মাওলানা মুহসিনুদ্দীন খান
মুরজিয়া—সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও ভ্রান্ত আকীদা :
মৌলিক আকীদাগত বিচ্যুতির শিকার পাপ-পুণ্যে অনুতাপহীন ভ্রান্ত এক ফিরকার নাম হল মুরজিয়া। এদের ভিতরে রয়েছে বিভিন্ন দল ও উপদল। দল ও উপদল ভেদে আকীদায়ও রয়েছে বৈচিত্র্য। ঈমানের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা এবং আমলের মান ও অবস্থা নির্ণয়ে তাদের রয়েছে প্রান্তিক চিন্তা ও অদ্ভুদ বিশ্বাস। তাদের প্রসিদ্ধ আকীদা ও নীতিবাক্য! হল ‘ঈমান হল তাসদীকে কলবী (কেবল অন্তরের সত্যায়ন ও দৃঢ় বিশ্বাস) ও আল্লাহকে মারেফাত ও চিনার নাম। ঈমান ব্যতীত যত নেক আমল আছে তা উপকারী নয় এবং কুফুর ব্যতীত যত পাপ কাজ আছে তা ক্ষতিকারক নয়।’ অর্থাৎ আমল ঈমানের সাথে সম্পর্কহীন একটি বিষয়। ঈমান থাকলে ইবাদতে কোন উপকারিতা নেই, পাপেও একবিন্দু ক্ষতি নেই। অতএব ঈমান আনার পরে সারা জীবন কেউ পাপের সাগরে ডুবে থাকলেও এটা তার জন্য বিন্দুমাত্র ক্ষতির কারণ নয়। এবং এই পাপ কাজের কারণে এক মূহুর্তের জন্যেও সে দোযখে যাবে না। (দল ও উপদল ভেদে তাদের এ আকীদায় কিছু পার্থক্যও রয়েছে।)
পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকীদা হল, ঈমানের জন্য ইকরার বিল-লিসান বা মুখের স্বীকারোক্তির সাথে সাথে তাসদীকে ইখতেয়ারী (ঐচ্ছিক সত্যায়ন) জরুরী। ঈমানের পাশাপাশি তআত বা নেক কাজ উপকারী। আর মাসিয়াত ক্ষতিকারক। কোন ঈমানদার ব্যক্তি পাপ করলে তাতে ক্ষতিবৃদ্ধি ঘটে না—একথা আমরা বলি না। [ মুরজিয়াদের বিভিন্ন দল-উপদল ও আকীদা এবং ইমাম আযমের উপর আরোপিত অভিযোগের খণ্ডন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখুন— আর-রফউ ওয়াত তাকমীমল, পৃ. ৩৫২-৩৮৮; ফজলুল বারী ১/২৪৫-২৫৭]
উস্তাযে মুহ্তারাম আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ. শাইখুল আরব ওয়ালআজম সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর বুখারী শরীফের অধ্যাপনার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে আমলের সঙ্গে ঈমানের সম্পর্ক এবং এ বিষয়ে ইমাম আবু হানীফা রহ. ও মুহাদ্দিসদের অবস্থান কলমের টানে অসাধারণ করে ফুটিয়ে তুলেছেন। এ আলোচনায় ইমাম আযমের উপর মুরজিয়া হওয়ার অপবাদও খণ্ডিত হয়েছে সুন্দরভাবে। এ বিষয়ে অজস্র কিতাব মুতালাআ করেও যা আয়াসসাধ্য করা কঠিন তিনি অল্পতেই তা ভাষার লালিত্যে আর সুন্দর ও সহজবোধ্য উপমা প্রয়োগে হৃদয়গ্রাহী করে তুলে ধরেছেন। আমরা প্রথমে হুবহু সেই আলোচনা পাঠকের সামনে নতুন কিছু শিরোনাম ও টীপ্পনী যুক্ত করে পেশ করছি। আশা করি, এ আলোচনার দ্বারা আমরা বিষয়টির হাকীকত বুঝতে পারব—ইনশাআল্লাহ।
আমল সম্পর্কে ইমাম আযমের দৃষ্টিভঙ্গি
‘ইমাম আবু হানীফা রহ. হলেন ফকীহগণের মুকুটমণি; একটি বিষয়ের তাহকীক বা সঠিক মর্ম বর্ণনা করা ফকীহগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সে জন্য তিনি তাসদীকে কলবী বা অন্তরের সুদৃঢ় বিশ্বাস—যে বিশ্বাস ব্যক্তিকে বিশ্বাস অনুযায়ী আমলের জন্য উদ্বুদ্ধ করে—সেই বিশ্বাসই হল মূল ঈমান, যার মাঝে সজীবতা ও শীর্ণতা তো আসতে পারে, কিন্তু হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না। কিন্তু এই মূল ঈমান আমলের অভাবে, গোনাহের কারণে ক্রমাগত দুর্বল হতে হতে একদম নিঃশেষ হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। সে জন্য ঈমানের সঙ্গে আমলেরও প্রয়োজনয়ীতা অনস্বীকার্য।
ঈমানের সঙ্গে আমলেরও প্রয়োজনয়ীতাকে অনস্বীকার্য বলে ইমাম আবু হানীফা রহ. স্বীকার করেছেন। মুরজিয়াদের মত—ইবাদতের কোন উপকারিতা নেই, পাপেও কোন ক্ষতি নেই— যদি তাঁর বিশ্বাস ও মতবাদ হত, তাহলে তো তাঁর প্রবাদতুল্য ইবাদত-বন্দেগী করার কোন প্রয়োজন ছিল না! তাঁর শাগরিদবৃন্দকেও বিভিন্ন সময় আমল সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ওসিয়্যাত করার দরকার ছিল না!
একটি অনুপম দৃষ্টান্ত : উদাহরণত একটি চারা (যা বৃক্ষের মূল) রোপণ করে তার গোড়ায় পানি সিঞ্চন ও সার প্রয়োগ করলে চারাটি সতেজ-সজীব হতে হতে ফলে ফুলে পত্রে সুশোভিত প্রকা- মহীরূহে পরিণত হবে, সার ও পানি গাছের চারা হতে অবশ্যই স্বতন্ত্র; কিন্তু চারাটি যখন শিকড় দ্বারা পানি ও সার শোষণ করে নিল, তখন আর তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকে না। একাকার হয়ে বিরাট বৃক্ষে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে সার ও পানির অভাবে চারাটি জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে থাকবে, আশঙ্কা থাকে যে, এক দিন শুকিয়ে মারা যাবে। আবার কোন কারণে জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থায় বেঁচেও থাকতে পারে। অনুরূপ মনের ক্ষেত্রে ঈমানের যে বীজ বপন বা চারা রোপণ করে তাতে আমলের পানি সিঞ্চন কর, সার প্রয়োগ কর, গোনাহের পোকা-মাকড় হতে রক্ষা কর, দেখবে তোমার রোপিত চারাটি কেমন সতেজ-সজীব ফলে, ফুলে, পত্রে সুশোভিত হয়ে উঠেছে। কুরআন মাজীদ ও হাদীসে নববী আমাদেরকে এরূপ সবল-সতেজ ঈমান আনয়নেরই আহবান জানিয়েছে। জীর্ণ-শীর্ণ মৃতপ্রায় চারা গাছের ন্যায় ঈমান আনয়নের আহবান জানায়নি। এরূপ সবল ঈমানকে الإيمان المطلوب من الشرع বলা হবে। মুহাদ্দিসগণ তাঁদের গ্রন্থে এই ঈমানের আলোচনা করেছেন। কাজেই তাঁরা পানি ও সার রূপী আমলকে ঈমানের অন্তর্ভুক্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বৃক্ষের চারা ও পানি, সার কি একই বস্তু? না ভিন্ন বস্তু? হযরত ইমাম আবু হানীফা রহ. ও তাঁর অনুসারী ফুকাহা, মুতাকাল্লিমীন এই মূল কথাটি ব্যক্ত করেছেন মাত্র। তাঁরা আমলের সংযোগে ও গোনাহের পরিত্যাজ্যে সবল-সতেজ ঈমান বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অবশ্য জোরে-শোরে স্বীকার করেছেন। এই ঈমানই শরীয়াতের পক্ষ হতে কাম্য।
কেবল উপস্থাপনার পার্থক্য; প্রকৃত কোন বিরোধ নেই : মুহাদ্দিসগণ এ চুল-চেরা বিশ্লেষণের ধারে-কাছে না যেয়ে সোজা ঘোষণা করে দিয়েছেন, ঈমান হল—তসদীকে কলবী বা মনের দৃঢ় বিশ্বাস, ইকরার বিল-লিসান বা মুখের স্বীকারোক্তি, আমল বিল জাওয়ারেহ বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অন্যান্যভাবে ইবাদত বন্দেগী/পূণ্য কর্ম—এর সমষ্টির নাম। অবশ্যই তাঁদের এ ঘোষণা প্রশংসনীয়। কারণ, শরীয়াত আমাদেরকে এই পর্যায়ের ঈমানের উপর টিকে থাকতে বলেছে এবং আমাদের এই ঈমানের উপরই টিকে থাকতে হবে। কিন্তু সার ও পানির অভাবে জীর্ণ-শীর্ণ চারা গাছটি যদি বেঁচে থাকে, তাকে কি তুমি গাছ বলে আখ্যায়িত করবে না? তোমার পানির সিঞ্চন না পেলেও গাছটি তো আল্লাহ তাআলার রহমতের বারি পেতে পারে। এভাবে সে গাছটি যদি টিকে থাকে, আর তাতে ২/৪ টি ফল আসে, পাতা বের হয়, তাহলে কি তুমি সে পাতা ঝরায়ে দিবে? ফলগুলো বের হতেই নিশ্চিহৃ করে দিবে? কখনও না। তদ্রুপ অন্তরের বিশ্বাসের চারার সাথে সার প্রয়োগকৃত, পানি সিঞ্চিত বৃক্ষটিই প্রকৃতপক্ষে কাম্য। এবং আখিরাতে এরূপ ঈমান বৃক্ষই ফলবান বলে স্বীকৃত হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর ঐ জীর্ণ-শীর্ণ বৃক্ষটি হয়তো আল্লাহ তাআলার কৃপা-বারিতে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি পাবে। অন্যথায় ফলবান বৃক্ষ না হবার অপরাধে শাস্তি ভোগ করে, বৃক্ষ তো বটে বলে জান্নাতে যাবার পথ তার রুদ্ধ হয়ে যায়নি। কাজেই কোন বিরোধ নেই।
قال الراقم: بوب الإمام عبد القاهر البغدادي في كتابه الفرق بين الفرق (الفصل الثالث من فصول هذا الباب ) “في بيان الاصول التى اجتمعت عليها اهل السنة قد اتفق جمهور اهل السنة والجماعة على اصول من اركان الدين كل ركن منها يجب على كل عاقل بالغ معرفة حقيقته ولكل ركن منها شعب وفي شعبها مسائل اتفق اهل السنة فيها على قول واحد وضللوا من خالفهم فيها “- ثم قال تحت عنوان هذا الباب “وقالوا في الركن الثالث عشر المضاف الى الايمان والاسلام إن اصل الايمان المعرفة والتصديق بالقلب وانما اختلفوا في تسمية الاقرار وطاعات الاعضاء الظاهرة ايمانا مع اتفاقهم على وجوب جميع الطاعات المفروضة وعلى استحباب النوافل المشروعة
ইমাম আবু হানীফা রহ. ও তাঁর মতের প্রতিধ্বনিকারীগণ বিষয়টির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেছেন। ইমাম বুখারী রহ. ও তাঁর স্বগোত্রীয়গণ এসব বিশ্লেষণের ধারে কাছে না যেয়ে যা কাম্য, ফলবান তারই আলোচনা করেছেন। এই কাম্য হওয়া, ফলবান হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ও স্বার্থকতা বরং সাফল্যের স্বীকৃতি ইমাম আবু হানীফা রহ. (৮০-১৫০) ইমাম বুখারী রহ. (১৯৪-২৫৬)-এর আবির্ভাবের বহু পূর্বেই জীবনভর প্রদান করে গেছেন। সেই সঙ্গে বিষয়টির প্রকৃত অবস্থাও বর্ণনা করেছেন, তা নাহলে লক্ষ লক্ষ নয়, বরং কোটি কোটি মুমিন, মুসলিম ঈমান ও ইসলামের গণ্ডি হতে বের হয়ে চিরকালের জাহান্নামী বলে তোমাকে সার্টিফিকেট দিতে হত। অথচ এ সার্টিফিকেট দিবার তোমার কোন অধিকার নেই। [বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের সুর ১/২৬৭; ২৬৮॥ মাকতাবাতুল ই’তিসাম]
সারকথা
১. আমল যে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এ ক্ষেত্রে সব ফরীক— মুহাদ্দিসীন এবং হযরত ইমাম আবু হানীফা রহ. ও তাঁর অনুসারী ফুকাহা, মুতাকাল্লিমীনের বক্তব্য অভিন্ন।
২. আবার আমল না থাকলে ঈমান চলে যায় না। তবে এরূপ ব্যক্তি অপূর্ণাঙ্গ ও গুনাহগার মুমিনরূপে বিবেচিত হবে। অতএব কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি কাফির নয়। এ বিষয়েও সবাই একমত।
৩. ঈমান থাকলে একসময় সে জান্নাতে যাবে এ বিষয়েও উভয় ফরীকের চিন্তাধারা একই।
واعلم أن مذهب أهل السنة وما عليه أهل الحق من السلف والخلف أن من مات موحدا دخل الجنة قطعا على كل حال فان كان سالما من المعاصى كالصغير والمجنون والذى اتصل جنونه بالبلوغ والتائب توبة صحيحة من الشرك أو غيره من المعاصى اذا لم يحدث معصية بعد توبته والموفق الذى لم يبتل بمعصية أصلا فكل هذا الصنف يدخلون الجنة ولا يدخلون النار أصلا لكنهم يردونها على الخلاف المعروف فى الورود والصحيح أن المراد به المرور على الصراط وهو منصوب على ظهر جهنم أعاذنا الله منها ومن سائر المكروه وأما من كانت له معصية كبيرة ومات من غير توبة فهو فى مشيئة الله تعالى فان شاء عفا عنه وأدخله الجنة أولا وجعله كالقسم الاول وان شاء عذبه القدر الذى يريده سبحانه وتعالى ثم يدخله الجنة فلا يخلد فى النار أحد مات على التوحيد ولو عمل من المعاصى ما عمل كما أنه لا يدخل الجنة أحد مات على الكفر ولو عمل من أعمال البر ما عمل. هذا مختصر جامع لمذهب أهل الحق فى هذه المسألة وقد تظاهرت أدلة الكتاب والسنة واجماع من يعتد به من الأمة على هذه القاعدة وتواترت بذلك نصوص تحصل العلم القطعى. شرح مسلم للنووي ۱: ٢۱۷
হুকুম ও বিধানগত দিক থেকে এ তিনও পয়েন্টে মুহাদ্দিসীন এবং হযরত ইমাম আবু হানীফা রহ. সবাই ঐকমত্য পোষণ করেছেন। বাকী মুহাদ্দিসীন কাজ করেছেন মুরজিয়াদের প্রান্তিকতা খণ্ডনে। কারণ তাদের সময় মুরজিয়াদের দাপট ছিল বেশি। আর ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর যামানায় খারেজী ও মুতাজিলাদের দাপট ও প্রোপাগান্ডা ছিল বেশি। তাই তিনি তাদের মুকাবেলা করেছেন, তাদের প্রান্তিকতার খ-নে কাজ করেছেন। আর এ উভয় ফিরকার অভ্যাস ছিল তাদের প্রতিপক্ষকে তারা মুরজিয়া বলে অপবাদ দিয়ে জনসাধারণের চিন্তা ও বিশ্বাস বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করার প্রয়াস চালাত।
এ দু’টি দলই আমলকে এরূপ সীমাতিরিক্ত গুরুত্ব দিত যে, আমল পরিত্যাগকারীকে ঈমানের গণ্ডি থেকে বের করে তাকে কাফের ও মুশরিকদের মত চিরস্থায়ী জাহান্নামী মনে করত; তাই ইমাম আযম রহ. ঈমান ও আমলের হাকীকতকে তুলে ধরে উভয়টাকে আলাদাভাবে তাবীর ও উপস্থাপন করেন। অর্থাৎ তিনি আমলকে ঈমান থেকে একেবারে বের করে দেননি। বরং আমলকে তার আপন মাকাম ও মর্যাদায় রেখেছেন। এবং এটা বলতে ও বুঝাতে চেয়েছেন যে, আমলের ঐ মাকাম ও মর্যাদা নেই যে মাকাম ও মর্যাদা রয়েছে ঈমানের।
ঈমানই হল আসল ও বুনিয়াদ। যদি তাসদীক ও ঈমান না হয়, তাহলে যত নেক আমলই করা হোক না কেন জান্নাতে প্রবেশের জন্য তার কানাকড়িও মূল্য নেই। যেহেতু ঈমানই হল সব কিছুর মূল এজন্য ইমাম আবু হানীফা রহ. কেবল এটা সুস্পষ্ট করেছেন যে, আমলের মান ও স্তর ঈমানের বরাবর নয়। বরং ঈমানের চেয়ে কম এবং ঈমানের পরেই তার স্থান। ইমাম আবু হানীফা রহ. উসমান আলবাত্তীকে লেখা চিঠিতে واعلم ان الهدي في التصديق بالله وبرسوله ليس كالهدي فيما افترض من الأعمال বলে এই তাৎপর্যের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। কথাটি এভাবেও ব্যক্ত করা যায় যে, তিনি স্বাস্থ্যের চাইতে সাজ-পোশাককে, লাবণ্যের চাইতে প্রসাধনকে অগ্রাধিকার দেননি। তিনি আমল যে ঈমানে কামেল বা পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অংশ তা স্বীকার করেছেন। তবে তা যে নফসে ঈমান বা মূল ঈমানের অংশ নয় তাও পরিস্কার করেছেন।
কেননা আমলকে মূল ঈমানের অংশ সাব্যস্ত করা হলে যে আমল করে না বা আমলে অলসতা করে তাকে ঈমানের গ-ি থেকে বের করে দিতে হবে। খারেজী ও মুতাজিলারা যেমনটি করে থাকে।
ইমাম আযমের অবস্থানের সপক্ষে কুরআন মাজীদের কিছু আয়াত : নিম্নে বৃক্ষের চারা তথা ঈমান এবং পানি ও সার তথা আমল যে ভিন্ন জিনিস সে সম্পর্কে কুরআন মাজীদের কিছু আয়াতে কারীমার কেবল আয়াত নাম্বার উল্লেখ করা হল—কুরআন মাজীদের ঐ সকল আয়াত যেখানে আমলকে আতফ (conjunction) করা হয়েছে ঈমানের উপর, যেমন সূরা কাহাফ আয়াত: ৮৮॥ সূরা কাসাস আয়াত : ৬৮॥ সূরা বাকারা আয়াত : ২৫॥ কুরআন মাজীদের ঐ সকল আয়াত যেখানে আমলের জন্য ঈমানকে শর্ত সাব্যস্ত করা হয়েছে, যেমন সূরা নিসা আয়াত : ১২৪॥ সূরা নাহল আয়াত : ৯৭॥
এছাড়া সূরা হুজরাতের নয় নম্বর আয়াত যেখানে কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির উপর মুমিন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কুরআন মাজীদের ঐ সকল আয়াতও আমাদের দলীল যে সব আয়াতে ঈমানের সাথে আমলেরও মুতালাবা করা হয়েছে। যেমন সূরা তাওবা ১১৯ নম্বর আয়াত। দলীলের তালিকায় আরো রয়েছে ঐ সকল আয়াত যে সব আয়াতে কলবকে ঈমানের মহল বা স্থান সাব্যস্ত করা হয়েছে। যেমন : সূরা মুজাদালা আয়াত : ২২॥ সূরা নাহল আয়াত : ১০৬॥ সূরা হুজুরাত আয়াত : ১৪॥
উল্লিখিত এসব আয়াত ইমাম আযমের মতের সপক্ষে কীভাবে দলীল হতে পারে তা বুঝার জন্য দেখুন, আল্লামা আকমালুদ্দীন বাবরতী রহ. কৃত শরহু ওয়াসিয়্যাতি আবী হানীফা পৃ. ৭৪-৭৭॥
হুকুমগত পার্থক্য নয় কেবল আমলের সম্পর্ক বুঝার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য : আরেকটি হৃদয়গ্রাহী উদাহরণ
মুহাদ্দিসগণ আমলকে যে ঈমানের অংশ সাব্যস্ত করেছেন তা কামিল ঈমানের অংশ। অর্থাৎ ঈমানের সংজ্ঞায় তারা আমল নিয়ে আসলেও এটা স্পষ্ট করেছেন যে, আমল ঈমানের গঠনগত অংশ নয় বরং সাজ-গোছ ও বেশভূষামূলক অংশ। পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানীফা রহ. ও মুতাকাল্লিমগণ যে আমলকে ঈমানের অংশ সাব্যস্ত করেন না এর দ্বারা উদ্দেশ্য তারা নফসে ঈমান বা মূল ঈমানের অংশ সাব্যস্ত করেন না। বরং কামেল বা পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অংশ সাব্যস্ত করেন। অতএব উভয় ফরীক তথা ইমাম আবু হানীফা রহ. ও মুহাদ্দিসদের মধ্যকার এ ইখতেলাফ হাকীকী নয় বরং শাব্দিক।
ইমাম আবু হানীফা রহ. ও মুহাদ্দিসদের মধ্যকার মতপার্থক্য যে কেবল অগৌণ ও শাব্দিক; বাস্তবিক নয় তা একটি উদাহরণ দিলে পাঠকের কাছে আরো বেশি সুস্পষ্ট হবে বলে আশা রাখি।
মুহাদ্দিসদের মতে আমল ঈমানের অংশ। তবে তা গঠনগত ও অস্তিত্বের অংশ নয় বরং সাজ-গোছ ও বেশভূষামূলক অংশ। একটি উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। উদাহরণটি বুঝার জন্য তৃণবিশারদ হওয়ার দরকার নেই। বৃক্ষের মত নির্বাক প্রাণসত্তা দিয়েই বুঝার চেষ্টা করি। শাখা-প্রশাখা, পত্র-পল্লব, ফুল-ফল মিলিয়ে বৃক্ষের নিজস্ব একটি সংসার রয়েছে। জন্মানো থেকে ঝরে পড়া পর্যন্ত গাছের পাতারও একটি নিজস্ব জীবন আছে। এই বৃক্ষের একটি কাণ্ড (বৃক্ষের মূল হইতে শাখা পর্যন্ত অংশ) ও শিকড় থাকে আবার ডালপালাও থাকে।
এই শিকড় ও কা- বৃক্ষের গঠনগত মূল অংশ। শিকড় বা কা- ব্যতীত বৃক্ষ আর বৃক্ষ থাকবে না। কিন্তু যদি শিকড়ও থাকে আবার কা-ও থাকে কিন্তু ডালপালা না থাকে কিংবা কিছু ডালপালাকে কেটে ফেলা হয়, তাহলে বৃক্ষ বিদ্যমান (বেঁচে) থাকবে। যদিও তা হবে অপূর্ণাঙ্গ বৃক্ষ। তাহলে এসব ডালপালা হল বৃক্ষের জন্য শোভা ও সৌন্দর্য বর্ধনমূলক অংশ। যদি তা কেটে ফেলা হয়, তাহলে মূল বৃক্ষের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যাবে না।
অনুরূপভাবে একজন মানুষ, যার হাত-পা কাটা। তাকে মানুষই বলা হয় তবে পূর্ণাঙ্গ মানুষ নয়। কেননা হাত-পা শরীরের গঠনগত মূল অংশ নয়। কিন্তু যদি মানুষের দেল-মস্তিষ্ক না থাকে, তাহলে সে আর মানুষরূপে বিবেচিত হয় না। মুহাদ্দিসগণও একথাই বলেন যে, আমল ঈমানের অংশ তবে তা সাজ-গোছ ও বেশভূষামূলক অংশ। আমল না থাকলে যে একেবারে ঈমান চলে যাবে বিষয়টি এমন নয়। যদিও তাতে খুঁত ও ত্রুটি তৈরী হবে। [ফাতহুল মুলহিম-১/৪৪৪]
সারকথা, মুহাদ্দিসদের বক্তব্য মতে আমলের সঙ্গে ঈমানের সম্পর্ক বৃক্ষের ডালের সাথে বৃক্ষের সম্পর্কের মত।
আর ইমাম আবু হানীফার মতানুযায়ী আমলের সঙ্গে ঈমানের সম্পর্ক বৃক্ষের ডালের সাথে বৃক্ষের শিকড়ের সম্পর্কের মত। তা কীভাবে বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করে বলি। ডালপালার সম্পর্ক মূল বৃক্ষের সাথে যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে শেকড়ের সাথেও। তবে বৃক্ষ ও কাণ্ডের সাথে ডালপালার যে সম্পর্ক এটি তার জীবন্ত সত্তার অংশ হিসেবে। আর শেকড়ের সাথে ডালপালার যে সম্পর্ক এটি জীবন্ত সত্তা বা দেহত্বের গঠনগত অংশের সম্পর্ক নয়, বরং এটা প্রশাখাগত আনুষঙ্গিক সম্পর্ক।
তবে একটি বিষয় স্মরণ রাখতে হবে যে, সব শাখা ও প্রশাখা এবং আনুষঙ্গিক ও সম্পূরক বিষয় এক পর্যায়ের নয়। বরং এর মাঝে রয়েছে স্তরগত তারতম্য। বৃক্ষের ডাল, শাখা ও প্রশাখা, পাতা, ফুল ও ফল এসব বৃক্ষের শরীরতত্ত্বের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়। তবে বৃক্ষের সাথে এসবগুলোর সম্পৃক্ততা এক পর্যায়ের নয়।
অতএব ইমাম আবু হানীফার মতানুযায়ী আমলের সঙ্গে ঈমানের সম্পর্ক বৃক্ষের ডালের সাথে বৃক্ষের শিকড়ের সম্পর্কের মত একথার অর্থ হল আমল ঈমানের অংশ নয়। বরং এটি ঈমানের শাখা; এবং ঈমান থেকেই উদগত হয়। হাদীস শরীফেও এদিকে ইঙ্গিত রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, الإيمان بضع وسبعون شعبة [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৬২]।
যার মর্মার্থ হল, ঈমানের একটি শাখার দ্বারা অপর শাখার শক্তি সঞ্চয় হয় ও উন্নতি ঘটে। শিকড় যত মজবুত ও কা- যত মোটা হবে ডালও তত মোটা ও শক্তিশালী হবে। ডালপালা যেরূপ বড় রড় হবে শিকড়ও সেরূপ মজবুত হবে আর কা- হবে মোটা। অনুরূপভাবে এখানেও ঈমান যত মজবুত ও পোক্তা হবে আমলও তত উন্নতি লাভ করবে। আর আমল যত তারাক্কি লাভ করবে ঈমানও তত মজবুত ও পোক্তা হবে। মারেফাতের স্তর বৃদ্ধি ঘটবে। [ফজলুল বারী-১/২৫৭]
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, ইমাম আযমের দিকে মুরজিয়া মতবাদকে সম্পৃক্ত করা একেবারে অবাস্তব।
قال العلامة محمود حسن التونكي في معجم المصنفين (٢:١٩٦) فهذه الرسالة (رسالة أبي حنيفة الى عثمان البتي) أصرح دليل على أن الإمام لم يكن من المرجئة أصلا فإن معنى الإرجاء معروف مشهور في كتب الفرق بل كان على ما عليه الصحابة والتابعون جماهيرهم الذين فرض الله علينا تقليدهم في كتابه وسمى سنتهم سبيل المؤمنين
কেননা ইমাম আযমের সব শাগরিদ-ই বিশ্বাসে ও আচরণে চূড়ান্তভাবে মুরজিয়া চিন্তাধারা লালনকারীদের বিরোধী ছিলেন। যদি ইমাম আবু হানীফা মুরজিয়া হতেন, তাহলে তাঁর শাগরিদরাও এ চিন্তাধারায় গড়ে উঠতেন। (এবং এটা নিয়ে তখন গোটা ইসলামী বিশ্বে কথার তুফান ছুটত। এ মতবাদের সাথে ইমাম আযমের যে বিন্দুমাত্র যোগসূত্র নেই তার একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ হল) ইমাম আযমের মতে মুরজিয়া মতবাদ লালনকারী ব্যক্তির পিছনে নামাজ পড়াও জায়েজ নয়। [উকুদুল জওয়াহিরিল মুযিয়্যাহ, ভূমিকা অংশ-১৫]
অতএব তাঁর উপর মুরজিয়া অপবাদ ভিত্তিহীন। যারা মনে করে, মুত্তাকী মুমিন ও কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি বরাবর তারাই মূলত আসল মুরজিয়া।
আমলকে মূল ঈমানের অংশ সাব্যস্ত না করার কারণে মানুষ কি পাপ কাজের দিকে ধাবিত হচ্ছে?
কিছু কিছু মাহওয়াল ও ঘরানায় ধারণাগত একটা ভ্রান্তি অদ্যাবধি প্রবলভাবে বিরাজমান। তারা মনে করেন, আমলকে মূল ঈমানের অংশ সাব্যস্ত না করার কারণে মানুষ মাসিয়াতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তারা বিষয়টির গভীরতায় যেতে নারাজ। তাই আমরা আমল সম্পর্কে ইমাম আযমের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আরো কিছু কথা আরজ করছি।
ইমাম আবু হানীফা রহ. যে আমলের গুরুত্ব স্বীকার করতেন তা যেমন তাঁর অবাক করা ইবাদত-বন্দেগী ও আমল-আখলাক দ্বারা প্রমাণিত তেমনি তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমেও প্রমাণিত। তিনি আমলের অপরিসীম গুরুত্বের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন,
إن العمل تبع للعلم كما أن الأعضاء تبع للبصر والعلم مع العمل اليسير انفع من الجهل مع العمل الكثير ومثل ذلك الزاد القليل الذى لابد منه في المفازة مع الهداية بها انفع من الجهالة مع الزاد الكثير.
‘আমল হল ইলমের অনুগামী, যেমন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হল চোখের অনুগামী। ইলমসহ (পরিমাণে) অল্প আমলও অজ্ঞতা ও মূর্খতাসহ অধিক আমলের চেয়ে উপকারী। এর উদাহরণ হল বিজন প্রান্তরে পথ-ঘাট চিনে প্রয়োজনীয় স্বল্প পাথেয় থাকা পথ-ঘাট না চিনে অধিক পাথেয় থাকার চেয়ে উপকারী।’ [মুওয়াফফাক বিন আহমদ আলমক্কীকৃত মানাকিবুল ইমামিল আযম ১/৯৭, আল-আলেম ওয়াল মুতাআল্লিম পৃ. ৯]
এ বক্তব্যে ইমাম আযম রহ. প্রকারন্তরে আমল ও আখলাক যেন খাঁটি ও নির্ভেজাল হয় আমলের ভিতরে প্রাণ ও রূহ যোগ হয়, গতি সঞ্চয় হয়, আমল যেন ইলম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, ইলমের স্বভাব অনুযায়ী গড়ে ওঠে বা বলতে পারেন ইলমকে যেন জীবনে প্রয়োগ করা যায় সেদিকেই মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। আবার আমলের পাওয়ার হাউজ যে ইলম তাও সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন।
মানুষের দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চোখের অনুগামী। চোখ ভালো হলে তার পথ চলা ও অন্যান্য কাজকর্ম সুচারূরূপে সম্পাদিত হয়। আর চোখে সমস্যা থাকলে অন্যান্য কাজকর্মও ব্যাহত হয়। প্রকৃত ইলম কেন দরকার বিজন প্রান্তরে সফরের সাথে তার সুন্দর একটি উপমা ও প্রতিতুলনা দিয়েও বুঝিয়েছেন। সারকথা, তাঁর দৃষ্টিতে তআত ও আমল আবশ্যক। এতে শিথিলতা জায়েজ নয়।
সারকথা, ঈমানের সাথে আমলের সম্পর্কের বিষয়ে ইমাম আযম রহ. অবলম্বিত মতের কারণে মানুষ পাপাচার ও অবাধ্যতার দিকে ধাবিত হচ্ছে এজাতীয় কথা প্রচার করা ইমাম আযমের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপের শামিল। আল্লাহ তাআলা সকলকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন। ইমামদের বক্তব্য ভাসাভাসাভাবে না বুঝে সঠিকভাবে বুঝার তাওফীক দান করুন।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের পরিপন্থী কোন ধরণের আকীদা ও চিন্তাধারার সাথে ইমাম আযমের বিন্দুমাত্র যোগসূত্র নেই: উদাহরণ হিসেবে এবং কিছু মানুষের অপপ্রচারের কারণে কেবল ইমাম আযমের উপর আরোপিত মুরজিয়া অপবাদের হাকীকত ও বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা করা হল। অন্যথায় আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের পরিপন্থী যে কোন ধরণের আকীদা ও চিন্তাধারার সাথে ইমাম আযমের বিন্দুমাত্র যোগসূত্র নেই। এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য এবং সূর্যের চাইতে প্রোজ্জ্বল বিষয়। তাঁর লিখিত আকীদা বিষয়ক গ্রন্থাবলী এর সুস্পষ্ট প্রমাণ।
ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ও ইমাম বুখারী রহ. : একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা
এখানে লুকোছাপার কোন ব্যাপার নেই। ইতিহাস সচেতন ও ধীমান পাঠক হয়তো লেখককে দায়ী করতে পারেন যে, এ গ্রন্থে ইমাম বুখারী রহ.-এর জীবনের সূচনাভাগ সম্পর্কে আলোচনা করা হলেও তাঁর জীবনের আরেকটি দিককে গোপন করা হয়েছে। ইমাম আযমের ব্যাপারে ইমাম বুখারী রহ.-এর পরবর্তী মনোভাবকে আলোচনায় আনা হয়নি। আত-তারীখুল কাবীর কিতাবে ইমাম আযমের ব্যাপারে ইমাম বুখারীর মন্তব্যের কোন পরিচ্ছন্ন জবাব দেওয়া হয়নি।
কিন্তু আসলে বিষয়টি এরূপ নয়। আমরা দ্বিতীয় নম্বর মূলনীতিতে ইমাম বুখারী রহ. বা অন্য কোন ইমামের নাম উল্লেখ না করে বরং ইমাম আযমের উপর সব জরাহ সংক্রান্ত মৌলিক জবাব ও জোরালো বক্তব্য প্রদান করে এসেছি। বুঝমান ও বোদ্ধাদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। তারপরও এ বিষয়ে আমরা আরো কিছু আলোচনা ও তথ্য পেশ করছি। সামনের আলোচনা শুরু করার পূর্বে আমরা ভূমিকামূলক কিছু কথা জেনে নিই।
এটি একটি বাস্তবতা যে, অনেক মাসআলায় ইমাম বুখারী ইমাম শাফেয়ীর মুখালাফাত করেছেন এবং হানাফীদের তায়ীদ ও সমর্থন করেছেন। তিনি যেমন আহনাফদের সাথে ইখতেলাফ করেছেন অনুরূপভাবে শাফেয়ীদের সাথেও করেছেন। [ফজলুল বারী-১/৬৪]
তবে ইমাম বুখারী রহ. শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী বলে যে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে তার কারণ হল, প্রসিদ্ধ মাসআলায় ইমাম বুখারী ইমাম শাফেয়ীর সাথে মুওয়াফাকাত বা সহমত ব্যক্ত করা। অন্যথায় যেসব মাসআলায় তিনি ইমাম আযমের সাথে একমত হয়েছেন তার সংখ্যা ইমাম শাফেয়ীর সাথে তাঁর ঐকমত্যপূর্ণ মাসআলার চেয়ে কম নয়। [বদরে আলম মিরাঠী রহ: এর প্রাককথন, ফয়জুল বারী-৫৮]
আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. ফয়জুল বারীতে যে সকল মাসআলায় ও আকীদায় ইমাম বুখারী রহ. ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর সাথে সহমত ব্যক্ত করেছেন তার সুদীর্ঘ ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। [ফয়জুল বারী-৪/৪৫-৪৬, বরাতে কাশফুল ইলতিবাস আম্মা আওরাদুরাহুল ইমাম বুখারী আলা বা’জিন নাস-১০]
বাদবাকী অন্যান্য যে সকল মাসআলায় ইমাম বুখারী রহ. ইমাম আযমের সাথে ইখতেলাফ করেছেন তা যদি আমরা একজন মুজতাহিদ হিসেবে অপর আরেক মুজতাহিদের সাথে ইখতেলাফ কিংবা কোন মাযহাবের অনুসারী হিসেবে সেই অনুসৃত ইমামের সাথে ইমাম আযমের ইখতেলাফের পর্যায়ে গণ্য করি তখন বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার মনে হবে।
ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর ব্যাপারে কি মুহাদ্দিসগণ মৌন ও নীরব থেকেছেন বা তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন?
ইমাম বুখারীর বক্তব্য
ইমাম বুখারী রহ. তাঁর আত-তারীখুল কাবীরে ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর জীবনীতে লিখেছেন—
روى عنه عباد بن العوام وابن المبارك وهشيم ووكيع ومسلم بن خالد وأبو معاوية والمقري كان مرجئا سكتوا عنه وعن رأيه وعن حديثه،
[তারীখুল কাবীর-৮/৮১, জীবনী নং-২২৫৩]ইমাম বুখারীর আপত্তি ও বক্তব্যের পরিচ্ছন্ন জবাব
বুখারী রহ. এখানে ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর ব্যাপারে তিনটি জরাহ! বা আপত্তি করেছেন।
এক. ‘ইমাম আবু হানীফা রহ.-মুরজিয়া ছিলেন।’
আমরা এ আপত্তির শানদার ইলমী জবাব কেবলই প্রদান করে এসেছি, যা এখানে আর পুনরুদ্ধৃত করার প্রয়োজন নেই।
দুই. ‘তাঁর ব্যাপারে ও তাঁর রায়ের ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ নীরবতা অবলম্বন করেছেন।’ এ মন্তব্যের জবাবে শুধু এতটুকু বলতে চাই যে, (ইমাম বুখারী রহ. তাঁর আত-তারীখুল কাবীর কিতাব আঠার বছর বয়সে লিখেছেন। তাঁর জন্ম ১৯৪ হিজরী।
অতএব ১৯৪+১৮=২১২ হিজরীতে এ কিতাব রচিত হয়।) এরও পঞ্চাশ বছর আগে ফিকহে হানাফী দুনিয়াতে মামূলবিহী ও সমাদৃত ছিল। রাষ্ট্রীয়ভাবেও এর গ্রহণযোগ্যতা ছিল তুঙ্গে। অতএব তাঁর রায় বা ফিকহের বিষয়ে মানুষ নীরব ছিল না সরব ছিল তা ইতিহাসই সাক্ষ্য দিবে।
তিন. তৃতীয় যে জরাহ! (কড়া সমালোচনামূলক শব্দ) তিনি করেছেন তা হল—‘মুহাদ্দিসগণ তাঁর হাদীসের ব্যাপারে নীরব বা চুপ থেকেছেন।’
এ বাক্য দ্বারা তিনি কোন রাবী মাযরূহ ও মাতরুক (পরিত্যাগযোগ্য) হওয়ার দিকেই ইঙ্গিত করে থাকেন, যেমনটি হাফেজ যাহাবী রহ. তাঁর আলমুকিযা গ্রন্থে বলেছেন। এখন আমরা মুহাদ্দিসগণ ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর ব্যাপারে সরব ছিলেন না কী নীরব ছিলেন সে সম্পর্কে আলোচনা করব। তার আগে আমাদের সামনের আলোচনা বুঝার সুবিধার্তে জেনে নেই শরয়ী জরাহ বলতে কী বুঝায়?
শরয়ী জরাহ এর সংজ্ঞা
জরাহ-এর উসূল বা নীতিমালার প্রতি লক্ষ্য করে জরাহ-তাদীলের দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে সুচিন্তিত যে মতামত ব্যক্ত করা হয় তাকে শরয়ী জরাহ বলা হয়। ইমাম বুখারী রহ. বা অন্য কোন ইমামের যবানে যা-ই বের হবে তা-ই জরাহ নয়। যেমন বিচারপতির সব কথা (বিশেষ করে যা তিনি উত্তেজনার বশে বলে থাকেন) কাযা বা বিচার নয়। বরং বিচারকের সুমহান মসনদে বসে তিনি যে সুচিন্তিত মতামত পেশ করেন সেটিই মূলত কাযা।
আত-তারীখুল কাবীর-এর মাঝে ইমাম বুখারীর জরাহটা যে সুচিন্তিত নয় এবং তা শরয়ী জরাহের আওতাভুক্ত নয় তা আমরা ইমাম বুখারীর আত-তারীখুল কাবীরের ঠিক উক্ত জায়গা ও বক্তব্য থেকে এবং তাঁর নিজের উল্লেখকৃত মূলনীতি থেকেই বুঝা ও বুঝানোর চেষ্টা করব।
আমাদের প্রথম প্রশ্ন হল, মুহাদ্দিসগণ ইমাম আবু হানীফাকে পরিত্যাগ করে থাকলে বুখারী রহ. তাঁর থেকে বর্ণনাকারী হিসেবে সাতজন শাগরিদের নাম উল্লেখ করলেন কিভাবে? যদি তিনি ইমাম আবু হানীফাকে পরিত্যাগকারী বা নীরবতা অবলম্বনকারী মুহাদ্দিসদের কোন একজনের নামও উল্লেখ করতেন, তাহলে বিষয়টি জরাহ-তাদীলের মূলনীতির আলোকে যাচাই করা যেত।
এবার বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। ইমাম আবু হানীফা রহ. থেকে হাদীসবর্ণনাকারী হিসেবে তিনি—আব্বাদ ইবনুল আওয়াম, ইবনুল মুবারক, হুশাইম, ওয়াকী, মুসলিম বিন খালেদ, আবু মুআবিয়া ও আলমুকরী—এই সাতজনের নাম তিনি উল্লেখ করেছেন।
প্রিয় পাঠক! আমরা লক্ষ করলাম সাতজন বর্ণনাকারীর তালিকায় ইবনুল মুবারক রহ.-এর নামও শোভা পাচ্ছে। এই আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. সম্পর্কে ইমাম বুখারী রহ. তাঁর রফউল ইয়াদাইন নামক পুস্তিকায় বলেন,
وهو أكثر أهل زمانه علما فيما نعرف فلو لم يكن عند من لا يعلم من السلف علم فاقتدى بابن المبارك فيما اتبع الرسول، وأصحابه، والتابعين لكان أولى به من أن يثبته بقول من لا يعلم،
আমাদের জানা মতে ইবনে মুবারক রহ. তাঁর যামানার সবচেয়ে বড় আলেম ছিলেন। আর লোকেরা যদি অন্যান্য স্বল্প ইলমের অধিকারী ব্যক্তিদের অনুসরণের পরিবর্তে তাঁকে অনুসরণ করত—ঐ বিষয়ে যে বিষয়ে তিনি আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবী এবং তাবেয়ীদের অনুসরণ করেছেন— তাহলে ভালো হত। [রফউল ইয়াদাইন, হাদীস নং-৪০, আনওয়ারুল বারী-১/৮০]
আমরাও বলি যদি বুখারী রহ. ইমাম আযমের ব্যাপারে মন্তব্যের ক্ষেত্রে অন্যান্য ব্যক্তিদের ….অনুসরণের পরিবর্তে ইবনে মুবারক রহ. এর অনুসরণ করতেন, তাহলে কতই না ভাল হত।
ইবনুল মুবারক রহ. তো হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ইমাম আযমকে আফকাহুন নাস (সর্বশ্রেষ্ঠ ফকীহ) বলে উল্লেখ করেছেন। [তাহযীবুত তাহযীব, ইমাম আবূ হানীফা রহঃ এর জীবনী]
ইমাম আযমের আছার—হাদীস বর্ণনায় উচ্চশিখরে পৌঁছানোকে তিনি অনেক উঁচুতে বিচরণকারী তীক্ষè দৃষ্টিসম্পন্ন শিকারী পাখির সাথে তুলনা করে অপূর্ব কাব্যিক ভাষায় তা প্রকাশ করেছেন। [মুহাদ্দিস খুওয়ারায্মীকৃত জামিউল মাসানীদ ২/৩০৮ দায়িরাতুল মাআরিফ-এর প্রকাশনা ১৩৩৩ হি.; ইমাম আযম সম্পর্কে ইবনুল মুবারক রহ.-এর অভিমত জানার জন্য দেখুন আল-ইন্তেকা, শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহ্ আবু গুদ্দাহ্ রহ.কৃত টীকাসহ, পৃ. ২০৪-২০৭]
যদি এ ক্ষেত্রে ইমাম বুখারী রহ. তাঁর পিতা ঈসমাইল-এর উস্তায ইবনুল মুবারক রহ.-এর অনুসরণ করতেন, কতইনা ভাল হত। (আর তাঁর শর্ত মোতাবেক ইবনুল মুবারক রহ. এক্ষেত্রে নবীজীকেই অনুসরণ করেছেন। কারণ মানুষকে তো যথাযোগ্য মর্যাদায় আসীন করা ও মূল্যায়ন সঠিকভাবে করা নবীর নির্দেশ, সাহাবী ও তাবেয়ীদের কর্মপন্থা।)
আরো কতইনা সুন্দর হত যদি তিনি হাদীসশাস্ত্রে তাঁর আরেক বর্ষীয়ান উস্তায শাইখুল ইসলাম হাফেজ আবু আব্দুর রহমান আলমুকরীর পথে চলতে পারতেন। বুখারী রহ. ইমাম আবু হানীফা থেকে বর্ণনাকারীর তালিকায় আবু আব্দুর রহমান আলমুকরী-এর নামও উল্লেখ করেছেন। যিনি হাদীসশাস্ত্রে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ইবনে রাহুয়া এবং ইমাম বুখারীরও উস্তায। যখন আবু আব্দুর রহমান আলমুকরী রহ. ইমাম আবু হানীফা থেকে কোন হাদীস রিওয়ায়েত করতেন তখন اخبرنا شاهنشاه শব্দে রিওয়ায়েত করতেন। [মুহাদ্দিস খতীব বাগদাদী রহঃ, তারীখে বাগদাদে সনদসহ বর্ণনা করেছেন]
অর্থাৎ ইলমে হাদীসের সম্রাট আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর সম্পর্কে আল্লামা কারদারী লিখেছেন, سمع من الإمام تسعمائة حديث. তিনি ইমাম আবু হানীফা থেকে নয়শত হাদীস শুনেছেন। [কারদারী, মানাকিবে ইমাম আযম-২/২৩১]
ইমাম বুখারী রহ. ইমাম আবু হানীফা রহ. থেকে বর্ণনাকরীদের নামের তালিকায় ওয়াকী ইবনুল জাররাহ্ রহ.-এর নাম উল্লেখ করেছেন। এই ওয়াকী ইবনুল জাররাহ্ (ওফাত : ১৯৭ হি.) হলেন আহমদ বিন মানী (ওফাত : ২৪৪ হি.) ও আলী ইবনুল মাদীনী (ওফাত : ২৩৪ হি.) এর মধ্যস্থতায় ইমাম বুখারী (ওফাত : ২৫৬ হি.)-এর দাদা উস্তায। এই ওয়াকী ইবনুল জাররাহ্ রহ. ইমাম আবু হানীফার মতামত অনুযায়ী ফতওয়া প্রদান করতেন। [আল ইন্তেকা-২১১]
যদি আমরা মেনে নিই যে, ইমাম বুখারী রহ. মুজতাহিদ ছিলেন। অতএব সে হিসেবে তিনি ইমাম আবু হানীফার মাযহাবের অনুসরণ না-ও করতে পারেন। এটি তাঁর ব্যাপার। কিন্তু ইমাম বুখারীর দাদা উস্তায ওয়াকী ইবনুল জাররাহ্ রহ.-এর মত যদি তিনি ইমাম আযমের প্রতি প্রসন্ন হৃদয়ের-অধিকারী হতেন, কতই না ভাল হত।
ইমাম বুখারীর দাবি কি বাস্তব ও ইতিহাসসম্মত?
মন ফুঁড়েই একটা প্রশ্ন জাগে— ইমাম আবু হানীফা রহ.-কে যদি সব মুহাদ্দিসগণ পরিত্যাগ করে থাকবেন, তাহলে মুহাদ্দিসদের এক বিশাল জামাত তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করলেন কীভাবে? আর মুহাদ্দিসদের এক বিপুল অংশ হানাফী মাযহাবের অনুসারী হলেন কীভাবে? আল্লামা যফর আহমদ উসমানী রহ. তো আবু হানীফা ও আসহাবুহুল মুহাদ্দিসুন কিতাবে হাদীসশাস্ত্রের পৃথিবী আলোকরা নক্ষত্রের ঝাঁক থেকে নমুনা স্বরূপ ইমাম আবু হানীফার ৩৩ জন শীর্ষ পর্যায়ের মুহাদ্দিস শাগরিদের জীবনী এনেছেন। এরপর আরবী বর্ণানুক্রমিক অনুযায়ী ২২৯ জন হানাফী মুহাদ্দিসের জীবনী এনেছেন। কিতাবটির পৃষ্ঠা সংখ্যা দুশ’ বারো। এটা জানা কথা যে, শীর্ষ পর্যায়ের মুহাদ্দিসগণ এমন ব্যক্তিকেই অনুসরণ করবেন বা মুক্তাদা বানাবেন হাদীস জগতে যার মাকাম সূর্যালোকে ঝলমলানো গিরিরাজ হিমালয়ের মত সুউচ্চ।
উপরে আলোচিত ইমাম ওয়াকী, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক ছাড়াও ইমাম শাফেয়ী, ইবনে মায়ীন, ইবনুল কাত্তান প্রমুখ ইমামগণ হলেন ইমাম বুখারীর দাদা উস্তায।
তাঁরা সকলেই ছিলেন ফিকহে হানাফীর গুণমুগ্ধ ও কদরদান এবং ইমাম আযমের প্রতি শ্রদ্ধাবনত। যা আমরা আগেও উল্লেখ করেছি।
ইমাম বুখারীর বর্ণনাকৃত মানদণ্ডে ইমাম বুখারী
১। ইমাম বুখারী রহ. তাঁর জুযউল কিরাত খলফাল ইমাম কিতাবে ইবনে ইসহাকের উপর আরোপিত জরাহকে মা’লুল সাব্যস্ত করে জরাহ-তাদীল সংক্রান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতির উল্লেখ করেছেন। যে মূলনীতি ইমাম আযমের ক্ষেত্রে ফিট করলে আবু হানীফা রহ. সম্পর্কে তাঁর আরোপিত জরাহ মা’লুল (ত্রুটিযুক্ত ও অপ্রমাণিত) সাব্যস্ত হয়। তিনি ইবনে ইসহাকের ব্যাপারে বলেন,
“ولم ينجُ كثيرٌ من الناس من كلام بعض الناس فيهم، وذلك نحوُ ما يُذكرُ عن إبراهيم من كلامه في (الشعبي)، وكلامِ (الشعبي) في (عكرمة) ، وكذلك من كان قبلهم، وتناوُلِ بعضهم في العِرْض والنَّفْس، ولم يلتفت أهل العلم إلى ذلك، ولا سقطت عدالة أحد إلا ببرهان ثابت وحجة ، والكلام في هذا كثير.
কিছু মানুষের জরাহ থেকে অনেক মানুষই (রাবী বা ইমাম) রেহাই পাননি। … এবং মান-সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে কিছু মানুষের আপত্তি করা থেকেও ( সেইসব রাবী বা ইমামগণও) মুক্তি পাননি। আহলে ইলমগণ এ সব বিষয়ে (প্রমাণিত দলীল-প্রমাণ ব্যতীত) ভ্রুক্ষেপ করে নি। প্রমাণিত দলীল-প্রমাণ ও হুজ্জাত ছাড়া এরূপ ব্যক্তির আদালত রহিত হয়নি বা কারো বিশ্বস্ততায় প্রভাব ফেলেনি। [বাক্যটির মূল পাঠের মাঝে ভিন্নতা থাকায় এটির তরজমাতেও ভিন্নতা হবে। তবে মূল কথা ও বক্তব্য একই। জুযউল কিরাত খালফাল ইমাম-১৪, বর্ণনা নং-৯৮]
২। খতীব বাগদাদী রহ. তাঁর আলকিফায়া গ্রন্থে (পৃ. ১০৮, ১০৯) হাফিজুল হাদীস ও আয়িম্মায়ে নুক্কাদ বা হাদীসপরখকারী ইমামদের এ মাযহাব উল্লেখ করেছেন যে,
জরাহ করলে যদি তার লাগসই ব্যাখ্যা না দেওয়া হয় বা সবব ও কারণ বর্ণনা না করা হয়, সে জরাহ প্রমাণিত বলে বিবেচ্য হবে না। [আর রফউ ওয়াত তাকমীল-৮০]
এ মত পোষণকারীদের নামের তালিকায় তিনি সর্বাগ্রে ইমাম বুখারী রহ.-এর নাম উল্লেখ করেছেন।
قلت وهذا القول هو الصواب عندنا واليه ذهب الأئمة من حفاظ الحديث ونقاده مثل محمد بن إسماعيل البخاري ومسلم بن الحجاج النيسابوري وغيرهما (الكفاية في علم الرواية– باب القول في الجرح هل يحتاج الى كشف أم لا)
ইমাম বুখারীর এ মূলনীতি অনুযায়ী ইমাম আযমের ব্যাপারে তাঁর জরাহ গ্রহণযোগ্য হবে কীভাবে?
শুধু ইমাম বুখারীর জরাহ-ই ঢালাও, অস্পষ্ট ও অব্যাখ্যাত এমন নয় বরং অন্যদের ক্ষেত্রেও একই কথা। ড. মুহাম্মাদ কাসেম আবদুহু আল-হারেসী তাঁর মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা বাইনাল মুহাদ্দিসীন গ্রন্থে ইমাম আযমের উপর আরোপিত সব জরাহের খণ্ডন শেষে এ জাতীয় মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন,
فإننا إذا نظرنا إلى كلام من جرحوه وجدناه كلاما عاما مجملا غير مفسر كما أنه نابع من التعصب أو تنافس الأقران، بينما نجد الأئمة الكبار وثقوه وأثنوا عليه، بل يكفى ثناء المخالفين له كابن عبد البر وابن السبكى والسيوطى وغيرهم من الأئمة المنصفين وكفى بذلك ردا على هؤلاء.
‘ইমাম আযমকে যারা জরাহ্ করেছেন তাদের বক্তব্যের দিকে যদি আমরা লক্ষ করি, তাহলে দেখব যে, তাদের এসব বক্তব্য ঢালাও অস্পষ্ট কথা, ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ জরাহ নয়। যেমন এসব জরাহ্ পক্ষপাতদুষ্টতা অথবা সমসাময়িকদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দোষে দুষ্ট। অথচ আমরা শীর্ষ পর্যায়ের ইমামদেরকে পাই যে, তারা তাঁকে ছিকা সাব্যস্ত করেছেন এবং তার প্রশংসা করেছেন। ভিন্ন মাযহাবের ইমাম যেমন : ইবনে আব্দুল বার, ইবনুস সুবকী ও সুয়ূতী রহ. প্রমুখ মুনসিফ ইমামদের প্রশংসাই তাঁর জন্য যথেষ্ট। শীর্ষ ইমামদের এসব প্রশংসাবাণী এদের খণ্ডনের জন্য যথেষ্ট।’ [মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা বাইনাল মুহাদ্দিসীন-২৫৬]
একটি বিষয় আমাদের মনে রাখা দরকার যে, জারেহ ইমামদের জরাহ তাকলীদের ভিত্তিতে ঐসব রাবীদের ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হবে যাদের ব্যাপারে জারেহ ইমামদের কথা গ্রহণ করা ছাড়া বাস্তব অবস্থা যাচাই করা সম্ভব নয়। অথচ আমাদের আলোচিত ক্ষেত্রটি সম্পূর্ণ এর ব্যতিক্রম। এখানে বাস্তব অবস্থা যাচাই করার জন্য অনেক পন্থা ও পদ্ধতি আমাদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে।
আসলে ইমাম বুখারী রহ. এর জ্ঞান-সাধনা যেমন বিচিত্র ও সংখ্যাবহুল, কর্ম-সাধনা ও বৈশিষ্ট্য তেমন বিশাল ও বহুমুখী তা আমরা স্বীকার করি। কিন্তু একটি প্রবাদ আছে যে, খুবই দক্ষ ও ক্ষিপ্রগামী অশ্বপদও অনেক সময় স্থলিত হয়। আবার দক্ষ তিরান্দাযের তীরও অনেক সময় লক্ষ্যচ্যুত হয়। তাঁর উল্লিখিত মূলনীতিকে সামনে রেখে আমরা মনে করি, খায়রূল কুরুনের ইমাম আযমের বেলায় আপত্তি করতে যেয়ে ইমাম বুখারীর ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটেছে।
আরো কিছু স্বীকৃত মূলনীতির আলোকে ইমাম বুখারীর দাবির খণ্ডন
মূলনীতি ০১:
অবাস্তব কথা একজনের কলমে আসলেই এর দ্বারা কোন ইমাম মাযরূহ ও অগ্রহণযোগ্য হয়ে যান না। বরং কেউ মাযরূহ হওয়ার জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি। তন্মধ্যে একটি মূলনীতি হল—কারো ব্যাপারে মুতাকাদ্দিমীন বা পূর্বজদের স্তুতি-প্রশংসা পাওয়া গেলে সেক্ষেত্রে পরবর্তী যুগের কারো জরাহ্ গ্রহণযোগ্য হয় না। আর ইমামগণ কাউকে তা‘দীল করলে তার ব্যাপারে অন্য কারো জরহে গয়রে মুফাস্সার (এমন জরাহ, যা কারণ বা ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ নয়) গ্রহণযোগ্য নয়। [কাওয়ায়েদ ফী উলূমিল হাদীস-৩৯৯]
মূলনীতি ০২:
কেউ জরাহ করে দিলেই তা নীতি-প্রমাণ ছাড়াই যদি গ্রহণ করা হয়, তাহলে ইমাম বুখারী রহ.-কেও এর আওতা থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়। কারণ ইমাম আবু হাতেম ও আবু যুরআ রাজী রহ.-এর মত শীর্ষ পর্যায়ের জরাহ-তাদীল শাস্ত্রের ইমামও বুখারী রহ.-কে ‘খলকুল করআন’ নিয়ে সৃষ্ট ইখতেলাফের কারণে পরিত্যাগ করেছেন। ফলে ইমাম যাহাবী রহ. তাঁর কিতাবুয যুআফা ওয়াল মাতরুকীন গ্রন্থে ইমাম বুখারীর নাম নিয়ে এসেছেন। [মাসআলাতু খালকিল কুরআন-১৩]
অতএব ইমাম বুখারীর মূলনীতির আলোকেই ইমাম আবু হানীফার ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য গ্রহনযোগ্য নয়। এতসব আলোচনার পরও কিছু মানুষের মনে এখনো খটকা থেকে যেতে পারে যে, ইমাম আযমের ব্যাপারে ইমাম বুখারী রহ. পরবর্তীকালে ইনহিরাফের শিকার হয়েছিলেন কেন? এক্ষেত্রে তাঁর ওজরই বা কি ছিল?
আসলে এখানে একগুচ্ছ ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে। ব্যাপারটি হল— ইমাম বুখারী রহ. ইমাম আযমের ব্যাপারে তথ্যবিভ্রাটের শিকার হয়েছেন। আর এর পিছনে কাজ করেছে আমাদের পূর্ব আলোচিত খালকুল কুরআন মাসআলার প্রভাব। ইমাম বুখারীর শফীক (অপত্যস্নেহশীল) উস্তায ইমাম আবু হাফস কাবীর রহ.-এর বিশাল অর্থায়নে ইমাম বুখারীর ইলমী সফর শুরু হলেও এ সফরে যাদের সঙ্গ ও সান্নিধ্য তিনি লাভ করেছেন তারা হলেন, তাঁর উস্তায হুমায়দী, নুআইম বিন হাম্মাদ, [তিনি ছিলেন আবু হানীফা রহ.-এর নামে মিথ্যা কথা ও ঘটনা নির্মাণকারী। এই নুআইম বিন হাম্মাদ হাফিজুল হাদীস হলেও এবং কেউ কেউ তাকে ছিকা বললেও আবু হানীফার বিষয়ে মিথ্যা ঘটনা বানানোর ব্যাপারে আযদীর উদ্ধৃতিকে হাফেজ যাহাবী রহ. কোন রকম আপত্তি ছাড়াই উল্লেখ করেছেন। (তাহযীবুত তাহযীব ১০/৪৬২)
তবে নুআইম বিন হাম্মাদের হাদীস বুখারী শরীফে বর্ণিত হওয়াই আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. তার উপর আরোপিত জরাহের একটি সমন্বয়ক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। (দেখুন, ফয়জুল বারী ৪/১৪৫)] ইসমাইল বিন আরআরা [জনৈক মাজহূল তথা অপরিচিত রাবী] প্রমুখ। এসব লোক ছিলেন খালকুল কুরআন-এর ফিতনা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত।
আর আমরা ইতঃপূর্বে আলোচনা করেছি যে, খালকুল কুরআনের মাসআলাকে কেন্দ্র করে মুতাযিলা চিন্তাধারা লালনকারী কাজীরা মুহাদ্দিসদের উপর যে জুলুম-নির্যাতন চালায় তা ইমাম আযম ও হানাফী মাযহাবের প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরীর পথকে সুগম করে। ফলে প্রাসঙ্গিক এ কারণে সেইসব মুহাদ্দিসদের অন্তরে হানাফীদের বিপক্ষে আসাবিয়্যাত বা কট্টরপন্থা ও পক্ষপাতপ্রবণতা সৃষ্টি হয়।
আমরা যাদের নাম উল্লেখ করলাম এ ধারাবাহিকতায় তারাও ছিলেন ইমাম আযমের ব্যাপারে অত্যন্ত মুতাআসসিব (কট্টরপন্থী ও পক্ষপাতপ্রবণ) এর শিকার। [দেখুন গুনজারকৃত তারীখে বুখারা, বরাতে জুযউল কিরাত খালফাল ইমাম এর উর্দু তরজমার শুরুতে আমীন সফদর উকাড়বী রহঃ লিখিত ইমাম বুখারী রহঃ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী-১১]
আর ইমাম আযম সম্পর্কে এরূপ ব্যক্তিদের দেয়া তথ্যের উপর নির্ভর করে কোন মন্তব্য প্রদান করলে কি অবস্থা হতে পারে তা পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন।
তাছাড়া বিভিন্ন মাসআলার ক্ষেত্রে ইমাম আযমের বক্তব্য তাঁর কাছে সঠিকভাবে না পৌঁছা বা সঠিকভাবে পৌঁছালেও বক্তব্যের মর্ম অনুধাবনে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়াটাও বিরূপ মন্তব্যের কারণ হতে পারে। আর ঈমানের সাথে আমলের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নতীজা ও ফলাফলের বিবেচনায় তা বড় ধরনের কোন ইখতেলাফ না হলেও বিষয়টি নিয়ে ইমাম আযমের সাথে ইমাম বুখারীর এ বিষয়কার ইখতেলাফ দু’টি ভিন্ন চিন্তাধারার রূপ পরিগ্রহ করে। ফলে এ মাসআলায় ইমাম বুখারীর কড়া উপস্থাপনা ও চিন্তাধারাও ইমাম আযমের প্রতি তাঁর বিরূপ মন্তব্যের পথকে সুগম করেছে বলে কোন কোন গবেষক মনে করেন। [দেখুন ওয়াহবী সুলায়মান গাবূজীকৃত আবূ হানীফা আননুমান-১৭৪-১৭৮]
কারণ ছিকা রাবী থেকে যেমন হাদীস বর্ণনায় কখনো ভুল হতে পারে তেমনি জারহ-তাদীলশাস্ত্রের ইমাম থেকে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা আরো বেশি। কেননা এটা ফন্নী ও শাস্ত্রীয় ইজতিহাদ। আর এতে যওক, মিজায ও মাশরাব ইত্যাদি বিষয়ের অনেক প্রভাব থাকে। এতএব মাযহাব ও মাকতাবায়ে ফিকিরের ভিন্নতার কারণেই যদি ইমাম আবু হানীফা রহ. সম্পর্কে ইমাম বুখারী রহ. এরূপ মন্তব্য করে থাকেন, তাহলে এ বিষয়ে এটি স্বীকৃত মূলনীতি—যা আমরা আলোচনা করে এসেছি—যে, দৃষ্টিভঙ্গিগত ও মাযহাবগত কারণে কারো প্রতি জরাহ করলে তা বিবেচ্য ও গ্রহণীয় নয়। এবং এর দ্বারা সে ব্যক্তি মাজরূহও প্রমাণিত হয় না।
আমরা দু’টি সারগর্ভ বক্তব্য পেশ করে ইমাম বুখারী রহ.-এর এ প্রসঙ্গের আলোচনা শেষ করছি।
১। ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. বলেন,
وكلام الأئمة بعضهم في بعض يجب أن لا يلتفت إليه، ولا يعرج عليه، فيمن صحت إمامته وعظمت في العلم غايته.
‘ইমামদের পরস্পর বিরূপ মন্তব্যের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করাই কর্তব্য। বিশেষত এমন ব্যক্তির বেলায়, যাঁর ইমাম হওয়াটা সুপ্রমাণিত এবং ইলমের শীর্ষ চূড়ায় যাঁর অবস্থান।’ [আল-জাওয়াহিরুল মুজিয়্যাহ-১/৫৮]
২। আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী রহ. উদ্ধৃত করেছেন,
والحاصل أنا لا نسيء الظن بالطاعنين في الإمام الهمام أبي حنيفة إذا كانوا أئمة ثقاتا، فإن الظاهر من أحوالهم أنهم تكلموا بحسن نية وإخلاص فيما زعموه صوابا، إلا أنهم قصروا في تحقيق ما نسب إلى أبي حنيفة، وأخطؤوا في فهمه، وعجزوا عن الوصول إلى عمقه، فأنكروا عليه من غير تثبت وتبين، وأما المتثبتون منهم فقد بان لهم الأمر، ووضح لديهم الحال، فصاحوا بأرفع صوت بما هو الحق ولله الحمد.
‘মোটকথা, আমরা ইমাম আযমের প্রতি বিরূপ-মন্তব্যকারী শীর্ষ ইমামদের প্রতি খারাপ ধারণা রাখি না। কেননা তাদের অবস্থা থেকে এটাই সুস্পষ্ট যে, তাঁরা তাঁদের ধারণায় সঠিক মনে করেই নেক নিয়্যতে ও ইখলাসের সাথে মন্তব্য করেছেন। তবে তাঁরা ইমাম আবু হানীফার উপর আরোপিত বিষয় তাহকীকের ক্ষেত্রে ত্রুটি করেছেন ও ভুল বুঝেছেন এবং গভীরতায় পৌঁছতে অক্ষম হয়েছেন। ফলে প্রমাণ ও যাচাই-পরখ ছাড়াই তাঁরা তাঁর উপর আপত্তি করেছেন। পক্ষান্তরে তাঁর পক্ষাবলম্বনকারীদের কাছে বাস্তব অবস্থা ও বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে। ফলে তাঁরা উচ্চকিত কণ্ঠে সঠিক বিষয়টিই প্রকাশ করেছেন। সকল প্রশংসা আল্লাহরই জন্য।’ [মাবাদিয়ু ইলমুল হাদীস ওয়া উসূলুহু-৪৮৪]
ব্যক্তি আবু হানীফার নিন্দুক থেকে ইমাম আবু হানীফার প্রেমিক!
কিছু মহান ব্যক্তিবর্গ এমন ছিলেন, যারা ভ্রান্ত তথ্যের শিকার হয়ে ভুল বুঝাবুঝির কারণে ইমাম আযমের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন ছিলেন। বাস্তব অবস্থা জানার পর তাঁরা ইমাম আযম সম্পর্কে পূর্ব লালিত ধারণার জন্য আফসোস করেছেন এবং অনুতপ্ত হয়েছেন। একটি উদাহরণ দিই—‘আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীস আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক বলেন, একদিন আমি শামে (সিরিয়াতে) হযরত আওযায়ীর নিকট এলাম। বায়রুতে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। তিনি আমাকে দেখামাত্র জিজ্ঞাসা করলেন, এই খুরাসানী! আবু হানীফা নামে কুফায় আবির্ভূত এই বিদআতী লোকটি কে? আমি (তখনকার মত কোন জবাব না দিয়ে) ঘরে ফিরে এসে ইমাম সাহেবের কিতাবগুলো ঘেটে সেরা কিছু মাসআলা চয়ন করতে লাগলাম। তিনদিন পর কিতাবটি হাতে নিয়ে তাঁর নিকট উপস্থিত হলাম মসজিদে। তিনি মহল্লার মসজিদের মুয়াজ্জিন এবং ইমাম। তিনি আমাকে দেখেই বললেন, এটা কী কিতাব? আমি কিতাবটি তাঁর হাতে তুলে দিলাম। তিনি কিতাবটি হাতে নিতেই এমন একটি মাসআলার প্রতি তাঁর দৃষ্টি পড়ল যাতে আমি قال النعمان بن ثابت নুমান বলেছেন…শব্দটি লিখে চিহ্নিত করে রেখেছিলাম। আযানের পর দাঁড়িয়ে থেকেই তিনি নামাযের ইক্বামত পর্যন্ত কিতাবটির শুরুর অংশটা (বিশেষ মনোযোগপূর্বক) পড়ে ফেললেন। অতঃপর কিতাবটি বন্ধ করে তিনি নামায পড়ালেন। নামাযের পর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নুমান ইবনি সাবিত’ লোকটি কে? আমি বললাম, তিনি একজন শাইখ—ইরাকে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে! তিনি (সোল্লাসে) বলে উঠলেন—
هذا نبيل من المشايخ، اذهب فاستكثر منه
‘এতো এক অত্যুচ্চ মাকাম ও মরতবার শাইখ! (জ্ঞানবৃদ্ধ মহান ব্যক্তি) যাও, তাঁর নিকট গিয়ে আরও অধিক পরিমাণ জ্ঞান আহরণ কর।’ [তারীখে বাগদাদ, ড. বাশশার আওয়াদ মারূফ এর তাহকীককৃত-১৫/৪৬৩-৪৬৪]
আমি বললাম, ইনিই তো সেই ব্যক্তি যার নিকট যেতে আপনি বারণ করেছিলেন।” আরেকটি বর্ণনায় আছে—যখন মক্কা শরীফে ইমাম আবু হানীফার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। (এই সাক্ষাতের ফলে দুই বিরাট ব্যক্তিত্বের মধ্যে নতুন করে একটা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিস্ময়বোধ জন্মলাভ করে। এবং নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠে।) তখন তিনি ইমাম আবু হানীফার সাথে সেইসব মাসআলার ব্যাপারে আলোচনা করলেন। ইবনুল মুবারক তাঁর কাছ থেকে যতটুকু লিখেছিলেন তিনি তার চেয়ে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা দিলেন। সেই মাজলিস থেকে ফিরে ইমাম আওযায়ী রহ. তাঁর মনের আকর্ষণ চেপে রাখতে না পেরে ইবনুল মুবারককে বললেন—
غبطت الرجل بكثرة علمه ووفورعقله، أستغفر الله تعالى لقد كنت في غلط ظاهر، الزم الرجل، فإنه بخلاف ما بلغنى عنه.
‘লোকটির অসাধারণ ও বিপুল ইলম এবং জ্ঞানের গভীরতা দেখে আমার (অবচেতন বুক জুড়ে) ঈর্ষান্বিত হয়েছি। আর আমি আল্লাহপাক-এর দরবারে ইস্তেগফার করছি। কেননা আমি প্রকাশ্য ভুলের মধ্যে ছিলাম। তুমি তাঁর সান্নিধ্য গ্রহণ কর। তাঁর সম্পর্কে ইতঃপূর্বে যে মন্তব্য আমার কাছে পৌঁছেছিল তিনি তার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ।’ [আলখাইরাতুল হিসান, দারুল হুদা ওয়ার রাশাদ, আব্দুল কারীম মুসার সম্পাদনায় প্রকাশিত-৮৪-৮৫]
পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে সরে এলেন ইমাম ইবনে আদীও
একটি প্রবাদ রয়েছে যে, কোন অকাট কৃপণের হাত হতেও স্বর্ণ-রৌপ্য খসানো যেতে পারে তবে কারো প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন লোকের মুখ হতে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে প্রশংসাবাণী বের করা সত্য-সত্যই কঠিন। এমন কঠিন কাজটি ঘটেছে হাফেজ ইবনে আদী (২৭৭ হি.-৩৬৫ হি.)-এর বেলায়। তিনি হলেন ‘আলকামেল ফিল জরহে ওয়াত তা‘দীল’ গ্রন্থ প্রণেতা। জরাহ্-তাদীল শাস্ত্রে তাঁর সুনাম ও সুখ্যাতি রয়েছে। আল্লামা যাহেদ আলকাওসারী রহ. ইবনে আদীর ব্যাপারে বলেন—
وكان ابن عدى على بعده عن الفقه والنظر والعلوم العربية: طويل اللسان في أبي حنيفة وأصحابه، ثم لما اتصل بأبى جعفر الطحاوى وأخذ عنه تحسنت حالته يسيرا، حتى ألف “مسندا” في أحاديث أبي حنيفة. انتهى.
‘ইবনে আদী ফিকহ্, ইজতিহাদ এবং উলূমে আরাবিয়্যাহ থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর আসহাবের ব্যাপারে (মন্দ ধারণার শিকার হওয়ার কারণে) রূঢ়ভাষী ছিলেন। এরপর যখন আবু জা‘ফর আতত্বহাবীর সাথে তাঁর সম্পর্ক হল এবং তাঁর থেকে ইলম অর্জন করলেন তখন তাঁর অবস্থা কিছুটা সুন্দর হল। এমনকি (পূর্ব অনাকাঙ্খিত ধারণার প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ) ইমামে আযম রহ.-এর একটি মুসনাদও সংকলন করে ফেলেন।’ [তা’নীবুল খতীব-১৬৯]
অতএব ইমাম আযমের মুসনাদ সংকলন করার দ্বারা ইবনে আদীর সংশোধিত মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে বলেই আমরা মনে করি। ইমাম আযম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাসৃষ্টিকারী কিছু ভ্রান্ত পুঁথি! নিয়ে যারা পড়ে থাকতে অভ্যস্ত তাদের জন্য রয়েছে এসব ঘটনায় বিরাট শিক্ষা। আল্লাহ্ তাআলা সকলকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন।
বিরূপ-মন্তব্যকারী সমসাময়িক শীর্ষ ব্যক্তিদের প্রতি সুধারণা রাখা
আসলে বহুবর্ণ বিরল মানিক্যের মত মহান ব্যক্তি ইমাম আযমকে চিনতে না পেরে ভুল বুঝাবুঝি বা দ্বীনী গায়রাতের কারণে নেক নিয়্যতে যারা তাঁর প্রতি বিরূপ মন্তব্য করে ফেলেছেন আমাদের উচিত তাদেরকে মাযূর মনে করে তাদের প্রতি সুধারণাা রাখা। এ বিষয়ে আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী রহ.-এর একটি প্রাজ্ঞচিত মন্তব্য রয়েছে। তিনি বলেন,
اعلم أن الذين طعنوا في إمامنا أبي حنيفة، وتحاملوا عليه من أكابر أقرانه، لا نظن بهم إلا خيرا، فإن المؤمن الغيور الصادقَ في نيته، إذا بلغه عن أحد من المعروفين شيئ يزعُمُ فيه أن القول به يرادف هدم الدين، ورد أحاديث سيد المرسلين صلى الله عليه وسلم— وإن لم يكن الواقع كذالك—تأخذه غيرة دينية، وحمية إسلامية، ينشأ عنها غضب في الله تعالى على ذالك القائل، وإبغاضه لوجه الله تعالى.
فيحمله ذلك على الوقيعة وإغلاظ القول فيه، والتكلم بمسشنعات الأقوال في حقه، ظنا منه أنه بصنيعه هذا مناضل عن الدين، وذاب عن حوزة الشريعة.
মর্মানুবাদ : জেনে রাখ! আমাদের ইমাম আযমের সমসাময়িক যে সব বর্ষীয়ান তাঁর ব্যাপারে সমালোচনা করেছেন এবং তাঁর প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছেন তাঁদের প্রতি আমরা কেবল সুধারণাই রাখব। (এটা বর্তমান সময়ের মত ঈর্ষাতাড়িত হয়ে পরস্পরের দুর্নাম রটানোর মত বিষয় নয়।) কেননা গায়রাত ও আত্মসম্মানবোধ-সম্পন্ন কোন ঈমানদারের কাছে যখন পরিচিত কারো ব্যাপারে এমন কিছু পৌঁছে, যে বক্তব্যের ব্যাপারে সে মনে করে—এ জাতীয় মতামত ব্যক্ত করা দ্বীন ধ্বংস করা এবং নবীজীর হাদীস প্রত্যাখ্যান করার নামান্তর। তখন এরূপ মন্তব্যকারীর বা মতামতব্যক্তকারীর প্রতি দ্বীনী গায়রাত ও জাত্যাভিমান জনিত কারণে এবং আল্লাহ্ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ক্রোধ আসাটাই স্বাভাবিক। যদিও ইমাম আবু হানীফার ক্ষেত্রে বাস্তবতা সম্পূর্ণ এর বিপরীত। সমালোচকরা তাঁর উপর উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে মর্মমূলে প্রবেশ করেননি। ফলে তাঁরা দ্বীনের পক্ষে তরফদারী মনে করে নিয়্যত ও সহীহ্ মানসিকতায় সমালোচনা করেছেন। [ফাতহুল মুলহিম-১/৭৩, হিন্দুস্তানী ছাপা-৪৮০, মাকতাবুল মাতবূআতিল ইসলামিয়্যাহ]