প্রশ্ন:
কতিপয় আহলে হাদীস ভাইয়েরা প্রচার করে থাকেন যে, ফিক্বহে হানাফীতে মদকে হালাল করা হয়েছে। এ কথা কি সত্য? দলিলসহ জানালে উপকৃত হবো।
জবাব
بسم الله الرحمن الرحيم
ফিক্বহে হানাফী সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিরাই এমন বক্তব্য প্রদান করতে পারে। মদের ব্যাপারে ফিক্বহে হানাফীতে সবচে’ কঠোর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রখ্যাত মুনাজির আল্লামা মুহাম্মদ আমীন সফদর রহঃ এর সাথে জনৈক কথিত আহলে হাদীসের এ ব্যাপারে একটি কথোপথন আশা করি এ ব্যপারে জবাব হিসেবে যথেষ্ট হবে বলে আশা করি। কথোপকথনটি নিম্নরূপ-
লোকটি বলতে লাগল-“ফাতওয়ায়ে আলমগীরীতে মদকে জায়েজ বলা হয়েছে। যেটা বাদশাহের জন্য লেখা হয়েছিল। সেই সাথে শরাবে আবি ইউসুফীর কথা সে কিতাবেই লিখা আছে”।
আমি ফাতওয়ায়ে আলমগীরীর উর্দু অনুবাদ তার সামনে রাখলাম। সেখানে লেখা হল- মদের ব্যাপারে হুকুম হল ৬টি। যথা-
১-সামান্য পান করা বা বেশি পান করা সবই হারাম। এ দিয়ে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করাও হারাম।
২- মদের হারাম হওয়া অস্বিকারকারী কাফের।
৩-যে পদ্ধতিতে মানুষ উপকারীতা অর্জন করে যেমন দান করে, ক্রয়-বিক্রয় করে, এভাবে নিজে মদের মালিক হওয়া বা অন্যকে মালিক বানানোও হারাম।
৪-মদ মূল্যহীন। এর মূল্য সাব্যস্ত করা বাতিল হয়ে গেছে। এমনকি মদ ধ্বংসকারীর জরিমানাও আবশ্যক হবে না। অর্থাৎ যদি কেউ কারো মদের ভান্ড থেকে মদ ঢেলে ফেলে দেয়, তাহলে এর জরিমানা দিতে হবে না।
৫-মদ প্রস্রাব ও রক্তের মতই নাজাসাতে গলীজা।
৬- মদ অল্প বা বেশি পান করুক, তার উপর শরয়ী শাস্তি আরোপিত হবে। {ফাতওয়ায়ে আলমগীরী-৯/৮১২}
আল্লাহ তাআলাকেতো ভয় পাও ভাই! এর নাম কি মদের ব্যাপাওে খোল্লামখোলা সুযোগ দিয়ে রাখা?!
আমাদের কাছে মদ প্রস্রাবের মত নাপাক, অথচ আপনাদের কাছে মদ পাক। দেখুন {নুজুলুল আবরার-১/৪৯}”।
কথিত আহলে হাদীসটি তখন বলতে লাগল- “তাহলে শরাবে আবি ইউসুফীর ঘটনা কি?”।
আমি বললাম- আবি ইউসুফী কোন মদ না, এর নাম হল বুখতুজ বা মুসাল্লাস। যা আলমগীরীতে উল্লেখ আছে। কাযী আবু ইউসুফ রহঃ মৃত্যু বরণ করেছেন ১৮২ হিজরীতে। আর আপনি উদ্ধৃতি দিলেন আলমগীরী থেকে, যেটা লিখা হয়েছে ১১১৮ হিজরীতে। অথচ ৩০৩ হিজরীতে লিখা সিহাহ সিত্তায় শামিল কিতাব সুনানে নাসায়ীর দিকে তাকালেন না। সুনানে নাসায়ীতে লিখা আছে- عنابراهيملابأسبنبيذالبختج অর্থাৎ সির্কা পান করাতে কোন সমস্যা নেই। [সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদীস নং-৫২৫৮, মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-২৪৫২৪}
এবার বলুন- যদি কাযী আবু ইউসুফ রহঃ যদি সে সির্কা পান করতে অনুমতি প্রদান করে থাকেন, তাহলে সেটা কোন হাদীসের বিপরীত? আপনি কি কোন হাদীস বা আয়াত পেশ করতে পারবেন যাতে বুখতুজ পান করাকে হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে?
অথচ বুখারীতে আছে যে, হযরত ওমর রাঃ, হযরত আবু ওবাদা বিন জাররাহ রাঃ, হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ তালায়ে মুসাল্লাস পান করাকে জায়েজ বলেছেন। {উর্দু অনুবাদ সহীহ বুখারী-৩/৩৮০}
কি এসকল হযরাতকেও কি কাযী আবু ইউসুফ রহঃ ফাতওয়া দিয়ে এসেছিলেন নাকি? আপনি শুধুমাত্র একটি রেফারেন্স দিন যে, ফিক্বহে হানাফীতে মদের একটি ফোটা পান করাকে হালাল বা পাক বলা হয়েছে। নতুবা মিথ্যা থেকে তওবা করুন”।
লোকটি বলতে লাগল-“ঠিক আছে, আমি মদের [খমর] শব্দ দেখাচ্ছি আদ দুররুল মুখতারে স্পষ্ট আছে যে, খমর তথা মদেও মাঝে কয়েকবার গমের জুস দিয়ে, তারপর একে শুকানোর দ্বারা এটা পাক হয়ে যায়”।
আমি তাকে আদ দুররুল মুখতার খুলে দেখালাম। সেখানে লিখা আছে যে, যখন গম মদের মাঝে পাকানো হয়, তাহলে এটি কখনো পাক হবে না। এর উপরই ফাতওয়া। {আদ দুররুল মুখতার-১৭২}।
মুর্খতার কারণে আপনি কতটা খিয়ানত করেছেন একবার ভাববেন কি?”
তারপর আমি তাকে নুজুলুল আবরার দেখালাম। বললাম-আপনাদের এখানেতো মদই পাক। মদ দিয়ে পাকানো গম পাক। বরং মদে আটা মিশিয়ে খামিরা বানিয়ে রুটি বানালে সেটা খাওয়াও হালাল”।
এবার লোকটি বলতে লাগল- “আপনাদের হেদায়ায় লিখা আছে যে, মদকে সির্কা বানানো জায়েজ”।
আমি সাথে সাথে তাকে কিতাব খুলে দেখালাম, এ কথা হেদায়ায় লিখার পর সাথে হাদীসও দিয়েছেন।عن جابر ، عن النبي صلى الله عليه وسلم خير خلكم خل خمركم অর্থাৎ হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-উত্তম সির্কা সেটা মদ থেকে বানানো হয়। {মারেফাতুস সুনান ওয়াল আসার লিল বায়হাকী, হাদীস নং-৩৭০৫} আপনাদের এখানেওতো তাই লিখা- اماالخمراذاصارخلافصيرحلالاঅর্থাৎ মদ যখন সির্কা হয়ে যায়, তখন তা হালাল হয়ে যায়। {নুজুলুল আবরার-১/২৮৫}
ঠিক আছে,বুখারী দেখুন! বুখারীতেও আছে-
وقال أبو الدرداء في المري ذبح الخمر النينان والشمس — ( المري . . ) هو خمر يجعل فيه الملح والسمك ويوضع في الشمس فيتغير طعمه والنينان جمع نون وهو الحوت . ومعنى قوله أن الشمس طهرت الخمر وأذهبت خواصها وكذلك السمك والملح أزالا شدتها وأثرا على ضراوتها وتخليلها فأصبحت بذلك حلالا كما أحل الذبح الذبيحة (صحيح البخارى، كتاب الذبائح والصيد، باب قول الله تعالى { أحل لكم صيد البحر } / المائدة)৯৬ /)
অর্থাৎ হযরত আবু দারদা রাঃ বলেছেন যে, মদের মাঝে যদি মাছ দেয়া হয়, তারপর তা সূর্যের তাপে রাখা হয়, তখন সেটা আর মদ থাকে না, অর্থাৎ তখন সেটা সির্কা হয়ে হালাল হয়ে যায়।
বুখারীতো হেদায়ার আগে লেখা হয়েছে। তাহলে প্রথমে প্রশ্ন বুখারীর উপর করা উচিত। তাই নয়কি?’
আল্লাহ তাআলা কথিত আহলে হাদীসদের মিথ্যাচার থেকে জাতিকে হিফাযত করুন। আমীন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।