লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
আমি পরিস্কার বুঝে যাই। আব্দুর রাজ্জাক সাহেব সরাসরি আলোচনায় ভয় পাচ্ছেন। তিনি টকশোতে অংশগ্রহণ করবেন না। এটাই তার চূড়ান্ত ফায়সালা। প্রয়োজনে তিনি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ না করে চলে যাবেন। তবু তিনি টকশোতে অংশগ্রহণ করবেন না। যেভাবে জেদ ধরেছেন। তারপরও তিনি টকশোতে অংশগ্রহণ করবেন বলে আমার মোটেও বিশ্বাস হচ্ছিল না।
তাহলে কি রাত ভর আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের ভিডিও দেখে যে ঘুম নষ্ট করলাম এ সবই বৃথা যাবে? এ হয় না। আমি চিন্তা করলাম। একটুতো কথা বলা দরকার। আমাদের বিরুদ্ধে এত বলিষ্ট ভাষায় সমালোচনাকারীকে সামনে পেয়ে চুপচাপ পালাতে দিতে পারি না। কিছুটা হলেও কথা বলা দরকার।
তাই কথা বলার সূচনা করলাম। পূর্ণ কথোপথনের ভিডিওটি দেখুন। আলোচনাটি শুরু হয়েছে ৭ মিনিট ২৭ সেকেন্ড থেকে।
আমি- হযরত! আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
আব্দুর রাজ্জাক সাহেব দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে ফিরলেন আমার দিকে। বললেন- হ্যাঁ।
আমি বললাম- কালকে রাত্রে আমি আপনার কিছু ভিডিও দেখেছিলাম। তা দেখে আমার মনে কিছু প্রশ্ন আসছে। একটু বলতে চাচ্ছিলাম।”
বিষন্ব চেহারা নিয়ে, দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে আব্দুর রাজ্জাক সাহেব ক্ষীণ শব্দে প্রশ্ন করলেন- এখন?!
আমি- “যদি সময় হয়। পরবর্তীতে যদি আপনাকে না পাই আরকি। এজন্য যদি এখন সময় হয়। দুইটা, দুইটা, তিনটা বিষয়। সিলেটের বয়ানে, আরেকটা হচ্ছে রামপুরা, আরেকটা রংপুরে।
আমি যেহেতু ইলমের নিসবতে লেগে থাকার চেষ্টা করি, তো সেই হিসেবে জানার জন্য, আমি বলছি না, আমার বক্তব্যটি চূড়ান্ত। জানার জন্যই বলছি, আপনি রামপুরা বা রংপুরের মাহফিলের বয়ানে বলেছেন- সন্তান জন্ম নেবার পর ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত একথাটার কোন ভিত্তি নেই। এটা জাল হাদীস। জাল হাদীস এভাবে বলা হয়নি, বলা হয়েছে এগুলোর কোন ভিত্তি নেই। এগুলোর জবাব কে দিবে? মূল বক্তব্যটা এমনি। আমি এ হাদীসটা খুজলাম। আমার কাছে মাকতাবায়ে শামেলা আছে। আর নেটে কিছু ওয়েব সাইট আছে। যেমন আদদুরারুস সুন্নিয়্যাহ। জরাহ তাদীলের যে কিতাবগুলো আছে। ওখানে হাদীসগুলোর যে হুকুমগুলো দেয়া আছে, সেসবের একটি সমৃদ্ধ একটি সাইট। আদদুরারুস সুন্নিয়্যাহ। সেখানে আমি সার্চ করেছি। মুহাদ্দিসীনে কেরামের বক্তব্য দেখেছি। হাদীসটি মুসনাদে ইসহাক বিন রাহুয়া গ্রন্থে আছে। [{শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৮৬১৯, মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদীস নং-৬৭৮০, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদীস নং-৭৯৮৫}
হাদীসটির হুকুম দেখলাম। এটাকে মওজু একথা আসলে জম্মে গাফীর কেউ বলেনি। দুই একজন হয়তো বলেছে। [আলবানী] বাকি সবাই এটি কে গ্রহণযোগ্য হাদীস বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আলবানী ছাড়া। আর বিশেষ করে আলবানী রহঃ এর তাহকীক অনেক ক্ষেত্রেই…।
আমার কথাকে শেষ করতে দিলেন না, আব্দুর রাজ্জাক সাহেব। আমি বলতে চাচ্ছিলাম আলবানী রহঃ এ হাদীসকে একা জাল বলেছেন। আর তার জাল জঈফ বলার গ্রহণযোগ্য নয়।”
কিন্তু আমার কথা শেষ করার আগেই চালাকির পরিচয় দিয়ে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন- “আপনি যে তদন্ত করেছেন, তাতে কেউ কেউ মওজু বলেছেন।”
আমি- এরকম আরো চোখে পড়েনি আরকি। আপনার দৃষ্টিতে পড়তে পারে, এজন্য কিছুটা ফাঁক রেখে বলেছি। আপনার দৃষ্টিকোণটা জানতে চাচ্ছি।
মিনমিন করে আব্দুর রাজ্জাক সাহেব জবাব দেন- “আমার দৃষ্টিকোণ, আমি যখন সাধারণ মানুষের সামনে কোন কথা বলি, তখন বহু গ্রন্থ দেখে বলার চেষ্টা করি।”একথা বলেই তিনি চুপ হয়ে গেলেন। ভাবটা এমন এত কথা বলছো কেন হে?
কিন্তু আমি ছাড়বার পাত্র ছিলাম না। আমি হযরততে আবার বললাম- “হযরত এটি যদি জাল হয়, তাহলে কি কারণে জাল? সেই সুনির্দিষ্ট কারণটি কি?”
বাধ্য হয়ে এবার আবার মুখ তুললেন আব্দুর রাজ্জাক সাহেব। বললেনঃ “বাচ্চা জন্ম নিলে আজান দিতে হবে মর্মে হাদীসটি হাসান। কিন্তু ডান কানে আজান আর বাম কানে ইকামত এই মর্মে হাদীসটি জাল।”
আমি বললাম- আমার কাছে সনদসহ উক্ত হাদীসটি লেখা আছে।
আব্দুর রাজ্জাকঃ সনদসহইতো থাকবে।
আমি- আমি বলতে চাচ্ছি, হাদীসটি জাল কেন? সুনির্দিষ্ট কারণতো থাকবে যে, এই কারণে হাদীসটি জাল। সেটি কি? সুনির্দিষ্ট কারণ ছড়াতো এটিকে জাল বলেননি। নাকে এটি কারণ ছাড়াই জাল?”
আব্দুর রাজ্জাক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হাত দিয়ে শুধু মুখ ঢাকছেন, আবার খুলছেন। কিন্তু এর কোন জবাব তিনি দিতে পারেননি। বুঝে যাই, তিনি এখানে হাজার বছর বসে থাকলেও ইনশাআল্লাহ এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন না।
হযরতের এই মৌনতাকে নষ্ট করে তাই দ্বিতীয় প্রশ্ন করলাম- “আরেকটি বিষয়। সেটি হল গর্দান মাসাহ করা। ওখানে আপনি বলেছেন- গর্দান মাসাহ করার কোন দলীল নেই। এর জবাব কে দেবে?
এটার ক্ষেত্রে আমার কথা হল, যদি কোন আমল এমন হয়, এর বিপক্ষে কোন দলীল নেই। তবে এর পক্ষে যদি দুর্বল দলীল থাকে, তাহলে এর হুকুম কি?
মুখে হাত রেখেই আব্দুর রাজ্জাক সাহেব বলে দিলেনঃ “তাহলে এটি বাতিল হয়ে যাবে।”
আমি বললাম- বিপক্ষে কোন দলীল নেই।
খুবই ক্ষীণ স্বরে বললেন আব্দুর রাজ্জাক সাহেবঃ তবু তা বাতিল।
আমি বললামঃ তাহলে রাসূল সাঃ যে বললেন, সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে। হাদীসের মাঝে এসেছে-عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ، সাথে সাথে আবার বলেছেন, তোমরা এটাকে কিভাবে আঁকড়ে ধরবে? তিনি বলেছেন যে, وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، আগে রাসূলের কথা,তারপর সাহাবীদের কথা বলার পর বলেছেন যে, এটাকে মাঢ়ির দাত দিয়ে আঁকড়ে ধরবে। তাহলে সাহাবায়ে কেরাম যে কাজটি করেছেন। সেটার ক্ষেত্রে, আমরা যদি বলি……।
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আব্দুর রাজ্জাক সাহেব বলতে লাগলেন- সেসবের যা সূত্রধারা সংরক্ষণ আছে সেটাও গ্রহণীয় হবে।”
আমি- সেটা গ্রহণযোগ্য হবে? তাহলে এই গর্দান মাসাহ করার হাদীসটি আমি খুঁজলাম। দেখলাম যে, এটি আছে তালখীসুল হাবীরে। ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ এর। তালখীসুল হাবীরে গর্দান মাসেহের হাদীস আনার পর ইবনে হাজার লিখেছেনঃ
قُلْتُ: فَيَحْتَمِلُ أَنْ يُقَالَ هَذَا وَإِنْ كَانَ مَوْقُوفًا فَلَهُ حُكْمُ الرَّفْعِ لِأَنَّ هَذَا لَا يُقَالُ مِنْ قِبَلِ الرَّأْيِ فَهُوَ عَلَى هَذَا مُرْسَلٌ (التلخيص الحبير، كتاب الطهارة، باب سنن الوضوء، رقم الحديث-97)
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ বলেন-বর্ণনাটি সম্পর্কে একথা বলা যায় যে,যদিও তা একজন তাবেয়ীর কথা হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে,কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে তা রাসূলুল্লাহ সাঃ এর হাদীস গণ্য হবে। কেননা,তিনি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এমন সংবাদ দেওয়া সম্ভব নয়। {আত তালখীসুল হাবীর-১/৯২,হাদীস নং-৯৭}
একটি রেওয়ায়াত যেহেতু আছে, তাই এটিকে বিদআত বলাটা কতটুকু যৌক্তিক?
নড়েচড়ে বসলেন আব্দুর রাজ্জাক সাহেব। হযরত বিপদে পড়ে যাচ্ছেন মনে করে বিরক্ত হবেন মনে করে সহজ হবার জন্য কিছুটা সান্ত¦না দিয়ে বলি, “হযরত! আপনার সাথে ডিবেটের জন্য নয়। বিষয়টি পরিস্কার হবার জন্য জিজ্ঞাসা করছি। যদি বিপরীতে শক্ত দলীল থাকতো তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু যেটির বিপরীতে শক্ত দলীল নেই, আর পক্ষে একটি বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে, সেটিকে বিদআত বলা কতটুকু যৌক্তিক?”
শায়েখ আব্দুর রাজ্জাকঃ “পক্ষে কথা, আর বিপক্ষে দলীল এইভাবে শরীয়ত চলে না। শরীয়ত চলে কুরআন ও সহীহ হাদীসের উপর দিয়ে। কোন মতামতেও নয়। সহীহ হাদীস যখন আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সাহাবীর পক্ষ থেকে হবে, আর ঐ আমলটা রাসূলের সহীহ হাদীসের আমলের বিপক্ষে হবে না, তখন সেটি শরীয়ত হয়ে গেল। সাহাবীগণের কথাও গ্রহণীয় হবে, সূত্র যখন সহীহ হবে। তবে সহীহ সূত্র দ্বারা রাসূল থেকেও হাদীস আছে, যাতে দেখা যাচ্ছে যে, সাহাবীর আমলের বিপক্ষে আমল হচ্ছে রাসূলের কথা। তখন ঐ সাহাবীর কথা গ্রহণীয় হবে না। এটুকু সামনে রাখার পরে মানার ব্যাপারে শরীয়তকে এভাবে দেখতে হবে যে, আমি যে সূত্রের ভিত্তিতে আমলটি করতে যাচ্ছি, সে সূত্র বিশুদ্ধ সূত্র কি না? আপনার কাঁধ মাসাহ করার হাদীসটি বিশুদ্ধ হবার ব্যাপারে আপনি হাদীসটি বের করেন। যেটাকে আপনাকে আমি তদন্ত করতে বলি। হাদীসটি বের করেন, ওটা কোন গ্রন্থের। বায়হাকী, মুস্তাদরাকে হাকেম? না মাআনিউল আসার? না মুসনাদে আহমাদ? এর একটি সূত্র আছে। মাওকুফ হোক বা মারফু হোক। মুরসাল হোক বা মুজাল হোক।”
বক্তব্য চালিয়ে যাচ্ছেন আব্দুর রাজ্জাক সাহেব। আমার হাসি পাচ্ছিল। তিনি নিজের ফাঁদে নিজেই পা দিচ্ছিলেন। সেই ফাঁদটি তিনি চিনতে পারছিলেন না। সেটি আমি এখনি ধরিয়ে দিতে চাইনি। রেখে দিয়েছিলাম টকশোর জন্য। জাতির সামনে তা উপস্থাপিত করতে জমা রেখেছিলাম। তাই হযরতকে তার এই অহেতুক কথন বলতে দিচ্ছিলাম। এখানেই এটি ধরিয়ে দিলে আজকের টকশোতো বাদই, তিনি কিয়ামতের আগে কোন দিন আমার সাথে মুখোমুখি আলোচনায় বসতে রাজি হবে না বলেই আমার এখনো দৃঢ় বিশ্বাস আছে আল্লাহ রহমাতে। যেহেতু হযরত তারপরও পালিয়ে গেছেন। টকশোতে যোগ দেননি। তাই সেই পয়েন্টটি সবাইকে জানিয়ে দেই।
আপনারা নিশ্চয় খেয়াল করেছেন। একটু আগে তিনি আমার কথা থেকে নিজেকে বাঁচাতে একটি কমন ডায়লগ দিয়েছিলেন। সেটি হল, “দলীল শুধু কুরআন ও সহীহ হাদীস। কারো মতামত নয়।”
কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এখন তিনি আমাকে কুরআন ও সহীহ হাদীস রেখে ব্যক্তির মতামতের কথাই মানার উপদেশ দিচ্ছেন। মুখে এসে গিয়েছিল কথাটা- “জারাহ তাদীলের কিতাবের সংকলকগণের বক্তব্যগুলো কি কুরআন, না সহীহ হাদীস? নাকি ব্যক্তির মতামত? যদি কুরআন ও সহীহ হাদীস না হয়, তাহলে কি? নিশ্চয় ব্যক্তির মতামত। আর আপনিতো আগেই বলেছেন, দলীল হবে কুরআন ও সহীহ হাদীস। ব্যক্তির মতামত গ্রহণযোগ্য নয়। আর একথাটি বলেছেন তাবেয়ীর কথাকে বাদ দেয়ার জন্য। এখন কোন মুখে ব্যক্তির মতামত নির্ভর জারাহ তাদীলের এসব কিতাবের নাম বলে উপদেশ খয়রাত করছেন? মাথা ঠিক আছে? নাকি পুরোপুরি শেষ?”
কিন্তু কথাটি বলিনি। টকশোতে বলবো আশায় মনে দাবিয়ে রাখি। কিন্তু আমার সে আশায় তিনি ছাই ছিটালেন। তিনি টকশো না করে সত্যি সত্যিই পালাবেন জানলে তার এসব অযথা কথন শোনার কষ্ট আমি কিছুতেই বরদাশত করতাম না।
যাইহোক, সুযোগ পেয়ে আব্দুর রাজ্জাক সাহেব আপন মনে বলেই যাচ্ছেন- “এরপর সূত্রে যেসব ব্যক্তিগুলো আছে, তা আপনি যদি নিজে দেখতে চান, তাহলে এ লোকগুলো তদন্ত করেন। লোকগুলো তদন্ত করবেন কী দিয়ে? সবচে’গ্রহণীয় সুন্দর গ্রন্থ হচ্ছে মিযানুল ইতিদাল।”
আমি উৎসাহ দিয়ে বললাম- “আল্লামা যাহাবী রহঃ এর।”
বিরক্ত হচ্ছিলাম খুব। কি বলতে গিয়ে কী শুরু করলেন? কোথায় প্রশ্ন ছিল, দলীলহীন স্থানে তাবেয়ীর আমল বা বক্তব্য পাওয়া গেলে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে কি না? না হলে কারণ কি? সেটির জবাব না দিয়ে তিনি হাদীস তদন্ত করার বিশাল ফিরিস্তি শুরু করলেন। যা দিয়ে তিনি সময় নষ্ট করতে চাচ্ছেন। সেই সাথে নিজের ইলমকেও জাহির করতে চাইলেন। আর ভিডিও হচ্ছে দেখে কথায় হেরে যাচ্ছেন একথা যেন প্রকাশ না পায় তাই আমাকে কথা বলতে সুযোগ দিতে চাচ্ছেন না। এ সুযোগ না দেয়া এ মাযহাবের অনুসারীদের পুরনো অভ্যাস আমি জানি। বিরক্ত হয়ে তাই আমি বলতে লাগলাম- “দেখুন! এখানে…….।”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে আব্দুর রাজ্জাক সাহেব বলতে লাগলেনঃ “আমি একটু বলি?”
অনুমতি চাইলেন হযরত। কি আর করা? জানি অযথা কথন। সময় নষ্ট করছেন ইচ্ছেকৃত। আমার প্রশ্নের কোন জবাব তার কাছে নেই তিনি বুঝে গেছেন। তাই দৃষ্টি ঘুরাতে শুরু করলেন তাহকীক পদ্ধতি নিয়ে অযথা আলোচনা। বড় মানুষ। সাথে আছে দুইজন শিষ্য। সেই সাথে কঠিন ভক্ত নজরুল ইসলাম সাহেব। তাদের সামনে অপদস্ত করতে চাইলাম না। চুপ হয়ে গেলাম। বলতে দিলাম হযরতকে। হাত নেড়ে কথা বলে যাচ্ছেন আব্দুর রাজ্জাক সাহেব। তার ডান হাতে রয়েছে জনাব ফাখরুল ইসলাম রচিত মাযহাবের বিষয়ে বিষোদগারমাখা বই। যার আলোকে আব্দুর রাজ্জাক সাহেব আজকে মাযহাবের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতেন। কিন্তু আমাদের দেখে সেই স্বপ্নে ছাই পড়ে গিয়েছিল। যাইহোক,
তিনি বলতে লাগলেন- “সবচে’সুন্দর গ্রন্থ হচ্ছে তাহযীবুত তাহযীব। সবচে’সুন্দর গ্রন্থ হচ্ছে তাকরীবুত তাহযীব। গ্রহণীয় কাছাকাছি গ্রন্থ হচ্ছে উসদুল গাবা। এই বইগুলো সামনে রেখে এইবার মধ্যের লোকগুলোকে তদন্ত করেন। মধ্যের লোকদের তদন্দে দেখেন যে, কেউ বলছেন নাকি মধ্যের রাবী মিথ্যুক। বা এইরকম কিছু আছে। ১০/১২টা কারণ আছে হাদীস জাল জঈফ হবার। এর মাঝে ৬টি উল্লেখযোগ্য। এইভাবে আপনি সূত্রগুলো তদন্ত করেন। যদি দেখা যাই, সূত্রের সব রাবী সহীহ। কারো উপর কোন আপত্তি নেই। তখন আপনি নিজের তদন্তে আমল করেন।”
এই বলে থামলেন তিনি। যখন আমি আবার কথা বলতে চাচ্ছিলাম, তখন তিনি হাত ইশারা দিয়ে আমাকে আবার থামিয়ে দিলেন। তিনি আরো বলতে চান। সুযোগ দিলাম। তিনি আবার স্টার্ট দিলেন তার কথা- “এটি এক নাম্বার কাজ। দুই নাম্বার পদ্ধতি হল। সহজে আপনি কিভাবে করবেন? সহজে দেখলে আপনি দেখুন যারা হাদীসগুলোর ব্যাপারে তদন্ত করেছে। শুদ্ধ বিশুদ্ধের আলোচনা পেশ করেছে। তার নতুন আধুনিক বই সিলসিলাজ জঈফা।”
নাম শুনে হাসি পেল। যার কিতাব দেখে তিনি এসব ইলম ঝারছেন। সেই আলবানী সাহেবের কিতাবের নামটি শুদ্ধ করে উচ্চারণ করতে পারলেন না। সিলসিলাজ জঈফা নামের কোন কিতাব নেই। নাম হল, সিলসিলাতুল আহাদীসিজ জঈফা। হযরতের গুরু নাসীরুদ্দীন আলবানী রহঃ এর সংকলিত বিতর্কিত কিতাব। বলতে দিলাম হযরতকে। বলতে ছিলেন- “ নাসীরুদ্দীন আলবানী রহঃ, পুরাতন বই মওজুআতে কাবীর। মোল্লা আলী কারীর। ………….. শুরুহাতের বই আপনার ঐ ইয়ে… বুলুগুল মারামের ব্যাখ্যা বই সুবুলুস সালাম, তিরমিজী ভাষ্য বই তুহফাতুল আহওয়াজী। যদি কেউ তুহফাতুল আহওয়াজীর লেখক একজন আহলে হাদীস ছিলেন….”।
আমি বলে দিলাম- “আব্দুর রহমান মুবারকপুরী।”
কিন্তু সেদিকে তিনি খেয়াল না করে, তিনি নিজের বক্তব্য বলেই যাচ্ছেন- “তারপরও আপনাকে দেখতে বলছি এইজন্য এর পাশাপাশি আমাদের মাযহাবী ভাইদের লেখা যে বই আছে, যেমন মারেফুস সুনান। এগুলোর চেয়ে ওখানে বেশি পাবেন এজন্য এগুলোতে হাদীসের বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত দেয়নি।”
ডাহা একটি মিথ্যা কথা বলে দিলেন শায়েখ। কিন্তু আমি শায়েখকে আটকাতে চাইনি। একেতো তিনি শুরু করেছেন অপ্রয়োজনীয় আলাপ। মূল বিষয় রেখে অন্য দিকে মোড় নিলেন। আবার যদি এখানে আটকাই, তাহলে না জানি আবার কোন দিকে ছুটেন। মারেফুস সুনানে হাদীসের ব্যাপারে যে পরিমাণ কালাম করা হয়েছে এর কাছাকাছি আসার যোগ্যতাও নেই আব্দুর রহমান মুবারকপুরীর তুহফাতুল আহওয়াজীর। তবু চুপ রইলাম। দেখি তিনি এর শেষ কোথায় করেন। তিনি বলছিলেন- “তবে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে এখন একটি বই বের হয়েছে। ৬ খন্ডে। সেটা হচ্ছে, ইমাম তিরমিজী যে, হাদীসকে বললেন, হাসান, সহীহ গরীব এগুলোর মানটা কতটুকু? শেষ পর্যন্ত হাদীসের ফলাফল কি? এই একটা গ্রন্থ পাওয়া যায়। এই হাদীসের মাধ্যম দিয়ে এগুলোর মাধ্যম দিয়ে আপনি সিদ্ধান্ত পেশ করেন। আরেকটা গ্রহণযোগ্য বই আছে। এর নাম হল, ইরওয়াউল গালীল।”
আমি বলে দিলাম- “নাসীরুদ্দীন আলবানীর।”
আবার বুঝাতে লাগলেন শায়েখঃ “আপনি মাথাটাকে প্রথমে খালি করে নিবেন। আহলে হাদীস হই, হানাফী হই আর যে হই না কেন? মাথাটাকে পুরোপুরি খালি করে, মনে কোন প্রকার স্বার্থ না রেখে হাদীস সহীহ হলে মানবো এরকম পরিকল্পনা নিয়ে আপনি এখন এই বইগুলো দেখেন। এই হাদীসটার উপর তারা কী মতামত পেশ করেছেন? এটা হল আপনার দ্বিতীয় স্তর। কথাটি কি আমার বুঝেছি?
আমি- “পরিস্কার।”
আব্দুর রাজ্জাক সাহেবঃ “তাহলে আপনার কাছে দেখা যাবে, বিষয়টি মানা না মানা জানা তদন্ত করা সহজ হবে।”এই বলে চুপ হয়ে গেলেন শায়েখ।
চুপ থাকা দেখে আদবের সাথে আমি হযরতকে বলি- “এই পয়েন্টে আমার কিছু জানার ছিল। আমি কি সেটি বলতে পারি?”
আমাকে সেই সুযোগ না দিয়ে আবারো কথা বলতে চাইলেন তিনি। বললেন-“ আমার দুইটাই তদন্ত আছে। তাতে কাঁধ মাসাহ করার বিষয়টি, আর ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত এ দুটি হাদীস আমার তদন্তে জাল প্রমাণ হয়েছে। ব্যক্তিগত রাবী তদন্তে আর ব্যক্তিদের তদন্তে। আপনার যদি এরকম বিষয়ে খুলাখুলি হয়ে থাকে, তাহলে ভাল, আর যদি না হয়ে থাকে, তাহলে আবার খুলাখুলি হোক তখন পরে আরেকদিন জিজ্ঞাসা করবেন”। হাসি দিয়ে আমাকে আর প্রশ্ন না করতে পরোক্ষ ইশারা করলেন শায়েখ।
কিন্তু নাছোড়বান্দা আমার মনে তখন প্রথম প্রশ্ন আসছিল, এই দীর্ঘ আলোচনা তিনি সূচনা করলেন কেন? আমি হযরতকে প্রশ্ন করেছিলাম কোন সুনির্দিষ্ট কারণে তিনি এসব হাদীসকে জাল বলছেন?
এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তিনি এই দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে খুলাসা বললেন, হযরতের তদন্তে এসব জাল প্রমাণ হয়েছে। এটাতো হযরতের দাবি। সেই দাবি তিনি প্রথমেই করেছিলেন। আমিতো দাবি শুনতে চাইনি, চেয়েছি দলীল। কোন দলীলের ভিত্তিতে এ দুই হাদীসকে তিনি জাল বলছেন? সেই সুনির্দিষ্ট কারণটি কি?
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তিনি দীর্ঘ সময় ধরে বিশাল ফিরিস্তিতো শুনালেন, কিন্তু কি কারণে হযরতের তদন্তে এ হাদীস দু’টি জাল বলে প্রমাণিত হয়েছে সেটি আঁধারেই রেখে দিলেন। আসলে মাইক পেয়ে সাধারণ মানুষের সামনে অনেক কিছুই বলা যায়, কিন্তু দলীল চাইলে এভাবে সটকে পড়া যায়, কিন্তু দলীল দেয়া সবার কাজ নয়।
যাইহোক, যেহেতু হযরত ইচ্ছেকৃত এ থেকে বাঁচতে চাচ্ছেন। আর এতটুকু যারা দেখবেন, তাদের মাঝে বিজ্ঞ ও সচেতন পাঠকগণ নিশ্চয় বিষয়টি ধরতে পারবেন যে, প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কিভাবে প্রথমে করা দাবিটিই দীর্ঘ আলোচনার পর করে গেলেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কারণ আর উল্লেখ করতে পারলেন না।
বিষয়টি নিয়ে আবার প্রশ্ন করা যেতো। যেহেতু আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি। কিন্তু এখনি হযরতকে হতভম্ব করে দিতে চাইনি। তাই প্রসঙ্গ চেঞ্জ করার সুযোগ দিয়ে নতুন উদ্ভব করা বিষয়েই কথা বললাম- “ আপনার এ তদন্তের বিষয়ে আমার একটি প্রশ্ন আছে। প্রশ্নটি হচ্ছে যে, আপনি বলেছেন দলীল হবে কুরআন ও সহীহ হাদীস। এখানে মৌলিক প্রশ্ন যেটি আসে, সেটি হল, “সহীহ”এই শব্দটা এটাতো কোন শাব্দিক [অর্থবোধক] শব্দ না, এটাতো একটি পারিভাষিক শব্দ। আমরা যে ঊসূলে হাদীস পড়েছি। এতে সহীহ এর সংজ্ঞায় অসংখ্য এখতিলাফ। যেমন ইমাম বুখারীর সহীহ এর সংজ্ঞার সাথে ইমাম তিরমিজীর সাথে মিল নেই, ইমাম বুখারীর সহীহ এর সংজ্ঞার সাথে ইমাম মুসলিমের মিল নেই। এরকম অনেকের সাথেই রয়েছে এ মতভেদ। এখন আমরা যখন বলবো, “কুরআন ও সহীহ হাদীস মানবো”তখন প্রশ্ন হল, কার বক্তব্যের আলোকে আমি সহীহ মানবো? ইমাম বুখারীর আলোকে, না ইমাম তিরমিজীর আলোকে? না ইমাম যাহাবী রহঃ এর আলোকে? এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন।
দুই নাম্বার বিষয় হল, আপনি কিছু কিতাবের নাম বললেন, যেমন মিযানুল ইতিদাল, তাকরীবুত তাহযীব, তাহযীবুল কামাল এই যে, কিতাবগুলো আছে, এই কিতাবগুলোর ক্ষেত্রে আমরা যদি ভাল করে দেখে, তাহলে একজন রাবী যেমন কথার কথা ইবনে লাহিয়া। এই একজন রাবীর ক্ষেত্রে একেকজনের একেক ধরণের মন্তব্য। একজন বলতেছেন যে, তিনি সিকা। আরেকজন বলতেছেন তিনি মুনকার। তারপর আরেকজন বলছেন ভিন্ন। মানে এরকম একাধিক বক্তব্য। এমনিভাবে হাদীসের ক্ষেত্রে আসছে কেউ বলছেন এটি সহীহ, কেউ বলছেন এ হদীস জঈফ। আরেকজন বলছেন মুনকার। আরেকজন বলছেন অধিক জঈফ।”
আমার কথা শেষ হবার আগেই কথা বলতে চাচ্ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক সাহেব। আমি হযরতকে বললাম- “আমি পয়েন্ট আউট করে দিচ্ছি, একটি হল, আমরা সহীহ হাদীস মানবো, কার সংজ্ঞার আলোকে সহীহ মানবো? এবং কেন?
আর যেহেতু আমি প্রথমেই পরিস্কার ভাষায় বলে গেলাম আমার দলীল হবে কুরআন ও সহীহ হাদীস। তাহলে কুরআন ও সহীহ হাদীসে কি সুষ্পষ্টভাবে সহীহের ক্ষেত্রে কার সংজ্ঞা মেনে নিব এ ব্যাপারে কোন সুষ্পষ্ট নির্দেশনা আছে কি না? এটা একটা প্রশ্ন।
আরেকটা প্রশ্ন হল, যখন এসব জরাহ তাদীলের কিতাবের মাঝে একাধিক মতামত পাওয়া যায়, আমার একটি লেখাও আছে, একই হাদীসকে একজন বলছেন এটি সহীহ, আরেকজন বলছেন এটি মুনকার। এই যে পরস্পর বিরোধী কথা, একজন মুনকার বলছেন, আরেকজন সহীহ বলছেন, কেন বললেন, তিনি বললেন, এই লোকটি মুনকার। আরেকজন বলছেন তিনি সিকা। মানে সম্পূর্ণ উল্টা বক্তব্য। এখন আমিতো সেই জমানায় যাইনি। এই সকল কিতাব লেখা হয়েছে প্রায় ৭ শত শতাব্দির পরে। ঐ সকল গ্রন্থ যখন লেখা হয়েছে, আমিতো সেখানে যেতে পারবো না, না এর ক্ষেত্রে পূর্ণ তদন্ত করতে পারবো। এক্ষেত্রে আমি যদি বলি, যে কেউ তদন্ত করবে, আর একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবে, তাহলে আমি কি সাধারণ মানুষকে একটি বিরাট ধর্মীয় বিভক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছি কি না? এই বিষয়টা একটু পরিস্কার করবেন”।