প্রচ্ছদ / কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা / সূরা জাসিয়ার ২৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা এবং শিরকের প্রকারভেদ প্রসঙ্গে

সূরা জাসিয়ার ২৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা এবং শিরকের প্রকারভেদ প্রসঙ্গে

প্রশ্ন

আস সালামু আলাইকুম,

নামঃ হাবিব

দেশঃ বাংলাদেশ

প্রশ্নের বিষয়ঃ  পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে,

আয়াতটি সূরা জাসিয়াহ এর ২৩ নং আয়াত থেকে নেয়া হয়েছে

এর বাংলা অর্থঃ “তুমি কি তবে তাকে লক্ষ্য করেছ যে তার খেয়াল খুশিকে তার উপাস্য রূপে গ্রহণ করেছে ?”

আমরা জানি, যিনা নিঃসন্দেহে একটি জঘন্য অপরাধ। আমার প্রশ্নটি হল,এই আয়াতের অর্থ অনুযায়ী কে যিনা এক ধরণের শিরক কিনা ? কারণ এখানে নিজের চাওয়াকে প্রাধান্য দেয়া হয়ে যায়।

আপনাদের একটি লেখা ছিল, শিরকের বিভিন্ন প্রকারভেদ নিয়ে… বিভিন্ন ওয়েবসাইটে গেলে শিরকের ব্যাপারে আরো ২ টি বিষয় দেখা যায় অতিরিক্ত…

১) বড় শিরক আর ছোট শিরক, এই দুটো ব্যাপারের পার্থক্য জানতে চাই…

২) শিরক আল মাহাব্বাহ, বা ভালোবাসার শিরক… অন্য কাউকে বা ক্নো কিছুকে আল্লাহর সমান বা বেশি ভালোবাসা, প্রশ্নটি হচ্ছে কোন ব্যক্তি কোন একটি কাজের জন্য আল্লাহর একটি আদেশ অমান্য করে ফেললে কি সেটি শিরক হবে ? (নিঃসন্দেহে ব্যাক্তির কাজটি অনেক বড় অপরাধ, প্রশ্নটি হচ্ছে এটি শিরক হচ্ছে কিনা ? যদি হয়ে থাকে তবে সেটি বড় না ছোট শিরকের অন্তর্ভূক্ত ?

আপনাদের অসাধারণ কাজের জন্য ধন্যবাদ… আল্লাহ আপনাদের সহায় হউন।

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

প্রথমে আমরা আয়াতটি দেখে নেই।

أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَى بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَنْ يَهْدِيهِ مِنْ بَعْدِ اللَّهِ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ (23)

অনুবাদ- তুমি কি দেখেছো তাকে, যে তার খেয়াল-খুশিকে নিজ মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে এবং জ্ঞান বিদ্যমান থাকা সত্বেও আল্লাহ তাকে গোমরাহীতে নিক্ষেপ করেছেন এবং তার কান ও অন্তরে মোহর করে দিয়েছেন আর তার চোখের উপর পর্দা ফেলে দিয়েছেন? অতএব, আল্লাহর পর এমন কে আছে, যে তাকে সুপথে নিয়ে আসবে? তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না। {সূরা জাসিয়া-২৩}

আয়াতে বর্ণিত খেয়াল খুশিকে মাবুদ বানিয়ে নেয়ার অর্থ কি?

মৌলিকভাবে এখানে স্বীয় খেয়াল খুশির অনুসরণকে সত্যিকার মাবুদ বলা হয়নি। কারণ কোন কাফের মুশরিকও নিজের খেয়াল খুশিকে মাবুদ বিশ্বাস করে না। তাহলে এটি মাবুদ হল কি করে?

আসলে এখানে মাবুদের একটি সিফাতের ক্ষেত্রে মিল বলা হয়েছে। সেটি হল, মাবুদ যিনি হন, তার অনুসরণ করা হয়ে থাকে। আর আমাদের সকলের মাবুদ হলেন আল্লাহ তাআলা। সুতরাং আমাদের সবার তারই অনুসরণ করা উচিত। কিন্তু কেউ যদি আল্লাহ তাআলার আদেশ নিষেধ অমান্য করে নিজের খেয়াল খুশির অনুসরণ করে, তাহলে এ অনুসরণ করা হিসেবে সে তার খেয়াল খুশিকে মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে। কারণ মাবুদই কেবল অনুসরণীয় হয়ে থাকেন। আর এখানে যেহেতু লোকটি তার খেয়াল খুশির অনুসরণ করছে, তাই যেন খেয়াল খুশিকে তার মাবুদ মনে করছে। যদিও সত্যিকারর্থে সে মাবুদ মনে করছে না। কিন্তু তার কার্যকলাপে খেয়াল খুশিটি মাবুদের স্থলেই চলে আসছে। {তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন-৭/১২৯, আশরাফিয়া বুক ডিবো দেওবন্দ, তাফসীরে মাযহারী-৮/৩২২, জাকারিয়া বুক ডিপো দেওবন্দ}

তাফসীর দ্বারা কি বুঝা গেল? আসলে খেয়াল খুশির অনুসরণ হাকীকী অর্থে মাবুদ বানানো নয়। বরং মাবুদের যেমন অনুসরণ করা হয়, তেমনি নফসের অনুসরণ করে মাবুদ অনুসরণের মত কাজ করেছে। এটি শিরকে আকবার তথা মৌলিক শিরক নয়। বরং বাহ্যিকভাবে শিরকের মতই মনে হয়।

যেমন রাসূল সাঃ এক হাদীসে বলেছেন, مَنْ تَرَكَ الصَّلَاةَ فَقَدْ كفرযে ব্যক্তি নামায ছেড়ে দিল সে কুফরী করল। {সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-১৪৬৩}

এর মানে কি? ইচ্ছেকৃত নামায কাযা করলে ব্যক্তি কাফের হয়ে যাবে? কস্মিনকালেও নয়। বরং সে কাফেরের মত কাজ করেছে। কাফেরের মত কাজ করলেই কেউ কাফের হয়ে যায় না।

যেমন আমরা ধোপা নই, তবু আমরা কাপড় পরিস্কার করি। এ কাপড় পরিস্কার করার দ্বারা আমরা ধোপার মত কাজ করি, কিন্তু আমরা ধোপা হয়ে যাই না। তেমনি আমরা ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করি। এ ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করার কারণে কিন্তু আমরা মেথর হয়ে যাই না। কিন্তু কাজটি মেথরের।

ঠিক তেমনি গোনাহের কাজ মনের খেয়াল খুশিমত করার দ্বারা খেয়াল খুশিকে মাবুদের মত আচরণ করা হয়, কিন্তু এটি সত্যিকার শিরক হয়ে যায় না যদিও কাজটি জঘন্য এবং মারাত্মক অপরাধ।

তবে এক্ষেত্রে স্মর্তব্য হল, যদি কেউ হারাম কাজকে হালাল মনে করে সম্পাদন করে তাহলে লোকটি কাফের হয়ে যায়। যেমন যিনা যদি কেউ হালাল মনে করে করে থাকে, তাহলে লোকটি কাফের হয়ে যায়। তার ঈমান দোহারানো আবশ্যক। কিন্তু গোনাহকে গোনাহ মনে করে করার দ্বারা গোনাহ হয়, বা কাজটি কুফরীর মত হয়, কিন্তু লোকটি কাফের হয়ে যায় না।

বিশেষজ্ঞগণ অনেকভাবেই শিরকের প্রকার করেছেন। এর মাঝে এটিও একটি প্রকার যে, শিরক দুই প্রকার। তথা-

১-শিরকে আকবর তথা বড় শিরক বা মৌলিক শিরক। এটি আবার কয়েক প্রকার। যা শিরক সংক্রান্ত প্রশ্œোত্তরে অতিক্রান্ত হয়েছে। যেমন সেখানে লেখা হয়েছিল-

শিরকের তিন সূরত

১-শিরক ফিজজাত

শিরক ফিজজাত। তথা আল্লাহ আল্লাহ তাআলা সত্বায় কাউকে শরীক করা। আরেক শব্দে বললে বলা যায় যে, আল্লাহ তাআলার সত্বার মাঝে কাউকে অংশিদার সাব্যস্ত করা। যেমন এক আল্লাহর বদলে দুই আল্লাহ বা তিন আল্লাহ বা একাধিক আল্লাহ বিশ্বাস করা। আল্লাহ তাআলার জন্য সন্তান, স্ত্রী, পিতা-মাতা ইত্যাদি সাব্যস্ত করা। যেমন খৃষ্টান ও হিন্দুদের আক্বিদা। এসবই শিরক ফিত তাওহীদ।

২-শিরক ফিস সিফাত 

শিরক ফিসসিফাত হল আল্লাহ তাআলার সাথে খাস সিফাত বা গুণের মাঝে কাউকে অংশিদার মনে করা। যা কিছু করার সম্পূর্ণ ক্ষমতা আল্লাহ তাআলা নিজের হাতে রেখেছেন সেটার মাঝে কোন বান্দা বা অন্য কোন সৃষ্টিকে অংশিদার মনে করা।

যেমন গোনাহ মাফ করা, রিজিক দেয়া, সন্তান দেয়া, সুস্থ্যতা দেয়া, অসুস্থ্যতা দেয়া, হিদায়াত দেয়া ইত্যাদি। এসবের মাঝে যেকোন ব্যক্তিকে চাই উক্ত ব্যক্তি আল্লাহর কোন প্রিয় বান্দাই হোক না আল্লাহ তাআলার এসব খাস সিফাতে শরীক বা অংশিদার মনে শিরক ফিসসিফাত।

 

৩-শিরক ফিলহুকুক

শিরক ফিলহুকুক তথা আল্লাহ তাআলার সাথে খাস হককে কোন বান্দা বা কোন সৃষ্টির জন্য মনে করা শিরক ফিলহুকুক। যেমন ইবাদত, সেজদা, রোজা, দুআ, কুরবানী, জবাই, মান্নত এবং কসম ইত্যাদি সবই আল্লাহ তাআলার সাথে খাস হক। এসব হকের মাঝে কাউকে শরীক করা। অর্থাৎ এসব আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন বান্দা বা সৃষ্টির নামে করা শিরক ফিলহুকুক।

এই প্রকারের শিরক যারা করেন, তারা মুসলমানিত্ব থেকে খারিজ হয়ে যান। তওবা করে পুনরায় মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করলে তার জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী জাহান্নাম।

২-

শিরকে আসগার তথা ছোট শিরক বা শিরকের মত কাজ।

এ প্রকার ব্যক্তিগণ ইসলাম থেকে বের হয়ে যান না। তবে কাজটি জঘন্য ও মারাত্মক। যেমন নিজের খেয়াল খুশির অনুসরণ করা। অন্যকে দেখানোর জন্য আমল করা, জোতিষ বিশ্বাস করা ইত্যাদি।

উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা আশা করি পরিস্কার হয়েছে যে, শিরকে আসগরকারী মুসলমানিত্ব থেকে খারিজ হয়ে যান না। এবং এটি মৌলিক শিরকের অন্তর্ভূক্ত নয়। বরং এটি শিরকের মত কাজ। তাই যিনা করা, আল্লাহর হুকুম অমান্য করা, আল্লাহ ছাড়া কাউকে অধিক মোহাব্বত করা ইত্যাদি শিরকে আসগারের অন্তর্ভূক্ত। শিরকে আকবরের অন্তর্ভূক্ত। এমন কাজ যারা করেন, তারা গোনাহগার, কিন্তু মুসলমানিত্ব থেকে খারিজ হয়ে যাবে না। ঐ ব্যক্তির জন্য খাঁটি দিলে তওবা করে নেয়া জরুরী।

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইমেইল- [email protected]

[email protected]

0Shares

আরও জানুন

আজানের সময় বা খানা খাওয়া ও বাথরুমে গমণ এবং স্বাভাবিক অবস্থায় মাথায় কাপড় রাখার হুকুম কী?

প্রশ্ন আমার চারটি বিষয়ে জানার ছিলো : ________ ১, বাথরুমে অবস্থানকালীন সময়ে মাথায় কাপড় দেওয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *