প্রচ্ছদ / তালাক/ডিভোর্স/হুরমত / তালাক দিলাম তিনবার বলার পর করণীয় কী?

তালাক দিলাম তিনবার বলার পর করণীয় কী?

প্রশ্ন

আমার বউ বাপের বাড়ী থাকে। আমি ঢাকায় থাকি। ৮ তারিখ রাতে আমাদের মধ্যে ফোনে কথা বলতে গিয়ে ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে আমি বলিঃ এমন করলে কিন্তু আমি তোমাকে তালাক দিবো। এটা ছিল ওকে ভয় দেখানোর জন্য, কিন্তু ও ভয় না পেয়ে রাগের মাথায় ও আমাকে বলে, দেন, তালাক দেন। তখন আমিও রাগে বলি তোমাকে তালাক দিলাম। তোমাকে তালাক দিলাম। তোমাকে তালাক দিলাম।

কিন্তু ৫ মিনিট এর মধ্যেই আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পারি। একজন আরেকজনকে সরি বলি। হুজুর আমরা যদি এক সাথে থাকতে না পরি, তাহলে দুই জনেই মারা যাবো। তাই আপনার কাছে আমাদের আকুল আবেদন আমাদের দুইজনকে এক সাথে থাকার ব্যবস্থা করে দিন। আমি এখন পাগলপ্রায়। কি করবো বুঝে পাচ্ছি না। কিছু বলুন। প্লিজ।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

একজনকে ছাড়া আরেকজন থাকতে পারবেন না। মারা যাবেন। এত মোহাব্বত থাকা অবস্থায় তালাক দেবার মত আত্মঘাতি কাজ কেন করতে গেলেন?

রাগ হলেই তালাক দিতে হবে এমন কথা আপনাদের কে শিখিয়েছে?

স্ত্রীর মাঝে একটি বিষয় খারাপ দেখলে তার আরেকটি বিষয়ের দিকে তাকিয়ে সেই খারাবী ভুলে যেতে হাদীসে উৎসাহিত করা হয়েছে।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً، إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِيَ مِنْهَا آخَرَ» أَوْ قَالَ: «غَيْرَهُ

হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, কোন মুমিন পুরুষ যেন কোন মুমিনা নারীকে শত্রু মনে না করে। কেননা, সে তার এক কাজকে নাপছন্দ করলে তার অপর কাজকে পছন্দ করবে। {মুসলিম, হাদীস নং-১৪৬৯}

মনের দুঃখে এখন মারা গেলেও মারা যাবেন। আর দু’দিন পর হলেও মারা যাবেন। আমরা কেউ দুনিয়াতে থাকবো না। সবারই একদিন চলে যেতে হবে। কেউ আগে। কেউবা পরে।

সবারই মহান মালিকের সামনে দাঁড়াতে হবে। নিজের কৃতকর্মের হিসেবে দিতে হবে। দুনিয়া এক পরীক্ষার স্থান। মায়ার পরীক্ষা। মোহাব্বতের পরীক্ষা। স্ত্রী সন্তানের পরীক্ষা। সম্পদের পরীক্ষা।

এমনি পরীক্ষায় যে ব্যক্তি মালিকের বিধানকে গলার মালা বানায়, আর সকল কিছুকে বিসর্জন দেয়, উক্ত ব্যক্তিই আখেরাতের প্রকৃত সফলকাম ব্যক্তি।

তাই মন না মানলেও শরয়ী বিধান মেনে নেয়া ব্যক্তিরাই প্রকৃত জ্ঞানী।

কারো গলা কেটে হত্যার পর আফসোস করে কোন লাভ নেই। তেমনি স্ত্রীকে তিন তালাক দেবার পর আফসোস করে কোন লাভ নেই।

তালাক তিনটি দেয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না। রাগ যদি কন্ট্রোলই করতে না পারেন। যদি স্ত্রীকে রাখতেই না চান, তাহলে এক তালাক দিন। সর্বোচ্চ দুই তালাক দিন।

তিন তালাক কেন?

তিন তালাক দিলে যেমন স্ত্রী আলাদা হয়ে যায়, তেমনি এক তালাক দিলেওতো আলাদা হয়ে যায়। তাহলে তিন তালাক দেবার প্রয়োজনই বা কি?

দেবার পর আফসোক করে কি লাভ?

আমরা শরীয়তের মাসআলা বলে দেবার অধিকারী। শরয়ী মাসআলা পরিবর্তন করার অধিকার আমাদের নেই। তাই আমাদের কাছে বৈধতার আবেদন করাটা অনর্থক। সেই সাথে আমাদের জন্য চরম বিব্রতকর।

মাসআলার সমাধান

তিন তালাক দেবার দ্বারা আপনার স্ত্রী আপনার উপর হারাম হয়ে গেছে। এখন ইদ্দত তথা তিন হায়েজ শেষ হবার পর আপনার স্ত্রীর যদি অন্য কোথাও বিয়ে হয়, সেখানে নিয়মমাফিক সংসার করতে থাকে। তারপর কোন কারণে দ্বিতীয় স্বামী তালাক দেয়, তাহলেই কেবল উক্ত স্ত্রীকে ইদ্দত শেষে পুনরায় আপনি বিয়ে করার সুযোগ পাবেন। এছাড়া আর কোন গত্যান্তর নেই।

الطَّلَاقُ مَرَّتَانِ ۖ فَإِمْسَاكٌ بِمَعْرُوفٍ أَوْ تَسْرِيحٌ بِإِحْسَانٍ ۗ وَلَا يَحِلُّ لَكُمْ أَن تَأْخُذُوا مِمَّا آتَيْتُمُوهُنَّ شَيْئًا إِلَّا أَن يَخَافَا أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ ۖ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا فِيمَا افْتَدَتْ بِهِ ۗ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَعْتَدُوهَا ۚ وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ اللَّهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ [٢:٢٢٩]

তালাকে-‘রাজঈ’ হ’ল দুবার পর্যন্ত তারপর হয় নিয়মানুযায়ী রাখবে, না হয় সহৃদয়তার সঙ্গে বর্জন করবে। আর নিজের দেয়া সম্পদ থেকে কিছু ফিরিয়ে নেয়া তোমাদের জন্য জায়েয নয় তাদের কাছ থেকে। কিন্তু যে ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই এ ব্যাপারে ভয় করে যে, তারা আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না, অতঃপর যদি তোমাদের ভয় হয় যে, তারা উভয়েই আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না, তাহলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী যদি বিনিময় দিয়ে অব্যাহতি নিয়ে নেয়, তবে উভয়ের মধ্যে কারোরই কোন পাপ নেই। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা। কাজেই একে অতিক্রম করো না। বস্তুতঃ যারা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করবে, তারাই জালেম। {সূরা বাকারা-২২৯}

এইতো গেল দুই তালাকের বিধান। এরপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তিন তালাক প্রদানের বিধান ঘোষণা করে ইরশাদ করেন-

فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِن بَعْدُ حَتَّىٰ تَنكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ ۗ فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَن يَتَرَاجَعَا إِن ظَنَّا أَن يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ ۗ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ [٢:٢٣٠]

তারপর যদি সে স্ত্রীকে (তৃতীয়বার) তালাক দেয়া হয়, তবে সে স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অপর কোন স্বামীর সাথে বিয়ে করে না নেবে, তার জন্য হালাল নয়। অতঃপর যদি দ্বিতীয় স্বামী তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তাদের উভয়ের জন্যই পরস্পরকে পুনরায় বিয়ে করাতে কোন পাপ নেই। যদি আল্লাহর হুকুম বজায় রাখার ইচ্ছা থাকে। আর এই হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা; যারা উপলব্ধি করে তাদের জন্য এসব বর্ণনা করা হয়। {সূরা বাকারা-২৩০}

وقال الليث عن نافع كان ابن عمر إذا سئل عمن طلق ثلاثا قال لو طلقت مرة أو مرتين فأن النبي صلى الله عليه و سلم أمرني بهذا فإن طلقتها ثلاثا حرمت حتى تنكح زوجا غيرك

হযরত নাফে রহ. বলেন,যখন হযরত ইবনে উমর রাঃ এর কাছে ‘এক সাথে তিন তালাক দিলে ‎তিন তালাক পতিত হওয়া না হওয়া’ (রুজু‘করা যাবে কিনা) বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলো,‎তখন তিনি বলেন-“যদি তুমি এক বা দুই তালাক দিয়ে থাকো তাহলে ‘রুজু’ [তথা স্ত্রীকে বিবাহ করা ছাড়াই ফিরিয়ে আনা] করতে পার। ‎কারণ,রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এরকম অবস্থায় ‘রুজু’ করার আদেশ দিয়েছিলেন। ‎যদি তিন তালাক দিয়ে দাও তাহলে স্ত্রী হারাম হয়ে যাবে, সে তোমাকে ছাড়া অন্য স্বামী গ্রহণ করা পর্যন্ত। {সহীহ বুখারী-২/৭৯২, ২/৮০৩}

عن مجاهد قال كنت عند ابن عباس فجاء رجل فقال إنه طلق امرأته ثلاثا. قال فسكت حتى ظننت أنه رادها إليه ثم قال ينطلق أحدكم فيركب الحموقة ثم يقول يا ابن عباس يا ابن عباس وإن الله قال (وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا) وإنك لم تتق الله فلم أجد لك مخرجا عصيت ربك وبانت منك امرأتك

অর্থ: হযরত মুজাহিদ রহঃ. বলেন,আমি ইবনে আব্বাস রাঃ-এর পাশে ছিলাম। সে সময় এক ব্যক্তি ‎এসে বলেন-‘সে তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ চুপ করে রইলেন। আমি ‎মনে মনে ভাবছিলাম-হয়ত তিনি তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার কথা বলবেন (রুজু করার হুকুম দিবেন)। কিছুক্ষণ ‎পর ইবনে আব্বাস রা. বলেন,তোমাদের অনেকে নির্বোধের মত কাজ কর;[তিন তালাক দিয়ে দাও!] তারপর ‘ইবনে ‎আব্বাস! ইবনে আব্বাস! বলে চিৎকার করতে থাক। শুনে রাখ আল্লাহ তা‘য়ালা বাণী-“যে ‎ব্যক্তি আল্লাহ তা‘য়ালাকে ভয় করে আল্লাহ তা‘য়ালা তার জন্য পথকে খুলে দেন। তুমিতো স্বীয় রবের নাফরমানী করেছো [তিন তালাক দিয়ে]। এ কারণে তোমার স্ত্রী তোমার থেকে পৃথক হয়ে গেছে। {সুনানে আবু দাউদ-১/২৯৯, হাদীস নং-২১৯৯, সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং-১৪৭২০, সুনানে দারা কুতনী, হাদীস নং-১৪৩}

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

ইমেইল[email protected]

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …