প্রশ্ন
মুসলিম শরীফের দু’টি হাদীসের ব্যাখ্যা জানতে চাই। হাদীস দু’টি হল,
ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি একদিন বলেন, বৃহস্পতিবার দিন, আর কি সে বৃহস্পতিবার দিন! এরপর তার অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকে। এমন কি, আমি দেখলাম যে, তাঁর দু’গণ্ডের উপরে যেন মুক্তার লহরী। রাবী বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমার নিকট হাড় ও দোয়াত নিয়ে আস, অথবা বলেছেন, কাঠফলক ও দোয়াত। আমি তোমাদের এমন একটা কিতাব লিখে (পত্র) দিব যে,এরপর আর তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। অতঃপর তারা বললো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্থহীন কথা বলেছেন? [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৬৩৭, ইফাবা-৪০৮৭]
ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুশয্যায় ছিলেন এবং ঘরে বেশ লোক উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে উমর ইবনু খাত্তাবও ছিলেন। তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এসো, আমি তোমাদের এক কিতাব (পত্র) লিখে দেই। এরপরে আর তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। উমার (রাঃ) বললেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তোমাদের কাছে কুরআন বর্তমান আছে। আল্লাহর কিতাবই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তখন ঘরের লোকজনের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয় এবং তারা ঝগড়ায় লিপ্ত হন।
তাদের কেউ কেউ বলেন, তোমরা (কাগজ) কাছে নিয়ে এসো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের এমন এক কিতাব লিখে দিবেন, যার পরে আর তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। আর কেউ কেউ সে কথাই বলেন, যা উমার (রাঃ) বলেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে যখন তাদের এ ঝগড়া ও কথা কাটাকাটি বৃদ্ধি পায়, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা উঠে যাও। উবায়দুল্লাহ (রহঃ) বলেন, এরপর থেকে ইবনু আব্বাস (রাঃ) আক্ষেপ করে বলতেন, বিপদ কত বড় বিপদ! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাদের জন্য সেই কিতাব লিখে দেওয়ার মাঝখানে তাদের মতবিরোধ ও ঝগড়া যে অন্তরায় হয়ে পড়ল। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৬৩৭, ইফাবা-৪০৮৮]
Name : Mohammed Saiful Islam
Country : Bangladesh
Jazakallhul Khair……..
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
উক্ত হাদীস দু’টিতে যে ঘটনাটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ এসেছে, সেটিকে ‘কিরতাস’ এর ঘটনা নামে প্রসিদ্ধ।
ঘটনাটি কখন ঘটে?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃত্যুপূর্ব অসুস্থ্যতা যখন তীব্র আকার ধারণ করে। ১১ হিজরীর রবিউল আউয়ালের প্রথম দশকের কোন এক বৃহস্পতিবার ঘটনাটি সংঘটিত হয়।
ঘটনাটির পরের সোমবার তথা ৪দিন পরেই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেন।
কিরতাস ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
বিশুদ্ধ বর্ণনায় ঘটনার যে সংক্ষিপ্ত কিন্তু পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়, সেটি হল,
ابْنَ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، يَقُولُ: يَوْمُ الخَمِيسِ وَمَا يَوْمُ الخَمِيسِ، ثُمَّ بَكَى حَتَّى بَلَّ دَمْعُهُ الحَصَى، قُلْتُ يَا أَبَا عَبَّاسٍ: مَا يَوْمُ الخَمِيسِ؟ قَالَ: اشْتَدَّ بِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَجَعُهُ، فَقَالَ: «ائْتُونِي بِكَتِفٍ أَكْتُبْ لَكُمْ كِتَابًا لاَ تَضِلُّوا بَعْدَهُ أَبَدًا»، فَتَنَازَعُوا، وَلاَ يَنْبَغِي عِنْدَ نَبِيٍّ تَنَازُعٌ، فَقَالُوا: مَا لَهُ أَهَجَرَ اسْتَفْهِمُوهُ؟ فَقَالَ: «ذَرُونِي، فَالَّذِي أَنَا فِيهِ خَيْرٌ مِمَّا تَدْعُونَنِي إِلَيْهِ»، فَأَمَرَهُمْ بِثَلاَثٍ، قَالَ: «أَخْرِجُوا المُشْرِكِينَ مِنْ جَزِيرَةِ العَرَبِ، وَأَجِيزُوا الوَفْدَ بِنَحْوِ مَا كُنْتُ أُجِيزُهُمْ» وَالثَّالِثَةُ خَيْرٌ، إِمَّا أَنْ سَكَتَ عَنْهَا، وَإِمَّا أَنْ قَالَهَا فَنَسِيتُهَا،
সা‘ঈদ ইবনু জুবাইর (রহ.) হতে বর্ণিত যে, তিনি ইবনু ‘আববাস (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ বৃহস্পতিবার! তুমি জান কি বৃহস্পতিবার কেমন দিন? এ বলে তিনি এমনভাবে কাঁদলেন যে, তাঁর অশ্রুতে কঙ্কর ভিজে গেল। আমি বললাম, হে ইবনু ‘আববাস (রাঃ)! বৃহস্পতিবার দিন কী হয়েছিল? তিনি বললেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রোগকষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, আমার নিকট গর্দানের হাড় নিয়ে এস, আমি তোমাদের জন্য এমন একটি লিপি লিখে দিব অতঃপর তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তখন উপস্থিত সহাবীগণের বাদানুবাদ হল। অথচ নাবীর সামনে বাদানুবাদ করা শোভনীয় নয়। সহাবীগণ বললেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কী হয়েছে? তিনি কি বলতে ভুলে গেলেন? তোমরা আবার জিজ্ঞেস করে দেখ। তখন তিনি বললেন, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি যে অবস্থায় আছি, তা তোমরা আমাকে যেদিকে ডাকছ তার চেয়ে উত্তম। অতঃপর তিনি তাঁদের তিনটি বিষয়ে আদেশ দিলেন। (১) মুশরিকদের আরব উপদ্বীপ হতে বের করে দিবে, (২) বহিরাগত প্রতিনিধিদের সেভাবে উপঢৌকন দিবে যেভাবে আমি তাদের দিতাম। তৃতীয়টি উত্তম ছিল হয়ত তিনি সে ব্যাপারে নীরব থেকেছেন, নতুবা তিনি বলেছিলেন, আমি ভুলে গিয়েছি। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩১৬৮, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৬৩৭, মুসনাদুল হুমায়দী, হাদীস নং-৫৩৬, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৯৩৫, মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদীস নং-২৪০৯, তারীখে তাবারী-৩/১৯২-১৯৩, আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৫/২৪৭]
এভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন কিছু লিখে দেবার ইচ্ছে মুলতবী করে দেন। মুখে অসিয়ত করেই দায়িত্ব শেষ করেন।
এই হল, কিরতাস ঘটনার প্রাথমিক অবস্থা।
খাতা কলম এনে লিখতে চাওয়ায় উপস্থিত সাহাবাগণের মাঝে মতবিরোধ হয় এজন্য যে, হযরত উমর রাঃ সহ উপস্থিত কিছু সাহাবা নবীজীর অসুস্থ্যতা বেশি হওয়ায় কাগজ কলমে লিপিবদ্ধ করাতে নবীজীর কষ্ট হবে বলে তা করতে আপত্তি জানান। আবার কিছু সাহাবী নবীজীর হুকুম অনুপাতে কাগজ কলম আনার পক্ষপাতি ছিলেন। তখন কিছুটা বাদানুবাদ হয়। এতেই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিরক্ত হয়ে উপস্থিত সবাইকে চলে যেতে বলেন। [সীরাতে মুস্তাফা, ইদ্রিস কান্ধলবীকৃত-৩/১৫৮]
তারপর আবার মৌখিক তিনটি অসিয়তের মাধ্যমে তার লিখিত অসিয়তের দায়িত্বটি আঞ্জাম দেন। যদিও তৃতীয় অসিয়তটি নবীজী বলেননি, বা রাবী ভুলে গেছে।
তবে কেউ কেউ বলেন, তৃতীয় কথাটি ছিল, কুরআনের উপর আমল করা। বা উসামা রাঃ এর বাহিনীকে রওনা করা। বা আমার মৃত্যুর পর কবরকে সেজদার স্থান না বানানো, অথবা নামাযের পাবন্দী করা কিংবা গোলামদের প্রতি যত্নবান হওয়া। [ফাতহুল বারী-৮/১০৩]
সকলে চলে যাবার পর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেন। এতে করে কিছুটা প্রশান্তি লাভ করেন। অসুস্থ্যতাও কিছুটা হ্রাস পায়। তখন তিনি বলেন, আমার মাথায় সাত মশক পানি ঢালো। যাতে করে কিছুটা আরাম অনুভব করি এবং লোকদের অসিয়ত করতে পারি’।
আদেশ অনুপাতে মাথায় সাত মশক পানি ঢালা হয়। [আলইতহাফ শরহু ইহয়াউল উলুম-২/২৮৮, আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৫/২২৯,৫/২৪৯]
এভাবে পানি ঢালার দ্বারা শরীর কিছুটা প্রশান্তি লাভ করে। তখন যোহরের সময় সন্নিকটে ছিল। তিনি আব্বাস রাঃ এবং হযরত আলী রাঃ সহযোগিতায় মসজিদে নববীতে আসেন এবং নামাযে ইমামতী করেন।
বৃহস্পতিবারের উক্ত যোহরের নামায শেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলের উদ্দেশ্যে একটি খুতবা প্রদান করেন। যা ছিল নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের সর্বশেষ খুতবা। [আলবিদায় ওয়াননিহায়া-৫/২২৭, ইফাবা-৫/৩৮২]
উক্ত খুতবায় তিনি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করেন এবং হযরত আবূ বকর রাঃ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব এবং ফযীলত উল্লেখ করেন। যেমন-
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ قَالَ: خَطَبَ رسول الله النَّاس فَقَالَ: إِنَّ اللَّهَ خَيَّرَ عَبْدًا بَيْنَ الدُّنْيَا وَبَيْنَ مَا عِنْدَهُ فَاخْتَارَ ذَلِكَ الْعَبْدُ مَا عِنْدَ اللَّهِ.
قَالَ: فَبَكَى أَبُو بَكْرٍ.
قَالَ: فَعَجِبْنَا لِبُكَائِهِ أَنْ يُخْبِرَ رَسُولَ اللَّهِ عن عبد، فكان رسول الله هُوَ المخيَّر وَكَانَ أَبُو بَكْرٍ أَعْلَمَنَا بِهِ.
فقال رسول الله: إِنَّ أمنَّ النَّاس عَلَيَّ فِي صُحْبَتِهِ وَمَالِهِ أَبُو بَكْرٍ، لَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا خَلِيلًا غَيْرَ ربي لَاتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ خَلِيلًا، وَلَكِنْ خُلَّةُ الْإِسْلَامِ وَمَوَدَّتُهُ لَا يَبْقَى فِي الْمَسْجِدِ بَابٌ إِلَّا سُدَّ إِلَّا بَابَ أَبِي بَكْرٍ
হযরত আবূ সাঈদ রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদের সামনে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, আল্লাহ একজন বান্দাকে দুনিয়া এবং তাঁর (আল্লাহর) কাছে যা রয়েছে তার মাঝে (পছন্দ ও বাছাই করার) এখতিয়ার দিলে সে বান্দা আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা পছন্দ করল”।
বর্ণনাকারী বলেন, ‘এতে আবূ বকর রাঃ কেঁদে দিলেন”। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা তার কান্না দেখে বিস্মিত হলাম এ কারণে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো কোন বান্দা সম্পর্কে খবর দিচ্ছিলেন (তাতে কান্নার কি রয়েছে? পরে বুঝা গেল যে,) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই হলেন সেই এখতিয়ারপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং আবূ বকর রাঃ ছিলেন এ বিষয়ে আমাদের মাঝে সর্বাধিক বিজ্ঞ।
পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“সংসর্গ ও সঙ্গদানে এবং সম্পদ দিয়ে আমার প্রতি সর্বাধিক ইহসান অনুগ্রহকারী ব্যক্তি হলেন আবূ বকর। আমার প্রতিপালক ব্যতীত অন্য কাউকে যদি আমি খলীল ও অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম, তাহলে আবূ বকরকেই করতাম। তবে হ্যাঁ, ইসলামী বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতি। মসজিদের দিকের কোন দরজা বন্ধ করে দেয়া ব্যতিরেকে থাকবে (সকল দরজাই বন্ধ করে দেয়া হবে)। তবে আবূ বকরের দরজা ব্যতীত। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৫/২৪৯,৫/২২৯, ইফাবা-৫/৩৮০, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১১১৩৪, মুসন্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-৩১৯২৬, তারীখুল ইসলাম, ইমাম যাহাবীকৃত-১/৫৪৯, ১/৩৭০]
ইমাম ইবনে কাসীর রহঃ উক্ত আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেনঃ
وَفِي قوله عليه السلام سدوا عنى كل خوخة- يعنى الأبواب الصغار- إِلَى الْمَسْجِدِ غَيْرَ خَوْخَةِ أَبِي بَكْرٍ إِشَارَةٌ إِلَى الْخِلَافَةِ أَيْ لِيَخْرُجَ مِنْهَا إِلَى الصَّلَاةِ بِالْمُسْلِمِينَ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশ বাণী “আবূ বকরের দরজা ব্যতীত মসজিদমূখী সব দরজা অর্থাৎ ছোট দরজাসমূহ বন্ধ করে দাও”। এতে করে তার খিলাফতের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে অর্থাৎ যাতে তিনি মুসলমানদের নিয়ে সালাতে ইমামতের জন্য বেরিয়ে আসতে পারেন। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৫/২৩০, ৫/২৫০, ইফাবা-৫/৩৮২]
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা বুঝা যায় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিরতাসের হাদীসের মাধ্যমে তার পরবর্তী খলীফা হযরত আবূ বকর রাঃ কে নিযুক্ত করতে চেয়েছেন। যা ইতোপূর্বের বিশুদ্ধ বর্ণনার মাধ্যমে প্রমাণিত।
কিন্তু শিয়া ধর্মাবলম্বীরা কিরতাসের ঘটনা উদ্ধৃত করে জল ঘোলা করার অপচেষ্টা করে যায়। এ বিষয়ে ইবনে কাসীর রহঃ লিখেন,
وَهَذَا الْحَدِيثُ مِمَّا قَدْ تَوَهَّمَ بِهِ بَعْضُ الْأَغْبِيَاءِ مِنْ أهل البدع من الشيعة وغيرهم كل مدع أَنَّهُ كَانَ يُرِيدُ أَنْ يَكْتُبَ فِي ذَلِكَ الكتاب ما يرمون إِلَيْهِ مِنْ مَقَالَاتِهِمْ، وَهَذَا هُوَ التَّمَسُّكُ بِالْمُتَشَابِهِ. وَتَرْكُ الْمُحْكَمِ وَأَهْلُ السُّنَّةِ يَأْخُذُونَ بِالْمُحْكَمِ. وَيَرُدُّونَ مَا تَشَابَهَ إِلَيْهِ، وَهَذِهِ طَرِيقَةُ الرَّاسِخِينَ فِي الْعِلْمِ كَمَا وَصَفَهُمُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ فِي كِتَابِهِ، وَهَذَا الْمَوْضِعُ مِمَّا زَلَّ فِيهِ أَقْدَامُ كَثِيرٍ مِنْ أَهْلِ الضَّلَالَاتِ، وَأَمَّا أَهْلُ السُّنَّةِ فَلَيْسَ لَهُمْ مَذْهَبٌ إِلَّا اتِّبَاعُ الْحَقِّ يَدُورُونَ مَعَهُ كَيْفَمَا دَارَ، وَهَذَا الَّذِي كَانَ يُرِيدُ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ أَنْ يَكْتُبَهُ قَدْ جَاءَ فِي الْأَحَادِيثِ الصَّحِيحَةِ التَّصْرِيحُ بِكَشْفِ الْمُرَادِ مِنْهُ
শীয়া ও অন্যান্য বাতিলপন্থী কতক স্থুল মেধার পণ্ডিত এ হাদীসের সূত্র ধরে কল্পনার জগতে বিচরণ করতে শুরু করেছে। তাদের প্রত্যেকে দাবী হল, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ পত্রে এমন একটি বিষয় লিখে দিতে চেয়েছিলেন যা তাদের উর্বর মস্তিস্কের কল্পনা প্রসূত ও তাদের নিজেদের পছন্দমাফিক তারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে আরোপ করেছেন। এসব দাবী মূলত মুতাশাবিহ তথা অস্পষ্ট বিষয়ে দিয়ে প্রমাণিতকরণ এবং মুহকাম তথা সুষ্পষ্ট বিষয় বর্জনের প্রয়াস মাত্র (যা বৈধ পন্থা নয়)।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত (ন্যায়পন্থী সুন্নাহ অনুসারী বিদ্বান ও গবেষকবর্গ) মুহকামকে প্রমাণরূপে গ্রহণ করে মুতাশাবিহকে মুহকামের সাথে সম্পৃক্ত ও সমন্বিত করে থাকেন। মহান গ্রন্থে মহান ও মহিয়ান আল্লাহ পাকের দেয়া বর্ণনা অনুসারে এটাই শরীয়তের ইলমে প্রজ্ঞাবান ও দৃঢ়তাসমৃদ্ধ বিজ্ঞজনের অনুসৃত পন্থা। এক্ষেত্রটিতে এসে পদস্খলন ঘটেছে অনেক নামীদামী বাতিলপন্থী ও বিভ্রান্ত মতাবলম্বীর। তবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মত মত ও পন্থা হল, সত্য ও ন্যায় পথের অনুসরণ করা এবং সত্য ও ন্যায়ের আবর্তনের সাথে আবর্তিত হতে থাকা।কেননা, বাস্তব বিচারে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা লিখিয়ে দেয়ার ইচ্ছে করেছিলেন, তা তার উদ্দেশ্যের স্পষ্ট অভিব্যক্তিসহ বিভিন্ন সহীহ হাদীসে প্রাঞ্জল ভাষায় বিবৃত হয়েছে। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৫/২২৮, ৫/২৪৮, ইফাবা-৫/৩৭৬-৩৭৭]
উপরোক্ত খুতবাটি দেবার পর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আয়শা রাঃ কে বললেন যে, তোমার পিতা আবু বকর এবং তোমার ভাই আব্দুর রহমানকে ডাকো। যেন আবু বকরের নামে আমি লিখিত দিয়ে দেই। যাতে করে খলীফা হবার আকাঙ্খী আর কেউ খলীফা হবার আকাঙ্খা না করে।
এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় ইচ্ছে পরিত্যাগ করে বলেন, আল্লাহ ও ঈমানদারগণতো আবূ বকরের নেতৃত্ব ব্যতীত অন্য কারো নেতৃত্ব প্রত্যাখ্যান করবেন। সুতরাং লিখে যাবার কোন দরকার নেই।
আয়শা রাঃ বলেন, (বাস্তবে হলও তা-ই) আল্লাহ তাআলা তা রহিত করলেন এবং ঈমানদারগণও তা প্রত্যাখ্যান করলেন। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-,৫/২২৮, ইফাবা-৫/৩৭৭, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৫১১৩, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৩৮৭, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৬৫৯৮]
সুতরাং বুঝা গেল যে, ‘কিরতাসের মাঝে হযরত আলী রাঃ কে পরবর্তী খলীফা ঘোষণা করতে চেয়েছেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কারণে অন্যান্য সাহাবীগণ তা লিখতে বারণ করেছেন’ এটা একটি অহেতুক ও বানোয়াট কথা। যার কোন সহীহ ভিত্তি নেই।
বরং বিশুদ্ধ কথা হল, কিরতাসের মাঝে কি লেখাতে চেয়েছেন তা মুতাশাবিহ হলেও পরবর্তী খুতবার মাধ্যমে পরিস্কার হয়ে যায় যে, হযরত আবূ বকর রাঃ কেই পরবর্তী খলীফা হিসেবে ঘোষণা করতে চেয়েছেন।
তাছাড়া নবীজীর জীবদ্দশায় নামাযের ইমামতি করতে দেয়া পরবর্তী খলীফা হবার দিকেই ইশারা করে।
সকল ছোট দরজা বন্ধ করে মসজিদের দিকে শুধু আবূ বকর রাঃ এর দরজা খুলে দেয়াও তাকে খলীফা হিসেবে নিযুক্তিকেই বুঝায়।
কিরতাসের ঘটনা হয়েছে বৃহস্পতিবার দিন। তারপর আরো ৪দিন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবিত ছিলেন। যদি হযরত আলী রাঃ এর খিলাফতের কথাই লিখাতে চেয়ে থাকতেন, তাহলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহরের নামাযের খুতবায় একথা কেন বলেননি?
বাকি ৪দিনের মাঝে কেন তা লিখিয়ে যাননি?
এর মানে এ দাবীটি শিয়াদের উর্বর মস্তিস্কের কল্পনা ছাড়া কিছু নয়।
আশা করি উপরোক্ত আলোচনার আলোকে মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীস দু’টির সঠিক মর্মার্থ উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক ও প্রধান মুফতী-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
ইমেইল– [email protected]