প্রচ্ছদ / জায়েজ নাজায়েজ / হজ্ব করতে যেহেতু হারাম ছবি তুলতে হয় তাই হজ্ব না করলেও চলবে?

হজ্ব করতে যেহেতু হারাম ছবি তুলতে হয় তাই হজ্ব না করলেও চলবে?

প্রশ্ন

হজ্ব করা ফরজ।কিন্তু ছবি তোলা হারাম । এখন হজ্ব করতে গেলে ছবি লাগবে। ছবি তোলা হারাম । আবার ভন্ড পীর রাজারবাগী বলে হজ করতে গিয়া হারাম ছবি তুলে গুনাহ করব নাকি। সমাধান চাই এবং এই ক্ষেত্রে যে ছবি তোলা যায়েজ হাদীছের আলোকে জানতে চাই।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

অহেতুক প্রাণীর ছবি আকা ও তোলা উভয়ই হারাম। এতে কোন সন্দেহ নেই। কুরআন ও হাদীসে আলোকে তা দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার।

কিন্তু কুরআন নির্ধারিত একটি মূলনীতি হল, তীব্র প্রয়োজন হারামকে সাময়িক হালাল করে দেয়।

কুরআনে ইরশাদ হচ্ছেঃ

وَقَدْ فَصَّلَ لَكُم مَّا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلَّا مَا اضْطُرِرْتُمْ إِلَيْهِ ۗ [٦:١١٩

যেগুলোকে তোমাদের জন্যে হারাম করেছেন;কিন্তু সেগুলোও তোমাদের জন্যে হালাল,যখন তোমরা নিরূপায় হয়ে যাও। [সূরা আনআমঃ ১১৯]

মৃত জীব, রক্ত, শুকরের গোস্ত এবং গাইরুল্লাহ নামে জবাইকৃত পশু হারাম হওয়া সত্বেও তীব্র প্রয়োজনের সময় তা ভক্ষণ করার অনুমতি প্রদান করে ইরশাদ হচ্ছেঃ

إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنزِيرِ وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ ۖ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ [٢:١٧٣]

তিনি তোমাদের উপর হারাম করেছেন,মৃত জীব,রক্ত,শুকর মাংস এবং সেসব জীব-জন্তু যা আল্লাহ ব্যাতীত অপর কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। অবশ্য যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানী ও সীমালঙ্ঘনকারী না হয়,তার জন্য কোন পাপ নেই। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মহান ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু। [সূরা বাকারা-১৭৩]

আরেক আয়াতে কারীমায় এসেছেঃ

قُل لَّا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَىٰ طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَن يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَّسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ أَوْ فِسْقًا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ ۚ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَإِنَّ رَبَّكَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ [٦:١٤٥]

আপনি বলে দিনঃ যা কিছু বিধান ওহীর মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে,তন্মধ্যে আমি কোন হারাম খাদ্য পাই না কোন ভক্ষণকারীর জন্যে,যা সে ভক্ষণ করে;কিন্তু মৃত অথবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শুকরের মাংস এটা অপবিত্র অথবা অবৈধ; যবেহ করা জন্তু যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়। অতপর যে ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ে এমতাবস্থায় যে অবাধ্যতা করে না এবং সীমালঙ্গন করে না, নিশ্চয় আপনার পালনকর্তা ক্ষমাশীল দয়ালু। [সূরা আনআম-১৪৫]

উপরোক্ত আয়াতে কারীমা পরিস্কার হারাম বস্তুও তীব্র প্রয়োজন দেখা দিলে সাময়িক হালাল হবার কথা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় প্রকাশ করছে।

যা আমাদের একটি মূলনীতি শিক্ষা দিচ্ছে যে, তীব্র প্রয়োজন দেখা দিলে হারাম বস্তুও সাময়িকভাবে জায়েজ হয়ে যায়।

ছবি আঁকা ও তোলা উভয় হারাম। হাদীসের মাঝে এ সংক্রান্ত অনেক ভয়ানক শাস্তিমূলক নির্দেশনা এসেছে। যেমনঃ

عبد الله بن عمر رضي الله عنهما أخبره : أن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال ( إن الذين يصنعون هذه الصور يعذبون يوم القيامة يقال لهم أحيوا ما خلقتم 

হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-যে লোকেরা ছবি আঁকে,কিয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দেয়া হবে। আর তাদের বলা হবে যে, যা তোমরা বানিয়েছো তাতে প্রাণ দাও। {তাহাবী শরীফ, হাদীস নং-৬৯৪১, সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৬০৭,৭১১৯, ৫৬১২,৫৬১৬,৭১১৮,সহীহ মুসলিম,হাদীস নং-৫৬৫৭,সহীহ ইবনে হিব্বান,হাদীস নং-৫৮৪৫, }

عبد الله قال : سمعت النبي صلى الله عليه و سلم يقول ( إن أشد الناس عذابا عند الله يوم القيامة المصورون 

হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন যে,কিয়ামতের দিন বেশি কঠিন শাস্তি হবে ছবি অংকনকারীদের। {তাহাবী শরীফ,হাদীস নং-৬৪৩২,সহীহ বুখারী,হাদীস নং-৫৬০৬,সহীহ মুসলিম,হাদীস নং-৫৬৫৯}

অপরদিকে প্রতিটি সামর্থবান ব্যক্তির জন্য হজ্ব করা ফরজ। সামর্থ সত্বেও হজ্ব না করলে উক্ত ব্যক্তির বিষয়ে কঠোর ধমকি এসেছে হাদীসের মাঝে। যেমন-

আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

يقول الله عز وجل : إن عبدا صححت له جسمه، ووسعت عليه في المعيشة تمضي عليه خمسة أعوام لا يفد إلى لمحروم.

আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি আমার বান্দার শরীরকে সুস্থ রাখলাম, তার রিযিক ও আয়-উপার্জনে প্রশস্ততা দান করলাম। পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যদি সে আমার গৃহের হজ্বের উদ্দেশ্যেআগমন না করে তবে সে হতভাগ্য, বঞ্চিত।-সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৬৯৫; মুসনাদে আবুইয়ালা, হাদীস : ১০৩১; তবারানী, হাদীস : ৪৯০; সুনানে কুবরা বায়হাকী ৫/২৬২; মাজমাউযযাওয়াইদ, হাদীস : ৫২৫৯।

শুধু তাই নয়, একসময় বায়তুল্লাহ উঠিয়ে নেয়া হলে মানুষ হজ্ব করতে পারবে না এই আশঙ্কার কারণেও আল্লাহর রাসূল উম্মতকে তাড়াতাড়ি হজ্ব করার হুকুম করেছেন। ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

استمتعوا بهذا البيت فقد هدم مرتين ويرفع في الثالثة.

তোমরা হজ্ব ও উমরার মাধ্যমে এই (বায়তুল্লাহ) গৃহের উপকার গ্রহণ কর। কেননা তা ইতিপূর্বে দু’বার ধ্বংস হয়েছে। তৃতীয়বারের পর উঠিয়ে নেওয়া হবে।-সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৫০৬; সহীহইবনে হিববান, হাদীস : ৬৭১৮; মুসনাদে বাযযার, হাদীস : ১০৭২; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস : ১৬৫২

হজ্ব করার শক্তি-সামর্থ্য ও অর্থ বিত্ত থাকার পরও যে ব্যক্তি হজ্ব করে না তার সম্পর্কে হাদীস শরীফে কঠোর হুমকি প্রদান করা হয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন-

من أطاق الحج فلم يحج فسواء عليه مات يهوديا أو نصرانيا.

যে ব্যক্তি হজ্ব করার সামর্থ্য রাখে, তবুও হজ্ব করে না সে ইহুদী হয়ে মৃত্যুবরণ করল কি খৃস্টান হয়ে তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই।-তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৫৭৮, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-১৭৮৬]

এখন এক দিকে হজ্বের সামর্থ থাকা অবস্থায় হজ্ব না করলে ভয়ানক শাস্তির হুমকি। অপরদিকে  ছবি তোলার অপরাধের শাস্তি। যখন দু’টি বিষয় একসাথে হয়ে গেল। তখন কুরআনে বর্ণিত মূলনীতি “তীব্র প্রয়োজন হারাম বস্তুকে সাময়িক হালাল করে দেয়”  হিসেবে উলামাগণ বলেন, হজ্বের ফরজ আদায় করতে হারাম ফটো তোলা সাময়িক বৈধতা পাবে।

তাই ছবি তোলা গোনাহ, তাই হজ্ব না করা একটি অজ্ঞতা বৈ কিছু নয়। শরীয়ত বুঝতে হবে সকল বিধানগুলোকে সামনে রেখে।

একটি বিধান নয়, সকল বিধানকে সামনে রেখেই শরীয়তের বিধানাবলীর উপর আমল করতে হবে। তাই ছবি তোলার অজুহাতে হজ্ব বর্জন করা কিছুতেই বৈধ হবে না।

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

ইমেইল[email protected]

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *