প্রশ্ন
পুরো দুনিয়াতো আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন। সবাই আল্লাহর বান্দা। কিন্তু কেউ গরীব কেউ ধনী কেন? আল্লাহ চাইলেতো সবাইকে ধনী হিসেবেই সৃষ্টি করতে পারতেন।
কিন্তু ধনী গরীব, আমীর ফকীরের এ বিভাজন কেন আল্লাহ তাআলা তৈরী করে দিলেন?
দয়া করে কুরআন ও হাদীসের আলোকে জবাব দিবেন।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
বেশ কিছু হেকমতের কারণে আল্লাহ তাআলা মানুষের সম্পদের এ বিভাজন তৈরী করে দিয়েছেন।
১
দুনিয়া হলো মূলত পরীক্ষার স্থান। এখানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে এর প্রতিফল আখেরাতে পাওয়া যাবে।
ধনী গরীবের এ তারতম্য হলো পরীক্ষারই একটি প্রশ্নের মতো। ধনী হওয়া যেমন পরীক্ষা, তেমনি গরীব হওয়াটাও একটি পরীক্ষা।
আল্লাহ তাআলা কাউকে ধনী বানিয়ে পরীক্ষা করেন। ধন সম্পদ পেয়ে সে কি আল্লাহকে স্মরণ করে নাকি ভুলে যায়। এসবকে নিজের কামাই মনে করে অহংকার করে নাকি আল্লাহর দান বলে শুকরিয়া জানায়?
সম্পদের যাকাত, দান, স্বজনদের হক আদায় এবং দ্বীনের কাজে, জনহিতকর কাজে ব্যয় ইত্যাদির মাধ্যমে সে কি আল্লাহর হুকুমের অধীনে থাকে, নাকি গোনাহের গড্ডালিকায় গা ভাসায়?
এটা তার জন্য বড়ই কঠিন পরীক্ষা।
আর দারিদ্রতাও একটি পরীক্ষা।
দারিদ্রতায় নিপতিত হয়ে সে কি আল্লাহর নাফরমান হয়ে যায়? হারাম পন্থায় অর্থ উপার্জনে চেষ্টা করে? নাকি আল্লাহর হুকুম আহকাম পালনে সচেষ্ট থাকে।
এসব কিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা।
মূলত দারিদ্রতার পরীক্ষার চেয়ে ধনী হবার পরীক্ষাটা বেশি কঠিন। কারণ, ধনাঢ্যতা মানুষকে বেশিরভাগ গোনাহের দিকে ধাবিত করে। অহংকারী মনোভাব চলে আসার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
তাই ধনী হবার পরীক্ষাটা গরীব হবার পরীক্ষার চেয়ে তুলনামূলক জটিল ও কঠিন।
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ ﴿الملك: ٢
যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য যে, কর্মে তোমাদের মধ্যে কে উত্তম। তিনিই পরিপূর্ণ ক্ষমতার মালিক, অতি ক্ষমাশীল। [সূরা আল মুল্ক – ২]
أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَن يَشَاءُ وَيَقْدِرُ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ ﴿الروم: ٣٧
তারা কি দেখেনি আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা রিযক প্রশস্ত করে দেন এবং (যার জন্য ইচ্ছা) সংকীর্ণ করে দেন? ১৯ নিশ্চয়ই এর মধ্যে নিদর্শন আছে সেই সব লোকের জন্য, যারা ঈমান আনে। [সূরা আর রুম – ৩৭]
وَلَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَىٰ مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِّنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَأَبْقَىٰ ﴿طه: ١٣١
তুমি পার্থিব জীবনের ওই চাকচিক্যের দিকে চোখ তুলে তাকিও না, যা আমি তাদের (অর্থাৎ কাফেরদের) বিভিন্ন শ্রেণীকে মজা লোটার জন্য দিয়ে রেখেছি, তা দ্বারা তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। বস্তুত তোমার রব্বের রিযক সর্বাপেক্ষা উত্তম ও সর্বাধিক স্থায়ী। [সূরা ত্বা-হা – ১৩১]
انظُرْ كَيْفَ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ وَلَلْآخِرَةُ أَكْبَرُ دَرَجَاتٍ وَأَكْبَرُ تَفْضِيلًا ﴿الإسراء: ٢١
লক্ষ্য কর, আমি কিভাবে তাদের কতককে কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। নিশ্চিত জেনো যে, আখেরাত মর্যাদার দিক থেকেও মহোত্তর এবং মাহাত্ম্যের দিক থেকেও শ্রেষ্ঠতর। [সূরা বনী ইসরাঈল – ২১]
الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُم بِالْفَحْشَاءِ وَاللَّهُ يَعِدُكُم مَّغْفِرَةً مِّنْهُ وَفَضْلًا وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ﴿البقرة: ٢٦٨
শয়তান তোমাদেরকে অভাব অনটনের ভীতি প্রদর্শন করে এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তোমাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও বেশী অনুগ্রহের ওয়াদা করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সুবিজ্ঞ। [সূরা বাকারা-২৬৮]
إِنَّ سَعْيَكُمْ لَشَتَّى (4) فَأَمَّا مَنْ أَعْطى وَ اتَّقى (5) وَ صَدَّقَ بِالْحُسْنى (6) فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرى (7) وَ أَمَّا مَنْ بَخِلَ وَ اسْتَغْنى (8) وَ كَذَّبَ بِالْحُسْنى (9)فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرى (10) وَ ما يُغْني عَنْهُ مالُهُ إِذا تَرَدَّى (11) إِنَّ عَلَيْنا لَلْهُدى (12) وَ إِنَّ لَنا لَلْآخِرَةَ وَ الْأُولى (سورة الليل-4/13)
বস্তুত তোমাদের প্রচেষ্টা বিভিন্ন রকমের। সুতরাং যে ব্যক্তি (আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ) দান করেছে ও তাক্বওয়া অবলম্বন করেছে। এবং সর্বোত্তম বিষয় মনে প্রাণে স্বীকার করে নিয়েছে। আমি তাকে স্বস্তিময় গন্তব্যে পৌঁছার ব্যবস্থা করে দেব। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কৃপণতা করল এবং আল্লাহর প্রতি বেপরোয়া দেখাল, এবং সর্বোত্তম বিষয়কে প্রত্যাক্ষান করল। আমি তার যাতনাময় স্থানে পৌঁছার ব্যবস্থা করে দেব। সে যখন ধ্বংস-গহ্বরে পতিত হবে, তখন তার সম্পদ তার কোন কাজে আসবে না। বস্তুত পথ দেখিয়ে দেওয়া আমারই দায়িত্ব। এবং অবশ্যই আখেরাত ও দুনিয়া আমারই কর্তৃত্বাধীন। অতএব আমি তোমাদের সতর্ক করে দিলাম এক লেলিহান আগুন সম্পর্কে। [সূরা লাইল-৪-১৬]
২
ধনী গরীবের তারতম্য করা হয়েছে যেন একজন অপরজন থেকে কাজ নিতে পারে।
যদি সবাই ধনী হয়, তাহলে কেউ কারো কাজে লাগতে চাইবে না। সম্পদের তারতম্য না থাকলে কে গাড়ি চালাবে? কে বিল্ডিং বানানোর মিস্ত্রির কাজ করবে? কে জুতা সেলাই করবে? কে রাস্তা পরিস্কার করবে? কে টয়লেট পরিস্কার করবে? কে রোগীর সেবা করবে? কে বাড়িঘর পাহারা দিবে?
যেন সমাজ ও রাষ্ট্র টিকে থাকে, একজন অপরজন থেকে উপকার নিতে পারে, এ কারণে আল্লাহ তাআলা ধনী গরীবের এ পার্থক্য করে দিয়েছেন।
نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُم مَّعِيشَتَهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِّيَتَّخِذَ بَعْضُهُم بَعْضًا سُخْرِيًّا وَرَحْمَتُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ ﴿الزخرف: ٣٢
পার্থিব জীবনে তাদের জীবিকাও তো আমিই বণ্টন করেছি এবং আমিই তাদের একজনকে অপরজনের উপর মর্যাদায় উন্নত করেছি, যাতে তাদের একে অন্যের দ্বারা কাজ নিতে পারে। তোমার প্রতিপালকের রহমত তো তারা যা (অর্থ-সম্পদ) সঞ্চয় করে, তা অপেক্ষা অনেক শ্রেয়। [সূরা আয্-যুখরুফ – ৩২]
৩
আল্লাহ তাআলা সবাইকে সম্পদের মালিক বানিয়ে দিলে তারা সেই সম্পদ নিয়ে গোনাহের সাগরে হাবুডুবু খেতো। তাই সবাইকে সম্পদের মালিক বানাননি।
وَلَوْ بَسَطَ اللَّهُ الرِّزْقَ لِعِبَادِهِ لَبَغَوْا فِي الْأَرْضِ وَلَٰكِن يُنَزِّلُ بِقَدَرٍ مَّا يَشَاءُ إِنَّهُ بِعِبَادِهِ خَبِيرٌ بَصِيرٌ ﴿الشورى: ٢٧
আল্লাহ যদি তার সমস্ত বান্দার জন্য রিযককে বিস্তার করে দিতেন, তবে পৃথিবীতে তারা তার অবাধ্যতায় লিপ্ত হত, কিন্তু তিনি যে পরিমাণে ইচ্ছা তা অবতীর্ণ করে থাকেন। নিশ্চয়ই তিনি নিজ বান্দাদের সম্পর্কে পরিপূর্ণরূপে জানেন, তাদের প্রতি দৃষ্টি রাখেন। [সূরা শুরা-২৭]
ইত্যাদি কারণে আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে মানুষকে ধনী গরীবে বিভাজিত করেছেন। আখেরাতে কেবল আল্লাহর হুকুম পালনকারীরাই শ্রেষ্টত্ব পাবে। সেখানে দুনিয়ার ধনী গরীব হওয়া কোন প্রভাব সৃষ্টি করবে না।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া ইসলামিয়া দারুল হক লালবাগ ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা: জামিয়াতুস সুন্নাহ কামরাঙ্গিরচর, ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা: কাসিমুল উলুম আলইসলামিয়া, সালেহপুর আমীনবাজার ঢাকা।
পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।
শাইখুল হাদীস: জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, সনমানিয়া, কাপাসিয়া, গাজীপুর।
ইমেইল– [email protected]