প্রশ্ন
ফাযায়েলে সাদাকাতের ২য় খন্ডের ৩৮৯ পৃষ্ঠায় আরবের একটি জামাতের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। যাতে এক মৃত ব্যক্তি স্বপ্নে তার উট বিক্রি করে এবং উট জবাই করে। বাস্তবেও তা জবাই হয়ে যায়।
এ ঘটনার মাধ্যমে কুরআনকে অস্বিকার করা হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে মৃত্যুর পর কেউ দুনিয়াতে ফিরে আসতে পারে না। অথচ উক্ত ঘটনায় বলা হচ্ছে মৃত্যুর পর লোকটি দুনিয়ার আসবাব বিক্রি করল।
এ বিষয়ে আপনাদের জবাব কামনা করছি।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
প্রথমে মূল ঘটনাটি দেখে নেইঃ
আরবের একটি জামাত একজন বিখ্যাত দানশীল দয়ালু ব্যক্তির কবর যিয়ারতের জন্য গেল। দূরের সফর ছিল। রাত্রে তাহারা সেখানে থাকিয়া গেল। তাহাদের মধ্য হইতে এক ব্যক্তি উক্ত কবরবাসীকে স্বপ্নে দেখিল। সে তাহাকে বলিতেছে তুমি তোমার উটটিকে আমার বুখতি উটের বদলে বিক্রয় করিবে? [বুখতি উট উন্নতমানের উটের মধ্যে গণ্য। এই উটটি মৃত ব্যক্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে রাখিয়া গিয়াছিল] স্বপ্নের মধ্যেই লেনদেন হইয়া গেল এবং কবরস্থ ব্যক্তি উঠিয়া তাহার উটটিকে জবাই করিয়া দিল। উটের মালিক ঘুম হইতে উঠিয়া দেখিল তাহার উটের রক্ত বহিতেছে। সে উঠিয়া উহাকে জবাই করিয়া দিল। [কেননা, উহার বাঁচিবার আশা ছিল না] অতঃপর তাহারা গোশত বন্টন করিয়া দিল। সকলে রান্না করিল এবং খাইল। অতঃপর তাহারা সেখান হইতে ফিরিয়া চলিল। যখন পরবর্তী মঞ্জিলে পৌঁছিল। তখন বুখতী উটের উপর সওয়ার এক ব্যক্তির সহিত তাহাদের সাক্ষাৎ হইল। সে জিজ্ঞাসা করিল, অমুক নামের কোন ব্যক্তি তোমাদের মধ্যে আছে কি? সেই স্বপ্নদ্রষ্টা ব্যক্তি বলিল, ইহা আমার নাম। সে জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি অমুক কবরবাসীর নিকট কোন জিনিস বিক্রয় করিয়াছো? স্বপ্নদ্রষ্টা ব্যক্তি স্বপ্নে ঘটনা শুনাইল। বুখতী উটের আরোহী ব্যক্তি বলিল, উহা আমার পিতার কবর ছিল। এই তাহার বুখতী উট। তিনি আমাকে স্বপ্নে বলিয়াছেন, যদি তুমি আমার সন্তান হইয়া থাক, তবে আমার বুখতী উট অমুক ব্যক্তিকে দিয়া দাও এবং তোমার নাম বলিয়াছিলেন। অতএব, এ বুখতী উট আপনার হাওয়ালা করিলাম। এই বলিয়া সে উট রাখিয়া চলিয়া গেল। [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন বিশরহি ইহয়াহু উলুমিদ্দীন]
চরম পর্যায়ের দানশীলতা যে, মৃত্যুর পরেও তাহার কবরে আগমনকারীদের মেহমানদারীর জন্য নিজের মূল্যবান উটকে বিক্রয় করিয়া আগন্তুকদের মেহমানদারী করিল। তবে এই বিষয় যে, মৃত্যুর পর এই ধরণের ঘটনা কিভাবে ঘটিল? ইহাতে অসম্ভবের কিছু নাই। রূহ জগতে এই ধরণের ঘটনাবলী হওয়া সম্ভব। [ফাযায়েলে সাদাকাত, ২য় খন্ড, ৩৮৯ পৃষ্ঠা, দারুল কিতাব প্রকাশনী, উর্দু ফাযায়েলে আমাল, ২য় খন্ড, ফাযায়েলে সাদাকাত-৫১৪-৫১৫]
কি বুঝা গেল?
উপরোক্ত ঘটনা শায়েখ জাকারিয়া রহঃ নিজের পক্ষ থেকে লিখেননি। বরং আল্লামা মুর্তাজা যুবাইদী রহঃ [মৃত্যু ১২০৫ হিজরী] এর কিতাব “ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন” এর ৮ম খন্ডের ১৮৬ পৃষ্ঠা থেকে গৃহিত।
আল্লামা যুরকালী রহঃ বলেন, যুবাইদী রহঃ হাদীস, লুগাত, রিজাল ইত্যাদি বিষয়ে আল্লামা ছিলেন এবং অনেক বড় মুসান্নিফ ছিলেন। [আলআলামু লিজযুরকালী-৭/৭০]
উপরোক্ত ঘটনাটি আল্লামা যুবাইদী রহঃ এর অনেক আগেই ইমাম গাজালী রহঃ [মৃত্যু ৫০৫ হিজরী] তার প্রসিদ্ধ কিতাব “ইহয়াউ উলুমিদ্দীন” নামক গ্রন্থে নকল করেছেন। এবং এর দ্বারা ইস্তিদলাল করেছেন।
দেখুন ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন-৩/২৪৯-২৫০]
আর ইমাম গাযালী রহঃ এর ব্যাপারে ইমাম ইবনে আসকারী রহঃ [মৃত্যু ৫৭১ হিজরী] বলেন, তিনি ইলমে ফিক্বহ ও মাযহাবে ইমাম। [তারীখে ইবনে আসাকীর-৫৫/২০০]
আর হাফেজ আবুল হাসান ফার্সী রহঃ [মৃত্যু ৫২৯ হিজরী] বলেন, তিনি ইসলাম এবং মুসলমানদের জন্য হুজ্জত ও আইয়িম্মায়ে দ্বীনের ইমাম। [তারীখে ইবনে আসাকীর-৫৫/২০০]
ইমাম যাহাবী রহঃ [মৃত্যু ৭৪৮ হিজরী] ইমাম গাযালী রহঃ এর পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেনঃ শায়েখ, ইমাম, বাহর, হুজ্জাতুল ইসলাম, দ্বীনকে সৌন্দর্যমন্ডিতকারী আবু আহমাদ মুহাম্মদ গাযালী রহঃ। [সিয়ারু আলামিন নুবালা-১৯/৩২২]
ইমাম তাকীউদ্দীন আবু ইসহাক মুহাম্মদ বিন ইব্রাহীম রহঃ [মৃত্যু ৬২৯ হিজরী] বলেন, তিনি দ্বীনের আইয়িম্মাদের ইমাম, হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন। তার মত কেউ নেই। [আলমুন্তাখাব মিনাস সিয়াক্ব-১/৭৬]
ইমাম আবুল কারীম বিন মুহাম্মদ সামআনী রহঃ [মৃত্যু ৫৬২ হিজরী] বলেন, তিনি ফযীলতপূর্ণ, যাহেদ, মুত্তাকী, উত্তম চরিত্রবান, অনেক ইবাদতগুজার ছিলেন। [আলমুন্তাখাব মিন মু’জামি শুয়ূখিস সামআনী-১/১৪৪১]
ইমাম ইবনে নাজ্জার রহঃ [মৃত্যু ৬৪৩ হিজরী] বলেন, ইমাম গাযালী রহঃ আলাল ইতলাক ইমামুল ফুক্বাহা। খোদাভীরু, সর্বসম্মতভাবে ইমাম এবং জমানার মুজতাহিদ ছিলেন। [আলমুস্তাফাদ মিন যাইলি তারীখীল বাগদাদ-২১/২৭]
এবার দেখার বিষয় হল, উপরোক্ত ঘটনাটি শায়েখ জাকারিয়া রহঃ স্বীয় কিতাবে আনার কারণে, যারা হযরতকে কুরআন বিরোধী, শিরক ও কুফরের ফাতওয়া দিচ্ছেন, তারা ইমাম গাযালী রহঃ [মৃত্যু ৫০৫ হিজরী] এর মত ইমামুল ফুক্বাহা, আল্লাহভীরু শায়েখের ব্যাপারে কী ফাতওয়া প্রদান করবেন?
আরেকটি বিষয় হল, ইমাম গাযালী রহঃও প্রশ্নোক্ত ঘটনাটি নিজে নিজে লিখেননি। বরং ইমাম আবুল হাসান মাদায়েনী রহঃ [মৃত্যু ২২৪ হিজরী] এর কিতাব “আখবারুল আসকিয়া” কিতাব থেকে নকল করেছেন।
যেদিকে ইমাম গাযালী রহঃ ইংগিত করেছেন। একথাই এহইয়াউ উলুমিদ্দীন কিতাবের ব্যাখ্যা গ্রন্থে আল্লামা মুর্তাজা যুবায়েদী রহঃ উল্লেখ করেছেন। [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন-৫/১৮৬]
আখবারুল আসকিয়া গ্রন্থ। যেখানে মূলত প্রশ্নোক্ত ঘটনাটি উদ্ধৃত হয়েছে। সেটির লেখক হাফিজ আবুল হাসান মাদায়েনী রহঃ [মৃত্যু ২২-৭ হিজরী] হলেন সহীহ মুসলিম, সুনানে তিরমিজী, সুনানে আবু দাউদ এবং সুনানে নাসায়ী রহঃ এর রাবী।
যার ব্যাপারে ইমাম ইবনে মাঈন রহঃ ইমাম আলী বিন মাদিনী রহঃ ইমাম আবু দাউদ রহঃ, ইমাম আবু বকর ইবনে আবী শাইবা রহঃ বলেন, তিনি সিক্বা রাবী।
ইমাম নাসায়ী রহঃ এবং ইমাম ইয়াহইয়া বিন মাঈন রহঃ বলেন, তার মাঝে কোন খারাবী ছিল না। [তাহযীবুল কামাল-২০/৪০৯-৪১১]
এরকম ঘটনাবলী সালাফে সালেহীন থেকে আরো অনেক বর্ণিত আছে।
তাছাড়া আমরা বলি, উক্ত ঘটনায় স্বপ্নে করা কর্মের ফলাফল বাস্তবে প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ তাআলার কুদরত। এটি কেবলি আল্লাহর হুকুমেই হয়েছে। এতে বান্দার কোন দখল নেই।
শেষ কথা হল, উপরোক্ত ঘটনা বর্ণনার কারণে যে ফাতওয়া শাইখুল হাদীস জাকারিয়া রহঃ এর উপর আরোপ করা হয়েছে, সেই একই ফাতওয়া কি ইমাম গাযালী রহঃ এবং ইমাম আবুল হাসান মাদায়েনী রহঃ এর উপরও আরোপ করতে পারবেন?
যদি উক্ত ঘটনা উল্লেখ করা কুফরী শিরকীর প্রচার হয়, কুরআন বিরোধী কাজ হয়, তাহলে যারা মূল কর্তা, সেই আবুল হাসান মাদায়েনী রহঃ, ইমাম গাযালী রহঃ এর উপরই উপরোক্ত উদ্ভট ফাতওয়া প্রয়োগ হবে। তারপর সেটি আরোপ হবে শায়েখ জাকারিয়া রহঃ এর উপর।
আল্লাহ তাআলা লা-মাযহাবী অজ্ঞ ব্যক্তিদের মুর্খতার দুর্গন্ধ থেকে উম্মতের ঈমান ও আমলকে হিফাযত করুন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা-ইমাম আবূ হানীফা ইসলামী রিসার্চ সেন্টার পিরোজপুর।
ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com