প্রশ্ন
From: মোঃনেছার উদ্দিন
বিষয়ঃ নামাজে নিয়্যত মুখে উচ্ছারন করা আবশ্যক কিনা?
প্রশ্নঃ
লা মাজহাবি এক ভাই বল্লেন যে,
১
আমরা নামাজে যে নিয়্যত করি তার কোন ভিত্তি নাই এই গুলো সম্পূর্ন বিদায়াত |
২
আমরা ফরজ নামাযের পূর্বে যে সুন্নতে মুয়াক্কাদা নামাজ আদায় করি এই গুলো নাকি আদায় করা না করার বেপারে রুখছত রয়েছে |
৩
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার দলিল কি এবং এই নামাজ গুলোর নাম কোথায় উল্লেখ আছে।
(দয়াকরে আমার এই প্রশ্ন গুলোর জওয়াব দলিল ভিত্তিক পেশ করলে উপকৃত হব ,এই প্রশ্নগুলো আমাদের এলাকায় এখন তর্ক এবং বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে )
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
১
নিয়ত ছাড়া নামায পড়লে নামায আদায় হবে না। নামায হবার জন্য নিয়ত করার শর্ত। তবে মুখে উচ্চারণ করে পড়া জরুরী নয়। বরং মনে মনে নিয়ত করলেই হবে।
عَلْقَمَةَ بْنَ وَقَّاصٍ اللَّيْثِيَّ، يَقُولُ: سَمِعْتُ عُمَرَ بْنَ الخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَلَى المِنْبَرِ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا، أَوْ إِلَى امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا، فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ»
আলকামা ইবনু ওয়াক্কাস আল-লায়সী (রহঃ) থেকে বর্ণিত, আমি উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-কে মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছিঃ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ প্রত্যেক কাজ নিয়তের সাথে সম্পর্কিত। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের অথবা নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে- সেই উদ্দেশ্যেই হবে তার হিজরতের প্রাপ্য। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১]
২
ফরজ নামাযে আগে ও পরের সুন্নাতগুলোর মাঝে পার্থক্য আছে। কিছু সুন্নত মুআক্কাদা। কিছু গায়রে মুআক্কাদা।
গায়রে মুআক্কাদা পড়া ও না পড়ার মাঝে রুখসত তথা সুযোগ আছে। কিন্তু মুআক্কাদা সুন্নাত পড়তে হবে। যদি না পড়ার অভ্যাস করে তাহলে কবীরা গোনাহ হবে।
যেমন ফজরের ফরজের আগের দুই রাকাত, যোহরের আগের চার রাকাত এবং পরের দুই রাকাত, মাগরিব নামাযের পর দুই রাকাত, ইশার নামাযের পর দুই রাকাত নামায এই মোট ১২ রাকাত চব্বিশ ঘন্টায় প্রতিদিন পড়া সুন্নাতে মুআক্কাদা।
এসব নিয়মিত না পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা কবীরা গোনাহ। মাঝে মাঝে কোন কারণে ছেড়ে দিলে গোনাহ হবে না।
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ ثَابَرَ عَلَى ثِنْتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً مِنَ السُّنَّةِ، بُنِيَ لَهُ بَيْتٌ فِي الْجَنَّةِ، أَرْبَعٍ قَبْلَ الظُّهْرِ، وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الظُّهْرِ، وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْمَغْرِبِ، وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْعِشَاءِ، وَرَكْعَتَيْنِ قَبْلَ الْفَجْرِ»
আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি নিয়মিত বারো রাকআত সুন্নাত সালাত (নামায/নামাজ) পড়বে, তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসা’দ নির্মাণ করা হবে। যোহরের (ফরজের) আগে চার রাকআত ও (ফরজের) পরে দু রাকআত, মাগরিবের (ফরজের) পরে দু রাকআত, এশার (ফরজের) পরে দু রাকআত এবং ফজরের (ফরযের) পূর্বে দু রাকআত। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১১৪০, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-১২৫১, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-৪১৪, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৭৩০]
عَنْ أُمِّ حَبِيبَةَ بِنْتِ أَبِي سُفْيَانَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «مَنْ صَلَّى فِي يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ ثِنْتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً، بُنِيَ لَهُ بَيْتٌ فِي الْجَنَّةِ»
আবূ সুফ্ইয়ান কন্যা উম্মু হাবীবা থেকে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি দিনে বারো রাকআত (সুন্নাত) সালাত (নামায/নামাজ) পড়লো, তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসা’দ নির্মাণ করা হয়। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১১৪১, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-১২৫০, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-৪১৫, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৭২৮]
আর যোহরের ফরজের আগে চার রাকাত সুন্নাতে মুআক্কাদা ছাড়াও চার রাকাত পড়া সুন্নাতে গায়রে মুআক্কাদা, আসরের ফরজের আগে চার রাকাত পড়া, মাগরিবের দুই রাকাত সুন্নাতের পর দুই রাকাত পড়া এবং ইশার ফরজের আগে চার রাকাত এবং পরে সুন্নাতের পর আরো দুই রাকাত পড়া সুন্নাতে গায়রে মুআক্কাদা। পড়লে সওয়াব হবে। না পড়লেও কোন গোনাহ নেই।
যদি কোন আহলে হাদীস সুন্নাতে গায়রে মুআক্কাদা নামায না পড়ার উৎসাহ দেয়, তাহলে তাকে বলবেন, তাহলে সে যেন অন্যান্য সুন্নাতের বিষয়েও বাড়াবাড়ি না করে। সেসব ক্ষেত্রেও যেন একই ফাতওয়া প্রদান করে। যেমন-
ক)- আমীন জোরে পড়া তাদের মতে সুন্নাত। সুতরাং তা পড়া ও না পড়া সমান। সুতরাং পড়ে ফিতনা সৃষ্টির দরকার কী?
খ)-রফউল ইয়াদাইন করা তাদের মতে সুন্নাত। সুতরাং তা না করার রুখসত আছে। সুতরাং করে ফিতনা সৃষ্টির দরকার কী?
৩
৫ ওয়াক্ত নামায ফরজ হবার দলীল কুরআনে বিদ্যমান। আর নামগুলো পরিস্কার শব্দে হাদীসে আসছে।
فَسُبْحَانَ اللَّهِ حِينَ تُمْسُونَ وَحِينَ تُصْبِحُونَ (17) وَلَهُ الْحَمْدُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَعَشِيًّا وَحِينَ تُظْهِرُونَ (18
অনুবাদ- সুতরাং তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা কর সন্ধ্যায় [মাগরিব ও ইশার নামায দ্বারা] ও প্রভাতে [ফজর নামায দ্বারা] এবং অপরাহ্নে [আসরের নামাযের দ্বারা] ও যোহরের [যোহরের নামায দ্বারা] সময়। আর আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে সকল প্রশংসা তো তাঁরই। {সূরা রূম-১৭-১৮}
সূরা রূমের উক্ত আয়াতে একই সাথে ৫ ওয়াক্ত নামাযের সময় আল্লাহর পবিত্র ও মহিমা প্রকাশের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর পবিত্রতা ও মহিমা প্রকাশের সর্বোত্তম মাধ্যম যে নামায একথা সর্বজন স্বীকৃত বিষয়। {তাফসীরে রূহুল মাআনী-৮/২৯, মাআরিফুল কুরআন-৬ খন্ড, ২১ পারা, পৃষ্ঠা- ৪০)
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَمَّنِي جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلَام عِنْدَ الْبَيْتِ مَرَّتَيْنِ، فَصَلَّى بِيَ الظُّهْرَ حِينَ زَالَتِ الشَّمْسُ وَكَانَتْ قَدْرَ الشِّرَاكِ، وَصَلَّى بِيَ الْعَصْرَ حِينَ كَانَ ظِلُّهُ مِثْلَهُ، وَصَلَّى بِيَ يَعْنِي الْمَغْرِبَ حِينَ أَفْطَرَ الصَّائِمُ، وَصَلَّى بِيَ الْعِشَاءَ حِينَ غَابَ الشَّفَقُ، وَصَلَّى بِيَ الْفَجْرَ حِينَ حَرُمَ الطَّعَامُ وَالشَّرَابُ عَلَى الصَّائِمِ، فَلَمَّا كَانَ الْغَدُ صَلَّى بِيَ الظُّهْرَ حِينَ كَانَ ظِلُّهُ مِثْلَهُ، وَصَلَّى بِي الْعَصْرَ حِينَ كَانَ ظِلُّهُ مِثْلَيْهِ، وَصَلَّى بِيَ الْمَغْرِبَ حِينَ أَفْطَرَ الصَّائِمُ، وَصَلَّى بِيَ الْعِشَاءَ إِلَى ثُلُثِ اللَّيْلِ، وَصَلَّى بِيَ الْفَجْرَ فَأَسْفَرَ» ثُمَّ الْتَفَتَ إِلَيَّ فَقَالَ: «يَا مُحَمَّدُ، هَذَا وَقْتُ الْأَنْبِيَاءِ مِنْ قَبْلِكَ، وَالْوَقْتُ مَا بَيْنَ هَذَيْنِ الْوَقْتَيْنِ»
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বাইতুল্লাহর নিকট জিবরীল (আঃ) দু’বার আমার সলাতে ইমামতি করেছেন। (প্রথমবার) সূর্য (পশ্চিম আকাশে) ঢলে যাওয়ার পর আমাকে নিয়ে তিনি যুহর সলাত আদায় করলেন। তখন (পূর্ব দিকে) জুতার ফিতার সমান ছায়া দেখা দিয়েছিল। অতঃপর তিনি আমাকে নিয়ে ‘আসরের সলাত আদায় করলেন, যখন (প্রত্যেক বস্তুর) ছায়া তার সমান হয়। এরপর আমাকে নিয়ে তিনি মাগরিবের সলাত আদায় করলেন, যখন সিয়াম পালনকারী ইফতার করে থাকে। এরপর তিনি আমাকে নিয়ে ‘ইশার সলাত আদায় করলেন, যখন শাফাক্ব (লাল শুভ্র রং) অন্তর্হিত হয় এবং ফজরের সলাত আদায় করলেন, যখন সিয়াম পালনকারীর জন্য পানাহার হারাম হয়ে যায়।
(দ্বিতীয়বারে) পরের দিন তিনি আমাকে নিয়ে যুহরের সলাত আদায় করলেন, (প্রত্যেক বস্তুর) ছায়া যখন সমান হলো। তিনি আমাকে নিয়ে ‘আসর সলাত আদায় করলেন, যখন ছায়া তার দ্বিগুণ হলো। তিনি আমাকে নিয়ে মাগরিবের সলাত আদায় করলেন, যখন সিয়াম পালনকারীর ইফতারের সময় হয়। তিনি আমাকে নিয়ে ‘ইশা সলাত আদায় করলেন রাতের তৃতীয়াংশে এবং ফজর সলাত আদায় করলেন ভোরের আলো ছড়িয়ে যাওয়ার পর। অতঃপর জিবরীল (আঃ) আমার দিকে ফিরে বললেন, হে মুহাম্মাদ! এটাই হচ্ছে আপনার পূর্ববর্তী নাবীগণের সলাতের ওয়াক্ত এবং সলাতের ওয়াক্তসমূহ এই দু’ সময়ের মাঝখানেই নিহিত। [সুনানে আবু দাউদ,হাদীস নং-৩৯৩, তাহাবী শরীফ, হাদীস নং-৯০০, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৩০৮১, আলমু’জামুল কাবীর লিততাবারানী, হাদীস নং-১০৭৫২]
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউন এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
ইমেইল– [email protected]