আল্লামা মনজূর নূমানী রহঃ
এ কথা সবাই জানে ও মানে, যে ব্যক্তি জন্ম গ্রহণ করেছে তাকে মৃত্যু বরণ করতেই হবে। কিন্তু মৃত্যুর পর কী হবে কেউ তা জানে না। আপনা আপনি জানারও কোনো উপায় নেই। এটা শুধু আল্লাহ পাকই ভালো জানেন। তিনি নবীদেরকে জানিয়েছেন, আমরা তা নবীদের কাছ থেকে জেনেছি। প্রত্যেক নবী তার জাতিকে জানিয়েছেন এবং প্রমাণ করে বুঝিয়েছেন, মৃত্যুর পরের ঘাটিগুলো কী কী, কোন ঘাটিতে কৃতকর্মের কোন শাস্তি বা পুরস্কার অপেক্ষা করছে সবি তারা উম্মতের সামনে বর্ণনা করেছেন। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু সর্বশেষ নবী, তাই তিনি এ বিষয়গুলো খুবই তফসিলের সাথে বয়ান করেছেন। সবগুলি একত্রিত করলে বিরাট এক কিতাব হয়ে যাবে।
কোরআন ও হাদীসে এ সম্পর্কে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, তার সারাংশ হলো, মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে তিনটি অধ্যায় আসবে ।
এক. বরযখ অধ্যায়:
এর পরিধি মৃত্যুর পর থেকে (কেয়ামত ও) পুনরুত্থান পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়। একে কবরের জগত বলা হয়। মৃত্যুর পর মানুষের দেহ দাফন হোক বা পুড়ে ছাই হোক, কিংবা জন্তুর পেটে যাক বা সাগরে ভাসুক সর্বাবস্থায় তার রূহ বা প্রাণ অক্ষয় থাকে। মৃত্যুর পর রূহ চলে যায় বরযখের জগতে। সেখানে ফেরেশতারা তাকে কিছু প্রশ্ন করে। যদি তার ঈমান ও আমলে সালেহ থাকে, তবে ঠিকঠিক উত্তর দিতে পারে। তখন ফেরেশতারা তাকে সুসংবাদ দিয়ে বলে, তুমি কেয়ামত পর্যন্ত আরামে ঘুমাও। কিন্তু সে যদি মুমিন না হয়, অথবা গোনাহগার মুসলমান হয়, তবে তখন থেকে তার উপর আযাব শুরু হয়ে যায় এবং কেয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকে।
দুই. হাশর ও কেয়ামত অধ্যায়:
এর সময়কাল কেয়ামত আরম্ভের পর থেকে বিচারকার্য শেষ হওয়া পর্যন্ত। কঠিন মাত্রায় ভূমিকম্প হলে যেমন সব কিছু চুরমার হয়ে যায়, তেমনি কেয়াতের সময় সমগ্র বিশ্বের সবকিছু ভেঙ্গেচুরে ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে। এই মহাপ্রলয় শেষে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হবার পর সকল মানুষের পুনরুত্থান হবে। দুনিয়াতে কে কী আমল করেছে তার হিসাব হবে। হিসাবে যাদের নেক আমল বেশী হবে তারা জান্নাতে যাবার অনুমতি পাবে। আর যাদের বদ আমলের পাল্লা ভারী হবে, তাদেকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এরই নাম হাশর ও কেয়ামত, মৃত্যুর পরের দ্বিতীয় অধ্যায়।
তিন. শেষ অধ্যায়:
বিচার শেষে জান্নাত বা জাহান্নামের ফায়সালা হবার পর এ অধ্যায়ের সূচনা হবে এবং অনন্ত কাল চলতে থাকবে। যারা জান্নাতী হবে, তারা এমন সুখ ও সম্ভোগে থাকবে, যা দুনিয়ার কোনো চোখ দেখেনি, কোন কান শোনেনি এবং কোনো হৃদয়ে তার কল্পনাও আসেনি। আর যারা দোযখে যাবে, তারা কঠিন থেকে কঠিন আযাব ও শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে জাহান্নাম থেকে হেফাজত করুন।
জান্নাত ও জাহান্নাম মৃত্যুর পরের তৃতীয় এবং শেষ অধ্যায়। এখানে মানুষ স্ব-স্ব আমল অনুসারে অবস্থান করবে। এ সম্পর্কিত কিছু আয়াত ও হাদীস তুলে ধরা হচ্ছে। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ
প্রত্যেক জীবন মরণের স্বাদ গ্রহণ করবে। অতঃপর তোমরা আমার নিকট প্রত্যানীত হবে। সূরা আনকাবূত ২৯/৫৭
অনুরূপ এক আয়াতে এসেছে,
كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
প্রতিটি প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর তোমাদের কৃতকর্মের ফল দেয়া হবে কেয়ামত দিবসে। সূরা আলে ইমরান ৩/১৮৫
অন্য আয়াতে এসেছে,
হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবের ক্রোধকে ভয় করো। জেনে রাখো, কেয়ামতের প্রকম্পন বড়ই ভয়াবহ বিষয়। যে দিন সেই প্রকম্পন প্রত্যক্ষ্য করবে, সে দিন সকল স্তন্যদায়িনী মা তার দুধের শিশুর কথা ভুলে যাবে। গর্ভবতীদের গর্ভপাত হয়ে যাবে। সকল মানুষকে তোমার মনে হবে নেশাগ্রস্থ মাতাল, অথচ তারা মাতাল বা নেশাগ্রস্থ নয়, আসলে সেদিন আল্লাহর আযাব হবে বড় কঠিন! সূরা ২২/১-২
আরেক আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন,
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ. يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا أَرْضَعَتْ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللَّهِ شَدِيدٌ
স্মরণ করো সেদিনের কথা, যেদিন ভূম-ল ও পর্বতমালা ভীষণভাবে কেঁপে ওঠবে এবং পাহাড়সমুহ ঝুরঝুরে বালুর মতো উড়ে যাবে। সূরা হজ্ব ৭৩/১৪
অন্যত্র বলেন,
فَكَيْفَ تَتَّقُونَ إِنْ كَفَرْتُمْ يَوْمًا يَجْعَلُ الْوِلْدَانَ شِيبًا
কুফুরি করে সে দিনের আযাব থেকে কিভাবে বাঁচবে, যেদিনের ভয়াবহতা কিশোরকে বৃদ্ধ বানিয়ে ছাড়বে। সূরা ৭৩/১৭
অপর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন,
فَإِذَا جَاءَتِ الصَّاخَّةُ. يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ. وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ. وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ. لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ. وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ مُسْفِرَةٌ. ضَاحِكَةٌ مُسْتَبْشِرَةٌ. وَوُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ عَلَيْهَا غَبَرَةٌ. تَرْهَقُهَا قَتَرَةٌ
যে দিন গগণবিদারী আওয়াজ উপস্থিত হবে, সেদিন মানুষ আপন ভাই, পিতা-মাতা, স্ত্রী এবং সন্তান থেকেও পালিয়ে বেড়াবে। প্রতেকের এমন কঠিন অবস্থা হবে যে, অন্যের প্রতি লক্ষ্য করার সুযোগই হবে না। সেদিন কিছু চেহারা প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে এবং হাস্যোজ্জ্বল দেখাবে, আর কিছু চেহারা ধূলিমলিন হবে, কালিমায় আচ্ছন্ন হয়ে যাবে। সূরা আবাসা ৮০/৩৩-৪১
কেয়ামতের দিন সকল মানুষকে আল্লাহ তাআলার সামনে হাজির করা হবে, কেউ কোন কিছু গোপন করতে পারবে না। আল্লাহ পাক বলেন,
يَوْمَئِذٍ تُعْرَضُونَ لَا تَخْفَى مِنْكُمْ خَافِيَةٌ
সেদিন এমনভাবে তোমাদেরকে উপস্থাপন করা হবে যে, তোমাদের কোনো গুপ্ত বিষয় আর গুপ্ত থাকবে না। সূরা হাক্কাহ ৬৯/১৮
অন্য আয়াতে বলেন,
الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
আজ আমি তাদের মুখ সিলগালা করে দিবো। তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের অপকর্মের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে। সূরা ইয়াসীন ৩৬/৬৫
অন্য জায়গায় আল্লাহ পাক বলেন,
وَيَوْمَ نُسَيِّرُ الْجِبَالَ وَتَرَى الْأَرْضَ بَارِزَةً وَحَشَرْنَاهُمْ فَلَمْ نُغَادِرْ مِنْهُمْ أَحَدًا. وَعُرِضُوا عَلَى رَبِّكَ صَفًّا لَقَدْ جِئْتُمُونَا كَمَا خَلَقْنَاكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ بَلْ زَعَمْتُمْ أَلَّنْ نَجْعَلَ لَكُمْ مَوْعِدًا. وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَاوَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا
সেদিনের কথা স্মরণ রাখো, যেদিন আমি পাহাড়গুলি টলিয়ে চুর্ণবিচূর্ণ করে মাটিতে মিশিয়ে দিবো। ফলে তুমি পৃথিবীটাকে একদম সমতল অবস্থায় দেখতে পাবে। তখন তাদের সকলকে আমি একত্রিত করবো এবং কাউকে বাদ দিবো না। সকলকে সারিবদ্ধভাবে আপনার পালনকর্তার দরবারে হাজির করা হবে। আল্লাহ পাক বলবেন, আমি যেভাবে প্রথমবার তোমাদের সৃষ্টি করেছি, সেভাবে তোমরা আমার কাছে এসেগেছো, অথচ তোমরা বলে বেড়াতে, এই নির্ধারিত সময় আমি কখনো তোমাদের সামনে উপস্থিত করবো না! আর আমলনামা তাদের সামনে রাখা হবে। অপরাধীরা ভয়ে ভয়ে তাতে যা লেখা আছে তা দেখে বলে উঠবে, হায় কপাল! এ কেমন কিতাব! এতো আমাদের ছোট-বড় সব কিছুই হিসাব করে রেখেছে! সুতরাং তারা কৃতকর্মের ভালো-মন্দ সাক্ষাৎ বুঝতে পারবে। আপনার রব তো কারো প্রতি জুলুম করেন না। সূরা কাহাফ ১৮/৪৭-৪৯
মোটকথা, কেয়ামতের সময় হাশরের মাঠে যা যা ঘটবে, কোরআন শরীফে তার বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। হাদীস শরীফে এসেছে,
مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى يَوْمِ القِيَامَةِ كَأَنَّهُ رَأْيُ عَيْنٍ فَلْيَقْرَأْ: إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ، وَإِذَا السَّمَاءُ انْفَطَرَتْ، وَإِذَا السَّمَاءُ انْشَقَّتْ
যে ব্যক্তি কেয়ামতের দৃশ্য চাক্ষুষ দেখতে চায়, সে যেন কোরআনের তাকবীর, ইনফেতার ও ইনশেকাক এই তিনটি সূরা পাঠ করে। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৩৩
এমনিভাবে হাদীস শরীফেও বরযখ, কেয়ামত ও আখেরাতের লম্বা বিবরণ এসেছে। নবীজী ইরশাদ করেন,
إِنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا مَاتَ عُرِضَ عَلَيْهِ مَقْعَدُهُ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ، إِنْ كَانَ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَمِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ، وَإِنْ كَانَ مِنْ أَهْلِ النَّارِ فَمِنْ أَهْلِ النَّارِ، يُقَالُ: هَذَا مَقْعَدُكَ، حَتَّى يَبْعَثَكَ اللَّهُ إِلَيْهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
তোমাদের কেউ যখন মৃত্যু বরণ করে, তখন প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা দুবার হিসাব শেষে প্রাপ্ত তার জান্নাত বা জাহান্নামের অবস্থানক্ষেত্র তার সামনে প্রদর্শন করা হয় এবং বলা হয়, কেয়ামতের পর এই ঠিকানায় তুমি অবস্থান করবে। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৩১৩
অন্য হাদীসে এসেছে,
নবীজী একবার ওয়াজের সময় দোযখের কঠিন অবস্থা ও পরীক্ষাসমুহের বিবরণ তুলে ধরলেন। এতে উপস্থিত লোকেরা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। সহীহ বুখারী
আরও অনেক হাদীসে কবর তথা বরযখের জগতের আযাব ও সুয়াল-জয়াবের বিবরণ এসেছে।
কেয়ামত সম্পর্কে এক হাদীসে এসেছে,
ثُمَّ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ، فَلَا يَسْمَعُهُ أَحَدٌ إِلَّا أَصْغَى لِيتًا وَرَفَعَ لِيتًا، قَالَ: وَأَوَّلُ مَنْ يَسْمَعُهُ رَجُلٌ يَلُوطُ حَوْضَ إِبِلِهِ، قَالَ: فَيَصْعَقُ، وَيَصْعَقُ النَّاسُ، ثُمَّ يُرْسِلُ اللهُ أَوْ قَالَ يُنْزِلُ اللهُ – مَطَرًا كَأَنَّهُ الطَّلُّ أَوِ الظِّلُّ فَتَنْبُتُ مِنْهُ أَجْسَادُ النَّاسِ، ثُمَّ يُنْفَخُ فِيهِ أُخْرَى، فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُونَ، ثُمَّ يُقَالُ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ هَلُمَّ إِلَى رَبِّكُمْ، وَقِفُوهُمْ إِنَّهُمْ مَسْئُولُونَ
আল্লাহ তাআলার হুকুমে কেয়ামতের সময় যখন প্রথমবার শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেয়া হবে, তখন বিকট আওয়াজে সকল মানুষ অজ্ঞান হয়ে মারা যাবে। এরপর দ্বিতীয় ফুঁৎকারে আবার সবাই জীবিত হয়ে উঠবে। বলা হবে, তোমরা আপন প্রতিপালকের দরবারে হাজিরা দিতে চলো। ফেরেশতাদের বলা হবে, এদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করাও। এখানে কৃতকর্মের ব্যাপারে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৯৪০
একটি হাদীসে এসেছে, জনৈক সাহাবী নবীজীকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ পাক সমস্ত মাখলুককে দ্বিতীয়বার কিভাবে সৃষ্টি করবেন, দুনিয়াতে কি এর কোনো নজির আছে? নবীজী ইরশাদ করলেন,
أَمَا مَرَرْتَ بِوَادِي أَهْلِكَ مَحْلًا ؟ قَالَ: بَلَى، قَالَ: ثُمَّ مَرَرْتَ بِهِ يَهْتَزُّ خَضِرًا؟ قَالَ: بَلَى، قَالَ: فَكَذَلِكَ يُحْيِي اللَّهُ الْمَوْتَى وَذَلِكَ آيَتُهُ فِي خَلْقِهِ
তোমার কি কখনো এমন হয়নি যে, একবার স্বজাতির শষ্যক্ষেত্র দিয়ে অতিক্রম করার সময় তুমি তা শষ্যহীন শুকনো অবস্থায় দেখেছো, আবার অতিক্রম করার সময় দেখেছো তাতে সবুজ ফসল ঢেউ খেলছে? সাহাবী বললেন, হ্যাঁ দেখেছি। নবীজী সাল্লাল্রাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটাই দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করার উদাহরণ। এভাবেই আল্রাহ পাক সকল মৃতকে জীবিত করবেন। মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস নং ৮৭৪৬
আর এক হাদীসে এসেছে, নবীজী কোরআন শরীফের এই আয়াতখানি তেলাওয়াত করলেন,
يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا
কেয়মতের দিন জমিন তার তথ্য প্রকাশ করে দেবে। এরপর বললেন,
قَالَ: أَتَدْرُونَ مَا أَخْبَارُهَا؟ قَالُوا: اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَالَ: فَإِنَّ أَخْبَارَهَا أَنْ تَشْهَدَ عَلَى كُلِّ عَبْدٍ أَوْ أَمَةٍ بِمَا عَمِلَ عَلَى ظَهْرِهَا، تَقُولُ: عَمِلَ يَوْمَ كَذَا كَذَا وَكَذَا، فَهَذِهِ أَخْبَارُهَا. هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ غَرِيبٌ.
তোমরা এই আয়াতের মতলব জানো কি? সাহাবারা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। নবীজী বললেন, ভূপৃৃষ্ঠ নিজেই কেয়ামতের দিন তার পৃষ্ঠে কৃত সকল নর-নারীর আমলের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে। অর্থাৎ আল্লাহ পাকের হুকুমে জমীন কথা বলবে, অমুক দিন অমুক বান্দা-বান্দী আমার পৃষ্ঠে অমুক কাজ করেছে। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৫৩
অন্য হাদীসে এসেছে,
كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ شَهِيدًا، وَبِالْكِرَامِ الْكَاتِبِينَ شُهُودًا، قَالَ: فَيُخْتَمُ عَلَى فِيهِ، فَيُقَالُ لِأَرْكَانِهِ: انْطِقِي، قَالَ: فَتَنْطِقُ بِأَعْمَالِهِ
কেয়ামতের দিন আল্লাহ পাক কোনো কোনো বান্দাকে বলবেন, আজ তুমিই তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হবে। আর আমার লেখক ফেরেশতারাও মওজুদ আছে। সুতরাং এটুকু সাক্ষ্য যথেষ্ট। অত:পর আল্লাহ পাকের হুকুমে এই বান্দার মুখে তালা লেগে যাবে। সে মুখে কিছুই বলতে পারবে না। তার অন্যন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সাক্ষ্য দিতে বলা হবে। তখন সেগুলি তার কর্মকা- সবিস্তারে তুলে ধরবে। সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৬৯
এক ব্যক্তি নবীজীর দরবারে হাজির হয়ে আরজ করলো,
يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنَّ لِي مَمْلُوكِينَ يُكَذِّبُونَنِي وَيَخُونُونَنِي وَيَعْصُونَنِي، وَأَشْتُمُهُمْ وَأَضْرِبُهُمْ فَكَيْفَ أَنَا مِنْهُمْ؟ قَالَ: يُحْسَبُ مَا خَانُوكَ وَعَصَوْكَ وَكَذَّبُوكَ وَعِقَابُكَ إِيَّاهُمْ، فَإِنْ كَانَ عِقَابُكَ إِيَّاهُمْ بِقَدْرِ ذُنُوبِهِمْ كَانَ كَفَافًا، لَا لَكَ وَلَا عَلَيْكَ، وَإِنْ كَانَ عِقَابُكَ إِيَّاهُمْ دُونَ ذُنُوبِهِمْ كَانَ فَضْلًا لَكَ، وَإِنْ كَانَ عِقَابُكَ إِيَّاهُمْ فَوْقَ ذُنُوبِهِمْ اقْتُصَّ لَهُمْ مِنْكَ الفَضْلُ. قَالَ: فَتَنَحَّى الرَّجُلُ فَجَعَلَ يَبْكِي وَيَهْتِفُ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَمَا تَقْرَأُ كِتَابَ اللَّهِ وَنَضَعُ المَوَازِينَ القِسْطَ لِيَوْمِ القِيَامَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ. فَقَالَ الرَّجُلُ: وَاللَّهِ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا أَجِدُ لِي وَلَهُمْ شَيْئًا خَيْرًا مِنْ مُفَارَقَتِهِمْ، أُشْهِدُكَ أَنَّهُمْ أَحْرَارٌ كُلُّهُمْ
হে আল্লাহর রাসুল! আমার কিছু ক্রীতদাস আছে, এরা কখনো কখনো অন্যায় করে, মিথ্যা বলে, খেয়ানত করে। আমি রেগে গিয়ে তাদের মন্দছন্দ বলি, মারধরও করি, কেয়ামতের দিন এর পরিণাম কী হবে? নবীজী ইরশাদ করলেন, আল্লাহ পাক কেয়ামতের দিন পূর্ণ ইনসাফের সঙ্গে ফায়সালা করবেন। তোমার-দেয়া শাস্তি যদি অপরাধ সমান হয়, তবে তোমার হিস্যায় কিছু আসবে না, হিস্যা থেকে কিছু যাবেও না। আর যদি শাস্তি অপরাধের তুলনায় কম হয়, তবে অপরাধের বাকি অংশ ক্ষমা করার সওয়াব তোমার হিস্যায় আসবে। কিন্তু যদি অপরাধের চে শাস্তি বেশি হয়, তবে তাদের জন্য তোমার থেকে শোধ নেওয়া হবে। হাদীস শুনে প্রশ্নকারী লোকটি কান্নাকাটি আরম্ভ করলো। নবীজী লোকটির সামনে এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন, ‘কেয়ামতের দিন আমি ইনসাফের পাল্লা কায়েম করবো। তখন কারো প্রতি চুল পরিমাণ বেইনসাফি করা হবে না। কারো যদি শরিষাদানা সমান হক থাকে, তবে তাও আমি উপস্থিত করবো। পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাবের জন্য আমি যথেষ্ট।’ লোকটি বললো, হে রাসুল! তবে তো এটাই আমার জন্য নিরাপদ যে, আমি তাদের মুক্ত করে দিবো। আপনি সাক্ষী, আমি আমার সকল গোলাম আজাদ করে দিলাম। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩১৬৫
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে জীবদ্দশায় মরণোত্তর জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণ করার এবং কবর, কেয়ামত ও আখেরাতের অবস্থাদির বিষয়ে সচেতন থাকার তাওফীক দান করুন, আমীন।