আল্লামা আব্দুল মতীন দামাত বারাকাতুহু
১.
হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেন,
كان النبي صلى الله عليه وسلم ينهض في الصلاة على صدور قدميه. أخرجه الترمذي (٢٨٨) وقال: حديث أبي هريرة عليه العمل عند أهل العلم يختارون أن ينهض الرجل في الصلاة على صدور قدميه.
অর্থ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে পায়ের উপর ভর দিয়েই উঠে পড়তেন। তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং ২৮৮; বায়হাকী, ২/১২৪ এর একজন রাবী খালিদ ইবনে ইলয়াস যঈফ। তিরমিযী র. বলেন, এ হাদীস অনুযায়ীই আলেমগণের আমল। তারা নামাযে পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ানোই পছন্দ করতেন।
২.
হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেন,
عن النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قال( في المسيئ في الصلاة): إِذَا قُمْتَ إِلَى الصَّلَاةِ فَأَسْبِغْ الْوُضُوءَ ثُمَّ اسْتَقْبِلْ الْقِبْلَةَ فَكَبِّرْ وَاقْرَأْ بِمَا تَيَسَّرَ مَعَكَ مِنْ الْقُرْآنِ ثُمَّ ارْكَعْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ رَاكِعًا ثُمَّ ارْفَعْ رَأْسَكَ حَتَّى تَعْتَدِلَ قَائِمًا ثُمَّ اسْجُدْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ سَاجِدًا ثُمَّ ارْفَعْ حَتَّى تَسْتَوِيَ وَتَطْمَئِنَّ جَالِسًا ثُمَّ اسْجُدْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ سَاجِدًا ثُمَّ ارْفَعْ حَتَّى تَسْتَوِيَ قَائِمًا ثُمَّ افْعَلْ ذَلِكَ فِي صَلَاتِكَ كُلِّهَا. أخرجه البخاري (٦٦٦٧)
অর্থ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (গলদ তরীকায় নামায আদায়কারী জনৈক ব্যক্তিকে) বলেছেন, তুমি যখন নামায পড়তে ইচ্ছা কর, তখন ভালভাবে ওযু করে নাও। অতঃপর কিবলামুখী হও। আল্লাহু আকবার বলো এবং কুরআনের যতটুকু তোমার জন্য সহজ হয় পাঠ কর। অতঃপর রুকু কর এবং স্থির হয়ে রুকু কর। এরপর মাথা তোল এবং স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাক। এরপর সেজদা কর এবং সেজদায় স্থির হয়ে থাক। অতঃপর ওঠো এবং স্থির ও শান্ত হয়ে বসে পড়। এরপর আবার সেজদা কর এবং সেজদায় স্থির হয়ে থাক। অতঃপর উঠে দাঁড়াও। পুরো নামাযে এভাবেই সব কাজ কর। বুখারী শরীফ, হাদীস নং ৬৬৬৭।
এখানে দ্বিতীয় সেজদা থেকে উঠে সোজা দাঁড়িয়ে যেতে বলা হয়েছে।
এ হাদীসের কোন কোন বর্ণনায় একটু বসে পরে দাঁড়ানোর কথা আছে। কিন্তু বায়হাকী এটাকে বর্ণনাকারীর ভুল আখ্যা দিয়েছেন। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. ফাতহুল বারী ও আত তালখীস উভয় গ্রন্থে তাঁর মত সমর্থন করেছেন।
৩.
হযরত রিফায়া রা. বর্ণনা করেন,
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم للمسيئ في الصلاة: ثم اركع حتى تطمئن راكعا ثم ارفع حتى تطمئن قائما ثم اسجد حتى تطمئن ساجدا ثم ارفع حتى تطمئن جالسا ثم اسجد حتى تطمئن ساجدا ثم قم (مختصرا)
রাসূলুল্লাহ সা. (নামাযে গলদকারী ব্যক্তিকে) বলেছেন, অতঃপর তুমি রুকু কর, স্থির হয়ে রুকু কর। এরপর ওঠো, এবং স্থির হয়ে দাঁড়াও। এরপর সিজদা কর, এবং সিজদায় স্থির হয়ে থাক। তারপর ওঠো এবং স্থিরভাবে বসে পড়। আবার সিজদা কর এবং সিজদায় স্থির হয়ে থাক। এরপর উঠে দাঁড়াও। মুসনাদে আহমদ (১৮৯৯৭), তাহাবী, মুশকিলুল আছার (৬০৭৪), তাবারানী, মুজামে কাবীর (৪৫২১)
৪.
ইকরিমা র. বলেন,
صَلَّيْتُ خَلْفَ شَيْخٍ بِمَكَّةَ فَكَبَّرَ ثِنْتَيْنِ وَعِشْرِينَ تَكْبِيرَةً فَقُلْتُ لِابْنِ عَبَّاسٍ إِنَّهُ أَحْمَقُ فَقَالَ ثَكِلَتْكَ أُمُّكَ سُنَّةُ أَبِي الْقَاسِمِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. أخرجه البخاري (٧٨٨)
অর্থ: আমি মক্কা শরীফে এক শায়খের পেছনে নামায পড়লাম। তিনি নামাযে ২২ বার আল্লাহু আকবার বললেন। আমি হযরত ইবনে আব্বাস রা.কে বললাম, লোকটি আহমক। তিনি বললেন, তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক, এটা তো আবুল কাসেম (রাসূল) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত। বুখারী শরীফ, হাদীস নং ৭৮৮।
এ হাদীস থেকে বোঝা যায়, ১ম ও ৩য় রাকাতের পরে না বসেই উঠে পড়বে। অন্যথায় বসাই যদি সুন্নত হতো তাহলে তাকবীর ২৪ বার হওয়া উচিৎ ছিল। কেননা একথা স্বীকৃত এবং হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক উঠানামায় তাকবীর বলতেন।
৪.
হযরত আব্বাস ইবনে সাহল আস-সাইদীর বর্ণনা:
أَنَّهُ كَانَ فِى مَجْلِسٍ فِيهِ أَبُوهُ وَكَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- وَفِى الْمَجْلِسِ أَبُو هُرَيْرَةَ وَأَبُو حُمَيْدٍ السَّاعِدِىُّ وَأَبُو أُسَيْدٍ فذكر الحديث وفيه: ثُمَّ كَبَّرَ فَسَجَدَ ثُمَّ كَبَّرَ فَقَامَ وَلَمْ يَتَوَرَّكْ. أخرجه أبو داود (٩٦٦) وإسناده صحيح.
অর্থ: তিনি একটি মজলিসে ছিলেন যেখানে তার পিতাও ছিলেন। তার পিতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী ছিলেন। উক্ত মজলিসে আবূ হুরায়রা রা., আবূ হুমায়দ আসসাইদী রা. ও আবূ উসায়দ রা.ও উপস্থিত ছিলেন। অতঃপর যে হাদীস উল্লেখ করেছেন, তাতে একথাও আছে- পরে তিনি তাকবীর বললেন এবং সেজদা করলেন। এরপর আবার তাকবীর বলে দাঁড়িয়ে গেলেন, বসেন নি। আবূ দাউদ শরীফ, হাদীস নং ৭৩৩, ৯৬৬; মুসনাদে সাররাজ ১০০, ১৯২৬; তাহাবী মুশকিলুল আছার ৬০৭২; তাহাবী শরীফ ৭৩১০; ইবনে হিব্বান ১৮৬৬; বায়হাকী ২৬৪২। এর সনদ সহীহ।
ইবনে রজব হাম্বলী রহ. তার বুখারী শরীফের ভাষ্যগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে এ হাদীসটি উল্লেখ করে বলেছেন,
وهذه الرواية صريحة في أنه لم يجلس بعد السجدة الثانية .ويدل عليه : أن طائفة من الحفاظ ذكروا أن حديث أبي حميد ليس فيه ذكر هذه الجلسة .
অর্থাৎ এ বর্ণনাটি খুবই স্পষ্ট যে, তিনি দ্বিতীয় সেজদার পর বসেন নি। এটা এভাবেও বোঝা যায়, হাফেযে হাদীসগণের এক জামাত বলেছেন, আবু হুমায়দের বর্ণনায় এই বৈঠকের কথা নেই। (৪/৩০১)
৫.
আব্দুর রহমান ইবনে গানম র. বলেন,
أن أبا مالك الأشعري جمع قومه فقال يا معشر الأشعريين اجتمعوا واجمعوا نساءكم وأبناءكم أعلمكم صلاة النبي صلى الله عليه و سلم صلى لنا بالمدينة فاجتمعوا وجمعوا نساءهم وأبناءهم فتوضأ وأراهم كيف يتوضأ فأحصى الوضوء إلى أماكنه حتى لما أن فاء الفيء وانكسر الظل قام فأذن فصف الرجال في أدنى الصف وصف الولدان خلفهم وصف النساء خلف الولدان ثم أقام الصلاة فتقدم فرفع يديه فكبر فقرأ بفاتحة الكتاب وسورة يسرهما ثم كبر فركع فقال سبحان الله وبحمده ثلاث مرار ثم قال سمع الله لمن حمده واستوى قائما ثم كبر وخر ساجدا ثم كبر فرفع رأسه ثم كبر فسجد ثم كبر فانتهض قائما فكان تكبيره في أول ركعة ست تكبيرات وكبر حين قام إلى الركعة الثانية فلما قضى صلاته أقبل إلى قومه بوجهه فقال احفظوا تكبيري وتعلموا ركوعي وسجودي فإنها صلاة رسول الله صلى الله عليه و سلم التي كان يصلي لنا كذا الساعة من النهار. أخرجه أحمد ٥/٣٤٣ (٢٣٢٩٤) قال النيموي: إسناده حسن
অর্থ: হযরত আবূ মালেক আল আশআরী রা . তার গোত্রের লোকদের একত্রিত করে বললেন, তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের নারী ও সন্তানরা একত্রিত হও। আমি তোমাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায শেখাব, তিনি আমাদেরকে নিয়ে মদীনায় পড়েছিলেন। তারা সবাই একত্রিত হলেন। স্ত্রী ও সন্তানদেরকেও একত্রিত করলেন। পরে তিনি ওযু করলেন এবং সবাইকে তার ওযু দেখালেন। তিনি ওযুর স্থানগুলো ভাল করে ধৌত করলেন। অতঃপর যখন বেলা গড়ে গেল তখন তিনি দাঁড়িয়ে আযান দিলেন। এরপর পুরুষদেরকে তার কাছের কাতারে দাঁড় করালেন। ছেলেদেরকে তার পরের কাতারে এবং নারীদেরকে তার পরের কাতারে দাঁড় করালেন। এরপর ইকামত দিয়ে সামনে গেলেন। অতঃপর হাত তুলে আল্লাহু আকবার বললেন। পরে সূরা ফাতেহা এবং অন্য একটি সূরা নিঃশব্দে পাঠ করলেন। অতঃপর তাকবীর বলে রুকু করলেন। রুকুতে তিনবার বললেন, سبحان الله وبحمده এরপর বললেন, سمع الله لمن حمده এবং সোজা দাঁড়িয়ে রইলেন। এরপর তাকবীর বলে সেজদায় চলে গেলেন। পরে তাকবীর বলে মাথা তুললেন। এরপর পুনরায় তাকবীর বলে সেজদা করলেন। অতঃপর তাকবীর বলে সোজা দাঁড়িয়ে গেলেন। এভাবে প্রথম রাকাতে তার তাকবীর হলো ছয়টি। দ্বিতীয় রাকাত থেকে তিনি যখন দাঁড়ালেন, তখনও তাকবীর বললেন। নামায শেষ করে গোত্রের লোকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বললেন, আমার তাকবীর (সংখ্যা) ভালভাবে স্মরণ রাখ এবং আমার রুকু ও সেজদা শিখে নাও। কেননা দিনের এই সময়ে আমাদের নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে নামায পড়েছিলেন, এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই নামায।
(মুসনাদে আহমদ, ৫খ,৩৪৩পৃ, হাদীস নং ২৩২৯৪)। এর সনদ হাসান।
ইমাম আহমদ বর্ণনা করেছেন, আবুন নদর (أبو النضر ) থেকে, তিনি আব্দুল হামীদ ইবনে বাহরাম আল ফাযারী থেকে, তিনি শাহর ইবনে হাওশাব থেকে, তিনি ইবনে গানম থেকে।
এ হাদীসে তিনি প্রথম রাকাতের পর না বসে সোজা দাঁড়িয়ে গেছেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তেমনটি করেছেন বলে বর্ণনা করেছেন। এ হাদীস থেকে আরেকটি বিষয় জানা গেল যে, নামাযে প্রথম তাকবীর ছাড়া কোথাও রফয়ে ইয়াদাইন নেই।
৬.
নুমান ইবনে আবূ আয়্যাশ র. বলেন,
أدركت غير واحد من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم فكان إذا رفع رأسه من السجدة في أول ركعة والثالثة قام كما هو ولم يجلس . أخرجه ابن أبي شيبة (٤٠١١) وإسناده حسن ، قاله النيموي رحمه الله.
অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক সাহাবীকে দেখেছি, তারা ১ম ও ৩য় রাকাতে সেজদা থেকে উঠে সোজা দাঁড়িয়ে যেতেন, বসতেন না। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৪০১১। নীমাবী র. বলেছেন, এটির সনদ হাসান।
৭.
আব্দুর রহমান ইবনে ইয়াযীদ র. বলেন,
رمقت عبد الله بن مسعود رض في الصلاة فرأيته ينهض ولا يجلس قال : ينهض على صدور قدميه في الركعة الاولى والثالثة. أخرجه عبد الرزاق (٢٩٦٦-٢٩٦٧) وابن أبي شيبة (٣٣٩٩) والطبراني في الكبير والبيهقي في السنن الكبرى (٢/١٢٥) وصححه. وقال الهيثمي في مجمع الزوائد: رجاله رجال الصحيح. (آثار السنن صـ ١٥٢)
অর্থ: আমি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.কে নামাযে ভালভাবে লক্ষ্য করলাম, আমি লক্ষ্য করলাম , তিনি সোজা উঠে পড়লেন, বসলেন না। তিনি আরো বলেন, তিনি ১ম ও ৩য় রাকাতে পায়ের উপর ভর দিয়েই দাঁড়িয়ে যেতেন। মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস নং ২৯৬৬,২৯৬৭। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৩৩৯৯,৪০০১। তাবারানী র. আলকাবীর গ্রন্থে, বায়হাকী আস সুনানুল কুবরা গ্রন্থে (২/১২৫), তিনি এটিকে সহীহ বলেছেন। হায়ছামী র. ‘মাজমাউয যাওয়াইদ’ গ্রন্থে বলেছেন, এর রাবীগণ সহীহ হাদীসের রাবী। (দ্র, আছারুস সুনান,পৃ ১৫২)।
৮.
আবু আতিয়্যা র. বর্ণনা করেছেন,
ابن عباس وابن عمر كانا يفعلان ذلك. أخرجه عبد الرزاق (٢٩٦٨)
অর্থ: ইবনে আব্বাস রা. ও ইবনে উমর রা.ও অনুরূপ করতেন। মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, হাদীস নং ২৯৬৮।
৯.
ইবনে জুরায়জ র. বর্ণনা করেন,
أخبرني عطاء : أنه رأى معاوية إذا رفع رأسه من السجود لم يتلبث قال : ينهض وهو يكبر في نهضته للقيام. أخرجه عبد الرزاق (٢٩٦٠) وإسناده صحيح
অর্থ: আতা র. আমাকে বলেছেন, মুআবিয়া রা.কে দেখেছি, তিনি সেজদা থেকে উঠে দেরী করতেন না। তাকবীর বলেই দাঁড়িয়ে যেতেন। মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, হাদীস নং ২৯৬০। এর সনদ সহীহ।
১০.
ওয়াহব ইবনে কায়সান র. বলেন,
رأيت ابن الزبير إذا سجد السجدة الثانية قام كما هو على صدور قدميهأخرجه ابن أبي شيبة (٤٠٠٥) وإسناده صحيح.
অর্থ: আমি আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়র রা.কে দেখেছি, তিনি যখন দ্বিতীয় সেজদা থেকে উঠতেন তখন পায়ের উপর ভর দিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে যেতেন। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৪০০৫। এর সনদ সহীহ।
১১.
উবায়দ ইবনে আবুল-জা’দ র. বলেছেন,
كان على ينهض في الصلاة على صدور قدميه . أخرجه ابن أبي شيبة (٤٠٠٠)
অর্থ: আলী রা. নামাযে পায়ের উপর ভর দিয়েই দাঁড়িয়ে যেতেন। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৪০০০।
১২.
হযরত ইবনে উমর রা. সম্পর্কে খায়ছামা র. বলেন,
ينهض في الصلاة على صدور قدميه . أخرجه ابن أبي شيبة (٤٠٠٢) وعن نافع كذلك (٤٠٠٧)
অর্থ: আমি তাঁকে নামাযে পায়ের উপর ভর দিয়ে উঠে পড়তে দেখেছি। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৪০০২। নাফে’ থেকেও অনুরূপ বর্ণিত আছে, (দ্র. হাদীস নং ৪০০৭)।
১৩.
শা’বী র. বর্ণনা করেন,
أن عمر وعليا وأصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم كانوا ينهضون في الصلاة على صدور أقدامهم . أخرجه ابن أبي شيبة (٤٠٠٤)
অর্থ: উমর রা., আলী রা. ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ নামাযে পায়ের উপর ভর দিয়েই উঠে পড়তেন। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৪০০৪।
১৪.
ইমাম যুহরী র. বলেন,
كان أشياخنا لا يمايلون يعني إذا رفع أحدهم رأسه من السجدة الثانية في الركعة الاولى والثالثة ينهض كما هو ولم يجلس . أخرجه ابن أبي شيبة (٤٠٠٩)
অর্থ: আমাদের উস্তাদগণ যখন ১ম ও ৩য় রাকাতে ২য় সেজদা থেকে উঠতেন তখন তাঁরা সোজা দাঁড়িয়ে যেতেন, বসতেন না। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৪০০৯।
১৫.
আবুয যিনাদ (একজন তাবেয়ী) রহ. বলেছেন, تلك السنة অর্থাৎ এটাই সুন্নত। (দ্র. ইবনে বাত্তাল রহ. কৃত বুখারীর ভাষ্য)
১৬.
আইয়্যুব সাখতিয়ানী রহ. বলেন,
كَانَ يَفْعَلُ شَيْئًا لَمْ أَرَهُمْ يَفْعَلُونَهُ كَانَ يَقْعُدُ فِي الثَّالِثَةِ وَالرَّابِعَةِ
অর্থাৎ আমি আমর ইবনে সালামা রহ.কে দেখেছি, তিনি এমনভাবে নামায পড়তেন, যেভাবে নামায পড়তে আমি অন্য কাউকে দেখিনি। তিনি তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাতে বৈঠক করতেন। (বুখারী, ৮১৮)
লক্ষ করার বিষয় হলো, আইয়্যুব সাখতিয়ানী রহ. নিজেও তাবেয়ী ছিলেন এবং বড় বড় অনেক তাবেয়ীকে তিনি দেখেছেন। কিন্তু এ বৈঠক করতে তিনি অন্য কাউকে দেখেননি। উল্লেখ্য, এখানে চতুর্থ কথাটি বর্ণনাকারীর ভুল। কারণ চতুর্থ রাকাতের পর বৈঠক হয় তাশাহহুদের জন্য। সুতরাং সঠিক কথা হবে প্রথম ও তৃতীয়।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণের আমলের ভিত্তিতেই পরবর্তী যুগে প্রায় সকল আলেম একমত ছিলেন যে, ১ম ও ৩য় রাকাতের পরে না বসে সোজা দাঁড়িয়ে যেতে হবে।
ইমাম মালেক, সুফিয়ান ছাওরী, ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ, ইমাম আহমদ, ইসহাক প্রমুখ সকলের মত হলো, উক্ত বৈঠক করবে না।
আল্লামা আলাউদ্দীন আল মারদীনী র. আল জাওহারুন-নাকী গ্রন্থে লিখেছেন,
أجمعوا على أنه إذا رفع رأسه من آخر سجدة من الركعة الأولى والثالثة نهض ولم يجلس إلا الشافعي.( ٢/١٢٦)
অর্থাৎ ইমাম শাফেয়ী র. ছাড়া সকল ইমাম ও আলেমই এ বিষয়ে একমত যে, প্রথম ও তৃতীয় রাকাতে দ্বিতীয় সেজদার পর সোজা দাঁড়িয়ে যাবে, বসবে না। (দ্র, ২খ, ১২৬পৃ) হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রহ. ফাতহুল বারী গ্রন্থে বলেছেন, لم يستحبها الأكثر অর্থাৎ অধিকাংশ আলেম এটাকে মুস্তাহাবও বলেননি। (২/৩৫২)
বৈঠক সম্পর্কিত হাদীসটির জবাব:
মালেক ইবনুল হুয়ায়রিছ রা. এর হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বসার যে কথা উল্লেখ করা হয়েছে সে হাদীস সম্পর্কে ইমাম আহমদ রহ. বলেছেন:ليس لهذا الحديث ثان يعنى أنه لم ترو هذه الجلسة في غير هذا الحديث অর্থাৎ মালেক ইবনুল হুওয়াইরিছ রা. এর হাদীসটি এমন যার সমর্থনে দ্বিতীয় কোন হাদীস নেই। অর্থাৎ এই বৈঠকটির কথা অন্য কোন হাদীসে উদ্ধৃত হয় নি। ইবনে রজব রহ. ফাতহুল বারী গ্রন্থে একথা উল্লেখপূর্বক লিখেছেন:
وهذا يدل على أن ما روي في هذه الجلسة من الحديث غير حديث مالك بن الحويرث ، فانه غير محفوظ. (৪/৩০০)
অর্থাৎ এ বক্তব্য নির্দেশ করে যে, মালেক ইবনুল হুওয়াইরিছ রা. বর্ণিত হাদীস ছাড়া এ বৈঠক সম্পর্কে অন্য যেসকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে সেগুলো সঠিক নয়। (৪/৩০০)
ইমাম তাহাবী র. বলেন:
فلما تخالف الحديثان احتمل أن يكون ما فعله رسول الله صلى الله عليه و سلم في الحديث الأول لعلة كانت به فقعد من أجلها لا لأن ذلك من سنة الصلاة وقال: ولو كانت هذه الجلسة مقصودة تشرع لها ذكر مخصوص. (باختصار ٢/٣٧٦)
অর্থাৎ যখন দু’টি হাদীসের মধ্যে বৈপরিত্য দেখা যাচ্ছে, তখন ধরে নিতে হবে, মালেক ইবনুল হুয়ায়রিছ রা. এর হাদীসে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলটি কোন উযরের কারণে হয়ে থাকবে। নামাযের সুন্নত হিসাবে করা হয়নি । তিনি আরো বলেন, এই বৈঠক যদি উদ্দেশ্য হতো, তাহলে এতে বিশেষ কোন যিকিরের বিধান অবশ্যই রাখা হতো। (তাহাবী, ২খ. ৩৭৬পৃ.)
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম র.ও তাঁর যাদুল-মাআদ গ্রন্থে বলেছেন,
ولو كان هديُه صلى الله عليه وسلم فعلَها دائماً، لذكرها كلُّ من وصف صلاته صلى الله عليه وسلم ومجردُ فعله صلى الله عليه وسلم لها لا يدلُّ على أنها من سنن الصلاة، إلا إذا علِمَ أنه فعلها على أنها سنَّة يُقتدى به فيها، وأما إذا قُدِّر أنه فعلها للحاجة، لم يدل على كونها سنة من سنن الصلاة،
অর্থাৎ এটা যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিয়মিত আমল হতো তবে তাঁর নামাযের বিবরণ দানকারী প্রত্যেক সাহাবী তা উল্লেখ করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুধু কোন কাজ করাই একথা প্রমাণ করে না যে, এটা নামাযের একটি অনুসৃত আমল। তবে হ্যাঁ, যদি জানা যায় এটাকে তিনি অনুসরণযোগ্য সুন্নত আখ্যা দিয়েছেন তবে সেটা নামাযের সুন্নত বলে গন্য হবে। কিন্তু যদি (কোন দলিলপ্রমাণের ভিত্তিতে) ধরে নেয়া হয় যে, তিনি বিশেষ প্রয়োজনে সেটা করেছেন, তাহলে তা নামাযের সুন্নত বলে প্রমাণিত হবে না। (দ্র. ১খ. ২৪০ পৃ.)
উল্লেখ্য যে, ইমাম শাফেঈ রহ. এর একটি মত তো হলো, এ বৈঠক করা মুস্তাহাব। তাঁর আরেকটি মত হলো বৈঠক করবে না, যেমনটি বলেছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম ও ফকীহ।
ইবনে রজব হাম্বলী রহ. লিখেছেন,
وحمل أبو إسحاق المروزي القولين للشافعي على اختلاف حالين ، لا على اختلاف قولين ، وحملوا حديث مالك بن الحويرث على مثل ذلك ، وان النبي ( كان يقعد أحيانا لمّا كبر وثقل بدنه ؛ فإن وفود العرب إنما وفدت على النَّبيّ ( في آخر عمره . ويشهد لذلك ، أن أكابر الصحابة المختصين بالنبي لم يكونوا يفعلون ذلك في صلاتهم ، فدل على أنهم علموا أن ذلك ليس من سنن الصلاة مطلقاً .
অর্থাৎ আবু ইসহাক মারওয়াযী রহ. ইমাম শাফেঈ রহ. এর দু’টি বক্তব্যকে দুটি অবস্থার সঙ্গে ফিট করেছেন। দুটি মত হিসাবে ধরেন নি। মালেক ইবনুল হুয়াইরিছ রা.এর বর্ণনাকে আলেমগণ একইভাবে গ্রহণ করেছেন। নবী করীম সা. যখন বৃদ্ধ হলেন এবং দেহ মুবারক ভারি হয়ে গেল তখন অনেক সময় তিনি এই বৈঠক করেছেন। মালেক রা.এর ঘটনাটি যে শেষ দিকের ছিল তার প্রমাণ, উফূদ বা আরবের বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধিদল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে তাঁর শেষ বয়সেই এসেছিল। (আর এ বৈঠক যে শেষ আমলে উযরের কারণে ছিল) তার বড় প্রমাণ, রাসূল সা. এর বিশিষ্ট সাহাবী ও শীর্ষ সাহাবীগণের কেউ তাঁদের নামাযে এ বৈঠক করেন নি। বোঝা গেল, তাঁরা জানতেন, এটা সাধারণ অবস্থায় নামাযের সুন্নত নয়।
আলবানী সাহেবের বাড়াবাড়ি
সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম ও ইমামের সঙ্গে এ বিষয়ে ইমাম শাফেয়ী রহ.এর দ্বিমত থাকলেও সেটা জায়েয-নাজায়েযের নয়। উত্তম-অনুত্তমের। তাই এ নিয়ে কখনোও বাড়াবাড়ি ছিল না। ফাতাওয়ায়ে জহীরিয়ার বরাতে আল্লামা ইবনে নুজায়ম রহ. তার আলবাহরুর রায়েক গ্রন্থে শামসুল আইম্মা হালওয়ানী রহ.এর এ বক্তব্য উল্লেখ করেছেন যে,
إن الخلاف إنماهو في الأفضلية حتى لو فعل كما هو مذهب الشافعي لا بأس به عندنا (فصل ما يفعله من أراد الدخول في الصلاة ، ১/৩৪০)
এ বিষয়ে দ্বিমত হয়েছে উত্তম অনুত্তম নিয়ে, তাই যদি কেউ শাফেয়ী রহ. এর মাযহাব মতো আমল করে তাতেও আমাদের মতে তেমন কোন অসুবিধা নেই।
কিন্তু দুঃখের বিষয় আলবানী সাহেব এক্ষেত্রে খুব বাড়াবাড়ি করেছেন। আর তারই অনুসরণ করছেন আমাদের দেশের লা-মাযহাবী বন্ধুরা।
আলোচ্য বিষয়ে তার লেখার দুর্বলতা ও ফাঁকগুলো তুলে না ধরলে পাঠক হয়তো ভুল বুঝবেন। তাই এখানে কিছু পর্যালোচনা তুলে ধরা হলো।
এক.
বুখারী শরীফে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদীসটি তিনি বিলকুল চেপে গেছেন। হাদীসটি পেছনে ২ নং দলিল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুই,
আবু হুমায়দ রা. বর্ণিত একটি হাদীস তিনি বিশ্রামের বৈঠকের পক্ষে প্রমাণস্বরূপ পেশ করেছেন। হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন আবু দাউদ (৭৩০), ইবনে মাজাহ (১০৬১), ইবনুল জারূদ (১৯২), ইবনে হিব্বান (১৮৬৭) ও বায়হাকী (৪০৮)।
হাদীসটি সম্পর্কে আলবানী সাহেব মন্তব্য করেন:
حديث أبي حميد فيه وصف صلاة النبي صلى الله عليه وسلم – وفيها الجلسة – بحضرة عشرة من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم وفي آخره : قالوا : صدقت هكذا كان يصلي صلى الله عليه وسلم أخرجه أصحاب السنن وغيرهم وهو مخرج في ” الإرواء ” ( ৩০৫ ) فليس الحديث من رواية أبي حميد وابن الحويرث فقط كما يوهمه الكلام المذكور عن ابن القيم وإنما معهما عشرة آخرون من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم الذين شاهدوا صلاته صلى الله عليه وسلم وقليل من السنن يتفق على روايتها مثل هذا الجمع الغفير من الصحابة رضي الله عنهم )تمام المنة)
অর্থাৎ আবু হুমায়দ রা. বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামাযের বিবরণ রয়েছে, এই বৈঠকের কথাও সেখানে উল্লেখ আছে। হাদীসটি তিনি দশজন সাহাবীর উপস্থিতিতে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটির শেষে আছে, তারা বলেছেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। তিনি (নবী সা.) এভাবেই নামায পড়তেন। সুনান (চতুষ্টয়) এর সংকলক অন্যান্য হাদীস গ্রন্থকারগণ এটি উদ্ধৃত করেছেন। ইরওয়া গ্রন্থেও এটি বিধৃত হয়েছে (৩০৫)।
সুতরাং (বৈঠকের) হাদীস শুধু মালেক ইবনুল হুওয়ায়রিছ রা. ও আবু হুমায়দ রা. কর্তৃক বর্ণিত, একথা ঠিক নয়। যেমনটি ধারণা জন্মে ইবনুল কায়্যিমের পূর্বোক্ত বক্তব্য থেকে। বরং তাদের দু’জনের সঙ্গে আরো দশজন সাহাবী আছেন যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায প্রত্যক্ষ করেছেন। আর এমন সুন্নাহ খুব কমই পাওয়া যাবে, যা এত বিরাট সংখ্যক সাহাবী বর্ণনা করেছেন। (দ্র. তামামুল মিন্নাহ, ১/২১১-২১২)
ক.
এটি আবু হুমায়দ রা. থেকে মুহাম্মদ ইবনে আমর ইবনে আতা বর্ণনা করেছেন, তাঁর সূত্রে আবার অনেকেই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আব্দুল হামীদ ইবনে জাফর ছাড়া অন্য কেউ এ বৈঠকের কথা উল্লেখ করেননি।
খ.
আব্দুল হামীদের বিশ্বস্ততা নিয়ে দ্বিমত আছে। সুফিয়ান ছাওরী ও ইয়াহয়া ইবনে সাঈদ আলকাত্তান তাকে ‘দুর্বল’ বলেছেন। আবু হাতেম রাযী বলেছেন, لا يحتج به অর্থাৎ তাকে প্রমাণস্বরূপ পেশ করা যাবে না। ইমাম নাসায়ী যুআফা গ্রন্থে বলেছেন, ليس بالقوي তিনি মজবুত নন। অন্যত্র তিনি বলেছেন, ليس به بأس তার ব্যাপারে অসুবিধার কিছু নেই। ইমাম আহমদও এমন মন্তব্য করেছেন। আলী ইবনুল মাদীনী ও ইয়াহয়া ইবনে মাঈন অবশ্য তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন। কিন্তু তাদের দৃষ্টিতেও তিনি খুব উঁচু মানের রাবী ছিলেন না। তার একটি প্রমাণ এও যে, ইবনে মাঈন অন্যত্র তার সম্পর্কে বলেছেন, ليس بحديثه بأس তার হাদীসের ব্যাপারে তেমন অসুবিধা নেই। একারণেই যাহাবী সিয়ার গ্রন্থে বলেছেন, وهو حسن الحديث তিনি এমন স্তরের, যার হাদীস হাসান হয়ে থাকে। ইবনে হাজার তাকরীবে বলেছেন, صدوق ربما وهم তিনি সাদূক (মধ্যম স্তরের জন্য ব্যবহৃত শব্দ) তবে মাঝেমধ্যে ভুলের শিকার হন। ইবনে হিব্বানও বলেছেন, ربما أخطأ তিনি কখনও কখনও ভুলের শিকার হন।
এ ধরনের বর্ণনাকারী যদি কোন হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ হন তবে তা দ্বারা প্রমাণ পেশ করা কঠিন। এটা উক্ত বর্ণনার বিশুদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
গ.
আব্দুল হামীদ ইবনে জাফর যে এই বৈঠকের উল্লেখ করেছেন, তাও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। কেননা তার অনেক শিষ্যই তার সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাদের বর্ণনায় এ বৈঠকের উল্লেখ আসে নি। যেমন, আব্দুল মালেক ইবনুস সাব্বাহ আল মিসমাঈ। (দ্র. ইবনে খুযায়মা ৬৭৭) ইয়াহয়া আলকাত্তান, (দ্র. ইবনে হিব্বান ১৮৬৫)।
ঘ.
এসব কারণেই হয়তো ইমাম আহমদ এ হাদীসকে দুর্বল মনে করেছেন। কেননা মালেক ইবনুল হুয়ায়রিছ রা. বর্ণিত হাদীসটি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ليس لهذا الحديث ثان এ হাদীসটির পক্ষে দ্বিতীয় কোন হাদীস নেই। অথচ এ বিষয়ে আবু হুমায়দ রা.এর হাদীসটির উক্ত বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ইমাম আহমদ রহ. এটিকে সমর্থক ও সাক্ষীরূপেও গুরুত্ব দেওয়ার উপযুক্ত বিবেচনা করেন নি।
তাঁর এ মন্তব্য উদ্ধৃত করে ইবনে রজব বলেছেন,
هذا يدل على أن ما روى في هذه الجلسة من الحديث غير حديث مالك بن الحويرث فإنه غير محفوظ فإنها قد رويت في حديث أبي حميد وأصحابه في صفة صلاة النبي صلى الله عليه وسلم ، أخرجه أحمد وابن ماجه.
অর্থাৎ একথা নির্দেশ করে যে, মালেক ইবনুল হুয়ায়রিছ রা. বর্ণিত হাদীস ব্যতীত উক্ত বৈঠকের পক্ষে আরো যেসব হাদীস বর্ণিত আছে, সেগুলো বিশুদ্ধ নয়। (সেগুলোর একটি হলো,) নবী সা. এর নামাযের বিবরণে আবু হুমায়দ রা. ও তাঁর সঙ্গীগণ কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি, সেখানে এ বৈঠকের উল্লেখ এসেছে। এটি আহমদ ও ইবনে মাজাহ উদ্ধৃত করেছেন। (দ্র. ফাতহুল বারী, ৭/২৮২, ৮৩২ নং হাদীসের আলোচনায়) ইমাম আহমদ এটিরই দুর্বলতার প্রতি ইংগিত করেছেন।
ঙ.
আব্দুল হামীদের আরেক সঙ্গী ঈসা ইবনে আব্দুল্লাহ একই উস্তাদ মুহাম্মদ ইবনে আমর ইবনে আতা থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। তার বর্ণনায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, রাসূল সা. বৈঠক না করেই উঠে গেছেন। এটিও আবু হুমায়দ রা.এর হাদীস। পেছনে ৪ নম্বরে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে।
চ.
আলবানী সাহেব দাবি করেছেন, দু’জন নয়, বারোজন সাহাবী এ বৈঠকের বর্ণনাকারী।
কিন্তু এ হাদীসটি যদি সহীহ না হয় তবে তো এগারজনই বাদ। বাকি থাকেন শুধু একজন। যেমনটি বলেছেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল। পক্ষান্তরে বৈঠক না করার পক্ষে অনেক হাদীস আমরা পেশ করেছি। বিশেষ করে আব্বাস ইবনে সাহল বর্ণিত হাদীসটিতে বলা হয়েছে, তিনি আনসার সাহাবীগণের এক মজলিসে ছিলেন। সেখানে তার পিতা সাহল ইবনে সাদ, আবু হুমায়দ, আবু উসায়দ ও আবু হুরায়রা রা. প্রমুখ ছিলেন। আবু দাউদ (৭৩৩), মুসনাদে সাররাজ (১০০) (১৯২৬)।
তাহাবী শরীফের বর্ণনায় উল্লিখিত সাহাবীগণের নাম উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে, ‘ওয়াল আনসার রা.’ অর্থাৎ আরো অন্যান্য আনসার সাহাবীগণ ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতে আবু হুমায়দ রা. এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, অতঃপর তিনি তাকবীর বললেন এবং সেজদা করলেন।
এরপর আবার তাকবীর বললেন এবং দাঁড়িয়ে গেলেন, বৈঠক করেন নি। তাহলে এখানেও তো একই হাদীসে অনেক বর্ণনাকারী সাহাবী পাওয়া গেল।
তিন,
আব্বাস ইবনে সাহল বর্ণিত হাদীসটি সম্পর্কে আলবানী সাহেব মন্তব্য করেছেন,
إن هذه الزيادة ضعيفة لأنه تفرد به عيسى بن عبد الله بن مالك وهو مجهول(أصل صفة الصلاة)
অর্থাৎ এ বাড়তি অংশটুকু (বৈঠক করেন নি) দুর্বল। কেননা ঈসা ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে মালেক এটি একাই বর্ণনা করেছেন। আর তিনি অজ্ঞাত ছিলেন।
কিন্তু এটাকে দুর্বল বলা আলবানী সাহেবের একটি ভুল। কারণ ঈসা ইবনে আব্দুল্লাহকে কেউ দুর্বল বলেন নি। বরং ইবনে হিব্বান তার আছছিকাত গ্রন্থে (বিশ্বস্ত রাবীচরিত) তাকে উল্লেখ করেছেন। ইমাম বুখারী তাঁর আত তারীখুল কাবীর গ্রন্থে এবং ইবনে আবু হাতেম তার আল জারহু ওয়াত তাদীল গ্রন্থে তাকে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তারা বিরূপ কোন মন্তব্য করেন নি।
আলী ইবনুল মাদীনী অবশ্য তাকে অজ্ঞাত বলেছেন। তবে তিনি তাকে অজ্ঞাত আখ্যা দেওয়ার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন যে, শুধু মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকই তাঁর সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেন। অথচ রিজাল শাস্ত্র অনুসন্ধান করে দেখা গেছে তার সূত্রে আরো সাতজন রাবী হাদীস বর্ণনা করেছেন। তারা হলেন যিয়াদ ইবনে সাদ, জাহহাফ ইবনে আব্দুর রহমান, হাসান ইবনে হুরর, উতবা ইবনে আবু হামীম, ফুলায়হ ইবনে সুলায়মান ও ঈসার ভ্রাতা মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ।
সুতরাং যে কারণে ইবনুল মাদীনী তাকে মাজহুল বা অজ্ঞাত বলেছেন, সেটি যখন ঠিক রইল না, তাই তাকে অজ্ঞাত বলাও আর সঙ্গত হবে না। তাই তো ইবনুল মাদীনীর পর অন্য কেউই তাকে মাজহুল বলেন নি। হাফেজ যাহাবী কাশেফ গ্রন্থে বলেছেন, وثق তাকে বিশ্বস্ত বলা হয়েছে। আর হাফেজ ইবনে হাজার তাকরীব গ্রন্থে বলেছেন, مقبول।
এ মাকবূল শব্দটি ইবনে হাজারের বিন্যাস অনুসারে গ্রহণযোগ্য রাবীর সর্বনিম্নস্তর।
তাছাড়া তাহাবী শরীফে (নং ১৫৪৮) উতবা ইবনে হাকীম এটি বর্ণনা করেছেন ঈসা ইবনে আব্দুর রহমান আল আদাবীর সূত্রে আব্বাস ইবনে সাহল থেকে, সেখানেও এই বৈঠকের কথা নেই।
চার.
ফিকহুস সুনান গ্রন্থে সায়্যেদ সাবেক এ বৈঠক সম্পর্কে লিখেছেন,
وقد اختلف العلماء في حكمها تبعا لاختلاف الأحاديث ونحن نوردها ما لخصه ابن القيم في ذلك.
অর্থাৎ হাদীসের বিভিন্নতার কারণে এ বৈঠকটি সম্পর্কে আলেমগণেরও মতভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এখানে ইবনুল কায়্যিমের সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরব। (দ্র. তামামুল মিন্নাহ, ১/২১০)
এ বক্তব্য সম্পর্কে আলবানী সাহেব লিখেছেন,
هذا يوهم أن في هذه المسألة أحاديث متعارضة وليس كذلك بل كل ما ورد فيها مثبت لها ولم يرد مطلقا أي حديث ينفيها غاية الأمر أنها لم تذكر في بعض الأحاديث وهذا لا يوجب الاختلاف المدعى وإلا للزم ادعاء مثله في كل سنة لم تتفق عليها الأحاديث وهذا لا يقول به أحد
অর্থাৎ উক্ত বক্তব্য এই ধারণা জন্মায় যে, এ মাসআলায় পরস্পর বিরোধী হাদীস রয়েছে। অথচ ব্যাপারটি এমন নয়। বরং এক্ষেত্রে যতগুলো হাদীস এসেছে সবগুলো এ বৈঠক প্রমাণ করে। এমন একটি হাদীসও আসে নি, যা এই বৈঠক সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেয়। খুব বেশি এ কথা বলা যায় যে, কিছু কিছু হাদীসে এর উল্লেখ আসে নি। আর এই না আসা ঐ বিভিন্নতাকে অনিবার্য করে না, যার দাবি করা হচ্ছে। অন্যথায় অনুরূপ দাবি প্রত্যেক সুন্নাহ সম্পর্কেই করা যাবে, যেগুলোর বিবরণ সব হাদীসে আসে নি। অথচ এমন কথা কেউ বলতে পারে না। (তামামুল মিন্নাহ, ১/২১০)
আলবানী সাহেবের এ বক্তব্য যে কতটা অন্তঃসারশূন্য তা পেছনের হাদীসগুলো লক্ষ করলেই ধরা পড়বে। নবী করীম সা. যখন এক ব্যক্তিকে নামায শেখাচ্ছিলেন, আর বলছিলেন, এরপর দ্বিতীয় সেজদা কর, এরপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যাও, এতে কি উক্ত বৈঠক সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বা নির্দেশনা পাওয়া যায় না? তবে কি সংখ্যাগরিষ্ট সাহাবী তাবেয়ী ও মুজতাহিদ ইমামগণ এতকাল ভুল বুঝেছেন?
পাঁচ.
হাফেজ ইবনুল কায়্যিমের বরাতে ফিকহুস সুন্নাহ গ্রন্থকার লিখেছেন,
وفي حديث ابن عجلان ما يدل على أنه كان ينهض على صدور قدميه وقد روى عدة من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم وسائر من وصف صلاته صلى الله عليه وسلم لم يذكر هذه الجلسة وإنما ذكرت في حديث أبي حميد ومالك بن الحويرث
অর্থাৎ ইবনে আজলান এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসটি নির্দেশ করে যে, তিনি (রাসূল সা.) পায়ের উপর ভর দিয়েই দাঁড়িয়ে যেতেন। রাসূল সা. এর অনেক সাহাবী এবং তাঁর নামাযের বিবরণদানকারীগণের কেউই এ বৈঠকের কথা উল্লেখ করেন নি। শুধুমাত্র আবু হুমায়দ ও মালেক ইবনুল হুয়ায়রিছ রা. বর্ণিত হাদীসে এর উল্লেখ এসেছে।
আলবানী সাহেব উক্ত বক্তব্যের উপর টীকা লিখে মন্তব্য করেছেন:
قلت : إن كان يعني حديث ابن عجلان عن رفاعة المذكور في رواية عبد الله عن أحمد المتقدمة فليس فيها ما ذكر من النهوض ثم هو من تعليمه صلى الله عليه وسلم للمسيء صلاته وليس من فعله صلى الله عليه وسلم كما تقدم وإن كان يعني غيره فلم أعرفه وعلى الأول فالعبارة مشكلة لأنها تفيد أن حديث رفاعة غير حديث ابن عجلان مع أنهما حديث واحد فتأمل
অর্থাৎ আমি বলব, যদি তাঁর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে রিফায়া রা. থেকে ইবনে আজলানের সূত্রে বর্ণিত হাদীস, যা ইতিপূর্বে আহমদ রহ.থেকে আব্দুল্লাহ’র বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, তাহলে সেখানে সেজদা থেকে ওঠার উল্লেখ নেই। তাছাড়া হাদীসটি মূলতঃ নামাযে গলদকারী ব্যক্তিকে দেওয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তালিম বা শিক্ষা। এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজের আমল সম্পর্কে নয়। যেমনটি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। আর যদি তাঁর উদ্দেশ্য অন্য কিছু হয়, তবে তা আমার জানা নেই। আর প্রথমটি উদ্দেশ্য হয়ে থাকলে বাক্যটি দুর্বোধ্য। কারণ এতে অনুমিত হয়: রিফায়া রা. বর্ণিত হাদীসটি ইবনে আজলান কর্তৃক বর্ণিত হাদীস থেকে ভিন্ন। অথচ দুটি একই হাদীস। (তামামুল মিন্নাহ, ১/২১১)
অধমের আরজ এই যে, আসলে ইমাম আহমদ রহ. ইবনে আজলানের সূত্রে বর্ণিত রিফাআ ইবনে রাফে রা.এর হাদীসকে আমলের জন্য অবলম্বন করেছেন। হাদীসটি মুসনাদে আহমদে (নং ১৮৯৯৭) উদ্ধৃত হয়েছে। এখানে ৩নং প্রমাণে আরো কে কে উদ্ধৃত করেছেন তার বিবরণ আছে।
হাদীসটিতে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় সেজদার পরেই তুমি দাঁড়িয়ে যাও। আর এর থেকেই বোঝা যায়, রাসূল সা. নিজেও দ্বিতীয় সেজদার পর সোজা দাঁড়িয়ে যেতেন। কেননা তিনি অন্যদেরকে যা আদেশ করতেন, নিজেও তাই করতেন। তাঁর তালীম ও নিজের আমলে কোন ফারাক ছিল না। এটাই স্বাভাবিক। হ্যাঁ, বার্ধক্যের কারণে কখনও কখনও বসতেন, সেটাই মালেক রা.এর হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে। ইমাম আহমদ রহ. বলেছেন:وأذهب أنا إلى حديث رفاعة “ثم قم” অর্থাৎ রিফায়া রা.এর বর্ণিত হাদীসে রাসূল সা. যে বলেছেন:এরপর তুমি দাঁড়িয়ে যাও, আমি এ হাদীস অনুযায়ী আমল করি।
এর উপর মন্তব্য করতে গিয়ে আলবানী সাহেব বলেন:
وهذا لا حجة فيه على نفي ما ثبت في حديث ابن الحويرث وغيره إذ غاية ما فيه أن الجلسة لم تذكر فيه وهي سنة وليست بواجب فكيف تذكر في حديث المسئ صلاته الذي علمه صلى الله عليه وسلم فيه الواجبات دون السنن والمستحبات راجع ” المجموع ” ( ৩ / ৪৪৩ ) وكأنه لضعف هذه الحجة رجع الإمام أحمد رحمه الله إلى العمل بحديث ابن الحويرث وهو الحق الذي لا شك فيه
অর্থাৎ হযরত মালেক ইবনুল হুওয়াইরিছ রা. প্রমুখের হাদীস থেকে যে বৈঠক প্রমাণিত, এটি তার বিপক্ষে প্রমাণ হয় না। কারণ বেশির থেকে বেশি একথা বলা যায় যে, এতে বৈঠকটির কথা উল্লেখ করা হয় নি। এ বৈঠক সুন্নত, ওয়াজিব নয়। সুতরাং নামাযে গলদকারী ব্যক্তির হাদীসে এর উল্লেখ থাকার কথা নয়। তাঁকে তো নবী সা. সুন্নত-মুস্তাহাব শেখান নি, ফরজ-ওয়াজিব শিখিয়েছেন। দেখুন, আলমাজমু’ ৩/৪৪৩। এ প্রমাণটি দুর্বল হওয়ার কারণেই হয়তো ইমাম আহমদ রহ. মালেক ইবনুল হুওয়াইরিছ রা. বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী আমলের দিকে ফিরে এসেছেন। এটা এমন সত্য, যাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। (তামামুল মিন্নাহ, ১/২১১)
আমাদের তো বুঝে আসে না, রিফায়া রা.এর হাদীসটি কেন প্রমাণ হতে পারবে না। উক্ত হাদীসে তো নবীজী সা. দ্বিতীয় সেজদার পর সোজা দাঁড়িয়ে যেতে বলেছেন। তাহলে বসার সুযোগ থাকল কোথায়?
ইমাম আহমদের মাযহাব
ইমাম আহমদের মাযহাব ও আমল নিয়েও আলবানী সাহেব সত্য গোপন করেছেন। তিনি শুধু খাল্লালের বক্তব্যের উপর নির্ভর করে দাবি করেছেন যে, ইমাম আহমদ ফিরে এসেছেন। খাল্লাল তো সরাসরি ইমাম আহমদের শিষ্য নন। আলবানী সাহেব এক্ষেত্রে ইমাম আহমদের শিষ্যবৃন্দ ও তার মাযহাবের সংকলকগণের বক্তব্য সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন।
ইমাম আহমদের সকল ছাত্র যারা তার মাসায়েল সংকলন করেছেন, যেমন, ইমাম আবু দাউদ, ইসহাক ইবনে মানসুর আলকাওসাজ, ইবনে হানী, আলআছরাম আবুবকর ও ইমাম আহমদের ছেলে আব্দুল্লাহ, তারা সকলেই তাঁর মত ও মাযহাব এটাই উল্লেখ করেছেন যে, এ বৈঠক করবে না। ইমাম আহমদের মাযহাবের সংকলকগণও তাই লিখে গেছেন। ইমাম আহমদ যদি এ মাসআলা থেকে ফিরে আসতেন তাহলে তার সরাসরি শিষ্যরা এবং তার মাযহাবের সংকলকরা তা কি জানতেন না?
ইমাম আবু দাউদ বলেন: سمعت أحمد يقول : ينهض على صدور القدمين لا يقعد অর্থাৎ আমি আহমদকে বলতে শুনেছি, পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে, বসবে না। (১/৫৩) ইসহাক আলকাওসাজ বলেন, قال : وفي الركعة الأولى والثالثة ينهض على صدور قدميه অর্থাৎ ইমাম আহমদ বলেছেন, প্রথম ও তৃতীয় রাকাতের পর পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। (নং ২২৬)
আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ বলেন,
قال أبي : واذهب انا الى حديث رفاعة …قال ابي بلغني ان حماد بن زيد كان يذهب الى حديث رفاعة والى ما روى عن عبد الله بن مسعود وغيره من اصحاب النبي صلى الله عليه وسلم انهم كانوا ينهضون على صدور اقدامهم اذهب الى هذا
আমার পিতা বলেছেন, আমার মত রিফাআর হাদীস অনুযায়ী। তিনি আরো বলেন, আমি শুনেছি, হাম্মাদ ইবনে যায়েদও উক্ত হাদীস এবং তৎসঙ্গে ইবনে মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবী সম্পর্কে যে কথা বর্ণিত আছে যে, তাঁরা পায়ের উপর ভর দিয়েই দাঁড়িয়ে যেতেন, সে অনুযায়ী আমল করতেন। আমিও এ অনুযায়ী আমল করি। (১/৮২)
তিনি আরো বলেছেন, وكذا قال داود بن قيس وافق ابن عجلان ‘রিফাআর হাদীসটি শুধু মুহাম্মদ ইবনে আজলানই ইয়াহয়া ইবনে খাল্লাদের সূত্রে বর্ণনা করেন নি, বরং দাউদ ইবনে কায়সও একইভাবে এটি বর্ণনা করেছেন।’ (মাসায়েলে আহমদ লি আব্দুল্লাহ, ১/৮১)
ইসহাক আল কাওসাজ আল মারওয়াযী সংকলিত ‘মাসাইলে ইমাম আহমাদ ওয়া ইসহাক’ গ্রন্থের টীকায় টীকাকার লিখেছেন:
نقل عنه نحوها عبد الله في مسائله ص৮২ (২৮৭، ২৮৮)، وابن هانئ في مسائله ১/৫৪ (২৫৯)، وأبو داود في مسائله ص৩৫. والصحيح من المذهب: موافق لهذه الرواية، حيث إن المصلي إذا قام من السجدة الثانية لا يجلس جلسة الاستراحة، بل يقوم على صدور قدميه معتمداً على ركبتيه إلا أن يشق عليه، فيعتمد بالأرض. قال ابن الزاغوني: هو المختار عن جماعة المشايخ. وروي عن أحمد: أنه يجلس جلسة الاستراحة، اختاره الخلال، وقال: إن أحمد رجع عن الأول، وقيل: يجلس جلسة الاستراحة من كان ضعيفاً، اختاره القاضي وابن قدامة وغيرهما الخ
অর্থাৎ ইমাম আহমদ থেকে অনুরূপ উল্লেখ করেছেন আব্দুল্লাহ (ইবনে আহমদ) তার মাসায়েলে (পৃ.৮২, নং ২৮৭,২৮৮), ইবনে হানী তার মাসায়েলে, (১/৫৪, নং ২৫৯) ও আবু দাউদ তার মাসায়েলে (পৃ.৩৫)। ইমাম আহমদের সহীহ মাযহাব এসব বর্ণনা অনুসারেই। অর্থাৎ মুসল্লী দ্বিতীয় সেজদা থেকে ওঠার পর বিশ্রামের বৈঠকটি করবে না, বরং উভয় পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। এ সময় দুই হাতের ভর থাকবে হাঁটুর উপর। তবে যদি কষ্ট হয় তবে মাটিতে হাত রেখে ভর দিয়ে উঠবে। ইবনুয যাগুনী (আবুল হাসান আলী ইবনে উবায়দুল্লাহ আল বাগদাদী, মৃত্যু ৫২৭ হি.) বলেছেন, এ মাযহাবের মাশায়েখগণের নিকট এটাই পছন্দনীয় মত।
ইমাম আহমদ থেকে ঐ বৈঠকের পক্ষেও একটি বর্ণনা আছে, খাল্লাল সেটি গ্রহণ করেছেন, এবং বলেছেন, আহমদ এ মতের দিকেই ফিরে এসেছেন। ইমাম আহমদ থেকে আরেকটি বর্ণনা হলো দুর্বল ব্যক্তি এ বৈঠক করবে। আলকাযী ও ইবনে কুদামা এটিই অবলম্বন করেছেন। (২/৫৬৬)
আলবানী সাহেব তার ‘আসলু সিফাতিস সালাহ’ গ্রন্থে ইমাম আহমদের এসব সরাসরি শিষ্যের বর্ণনা উপেক্ষা করে লিখেছেন:
وعن أحمد نحوه في ” التحقيق ” (১/১১১) وهو الأحرى به لما عرف عنه من الحرص على اتباع السنة التي لا معارض لها . وقد قال ابن هانئ في ” مسائله عن الإمام أحمد ” (১/৫৭) : ” رأيت أبا عبد الله ربما يتوكأ على يديه إذا قام في الركعة الأخيرة ، وربما استوى جالساً ، ثم ينهض . وهو اختيار الإمام إسحاق بن راهويه ؛ فقد قال في “مسائل المروزي ” : ” مضت السنة من النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أن يعتمد على يديه ويقوم ؛ شيخاً كان أو شاباً ” . واستحبه الإمام ابن حزم وهو الصواب لعدم ثبوت ما يعارض هذه السنة وكل ما جاء مما يخالفها لا يثبت ؛الخ
অর্থাৎ ইমাম আহমদ থেকে তাহকীক গ্রন্থে (১/১১১) অনুরূপ বর্ণিত আছে। তিনি এর অধিক উপযুক্তও বটেন। কেননা যে সব সুন্নাহর কোন বিপরীত বর্ণনা নেই, সেসব সুন্নাহর অনুসরণে তাঁর অতীব আগ্রহ লক্ষ করা গেছে। ইবনে হানীও ইমাম আহমদ থেকে সংগৃহীত মাসাইলে উল্লেখ করেছেন যে, আমি আবু আব্দুল্লাহ (আহমদ) কে দেখেছি, কখনও কখনও তিনি শেষ রাকাতে উভয় হাতের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতেন। আবার কখনও কখনও সোজা বসে যেতেন। অতঃপর উঠতেন। (১/৫৭) ইসহাকও এটাই পছন্দ করেছেন। মারওয়াযী সংকলিত মাসাইলে তিনি বলেছেন, নবী সা. থেকে এ সুন্নাহই চলে আসছে যে, বৃদ্ধ যুবক সকলেই হাতের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াবে। ইবনে হাযমও এটিকে মুস্তাহাব মনে করতেন। আর এটাই সঠিক। কেননা এ সুন্নাহর বিপরীত কোন কিছু প্রমাণিত নেই। এর বিপরীত যা কিছুই এসেছে তার কোনটিই প্রমাণযোগ্য নয়। (৩/৮১৭, ৮১৮)
আলবানী সাহেব সিফাতু সালাতিন নবী স. (নবী সা. এর ছলাত সম্পাদনের পদ্ধতি) গ্রন্থেও ইসহাক রহ.এর অনুরূপ বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। শেষে বলেছেন, দেখুন আল ইরওয়া, ২/৮২, ৮৩। অথচ সেখানে ইসহাক রহ.এর বক্তব্য নেই। (দ্র. নবী সা. এর ছলাত …, পৃ. ১৫৩)
আলবানী সাহেব এখানেও অনেক বিষয় গোপন করে গেছেন। ইমাম আহমদের মাযহাব প্রমাণ করার জন্য তিনি প্রথমত ইবনুল জাওযীর আত তাহকীক গ্রন্থের বরাত উল্লেখ করেছেন। অথচ তাহকীক গ্রন্থে বলা হয়েছে:
الْمُسْتَحبّ أَن ينْهض من السُّجُود عَلَى صُدُور قَدَمَيْهِ مُعْتَمدًا عَلَى رُكْبَتَيْهِ وَعنهُ أَنه يجلس جلْسَة الإستراحة عَلَى قَدَمَيْهِ وأليتيه ) رقم ৫৯৭)
অর্থাৎ মুস্তাহাব হলো হাঁটুর উপর হাতের ভর রেখে পায়ের উপর ভর দিয়ে সেজদা থেকে উঠবে। ইমাম আহমদ থেকে একটি বর্ণনা এও আছে যে, উভয় পা ও নিতম্বের উপর বিশ্রামের জন্য বসে পড়বে। (আত তাহকীক, নং ৫৯৭)
লক্ষ করুন, তাহকীক গ্রন্থে ইবনুল জাওযী ইমাম আহমদের মূল মাযহাব হিসাবে বৈঠক না করার কথাই উল্লেখ করেছেন। আর বৈঠক করার পক্ষে ইমাম আহমদের একটি মত থাকার কথা বলেছেন। অথচ আলবানী সাহেব প্রথম ও মূল মতটির কথা সম্পূর্ণ গোপন করে গেছেন।
ইমাম আহমদের মাযহাব প্রমাণের জন্য তিনি দ্বিতীয়ত দাবি করেছেন যে, ‘বিরোধপূর্ণ নয় এমন সুন্নাহর অনুসরণের প্রতি তাঁর যে অতীব আগ্রহ লক্ষ করা গেছে সে হিসাবে এর উপর আমল করার তিনিই সর্বাধিক উপযুক্ত।’ এখানে আলবানী সাহেব মাযহাব বর্ণনার ক্ষেত্রে কেয়াস ও যুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন। অথচ পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, ইমাম আহমদের যারা সরাসরি শিষ্য ছিলেন এবং যারা তার মাসাইল সংকলন করেছেন তারা সকলেই তার মত এটাই উল্লেখ করেছেন যে, এ বৈঠকটি করবে না। পরবর্তীকালে হাম্বলী মাযহাবের বড় বড় মনীষীবৃন্দও এটাকেই তাঁর মাযহাব আখ্যা দিয়েছেন। সুতরাং এখানে এদিক-সেদিকের কথা বলে কোন লাভ নেই।
তাছাড়া ইমাম আহমদ সম্পর্কে তাঁর উপরিউক্ত মন্তব্য অন্যান্য মুজতাহিদ ইমামগণের মর্যাদাকে খাটো করে কি না তাও ভাববার বিষয়। ইমাম আহমদ থেকে বৈঠক না করার মতটি যখন অকাট্য ভাবে প্রমাণিত, আর আলবানী সাহেবের দাবি অনুযায়ী তিনি সুন্নাহর অনুসরণে অতীব আগ্রহী ছিলেন, তাহলে তো একথা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, মূল সুন্নাহ হলো বৈঠক না করা। অন্যথায় ইমাম আহমদ এটি অবলম্বন করতেন না।
এরপর আলবানী সাহেব ইবনে হানীর মাসাইল গ্রন্থের উদ্ধৃতি টেনেছেন। সেখানেও তিনি সত্য গোপন করেছেন। কারণ ইবনে হানীর যে বক্তব্য তিনি উল্লেখ করেছেন তার পূর্বেই ইবনে হানী লিখেছেন, ইমাম আহমদ বলেছেন,
لا ينهض على يديه إلا أن يكون شيخا كبيرا فينهض على يديه وينهض على صدور قدميه (رقم ২৫৯)
বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি ছাড়া কেউ হাতের উপর ভর দিয়ে উঠবে না। পায়ের উপর ভর দিয়েই উঠে দাঁড়াবে। (নং ২৫৯)
এরপর ২৬০ নম্বরে আলবানী সাহেবের উদ্ধৃত অংশটুকু উল্লেখ করা হয়েছে। আলবানী সাহেব কেন ইমাম আহমদের উক্তিটি গোপন করে গেলেন তা বোধ করি বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
আলবানী সাহেবের উদ্ধৃত অংশটুকুর সঙ্গে ইমাম আহমদের পূর্বের বক্তব্য ও ফতোয়ার মধ্যে কোন বৈপরিত্ব নেই। কারণ আহমদ রহ.তো বলেছেন, বয়োবৃদ্ধের জন্য এমন করার সুযোগ আছে। ইবনে হানী (জন্ম ২২৮ হি. মৃত্যু ২৭৫ হি.) ইমাম আহমদকে বার্ধক্য অবস্থাতেই পেয়েছিলেন। ইমাম আহমদ ২৪১ হি. সনে ইন্তেকাল করেছিলেন। তাই ইবনে হানী যদি কখনও কখনও তাকে এ বৈঠক করতে এবং হাতের উপর ভর দিয়ে উঠতে দেখে থাকেন তাতে তো বৈঠক না করার ব্যাপারে ইমাম আহমদের উল্লিখিত ফতোয়াটি আরো মজবুতভাবে প্রমাণিত হয়। কেননা বার্ধক্য বয়সেও তিনি সব সময় নয়, বরং মাঝেমধ্যে তাও আবার শেষ রাকাতে ওঠার সময় এ বৈঠক করতেন।
এরপর তিনি ইসহাক রহ. সম্পর্কে লিখেছেন, তিনি এ মতটি অবলম্বন করেছেন। ‘এ মতটি’ বলতে তিনি কি বুঝিয়েছেন সেটা তিনিই জানেন। কিন্তু এর প্রমাণ হিসাবে তিনি মারওয়াযী সংকলিত মাসাইল এর উদ্ধৃতি টেনে যে কথাটি বলেছেন তাতে বৈঠক সম্পর্কে কোন কথা এমনকি ইশারা ইঙ্গিতও নেই। সেখানে শুধু হাতের উপর ভর দিয়ে ওঠার কথা বলা হয়েছে। এমন তো হতে পারে, উক্ত উদ্ধৃতি অনুসারে তার মত হচ্ছে বৈঠক না করেই হাতের উপর ভর দিয়ে উঠে পড়বে। অধিকন্তু উদ্ধৃত অংশটুকু আমরা বহু খোঁজাখুঁজি করেও মারওয়াযীর উক্ত গ্রন্থে পাই নি। পেয়েছি তার বিপরীত কথা।
ইসহাক ইবনে রাহুয়ার মাযহাব
মারওয়াযী তাঁর উক্ত গ্রন্থে পরিষ্কার লিখেছেন,
قال إسحاق: ينهض على صدور قدميه ويعتمد بيديه على الأرض، فإن لم يقدر أن يعتمد على يديه وصدور قدميه جلس، ثم اعتمد على يديه وقام.(رقم ২২৬)
অর্থাৎ ইসহাক বলেছেন, উভয় হাত দ্বারা মাটিতে ভর দেবে, এবং পায়ের উপর ভর দিয়েই দাঁড়িয়ে যাবে। যদি মাটিতে ভর দিয়েও পায়ের উপর ভর করে দাঁড়াতে না পারে, তাহলে বসে পড়বে, পরে হাতের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। (নং ২২৬)
আলবানী সাহেব যে মাঝে মধ্যে ভুল বরাত দেন এটি তার একটি প্রমাণ।
ইসহাক রহ. যে বৈঠক না করার পক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন, সে কথা শুধু মারওয়াযীই বলেন নি। ইবনুল মুনযির রহ. (মৃত্যু ৩১৮ হি.) তার আল আওসাত গ্রন্থে (৩/১১৫) ও ইমাম বাগাবী রহ. তাঁর শারহুস সুন্নাহ গ্রন্থে (৩/১৬৫) একই কথা বলেছেন।
বড়ই আশ্চর্য লাগে, কোনরূপ তাহকীক ছাড়া আসাদুল্লাহ গালিব তার ছালাতুর রাসূল ছাঃ গ্রন্থে (পৃ. ১১৫) ও মুযাফফর বিন মুহসিন তার জাল হাদীসের কবলে রাসূলুল্লাহ ছাঃ এর ছালাত গ্রন্থে (পৃ. ২৭৩) আলবানী সাহেবের উদ্ধৃত ইসহাক রহ.এর পূর্বোক্ত বক্তব্যটি উল্লেখ করে দিয়েছেন।
শায়খ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম রহ.এর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্য :
আরবের প্রথম ও প্রধান মুফতী তৎসঙ্গে প্রধান বিচারপতি খ্যাতনামা আলেম শায়খ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম রহ. (মৃত্যু ১৩৮৯ হি.) এবং সেই সঙ্গে শায়খ সালিহ উছায়মীনের তথ্যপূর্ণ ও প্রমাণভিত্তিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এই পর্যালোচনার ইতি টানছি। তাদের বক্তব্যে পাঠক মহোদয় অন্যান্য উপকারী কথার পাশাপাশি আলবানী সাহেবের সে প্রশ্ন ও আপত্তির জবাবও পেয়ে যাবেন, যা তিনি ইবনুল কায়্যিম রহ. এর বক্তব্য না বুঝেই তার উপর উত্থাপন করে বসেছেন। শায়খ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম লিখেছেন :
فإِن الجماعة من الصحابة الذين رووا صفة صلاة النبي صلى الله عليه وسلم كأَبي حميد الذي كان أَوعى لهذا، وكذلك سائر الصحابة الذين رووا(৩) لم يذكروا هذه الجلسة. ولا يقال هنا أَنها من باب الزيادة التي انفرد بها الثقة، فإِن مثل هذا الشيء المتكرر في اليوم والليلة خمس مرات خمسة عشر عامًا لا يتصور أَن يحفظه واحد والبقية لا يحفظون. أَما لو كانت واقعة واحدة لتصور فيها. الحاصل أَنهم جماعة وعدد كثير لا يحفظون صلاة الرسول كل يوم خمس مرات ويحفظ الواحد!. هذا من البعيد جدًا أَو الممتنع.) فتاوى ورسائل محمد بن إبراهيم آل الشيخ، رقم: ৫৫৮)
অর্থাৎ বিরাট সংখ্যক সাহাবা যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামাযের বিবরণ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে বিশেষত আবু হুমায়দ রা. যিনি খুব বেশি তা মনে রেখেছেন, এছাড়া অন্যান্য সকল সাহাবী, যারা এতদবিষয়ে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাদের কেউই এ বৈঠকের কথা উল্লেখ করেন নি। এখানে একথা বলার সুযোগ নেই যে, এটা সেই বাড়তি অংশের মতো যা কোন বিশ্বস্ত ব্যক্তি এককভাবে বর্ণনা করে থাকেন। কেননা এ ধরনের আমল, যা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে পনের বছর পর্যন্ত বারবার ঘটতে থাকবে, তা শুধু একজন মনে রাখবেন আর বাকিরা কেউই মনে রাখবেন না, এটা কল্পনাও করা যায় না। হ্যাঁ, ঘটনা যদি শুধু একবার ঘটতো তবে এটা ভাবতে অসুবিধা হতো না। সারকথা, এত বিরাট সংখ্যক সাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের এ আমল মনে রাখবেন না, শুধু একজন মনে রাখবেন, এটা দুস্কর বা প্রায় অসম্ভব। (ফাতাওয়া ওয়া রাসায়েল, শায়ক মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম আলে শায়েখ, নামায অধ্যায়, নং ৫৫৮)
একইভাবে শায়খ মুহাম্মদ সালিহ উছায়মীন রহ. তার ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম গ্রন্থে (এটির বাংলা অনুবাদও প্রকাশ পেয়েছে) বলেছেন, এ মাসআলাটিতে বিদ্বানদের তিন ধরনের মত পাওয়া যায়। এক. উক্ত বৈঠক সর্বদাই মুস্তাহাব। দুই. কখনোই মুস্তাহাব নয়। তিন. উল্লিখিত দুটি মতের মাঝামাঝি মত। অর্থাৎ সরাসরি দাঁড়াতে যাদের কষ্ট হয় তারা বৈঠক করবে। আর যাদের কষ্ট না হয় তারা করবে না। মুগনী গ্রন্থকার (ইবনে কুদামা রহ.) এটিকে মধ্যপন্থী মত আখ্যা দিয়েছেন। আর মালেক ইবনুর হুওয়ায়রিছ রা. বর্ণিত হাদীসটিকে রাসূল সা. এর বৃদ্ধকালীন আমল হিসাবে গণ্য করেছেন। শায়খ উছায়মীন বলেন,
وهذا القول هو الذي أميل إليه أخيراً وذلك لأن مالك بن الحويرث قدم على النبي صلى الله عليه وسلم وهو يتجهز في غزوة تبوك والنبي صلى الله عليه وسلم فى ذلك الوقت قد كبر وبدأ به الضعف،
অবশেষে আমি এমতটিই গ্রহণ করেছি। কেননা মালেক ইবনুল হুওয়ায়রিছ রা. এমন সময়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করেছিলেন, যখন তিনি তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আর এসময় তিনি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এবং তার শারীরিক দুর্বলতাও শুরু হয়ে গিয়েছিল।
এরপর শায়খ এই শারীরিক দুর্বলতার কিছু প্রমাণ তুলে ধরে বলেন,
ويؤيد ذلك أن في حديث مالك بن الحويرث ذكر الاعتماد على الأرض، والاعتماد على الشيء إنما يكون عند الحاجة إليه
অর্থাৎ উক্ত দুর্বলতা এর দ্বারাও সমর্থিত হয় যে, মালেক ইবনুল হুওয়ায়রিছ রা. বর্ণিত হাদীসে মাটির উপর ভর করার উল্লেখ এসেছে। আর প্রয়োজনের মুহূর্তেই কেবল কোন কিছুর উপর ভর দেওয়া হয়ে থাকে। (নং ২৫৩)
উলামায়ে কেরামের এসব বক্তব্য সামনে রেখে আলবানী সাহেবের বক্তব্যগুলো একটু ভেবে দেখুন। সেই সঙ্গে তামামুল মিন্নাহ গ্রন্থে তার যে চূড়ান্ত বক্তব্য এসেছে সেটি আরো বেশি করে ভেবে দেখুন। তিনি বলেছেন,
وإذ الأمر كذلك فيجب الاهتمام بهذه الجلسة والمواظبة عليها رجالا ونساء وعدم الالتفات إلى من يدعي أنه صلى الله عليه وسلم فعلها لمرض أوسن لأن ذلك يعني أن الصحابة ما كانوا يفرقون بين ما يفعله صلى الله عليه وسلم تعبدا وما يفعله لحاجة وهذا باطل بداهة
অর্থাৎ বিষয়টি যখন এমন, তাই এই বৈঠকটির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া এবং সদা সর্বদা আমল করা অত্যাবশ্যক। চাই পুরুষ হোক বা নারী। সেই সঙ্গে যারা দাবি করেন যে, নবী সা. অসুস্থতা বা প্রয়োজনের তাগিদে এমনটি করেছিলেন, তাদের কথায় কর্ণপাত না করা চাই। কেননা এর অর্থ দাঁড়ায় সাহাবীগণ এ পার্থক্যটিও করতে পারতেন না যে, কোনটি তিনি ইবাদত হিসাবে করেছেন আর কোনটি প্রয়োজনের খাতিরে। আর একথা সুস্পষ্ট বাতিল। (দ্র. ১/২১২)
এ বাড়াবাড়িরই শিকার হয়েছেন আমাদের দেশের কিছু লোক। মুযাফফর বিন মুহসিন কৃত জাল হাদীসের কবলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায গ্রন্থটিতে এ মাসআলাটিও উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে আমাদের উদ্ধৃত তিনটি দলিল উল্লেখ করা হয় নি। কিছু দুর্বল বর্ণনা এনে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এমনিভাবে মুরাদ বিন আমজাদ কৃত ‘প্রচলিত ভুল বনাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাত আদায়ের পদ্ধতি’ গ্রন্থ ও আসাদুল্লাহ গালিব কৃত ‘ছালাতুর রাসূল (ছা.)’ গ্রন্থে একই পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে।