝ হয়নি। একথাও জানা ছিলনা যে, এই আহলে হাদিসদের ভাই হল আহলে কুরআন। কিন্তু এটি উস্তাদজির ধোঁকা ছিল যে, আমাকে বলনি যে, “কুরআন শুধু আহলে কুরআন থেকেই শিখা উচিত” কেননা তার সাথে আহলে কুরআনের কি সম্পর্ক?
মোটকথা, আমাকে বিশ্বাস করানো হল যে, আমরা কিছু লোক মূলত নবীজী সা. কে মানি আর বাকি সবাই নবীজী সা.কে মানেনা।
একশত শহীদের সওয়াব
আমার ভাল ভাবেই মনে আছে যে, নফল আদাই করা হতনা। বরং এতে ঠাট্টা করা হত। আর সুন্নাতেরও বিশেষ প্রয়োজন নেই। কেননা হানাফীরা নফল এবং সুন্নাত পূর্ণ গুরুত্বের সাথে পালন করে থাকে। হ্যাঁ, যে সকল সুন্নাত মৃত হয়ে গেছে, সেগুলি জিন্দা করতে অনেক তাগিদ দেয়া হত। যেমন জামাতে নামাযের মাঝে পাশের মুসল্লির সাথে টাখনোর সাথে টাখনো মিলানো সুন্নাত। যেটা মৃত হয়ে গেছে এটার উপর আমল করা একশত শহীদের সওয়াব পাওয়া যায়। এমনিভাবে জোড়ে আমীন বলা সুন্নাত। নবীজী সা. বলেছেন যে, “যে ব্যক্তি আমীন বলা ছেড়ে দিবে সে আমার উম্মতের ইহুদি”। সুতরাং আমীন জোড়ে বলে যত হানাফীদের কান পর্যন্ত সেই আওয়াজ পৌঁছানো যাবে তত শত শহীদের সওয়াব পাওয়া যাবে। আর ইহুদীদের কষ্ট দেবার সওয়াবও পাওয়া যাবে।
হাকিকাতুল ফিক্বহ
উস্তাদজির কাছে মাওলানা ইউসুফ জীপুরীর “হাকিকাতুল ফিক্বহ” কিতাব আর মাওলানা মুহাম্মদ রফীক পাসরুরী সাহেবের পুস্তিকা “সমশীরে মুহাম্দাদিয়া বর আক্বায়েদে হানাফিয়্যা” এবং “শময়ে মুহাম্মদি” কিতাব ছিল। উস্তাতজি আমাকে নিয়ে বসতেন আর এই সকল কিতাব থেকে একেকটি মাসআলা পড়তেন। তারপর পাঁচ মিনিট পর্যন্ত আমি এবং উস্তাদজি কানে হাত লাগিয়ে তওবা! তওবা! করতাম। হায়! হায়! এরকম নোংরা মাসআলা হিন্দুদের বইয়েও নাই। আয় আল্লাহ! যদি হিন্দুরা, শিখেরা অথবা খৃষ্টানেরা এই মাসআলা জানে, তাহলে তারা মুসলমানদের কতটা নিচু মনে করবে?!
মোটকথা হল আমাকে এই বিষয়টি বদ্ধমূল করে দেয়া হত যে, দুনিয়ার মাঝে হানাফী মাযহাব এমন একটি নোংরা মাযহাব, যা থেকে হিন্দু, শিখ এবং ইয়াহুদী খৃষ্টানেরসহ সকল কাফেররাও আশ্রয় চাইবে।
কর্ম পদ্ধতি
আমার ব্রেইন যখন পোক্ত হয়ে গেল তখন আমার উস্তাদজি বলতেন-“একবার দু’ তিনজন সাধারণ হানাফী যুবককে ধরে আমি বললাম-‘আমাকে তোমাদের হানাফী মাওলানা সাহেবের কাছে নিয়ে চল, সে যদি আমাকে একটি হাদিস দেখাতে পারে তাহলে আমি হানাফী হয়ে যাব’। সেই বেচারারা আমাকে তাদের মাওলানা সাহেবের কাছে নিয়ে গেল। আমি মাওলানা সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম-“মাওলানা সাহেব! একটি হাদিস দেখাও! যেখানে নবীজী সা. বলেছেন যে, তাকে ছেড়ে আবু হানীফার তাকলীদ করতে বলেছেন”। প্রশ্নটি করার পর আমি তাদের জবাব ভাল করে শুনিনা কখনো। বরং প্রতি দু’ মিনিট পরপর আমি এই দুই যুবককে স্বাক্ষ্য বানিয়ে বলতাম-‘দেখ! মাওলানা সাহেবের একটি হাদিসও মুখে আসেনা। যখন দ্বিতীয়বার আমি মাওলানা সাহেবকে বলতাম যে, ‘আপনারতো একটি হাদিসও মুখ দিয়ে বের হয়না’। তখন তিনি স্বাভাবিকভাবেই ক্ষেপে যান। তখন আমি উঠে চলে আসলাম”।
উস্তাদজি আনন্দচিত্তে আমাকে নিয়ে কয়েকটি গ্রামে ভ্রমণ করেছেন, আর আমার ব্যাপারে প্রচার করতেন যে, ‘দেখ! এই ছেলে ওমুক হানাফী মুফতী সাহেবকে লা-জাওয়াব করে দিয়েছে। সে একটি প্রশ্নের জবাবও দিতে পারেনি। একটি হাদিসও দেখাতে পারেনি। جاء الحق وزحق الباطل ان الباطل كان زهوقا অর্থাৎ সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত, নিশ্চয় মিথ্যা অপসৃতই হয়ই, এই স্লোগান দিতে থাকতেন’।
ছয় নাম্বার
উস্তাদজি এই বিষয়ে অভিজ্ঞ ছিলেন। তিনি বলতেন যে, হানাফীদের পর্যুদস্ত করার জন্য কুরআন হাদিস আর ফিক্বহ পড়ার কোন দরকার নাই। নিম্নের কয়েকটি বিষয় ভাল করে পড়েই তাদেরকে পর্যুদস্ত করে একশত শহীদের সওয়াব পেতে পার।
১. যখন কোন হানাফীর সাথে সাক্ষাত হয় তখন তাকে প্রশ্ন কর যে, আপনি যে ঘড়ি হাতে দিলেন এটা কোন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত? এরকম প্রশ্নের জন্য কোন ইলমের প্রয়োজন নেই। তুমি একটি ছয় বছরের বাচ্চাকে মেডিকেল ষ্টোরে পাঠিয়ে দাও। সে ওষুধের উপর হাত রেখে প্রশ্ন করবে যে, এই ওষুধের নাম হাদিসের কোথায় আছে? এই প্রশ্নটির পর নিজের মসজিদে এসে বলবে যে, আমি অমুক হানাফী মাওলানা সাহেবকে হাদিস জিজ্ঞেস করলাম, সে বলতে পারেনি। তারপর তখন সকল গায়রে মুকাল্লিদ বাচ্চা ও বয়স্কদের উপর ফরজ হল, তারা প্রত্যেক অলিতে গলিতে এই প্রচারণা চালাবে যে, ওমুক হানাফী মাওলানা সাহেব একটি হাদিসও জানেনা।
২.
দ্বিতীয় নাম্বার হল এই যে, আল্লাহ না করুন যদি তুমি কোথাও ফেঁসে যাও, আর তোমাকে জিজ্ঞেস করে বসে যে, তুমি যে পাঞ্জাবীতে পকেট লাগালে তার নাম হাদিসের কোথায় আছে? তখন ঘাবরিওনা, বরং তৎক্ষণাৎ তাকে জিজ্ঞেস কর যে, কোন হাদিসে এর নিষেধাজ্ঞা আছে? আর শোরগোল শুরু করে দিবে যে, নিষেধাজ্ঞার হাদিস দেখাতে পারবেনা, ওমুক কাজ করারও হাদিসও দেখাতে পারবেনা। তখন সকল গায়রে মুকাল্লিদরা এটা প্রচার করতে শুরু করবে যে, সে হাদিস কোত্থেকে পাবে? সেতো সারা জীবন ফিক্বহ নিয়েই পড়ে থাকে।
৩.
আর যদি কোন স্থানে এভাবে ফেঁসে যাও যে, ‘কোন হাদিসের কিতাব নিয়েই আসে, আর বলে যে, তুমি আহলে হাদিস, অথচ কত হাদিসের উপর তোমাদের আমল নেই’। একথা শুনে ঘাবরানোর দরকার নেই, তখন হঠাৎ করেই কাশি দিয়ে বলতে শুরু করবে যে, এই হাদিসের কোন ঠিক নেই, কোত্থেকে এনেছ? আমরাতো কেবল বুখারী মুসলিম আর বড় জোর সিহাহ সিত্তার হাদিসই কেবল মানি। বাকি সব হাদিসের অধিকাংশ কেবল শুধু অস্বিকারই করিনা, বরং বিদ্রোপও করি। আর আমাদের হাসি তামাশা দেখে বেচারা এতটাই লজ্জা পাবে যে, সে হাদিসের কিতাব লুকিয়ে জান বাঁচাতে ছুটে পালাবে।
৪.
যদি কেউ এই ছয় কিতাবের মধ্য থেকে কোন হাদিস দেখিয়ে দেয়, যা তোমাদের বিপরীত। তখন তাড়াতাড়ি কোন শর্ত নিজের পক্ষ থেকে লাগিয়ে দিবে যে, ‘ওমুক শব্দ দেখাও! তাহলে এক লাখ টাকা তোমাকে পুরস্কার দিব। যেমন মির্যায়ীরা বলে থাকে যে, “এই শব্দে হাদিস দেখাও যে, জাগতিক শরীরসহ হযরত ঈসা আ. জীবিত আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। সেটা সহীহ, সুষ্পষ্ট, আর মারফু’ আর গায়রে মারজুহ, হতে হবে”। যেমন গায়রে মুকাল্লিদরা বলে থাকে যে, “রফয়ে ইয়াদাইন এর সাথে রহিত হবার শব্দ দেখাও”। তখন নিজের বক্তব্যের উপর এতটা চিল্লাফাল্লা করবে যে, বিরোধি ব্যক্তি চুপ হয়ে যাবে।
৫.
যদি কখনো সে শব্দটা পেয়েও যায়, আর দেখিয়ে দেয়, যে শব্দ তুমি জানতে চেয়েছিলে, তখন পূর্ণ শক্তিমত্তা দিয়ে জোরে তিনবার ঘোষণা দিয়ে দিবে যে, এটা দুর্বল! দুর্বল!! দুর্বল!! তখন হাদিসও মানতে হলনা, আবার ভীতিও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে যে, দেখ! মাওলানা সাহেবের তাহকীকই নাই যে, এটা দুর্বল হাদিস।
৬.
ছষ্ঠ ও শেষ নাম্বার হল-উস্তাদজি তাগীদ দিয়ে বলতেন যে, ‘যে নামায পড়েনা তাকে তাকে নামায পড়ার কথা বলা যাবেনা। হ্যাঁ যে নামায পড়ে তাকে অবশ্যই বলবে যে, “তোমার নামায় হয়না”।
ব্যাস। এই ছয় নাম্বার আমাদের ইলমে কালাম তথা তর্কশাস্ত্রের মেরুদন্ড ছিল। আমার পিতা নামায, রোযা, আর তাহাজ্জুদের খুব পাবন্দ ছিলেন। তিনি খুবই ইবাদতগুজার মানুষ ছিলেন। প্রতিদিন তার সাথে আমার ঝগড়া হত। আমি বলতাম তাকে-“আপনার নামায হয়না। আপনার দ্বীন আপনার তাহাজ্জুদ কিছুই কবুল হবেনা। আপনার কোন ইবাদতই গ্রহণযোগ্য নয়”। আমার পিতা বলতেন-“ঝগড়া করনা, তোমার নামাযও হয়, আমার নামাযও হয়”। আমি বলতাম-“কত বড় ধোঁকা এটা! কি এক খোদা দুই নামায নাজিল করেছেন? একটা মদীনায় আর একটা কুফায়? আমাদের নামায নবীজী সা. এর নামায, যা আমাদের জান্নাতে নিয়ে যাবে। আপনাদের নামায কুফাবাসীর নামায। এটা আপনাদের সোজা জাহান্নামে নিয়ে যাবে”। আমার পিতা বলতেন-“ফালতু প্যাচাল করনা”। আমি এটাকে আমার জীবনের বড় বিজয় মনে করতাম। আর অহংকারের সাথে বলতাম-“আমিতো আপনাকে অনেক সম্মান করি, নতুবা ফিক্বহের গোমর ফাঁক করে দিতাম। যার ফলে সবার মাথা গরম হয়ে যাবে”।
এরকম করেই কেটে গেল কয়েক বছর।
স্থানান্তর
আমরা সেখান থেকে অন্যত্র চলে গেলাম। সেখানে কোন উৎসাহদাতাও ছিলনা। ছিলনা কোন সাবাশদাতাও। শহরের এক মাদরাসায় এক সময় পড়তে চলে যাই। সেখানে আসবাকে ইলমুন নাহু আর বুলুগুল মারাম এবং নাসায়ী শরীফ ছিল। শিক্ষার উদ্দেশ্য কোন কিতাব পূর্ণ পড়া ছিলনা, বরং ফাতিহা খালফাল ইমাম, রফয়ে ইয়াদাইন, আমীন জোরে বলা, সীনার উপর হাত বাঁধা, টাখনো মিলিয়ে দাঁড়ানো, ইত্যাদি মাসআলা যদি এসে যেত তাহলে প্রথম বিভাগে পাশ করা সুনিশ্চিত ছিল। অবশ্য তখন গ্রামেও সেই তুলকালাম অবস্থা আর বাকি ছিলনা।
খতমে নুবওয়াত আন্দোলন
সে সময় ৫৩ ঈসাব্দের খতমে নবুওয়াত আন্দোলন চলছিল। আমাদের লক্ষ্ণৌ সাহেবরা সেই আন্দোলনের বিরোধি ছিল। কেননা তারা কাদিয়ানীদের মুসলমান বলত। সে সময় এলাকা ঘেঁটে দুই জন বুযুর্গ মানুষ হযরত মাওলানা সাইয়্যিদ মুহাম্মদ আব্দুল হান্নান সাহেব রহ. আর রাওয়ালপিন্ডির তায়ালীমুল কুরআন রাজাবাজারের সাবেক শাইখুল হাদিস হযরত মাওলানা আব্দুল কাদির সাহেব রহ. গ্রেফতার অবস্থায় ছিলেন। এই দুই হযরতকে সাহওয়াল জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। এই জেলে দারুল উলুম দেওবন্দের ফারেগ ওকারার খতমে নবুওয়াত আন্দোলনের নেতা হযরত মাওলানা জিয়উদ্দীন সিহারওয়ী রহ. ও ছিলেন। এই দুই জনই দারুল উলুম দেওবন্দের ফারিগ আর ইমামুল আসর আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. এর খাস ছাত্র ছিলেন। হযরত সিহারওয়ী রহ. দুইজনকেই রাজী করালেন যে, তারা মুক্তি পাবার পর ওকারাতে শিক্ষকতা করাবেন। সুতরাং মুক্তির পর উভয় শায়েখ ওকারাতে আসলেন। হানাফীরা ওকারার মাঝে ইলম ও মারেফাতের এই অনাবিল বৃষ্টিকে অনেক প্রচার করে। আর এই দুই হযরতকে শানদার অভ্যার্থনা জানায়।
বিতর্কের আকাংখা
সে সময় আমার গায়রে মুকাল্লিদ উস্তাদ খান্ডিলওয়ীর মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল জাব্বার সাহেব ছিলেন। তিনি আমাকে ডেকে বললেন-“শোন! আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. এর ছাত্র এসেছে। তাদের সাথে বিতর্ক করতে হবে”। আমি তাচ্ছিল্যের সাথে বললাম-“তারা কি করবে? খোদ ইমাম আবু হানীফা রহ. কবর থেকে উঠে এলেও আমাদের সাথে মুকাবিলা করতে পারবেনা। আমাদের সাথে আছে হাদিস। আর তাদের কাছে কিয়াস তথা যুক্তি”। উস্তাদ সাহেব এতে খুব খুশি হলেন। অনেক দু’আ করলেন। একটি প্রচারপত্র দিলেন, যার শিরোনাম ছিল “সারা পৃথিবীর হানাফীদের এগারো হাজার টাকা পুরস্কারের খোলা চ্যালেঞ্জ”। তিনি বললেন-“এই ইশতিহার নিয়ে যাও! তোমার বিজয় অবশ্যাম্ভাবী।
ঈদগাহ ময়দানে
সেই হযরতদের অবস্থান ঈদগাহ মাদরাসায় ছিল। আমি দেখলাম যে, হযরত মাওলানা আব্দুল হান্নান সাহেবের আশেপাশে বহুত মানুষ। আর হযরত মাওলানা আব্দুল কাদির সাহেবের কাছে কম মানুষ। প্রথম দর্শনেই আমি আন্দাজ করলাম যে, তাদের মাঝে বড় আলেম কে? আমি পিছনের চেয়ারে বসে গেলাম। হযরতের কাঁধ এবং মাথার উপর হাত বুলাতে শুরু করলাম। হযরত আমার দিকে দুই তিনবার তাকালেন। কিন্তু চুপ রইলেন। চতুর্থবার জিজ্ঞেস করলেন-“কি কর?” আমি এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলাম। চট করে পকেট থেকে প্রচারপত্রটি বের করে হযরতের সামনে খুলে দিলাম। আর আরজ করলাম যে, ‘হযরত! আহলে হাদিসের লোকেরা আমাকে খুব চাপে ফেলেছে। তারা হাজার টাকা পুরস্কারও ঘোষণাও করেছে। কিন্তু আমাদের ওলামাদের কাছে কোন হাদিসই নাই। আপনি কষ্ট করে তাড়াতাড়ি আমাকে রক্ষা করুন। আর হাদিস লিখে দিন। যাতে এই এগার প্রশ্নের জবাব থাকবে’। হযরত বললেন-“আমি পাঞ্জাবে অধ্যাপনা খুব কম করেছি। আমার উর্দু বেশি ভালনা। মাওলানা আব্দুল কাদির সাহেব পাঞ্জাবে অনেক অধ্যাপনা করেছেন। তার উর্দুও খুব ভাল। তার এই সকল মাসআলায় আগ্রহও আছে। তুমি তার কাছ থেকে বুঝে নাও”।
আমি উঠে হযরত মাওলানা আব্দল কাদির সাহেবের দিকে চললাম। এদিকে হযরত মাওলানা আব্দুল হান্নান সাহেব আওয়াজ দিয়ে বললেন-“ছেলেটা বুদ্ধিমান তাকে ভাল করে বুঝান, আল্লাহর কাছে এই প্রত্যাশা রাখি যে, প্রথম চান্সেই তার থেকে অন্ধকারচ্ছন্নতা বিদূরিত হবে”। হযরতের বলার পর আমার হাত থেকে মাওলানা সাহেব ইশতিহারনামাটি নিলেন। মাওলানা সাহেব ইশতিহার পড়তে ছিলেন আর আমার চোখ ছিল মাওলানা সাহেবের চেহারার উপর। কিছুক্ষণ পরপর ঠোঁটে মুচকি হাসি দেখা দিত। কখনো চেহারায় অসন্তুষ্টির ছাপ পরিলক্ষিত হত। অবশেষে মাওলানা সাহেব পূর্ণ ইশতিহারটি পড়লেন।
নিয়ত
হযরত সর্বপ্রথম এটা বললেন যে, “বেটা! নিয়ত ঠিক করে নাও! যদি কোন ব্যক্তি এই নিয়তে মাসআলা জিজ্ঞেস করে যে, দ্বীন বুঝে আমল করবে, তো মাসআলা জিজ্ঞেস করার জন্য আলাদা সওয়াব পায়। আর এই মাসআলার উপর আমল করার সওয়াব পায় আলাদা। আর যদি কোন ব্যক্তি এই নিয়তে মাসআলা জিজ্ঞেস করে যে, খারাপ ও ফিতনার জন্য হয়, তাহলে মাসআলা জিজ্ঞেস করা ও ফিতনার গোনাহ আলাদা আলাদা পায়। আমিতো এই নিয়তে তোমাকে মাসআলা বুঝাব যে, এতে একনিষ্টভাবে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টিই উদ্দেশ্য থাকবে। এতটুকুই যথেষ্ট”। আমি বললাম-“আমিও আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করার জন্যই বুঝতে চাই”।
দলিল দেয়া কার জিম্মায়?
হযরত বললেন-“এই ইশতিহারে অনেক ধোঁকাবাজি আছে। কিন্তু মাওলানা সাহেবের ধোঁকা মাওলানা সাহেবই বুঝতে পারে। সবাই এটা বুঝতে পারেনা। যদিও ইশতিহারের লেখক নিজেকে আহলে হাদিস দাবি করেছে, কিন্তু সে মূলত হাদিস অস্বিকারকারী। কেননা প্রসিদ্ধ হাদিসে এসেছে যে, রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন যে, البينة على المدعى অর্থাৎ “দলিল হল দাবিকারীর জিম্মায়” দুনিয়ার সকল আদালতে সর্বদা বাদির কাছেই দলিল চাওয়া হয়। আর এই এগার মাসআলায় বাদি হল গায়রে মুকাল্লিদরা। সুতরাং দলিল দেয়া তাদের জিম্মায় আবশ্যক। কিন্তু নিজের দুর্বলতার উপর পর্দা ঢাকার জন্য আমাদের জিম্মায় তা প্রয়োগ করার অপচেষ্টা করছে। এর একটি উপমা দেখ-‘রাফেজীরা আযানের শব্দে কিছু অতিরিক্ত শব্দ বলে, যেমন তারা বলে যে, আশহাদু আন্না আলিয়্যান অলীআল্লাহ….’ এখন আমাদেরতো এই অধিকার আছে যে, তাদেরকে এই প্রশ্ন করা যে, “আপনারা কোন আয়াত বা হাদিস কিংবা কমপক্ষে হযরত আলী রা. থেকে এই সকল শব্দ প্রমাণিত তা দেখান”। কিন্তু কিয়ামত পর্যন্ত তারা তার প্রমাণ দেখাতে পারবেনা। তারা তাদের মুর্খ লোকদের ধোঁকা দেবার জন্যএই প্রশ্ন বানায়, যেমন এই গায়রে মুকাল্লিদরা বানিয়েছে। গায়রে মুকাল্লিদদের মত যদি এরকম প্রশ্ন বানানো হয় যে, “সারা দুনিয়ার গায়রে মুকাল্লিদরা এক হয়ে একটি সহীহ সুষ্পষ্ট, মারফু’ এবং গায়রে মাজরুহ এমন হাদিস উপস্থাপিত করুক, যাতে হুজুর সা. অথবা হযরত আলী রা. আজানের মাঝে অতিরিক্ত বাক্য সংযোজিত করতে নিষেধ করেছেন?” আর নিষেধাজ্ঞার হাদিস দেখালে এক লাখ টাকা নগদ পুরস্কার দেয়া হবে মর্মে ঘোষণা দেয়া হয়! তুমি তোমার উস্তাদ থেকে এরকম হাদিস লেখিয়ে নিয়ে আস। নতুবা শিয়া মতবাদ সত্য আর গায়রে মুকাল্লিদদের মতবাদ মিথ্যা একথা মেনে নাও।
কি সারা দুনিয়ার সকর গায়রে মুকাল্লিদরা মিলে একটি হাদিসও দেখাতে পারবে এ ব্যাপারে?”
আমি বললাম-“আমরা কেন হাদিস দেখাব? যারা এই বাক্যগুলি অতিরিক্ত দেখাচ্ছে তারা তাদের প্রমাণ দেখাবে। এটাইতো যৌক্তিক। আমাদের নিষেধাজ্ঞার হাদিস তাদেরকে দেখানোর কি প্রয়োজন? এই প্রশ্নটিতো কেবলি একটি ধোঁকা।”
তিনি বললেন-“তাহলে রফয়ে ইয়াদাইন তোমরা কর, আর আমাদের কাছে নিষেধাজ্ঞার হাদিস চাওয়াটাও তেমনি একটি ধোঁকা। দেখ! কুরআন পাকের প্রথম সূরা ফাতিহা। এরই নাম উম্মুল কুরআন তথা কুরআনের মা। আর এরই মাঝে অনেক বিবাদ। কেউ فاتحة على الطعامতথা ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্য খানা পাকিয়ে মানুষকে খানা খাওয়ানোর সময় ফাতিহা পড়া নিয়ে ঝগড়া করে। আর কেউবা فاتحة خلف الإمامতথা ইমামের পিছনে ফাতিহা পড়া নিয়ে ঝগড়ায় মাতে।
মৌলিকভাবে ফাতিহার ক্ষেত্রে দু’টি মাসআলা। একটি হল মাসআলায়ে তাওহীদ তথা একত্ববাদের বিষয়। অন্যটি মাসআলায়ে তাক্বলীদ তথা অনুসরণের বিষয়। ফাতিহা আলা তয়ামদের তাওহীদ ভাল নয়। আর ফাতিহা খালফাল ইমাম দলের তাক্বলীদ ভাল নয়। অর্থাৎ ফাতিহাকে মানার মত মন এই দুই দলের কারো নেই”।
তারপর তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন-“আচ্ছা! যদি তোমার বিতর্ক ফাতিহা আলাত তয়াম গ্রুপের সাথে হয়। সে সময় যখন তুমি তাকে প্রশ্ন করবে যে, ‘ঈসালে সাওয়াবের নিয়তে খানা পাকিয়ে ফাতিহা পড়ার উপর হাদিস নিয়ে আস’। তখন কি তাদের এই প্রশ্ন করার অধিকার থাকবেনা যে, ‘সারা দুনিয়ার গায়রে মুকাল্লিদরা মিলে শুধুমাত্র একটি সহীহ সুষ্পষ্ট, মারফু’ এবং গায়রে মাজরুহ এমন হাদিস উপস্থাপিত কর, যাতে হুজুর সা. বিশেষ করে ঈসালে সাওবাবের নিয়তে খানা সামনে রেখে ফাতিহা পড়তে নিষেধ করেছেন। বিশেষভাবে এটা করতে নিষেধ করেছেন এই মর্মে হাদিস দেখাতে পারলে এক লাখ টাকা নগদ পুরস্কার দেয়া হবে’। এরূপ হাদিস কি তুমি দেখাতে পারবে?”
আমি বললাম-“আমাদের কাছে নিষেধাজ্ঞার হাদিস কেন চাইবে?”
তিনি বললেন- “কি শুয়াইব আ. এর জাতির মত তোমাদের নেবার বাটখারা একটি। আর দেবার বাটখারা অন্যটি সাব্যস্ত করলে নাকি? হুজুর সা. এর ফরমান কি মনে নেই যে, ‘তোমরা নিজের ভাইয়ের জন্য তা’ই পছন্দ কর যা নিজের জন্য পছন্দ কর’”।!
বিশেষ দলিল চাওয়া
তিনি বললেন-“বাদীর কাছে প্রমাণতো চাওয়া যায়, কিন্তু বিশেষ প্রমাণ চাওয়া বৈধ নয়। এটাতো কাফেরদের তরীকা ছিল। তারা সে সকল মুজিজাকে মানত না, যা নবীজী সা. থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বরং তারা নিজেদের পক্ষ থেকে শর্ত লাগিয়ে ফরমায়েশী মুজিজা দেখানোর জন্য আবেদন করল। তারপর যখন তাদের ফরমায়েশী মুজিজা দেখানো হয়নি, তখন তাদেরতো কেবল এই অধিকার ছিল যে, তারা বলবে যে, ‘আমাদের দাবিকৃত মুজিজা নবীজী সা. দেখাতে পারেনি’। কিন্তু তারা উল্টো অপপ্রচার শুরু করল যে, নবীজী সা. এর কোন মুজিজা’ই নেই।
এটার উপমা এমন যে, এক ব্যক্তি এসে বলল-‘আমি অনেক গোনাহগার। ষাট বছর বয়স হয়ে গেছে। কখনো নামায পড়িনি। আজ তওবা করতে এলাম। আপনি আমাকে নামায পড়ার পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি শিক্ষা দিন। কিন্তু একটি শর্ত আছে। সেটা হল নামাযের রাকাত সংখ্যা ও কুরআন থেকে দেখাতে হবে। সানা পড়ার বিষয়টিও। তাশাহুদ, দরুদ শরীফের শব্দও কুরআন থেকে দেখাতে হবে। কারণ আমি আল্লাহর ইবাদত কেবল তার কিতাব থেকেই করতে চাই। অন্য কারো কথা মানিনা’। তাহলে কি তুমি তাকে এই সব বিষয় কুরআন থেকে দেখাতে পারবে? যদি না দেখাতে পার, আর সে একথা বলতে শুরু করে যে, ‘কুরআন থেকে নামায শিখাতে পারনা’। তার এই কথা বলা ঠিক আছে। কিন্তু সে যদি এটা বলতে শুরু করে যে, এই মাসআলার কোন প্রমাণই নাই!! তাহলে একথাটি কি ভুল নয়? এটাকেই বলে দলিলকে খাস করে ফেলা।
যদি কোন আদালতের সাথে এরকম আচরণ করা হয়, তাহলে আদালত সারা জীবনেও কোন মামলা নিষ্পত্তি করতে পারবেনা। যেমন-আদালত বাদির কাছে তার নিজের পক্ষে স্বাক্ষী পেশ করার জন্য বলল। তখন বাদি যদি কোন স্বাক্ষি পেশ করে তাহলে উক্ত স্বাক্ষির খুঁত বের করার তোমার পূর্ণ হক আছে। কিন্তু বিশেষ দলিলের উপর তোমার জিদ ধরাকে আদালত মানবেনা। যেমন বাদি যায়েদকে স্বাক্ষি বানাল। তোমাকে আদালত বলল –এই স্বাক্ষির কোন খুঁত থাকলে তুমি বল। কিন্তু তুমি যদি বল-‘আমি একে স্বাক্ষিই মানিনা। বরং বাদশা বা তার নায়েব যদি স্বাক্ষি দেয় তাহলে আমি মানব’। তাহলে কি আদালত তোমার এই উদ্ভট কথা মানবে?”
ঈমান নবীর উপর নাকি শর্তের উপর?
হযরত আরো বলেন-“কাফেররা নবীর উপর বিশ্বাস রাখেনি, রেখেছে তাদের দাবিকৃত বিষয়ের উপর। এমনিভাবে তুমি মন থেকে এই কথা দূরিভূত করে দাও যে, তোমাদের ঈমান নবী সা. এর উপর। কখনোই নয়। বরং তোমাদের ঈমান হল তোমাদের উস্তাদের শর্তের উপর। যেমন কাফেররা নবী সা. কে বলত যে, ‘যা আমরা বলছি, তা আল্লাহ তায়ালা থেকে বলিয়ে নাও। অথবা আল্লাহ তায়ালা থেকে করিয়ে নাও। যদি এমন করতে পার তাহলে তা মানব। নতুবা নয়। এমনিভাবে তোমাদের উস্তাদ তোমাদের একটি ইবারত লিখে দেয়, আর বলে যে, এর হুবহু শব্দ আল্লাহর নবী সা. থেকে বলিয়ে নাও। তাহলে আমরা মানব। নতুবা এর আগে নবীজী সা. যা কিছু নিজে বলেছেন তা আমরা মানবনা”।
আমি মনে মনে বুঝতে ছিলাম। মাওলানা সাহেব যা কিছু বলছেন ঠিকইতো বলছেন। আমাদের যদি হাজারো হাদিস শুনিয়ে দেয়া হয়, আমরা তা মানিনা। বরং এসব বাতিল বলে ছেড়ে দেই। কারণ আমাদের উস্তাদ যে শব্দ বলেছেন তা হুজুর সা. কেন বলেননি এই কারণে। এটাতো খোদ নবীজী সা. কে পরামর্শ দেয়া যে, আপনি যদি কোন মাসআলা বলতে চান, তাহলে শব্দ আমাদের থেকে জেনে নিন। আর শর্তও আমাদের জিজ্ঞেস করে নিন। কেননা যদি আমাদের শর্ত মেনে আমাদের অনুকূল শব্দ আপনি না বলেন, তাহলে আমরা তা কখনোই মানবনা।
একটি প্রশ্ন
আমি বললাম-“হযরত! আপনি নিজেওতো এমন প্রশ্ন বানাতে পারেন, যাতে শুধু হাদিস জানতে চাওয়া হবে। আর সাথে সাথে পুরস্কারের ওয়াদা থাকবে এতে। আর আমাদের উস্তাদও এ ধরণের হাদিস পেশ করতে সক্ষম হবেনা। বরং একে কেবল ধোঁকা বলতে পারবে। যেমন এই প্রশ্নগুলিকে ধোঁকা বলেছেন”। হযরত মুচকি হাসি দিয়ে বললেন-“কি ধোঁকাও ভাল কাজ যে, আমি তা করতে শুরু করব?”
আমি বললাম-“আমাকে বুঝানোর জন্য আপনি অবশ্যই একটি প্রশ্ন বানিয়ে দিন”। একথা শুনে হযরত এই প্রচারপত্রের উল্টোপিঠে একটি প্রশ্ন লিখলেন যে, “আপনি নিজের শর্তানুযায়ী একটি সহীহ, সুষ্পষ্ট, মারফু’ গায়রে মাজরুহ এমন হাদিস পেশ করুন। যাতে প্রমাণিত হয় যে, শরয়ী দলিল শুধুমাত্র সহীহ, সুষ্পষ্ট, মারফু’ গায়রে মাজরুহ হাদিসের উপরই নির্ভরশীল। যদি এমন হাদিস দেখাতে পারেন, তাহলে আমি আপনাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদ পুরস্কার দিব”। মাওলানা সাহেব এটা লিখে এর উপর দস্তখত করে দিলেন। আমি তখন ভাবতে ছিলাম। আমার উস্তাদ বলতেন যে, চ্যালেঞ্জতো পঞ্চাশ হাজার টাকার কমে করবেনা। কিন্তু পাঁচ পয়সার চ্যালেঞ্ছের উপরও কখনো দস্তখত করবেনা। অথচ মাওলানা সাহেব নিশ্চিন্তমনে পঞ্চাশ হাজার টাকার চ্যালেঞ্ছের উপর দস্তখত করে দিলেন!!
প্রত্যাবর্তন
আসি তারপর সেই প্রচারপত্রটি নিয়ে উঠলাম। ফিরে এলাম। উস্তাদজি ব্যাকুল হয়ে আমার অপেক্ষায় গেটে পাইচারী করছেন। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন-“কেউ আমার ইশতিহারের উপর হাত লাগাতে পারেনা”। আমি বললাম-“আজতো ভাল করেই হাত লাগিয়ে দিল একজন। আর তিনি নিজেও একটি হাদিস আপনার কাছ থেকে জানতে পাঠাল। আপনি যদি তা লিখে দিতে পারেন, তাহলে তিনি আপনাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার দিবেন। তিনি দস্তখতও করে দিয়েছেন। উস্তাদজি! আপনি হাদিস লিখে দিন, আমি পুরস্কার নিয়ে আসি”। ডিসেম্বরের তীব্র শীতের সময় ছিল। উস্তাদজি প্রশ্নটি একবার পড়তেই তিন বার কপাল থেকে ঘাম মুছলেন। উস্তাদজির ঘামের তীব্রতা দেখে প্রশ্নের ওজন আমার আন্দাজ হয়ে যায়। এদিকে মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আমার হিদায়াতের সময় ঘনিয়ে আসছিল। উস্তাদজি প্রশ্নটি শেষ করেই প্রথমে বললেন-“এই শর্তটি ধোঁকাবাজীর জন্য লাগানো হয়েছে”। একথা শুনেই আমার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সড়ে গেল। আমি বললাম-“হযরত! ধোঁকা দ্বীনের মাঝে? আবার কুরআন ও হাদিসের মাঝে? একথাইতো আমাকে আজ মাওলানা সাহেব বুঝালেন যে, আমাদের ঈমান নবী সা. এর উপর নয়, বরং উস্তাদের বানানো শর্তের উপর! আর আজ আপনি নিজেই নিজের শর্তকে ধোঁকা বলছেন? তাহলে আমি যাব কোথায়?”
না পাইলাম মুর্তি না পাইলাম স্রষ্টারে, না আছে এদিকে পথ না আছে ওদিকেরে।
আরো একটি প্রশ্ন
উস্তাদজির ক্লাশরুমে টেবিলের উপর তার কিতাবাদীর কপি থাকত। এর মাঝে মোটা মোটা দু’টি কপি ছিল। একটির উপর লিখা-“দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. এর বুখারী শরীফের তাক্বরীর”। আর অন্যটির উপর লিখা “দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান শিক্ষক সাইয়্যিদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এর তিরমিযী শরীফের তাক্বরীর”। একদিন আমি উস্তাদজিকে জিজ্ঞেস করলাম-“উস্তাদজি! এই মুশরিকদের কিতাব আপনার কাছে কেন রাখেন?” সে সময় ওলামায়ে আহনাফকে মুশরিক বলাটা আমাদের কাছে অনেক সওয়াবের কাজ আর উস্তাদজিকে খুশি করার মুক্ষম পদ্ধতি ছিল। উস্তাদে মুহতারাম এতে খুব খুশি হলেন। সাবাশ দিতে দিতে বললেন-“বেটা! মাসআলার ব্যাপারে আমাদের সাথে তাদের মতভেদ আছে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদের জ্ঞান দ্বারা ভরপুর করে দিয়েছেন। আমি এই কপিগুলি পড়া ছাড়া না বুখারী পড়তে পারি। না তিরমিযী”। হযরতের এই কথা আমার মনে ধাক্কা দিল। আমি বললাম-“উস্তাদজি! আপনি ধোঁকাবাজি এই লোকদের সাথে করছেন। যাদের কপি পড়া ছাড়া আপনি বুখারী বুঝেন না, বুঝেন না তিরমিযীও”। উস্তাদজি আমার কথা শুনে আমাকে বললেন-“যাও! এখান থেকে চলে যাও! এখানে আর কখানো আসবেনা”। আমি বললাম-“উস্তাদজি! আপনি হাদিসটা লিখে দিন। আমি পুরস্কার নিয়ে আসি”। উস্তাদজি রেগে আমাকে একটি থাপ্পড় মারলেন-“ভাগো এখান থেকে!”
দ্বিতীয়বার হযরতের কাছে গমণ
সেদিন আসরের পর আমি হযরত মাওলানা আব্দুল কাদির সাহেবের খিদমতে হাজির হলাম। আমি তাকে বললাম-“হযরত! এই কথাতো নিশ্চিত হয়ে গেল যে, এই প্রশ্নগুলি কেবলি ধোঁকাবাজি। কিন্তু আমাকে এটা বলুন যে, আপনারা হাদিসের বিপরীতে ইমাম আবু হানীফার কথাকে কেন প্রাধান্য দিয়ে থাকেন?” হযরত বললেন-“এটা পুরোপুরি মিথ্যা কথা!” হযরত আমাকে পড়ার জন্য ‘ইলাউস সুনান’ কিতাবটি দিলেন। যার সাথে উর্দু অনুবাদও ছিল। তারপর যখন আমি হাদিস পড়তে শুরু করলাম তখন অবাক হয়ে গেলাম! এটা কত বড় মিথ্যা! যা আমরা সকাল সন্ধ্যা জপ করি!
একদিন আমি উস্তাদজিকে জিজ্ঞেস করি যে, “উস্তাদজি! ‘ইলাউস সুনানে’ থাকা হাদিস আপনি কেন মানেন না? আর এসবের উপর আমলকারীকে আপনি যুক্তিপূজারী বলেন কেন? আর এই কিতাবের কোন পূর্ণাঙ্গ জবাব কোন গায়রে মুকাল্লিদ লিখে থাকলে তা আমাকে বলুন। আমি সেটাও পড়ব”। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধানের পর আমি বুঝতে পারি এর জবাব দেবার ক্ষমতা সারা দুনিয়ার গায়রে মুকাল্লিদদের নেই।
আমি সেই ইলাউস সুনান কিতাবটি সেই মাদরাসায় বসেই পড়তাম। তখন উস্তাদজি খুবই রাগ করতেন। কখনো কখনো আমাকে মেরেছেনও। আমার বুঝে আসতনা যে, আহলে হাদিস হাদিসের এত দুশমন কেন? আমি বলতাম-“আপনি আমাকে হাদিস কেন পড়তে দেন না?” তিনি শুধু একটি কথাই ধমকের সাথে বলতেন যে, “এই হাদিসের কিতাব তুমি আমার মাদরাসায় বসে পড়তে পারবে না”।
আমি একদিন মসজিদের দেয়ালে সুন্দর করে এই হাদিস লিখে দিলাম যে, “হুজুর সা. থেকে নিরবচ্ছিন্ন সূত্র পরম্পরায় বর্ণিত আছে যে, اسفروا بالفجر فانه اعظم للأجر অর্থাৎ নবীজী সা. ইরশাদ করেছেন যে, তোমরা ফজরের নামায ফর্সা হলে পড় তাহলে সওয়াব বেশি পাবে। সেদিন শোরগোল লেগে গেল। “এই হাদিস কে লিখল? কেন লিখল? প্রহার কর তাকে। বহিস্কার কর তাকে”।
পরদিন দেয়ালে এই হাদিস লিখলাম যে, ابردوا بالصلاة فان شدة الحر من فيح جهنم অর্থাৎ তোমরা জোহরের নামায ঠান্ডা অবস্থায় পড়, কেননা তীব্র গরম জাহান্নামের শ্বাস থেকে হয়”। এ কারণে আমাকে জবাবদিহী করতে হয়েছে। আমাকে বলা হয়-“তুমি ফেতনা সৃষ্টি করছ কেন?” পরের নামাযের আগে আমি দেয়ালে এই হাদিস লিখে দিলাম যে, “فقيه واحد اشد على الشيطان من الف عابدএক ফক্বীহ শয়তানের উপর এক হাজার আবেদের চে’ শক্তিশালী। আমি আন্দাজ করে নিলাম-এই সকল লোকদের হাদিসের প্রতি যতটা বিদ্বেষ আর কারো এমনটি নেই।
তৃতীয়বার
আমি আবার মাওলানা সাহেবের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলাম-“তাক্বলীদে শখসী কাকে বলে?”আমি বললাম-“শিরক”।
-“যত মুহাদ্দিসগণের উল্লেখ তবক্বাতে হানাফিয়্যা, তবক্বাতে মালিকিয়্যাহ, তবক্বাতে শাফিয়িয়্যাহ, আর তবক্বাতে হানাবেলার মাঝে আছে এই সবাই কি মুশরিক?”
আমি বললাম-“নিঃসন্দেহে”।
-“তাহলেতো সিহাহ সিত্তাহ লিখকরা সব মুশরিক হয়ে যায়। তুমি কি বুলুগুল মারাম পড়? ইবনে হাজার শাফেয়ীও তাহলে মুশরিক হয়ে গেছেন! তুমিতো নাসায়ী শরীফ পড়? তিনিওতো ইমাম শাফেয়ী রহ. এর মুকাল্লিদ। সুতরাং মুশরিক”।
এসব কথা শুনে আমি উস্তাদের কাছে এলাম। জিজ্ঞেস করলাম-“কোন মুহাদ্দিস বা গ্রহণযোগ্য কোন ইতিহাসবিদ মুহাদ্দিসীনদের তালিকায় কোন কিতাব তবক্বাতে গায়রে মুকাল্লিদীনদের নামে লিখেছেন? লিখে থাকলে আমাকে দেখান”। উস্তাদ সাহেব খুব নারাজ হলেন। “তুমি ফেতনাবাজী শুরু করেছো! ছাত্রদের ‘ইলাউস সুনানের’ হাদিস শুনাচ্ছো! আর মসজিদের দেয়ালে হাদিস লিখে লিখে লাগাচ্ছ! আমরা এ বিষয়টি সহ্য করব না। তুমি এসব করা বন্ধ কর। হাদিস শুনানো আর লিখা থেকে ফিরে আস। নতুবা মাদরাসা থেকে বের হয়ে যাও। আমাদের কাছে তবক্বাতে গায়রে মুকাল্লিদীনদের কোন কিতাব নেই”।
আমি আবার হযরতের কাছে এলাম। হযরত বললেন-“ইংরেজদের শাসনামলের পূর্বে গায়রে মুকাল্লিদদের কোন কিতাব, কোন মাদরাসা, কোন কবর, কোন তরজমায়ে কুরাআন, কোন তরজমায়ে হাদিস ছিলনা। থাকলে দেখাও। তাদের লেখা কোন নামাযের পূর্ণাঙ্গ কিতাব থাকলে দেখাও”। এসব কথা আমি যখন আমার উস্তাদজিকে জিজ্ঞেস করলাম তখন তার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। অগ্নিশর্মা হয়ে আমাকে বললেন-“ফিতনাবাজী ছাড়া তোমার আর কোন কাজ নেই?”
একটি মজার ঘটনা
একদিন নাসায়ী শরীফের ক্লাশ চলছিল। পড়া চলছিল “ক্বিরাত খালফাল ইমাম” নিয়ে। আমিও ক্লাশে ছিলাম। কিন্তু কিতাব হাতে ছিলনা। উস্তাদজি জিজ্ঞেস করলেন-“তোমার কিতাব কই?”
আমি বললাম-“কামরায়”।
-“নিয়ে আসনি কেন?” রেগে বললেন উস্তাদজি।
-“এটাতো মুশরিকের লেখা কিতাব। আমি এতে হাত লাগাব কেন?”
উস্তাদজি প্রচন্ড শকট খেলেন। চুপ হয়ে গেলেন। ইমাম নাসায়ী নিজেই অধ্যায় স্থাপন করেছেন-باب تأويل قوله تعالى واذا قرئ القرآن فاستمعوا له وانصتوا لعلكم ترحمونঅর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার বাণী-“যখন তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তোমরা তা শোন, এবং চুপ থাক যেন তোমাদের উপর রহম করা হয়” এর ব্যাক্ষা। এর পর তিনি হাদিস আনলেন-اذا قرأ فانصتواঅর্থাৎ “যখন তিলাওয়াত করা হয় তখন চুপ থাক”। যেন আল্লাহ এবং তার রাসূল উভয়েই বলছেন-“যখন ইমাম ক্বিরাত শুরু করবে, তখন মুক্তাদীরা চুপ থাকবে”।
এই আয়াত এবং হাদিস উস্তাদজির মতের বিপরীত ছিল। উস্তাদজি এই হাদিসকে বাতিল করার জন্য কসরত শুরু করলেন। বললেন-“আবু খালিদ আহমর মুদাল্লিস (যিনি ধোঁকাবাজী করেন)। এই হাদিসটি মিথ্যা। আবু খালেদ আহমরের কোন মুতাবি’ (অনুসারী) দুনিয়াতে কোন হাদিসের কিতাবে নেই। আমি আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী সাহেবের সাথে কথা বলেছি, তিনিও তার কোন মুতাবি’ দেখাতে পারেন নি। আমি আট দশটি বিতর্ক অনুষ্ঠানে তা উত্থাপন করেছি, কেউ এর সঠিক জবাব দিতে পারেনি”।
আমিতো মুতালাআ করে বসেছিলাম। মনে মনে উস্তাদজির এই মিথ্যাচারের কারণে প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল। কিন্তু চুপ করে রইলাম। উস্তাদজির দৃষ্টি আমার উপর নিপতিত হল। বললেন-“ঐ হানাফী! খালেদের কোন মুতাবি’ আছে?” অথচ আমি তখনো হানাফী হইনি। রাগের বশে তিনি আমাকে হানাফী বলে সম্বোধন করলেন।
আমি বললাম-“উস্তাদজি আপনি মুখ উপরের দিকে করে বসে থাকেন। তাই আপনার মুতাবি’ চোখে পরেনা। আপনি আপনার চোখটা একটু কিতাবের দিকে বুলান। দেখুন এই কিতাবেই মুতাবি’ মুহাম্মদ বিন সাআদ আনসারী বিদ্যমান আছে। আমি উঠে গিয়ে আঙ্গুলি সেই রাবীর উপর ধরলাম”। উস্তাদজি এবার রাগে গালাগালি শুরু করে দিলেন। আমি আস্তে করে তাসবীহ বের করে তার সামনে রেখে দিলাম। তিনি বললেন-“এটা কি?” আমি বললাম-“আপনি আপনার গালির যেই তাসবীহ আছে সেটা শেষ করুন। তারপর আমাকে বলুন আপনার সামনে থাকা এই মুতবি’ কেন আপনার চোখে পরেনি?” একথা শুনেই তিনি আমাকে লাঠি দিয়ে পিটাতে শুরু করলেন। আর আমাকে মাদরাসা থেকে বাহির করে দিলেন।
এখন আমি ইলাউস সুনান আর হযরত মাওলানা মুহাম্মদ হাসান সাহেব মুহাদ্দিসে ফয়েজপুরী রহ. এর “সিত্তা জরুরিয়্যা”“আদ দালিলুল মুবীন” ইত্যাদী পড়তে লাগলাম। তখনো আমার মাথা থেকে গায়রে মুকাল্লিদিয়্যাতের ভূত নামেনি। যখনি কোন ফিক্বহী মাসআলা দেখতাম। তখনি এর পক্ষে কোন হাদিস আছে কিনা এর পিছনে লেগে যেতাম। কয়েক মাস পর আমার মন হঠাৎ পাল্টে গেল। এখন আমি যখন কোন আয়াত ও হাদিস দেখি তখন এই প্রশ্ন মনে জাগরিত হয় যে, আমি যা বুঝছি তা কি মীর্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মত নতুন? না আমাদের আকাবীর ও পূর্বসূরীরা ও এমনি বুঝেছিলেন।
তো এখন আর নিজস্ব মতামত আর নিজের জ্ঞানের উপর পূর্ণ নির্ভরশীলতার রোগ ব্রেইন থেকে দূরিভূত হয়েছে। আর গায়রে মুকাল্লিদিয়্যাতের অসুখটাও মন থেকে সেরে গেছে। আর আমি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত হানাফী মতাদর্শী হয়ে গেলাম।
দুআ করবেন-আল্লাহ তায়ালা যেন এই সত্য মত ও পথের উপর অবিচল থাকার তৌফিক দেন। আমীন।
আলহামদুলিল্লাহ