প্রশ্ন
নামাযের বৈঠকে আত্তাহিয়্যাতু পড়ার সময় আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করতে হবে? আঙ্গুল নাড়ানো কি হাদীস দ্বারা প্রমানিত নাকি শুধু ইশারা করা প্রমানিত?
প্রশ্নকর্তা-মুহাঃ মুফাজ্জাল হোসাইন
ঢাকা, বাংলাদেশ।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
আত্তাহিয়্যাতু পড়ার শেষের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করা রাসূল সাঃ থেকে প্রমাণিত। তাই এ আমলটি সুন্নত। সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে কেবল আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করা প্রমাণিত। আঙ্গুল নাড়ানো নয়। যারা আঙ্গুল নাড়ানোর কথা বলেন, তাদের বক্তব্যটি বিশুদ্ধ নয়।
عَنْ عَامِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ الزُّبَيْرِ عَنْ أَبِيهِ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- إِذَا قَعَدَ يَدْعُو وَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى فَخِذِهِ الْيُمْنَى وَيَدَهُ الْيُسْرَى عَلَى فَخِذِهِ الْيُسْرَى وَأَشَارَ بِإِصْبَعِهِ السَّبَّابَةِ وَوَضَعَ إِبْهَامَهُ عَلَى إِصْبَعِهِ الْوُسْطَى وَيُلْقِمُ كَفَّهُ الْيُسْرَى رُكْبَتَهُ
হযরত আমের আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূল সাঃ যখন তাশাহুদ পড়ার জন্য বসতেন, তখন ডান হাতখানা ডান উরুর উপর এবং বাঁ হাতখানা বাঁ উরুর উপর রাখতেন। আর শাহাদত আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করতেন। এ সময় তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলিকে মধ্যমার সাথে সংযুক্ত করতেন এবং বাঁ হাতের তালু [বাঁ] হাঁটুর রাখতেন। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৩৩৬, সহীহ ইবনে হিব্বান-৫/২৭০}
عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- كَانَ إِذَا جَلَسَ فِى الصَّلاَةِ وَضَعَ يَدَيْهِ عَلَى رُكْبَتَيْهِ وَرَفَعَ إِصْبَعَهُ الْيُمْنَى الَّتِى تَلِى الإِبْهَامَ فَدَعَا بِهَا وَيَدَهُ الْيُسْرَى عَلَى رُكْبَتِهِ الْيُسْرَى بَاسِطُهَا عَلَيْهَا
হযরত ইবনে ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ নামায পড়ার সময় যখন বসতেন বৈঠক করতেন] তখন হাত দুইখানা দ্ইু হাঁটুর উপর রাখতেন। আর ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির পার্শ্ববতী [শাহাদাত] আঙ্গুল উঠিয়ে ইশারা করতেন এবং বাঁ হাত বাঁ হাঁটুর উপর ছড়িয়ে রাখতেন। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৩৩৭}
عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- كَانَ إِذَا قَعَدَ فِى التَّشَهُّدِ وَضَعَ يَدَهُ الْيُسْرَى عَلَى رُكْبَتِهِ الْيُسْرَى وَوَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى رُكْبَتِهِ الْيُمْنَى وَعَقَدَ ثَلاَثَةً وَخَمْسِينَ وَأَشَارَ بِالسَّبَّابَةِ
হযরত ইবনে ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ যখন তাশাহুদের জন্য বসতেন, তখন বাম হাতকে রাখতেন বাম হাঁটুর উপর এবং ডান হাতখানা ডান হাঁটুর উপর রাখতেন। আর [হাতের তালু ও আঙ্গুলসমূহ গুটিয়ে আরবী] তিপ্পান্ন সংখ্যার মত করে শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করতেন। {সহীহ মুসলিম,হাদীস নং-১৩৩৮}
উল্লেখিত হাদীসমূহে শুধুমাত্র আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করার কথা এসেছে। আঙ্গুল নাড়ানোর কথা আসেনি। কিন্তু আঙ্গুল নাড়বে কি না? এ ব্যাপারে কোন স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। অন্য হাদীসে তাও স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে। যেমন-
عن عبد الله بن الزبير أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «كَانَ يُشِيرُ بِأُصْبُعِهِ إِذَا دَعَا، وَلَا يُحَرِّكُهَا
হযরত আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ যখন তাশাহুদ পড়তেন, তখন আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করতেন, কিন্তু আঙ্গুল নাড়াতেই থাকতেন না। {সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদীস নং-১১৯৩, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৯৮৯, মুসনাদে আবী আওয়ানা, হাদীস নং-১৫৯৪}
হাদীসটি সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের মন্তব্য
১-
ইমাম আব দাউদ উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করার পর কোন মন্তব্য করেননি। আর মুহাদ্দিসদের কাছে এটি প্রসিদ্ধ যে, ইমাম আবু দাউদ কোন হাদীস বর্ণনা করার পর তার ব্যাপারে কোন মন্তব্য না করার মানেই হল, উক্ত হাদীসটি তার কাছে সহীহ।
২
ইমাম নববী রহঃ বলেন- হাদীসটির সনদ সহীহ। {আলখুলাসা-১/৪২৮, আলমাজমূ-৩/৪৫৪}
৩
মুহাদ্দিস আব্দুল হক শিবলী রহঃ বলেন- হাদীসটির সনদ সহীহ। {আলআহকামুস সুগরা-২৪৯}
৪
ইবনে দাকীকুল ঈদ রহঃ বলেন- কতিপয় মুহাদ্দিসদের বক্তব্য অনুপাতে হাদীসটি সহীহ। {আলইলমাম ফি বিআহাদীসিল আহকাম-১/১৭৫}
৫
আল্লামা ইবনুল মুলাক্কিন রহঃ বলেন- হাদীসটি সহীহ। {খুলাসাতুল বদরুল মুনীর-১/১৩৯, আলবাদরুল মুনীর-৪/১১, তুহফাতুল মুহতাজ-১/৩২৩}
৬
শায়েখ হায়সামী রহঃ বলেন- সনদের রাবীগণ সিক্বা। {মাযমাউজ জাওয়ায়িদ-২/১৪৩}
৭
ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ বলেন- হাদীসটি হাসান। {তাখরীজে মিশকাতুল মাসাবীহ-১/৪১১}
উক্ত সহীহ হাদীস দ্বারা একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, রাসূল সাঃ তাশাহুদের সময় শুধুমাত্র আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করতেন, আঙ্গুল নাড়াতেই থাকতেন না।
তবে অপর একটি হাদীসের বাহ্যিক শব্দ দ্বারা ধারণা হয় যে, রাসূল সাঃ আঙ্গুল নাড়াতে থাকতেন। হাদীসটি ওয়ায়েল বিন হুজুর রাঃ থেকে বর্ণিত। হাদীসটির শব্দ হল-
ثُمَّ رَفَعَ أُصْبُعَهُ فَرَأَيْتُهُ يُحَرِّكُهَا
তারপর তিনি আঙ্গুল উঠালেন, তারপর আমি দেখলাম তিনি তা নাড়াচ্ছেন। {সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদীস নং-১১৯১, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-১৩৫৭}
হাদীসটি সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের মন্তব্য
আল্লামা ওয়াদেয়ী রহঃ বলেনঃ বাহ্যিকভাবে বুঝা যায় হাদীসটি হাসান। কিন্তু তাতে শাজ শব্দ আছে। সেটি হল আঙ্গুল নাড়ানোর বিষয়টি। {আহাদীসে মুআল্লাহ-৩৮৯}
তবে অন্যান্য মুহাদ্দিসীনে কেরাম, যেমন ইবনে হাজার আসকালানী, ইমাম নববী রহঃ, ইবনুল মুলাক্কিন রহঃ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ হাদীসটির সনদকে সহীহ বলেছেন।
দুই হাদীসের মাঝে বৈপরীত্বের সমাধান কি?
আল্লামা ইমাম বায়হাকী রহঃ উভয় হাদীসের বাহ্যিক এ বৈপরীত্ব নিরসন করে বলেনঃ
فَيُحْتَمَلُ أَنْ يَكُونَ الْمُرَادُ بِالتَّحْرِيكِ الْإِشَارَةَ بِهَا لَا تَكْرِيرَ تَحْرِيكِهَا فَيَكُونَ مُوَافِقًا لِرِوَايَةِ ابْنِ الزُّبَيْرِ وَاللهُ تَعَالَى أَعْلَمُ
আঙ্গুল নাড়াতে থাকা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, ইশারা করা। আঙ্গুল নাড়াতেই থাকা উদ্দেশ্য নয়। এ অর্থ নিলে এ হাদীসটি আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের রাঃ এর বর্ণনার সাথে মিলে যায়। {সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং-২৬১৫}
ইমাম বায়হাকী রহঃ যে সমাধান দিয়েছেন এটিই এ দুই হাদীসের মাঝের বাহ্যিক বৈপরীত্ব নিরসনের প্রকৃত সমাধান। অর্থাৎ ওয়ায়েল বিন হুজুর রাঃ এর হাদীস দ্বারা যে বুঝা যাচ্ছে যে, আঙ্গুল নাড়াতে ছিলেন। এর মানে হল, আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করতে ছিলেন। নাড়াতেই ছিলেন উদ্দেশ্য নয়। এ ব্যাখ্যা নিলে ওয়াইল বিন হুজুর রাঃ এর হাদীস এবং আব্দুল্লা বিন জুবায়ের রাঃ থেকে বর্ণিত হাদীস একই অর্থবোধক হয়ে যায়, কোন বৈপরীত্ব আর বাকি থাকে না।{বাজলুল মাযহুদ-২/১২৭}
স্বাভাবিক যুক্তিও একথা বলে যে, তাশাহুদের সময় বসে বসে আঙ্গুল নাড়াতে থাকবে না। কারণ এটি নামাযের খুশু খুজুর খেলাফ। তাছাড়া এভাবে আঙ্গুল নাড়াতে থাকলে পাশের জনের নামাযে মনযোগের মাঝে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। তাই একটি সুষ্পষ্ট সহীহ হাদীসের উপর আমল ছেড়ে দিয়ে একটি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ্য হাদীসের উপর আন্দাজের উপর আমল করে আঙ্গুল নাড়াতেই থাকা কোন বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
jajakumullahu haira
আল্লাহ আপনাকে হেদায়াত করুক। আমীন