প্রচ্ছদ / অপরাধ ও গোনাহ / দুইবোনকে একই সাথে বিবাহে রাখার বিধান!

দুইবোনকে একই সাথে বিবাহে রাখার বিধান!

প্রশ্ন

আমার নাম আরিফ…আমি চাঁদপুর থেকে …। একটা জরুরি মাসয়ালা জানতে চাই…।

আমার ছোট খালার দুই মেয়ে …। দুইজনই বিবাহিত । বড় মেয়ের সামী বিদেশ থাকে । দুর্ভাগ্যক্রমে বড় মেয়ে (ফারজানা) পরকিয়ার দরুন অন্য ছেলের সাথে পালিয়ে যায়। আর সামীকে ডিভোর্স দেয় এবং ঐ ছেলেটাকে বিয়ে করে …। এদিকে সামি এখবর শুনে দেশে চলে আসে…। আফসোস এদিকে আমার খালু জোর করে তার ছোট মেয়ে রোকসানাকে তার সামীর ঘর থেকে ডিভোর্স করিয়ে নিয়ে আসে এবং বড় মেয়ের সামীর সাথে ১০ দিনের মাথায় বিয়ে পরিয়ে দেয়…। আর সেই সেই সাথে আমার খালাকে তালাক দেয়…। এর কিছুদিন পর বড় মেয়ে মায়ের বাড়িতে ফিরে আসে…। এবং পুর্বের সামির ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য কান্নাকাতি করে…। তখন আমার খালা একজন সাধারন লোক  দিয়ে দুইজন সাক্ষী ( একজন আমার খালা আর একজন আমার খালাত ভাই ) মিলে ৫ মাসের ব্যবধানে বড় মেয়ে ও বড় জামাইয়ের পুনরায় বিয়ে পড়ায়…। কিন্তু ছোট স্ত্রী ( রোকসানাকে ) তালাক দেয় নি …।আর রোকসানা ও এ নিয়ে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় নি …। একন এভাবে সংসার চলছে…। জানতে চাই তাদের শরিয়ত এটাকে কতটুক সমর্থন করে…। আর কোন ভুল হয়ে থাকলে কি করলে বড় মেয়ে এখন যে আগের সামীর সাথে সংসার করতেছে তা শরীয়ত সমর্থ হবে ।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

এটি বাংলাদেশের পারিবারিক জীবনের চিত্র তা আমাদের ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। বিয়ে তালাক এটি কি কোন ছেলেখেলা? ইচ্ছে হলেই বিয়ে দেয়া হল, ইচ্ছে হলেই তালাক দিয়ে দেয়া হল! এ কেমন অদ্ভূত আচরণ?

উপরোক্ত অদ্ভূত বিয়ে তালাকের বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলঃ

ফারজানার প্রথম স্বামীকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিবাহ শুদ্ধ হয়েছে কি না?

রোকসানাকে তার আপন বোনের স্বামীর সাথে বিবাহ দেয়া শুদ্ধ হয়েছে কি না?

এক ছেলে এক মহিলার স্বাক্ষীর উপস্থিতিতে বিয়ে শুদ্ধ হয়েছে কি না?

আপন দুইবোনের এক স্বামীর সংসার করার বিধান কী?

ফারজানা তার প্রথম স্বামীর কাছে থাকার শরীয়ত সম্মত পদ্ধতি কী?

এই হল মোট পাচটি বিষয়। যে বিষয়গুলো পরিস্কার হলে আপনার কাংখিত প্রশ্নটির সঠিক জবাব বুঝা যাবে।

১ নং পয়েন্টের জবাব

যদি স্বামী ফারজানাকে কাবিননামার মাধ্যমে, কিংবা মৌখিক বা লিখিতভাবে নিজের উপর তালাক পতিত করার অধিকার দিয়ে থাকে, তাহলে যেসব শর্তসাপেক্ষে তালাকের অধিকার প্রদান করেছে, সেসব শর্ত পাওয়া যাবার পর ফারজানা যদি নিজের উপর তালাক পতিত করে স্বামী থেকে আলাদা হয়ে অন্য স্বামীকে গ্রহণ করে থাকে, তাহলে ফারজানার পরকীয়া করা ছেলের সাথে দ্বিতীয় বিবাহ শুদ্ধ হয়েছে।

কিন্তু যদি ফারজানার বিদেশ থাকা স্বামী স্ত্রীকে তালাকের অধিকার না দিয়ে থাকে, তাহলে ফারজানার নিজের তালাক দেয়ার দ্বারা কোন তালাক হয়নি। তার দ্বিতীয় বিবাহও শুদ্ধ হয়নি। বরং পরকীয়া করে যিনার গোনাহে লিপ্ত হয়েছিল।

২ নং পয়েন্টের জবাব

প্রথমোক্ত পয়েন্টটিতে আমরা জেনেছি ফারজানার তালাক শুদ্ধ হবে এক সূরতে। আরেক সূরতে হবে না।

যদি ফারজানার তালাক শুদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে ফারজানার স্বামীর সাথে রোকসানার বিবাহ শুদ্ধ হয়েছে।

আর যদি ফারজানার তালাক শুদ্ধ হয়ে না থাকে, তাহলে ফারজানার স্বামীর সাথে রোকসানার বিবাহ শুদ্ধ হয়নি।

৩নং পয়েন্টের জবাব

বিবাহ শুদ্ধ হবার জন্য দুইজন প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম পুরুষ বা একজন পুরুষ ও দুইজন মহিলা থাকা আবশ্যক।

তাই, যদি রোকসানার ১নং পয়েন্ট অনুপাতে তালাক হয়ে থাকে, তাহলে দুই কারণে তার দ্বিতীয়বার প্রথম স্বামীর সাথে বিবাহ শুদ্ধ নয়। যথা-

ক) বিয়ের স্বাক্ষী না থাকায়।

খ) আপন বোন  জীবিত বা বিবাহে থাকা অবস্থায় তার স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আসার কারণে। কারণ শরীয়তে একই সাথে আপন দুইবোনকে বিবাহে রাখা বৈধ নয়।

আর যদি ১নং পয়েন্ট অনুপাতে তালাক না হয়ে থাকে, তাহলে রোকসানার সাথে ফারজানার স্বামীর বিবাহ শুদ্ধই হয়নি। আর ফারজানার বিবাহ ভেঙ্গে যায়নি। তাই নতুন করে বিবাহ পড়ানোটা একটি বেহুদা কাজ হয়েছে।

৫ নং পয়েন্টের জবাব

৪নং পয়েন্টের জবাবেই বিষয়টি পরিস্কার। তবু আরো পরিস্কার হবার জন্য বলছিঃ

যদি ১নং পয়েন্ট অনুপাতে ফারজানার তালাক হয়ে থাকে, তাহলে ফারজানার জন্য রোকসানা বিবাহে থাকা অবস্থায় প্রথম স্বামীর বিবাহে বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না।

যদি ফারজানা তার প্রথম স্বামীর কাছে থাকতে চায়, তাহলে তার প্রথম স্বামীর ফারজানার বোন রোকসানাকে তালাক দিতে হবে, তারপর দুইজন শরয়ী সাক্ষির উপস্থিতিতে নতুন মোহর ধার্য করে নতুন করে বিবাহ করতে হবে। তাহলেই কেবল ফারজানা তার প্রথম স্বামীর সাথে ঘর সংসার করতে পারবে।

আর যদি ১ নং পয়েন্ট অনুপাতে ফারজানার তালাক না হয়ে থাকে, তাহলে ফারজানার প্রথম স্বামীর সাথে বিচ্ছেদই হয়নি। সেই সাথে রোকসানার বিবাহ ফারজানার স্বামীর সাথে শুদ্ধই হয়নি। রোকসানার ঘর সংসার করাটা যিনা ছাড়া আর কিছু নয়।

তাই এখন ফারজানা বিবাহ ছাড়াই এমনিতেই তার স্বামীর সাথে ঘর সংসার করতে পারবে। কিন্তু রোকসানা আলাদা থাকতে হবে। কারণ তার বিবাহ তার বোনের স্বামীর সাথে শুদ্ধ হয়নি। কারণ আপন বোন বিবাহে থাকা অবস্থায় তার স্বামীর সাথে বিবাহ শুদ্ধ হয় না।

উপরোক্ত উত্তরের আলোকে আপনিই নির্ণিত করে নিন আপনার খালাত বোনদের বিবাহের হালাত এবং তালাকের হালাত এবং বর্তমান করণীয় কী?

পরামর্শ

আপনার প্রশ্ন পড়ে আমরা যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি।আপনার খালার পুরো পরিবারে দ্বীনদারী বলতে কিচ্ছু নেই। নেই আখেরাতের ভয়ও। ইসলাম ও শরীয়ত সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ এ পরিবার। একটি মুসলিম রাষ্ট্রে এমন বেহাল অবস্থা ভাবতেও অবাক হচ্ছি আমরা।

পুরো পরিবারকে দ্বীনদার বানানোর মেহনত করা আপনার ঈমানী দায়িত্ব। এভাবে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত। যিনার পাপ। এসব থেকে আপনার খালা ও খালু মুক্ত নয়। তাই পুরো পরিবারের জন্যই দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ আবশ্যক।

তাবলীগের মাধ্যমে কিংবা আলেমদের কাছ থেকে দ্বীনী কথা শুনানোর মাধ্যমে, বা কোন হক্কানী আমলওয়ালা পীর সাহেবের মুরীদ বানানোর মাধ্যমে কিংবা চরমোনাইয়ের বয়ান শুনানোর মাধ্যমে তাদের দ্বীনের পথে আনার চেষ্টা করুন।

আল্লাহ তাআলা উক্ত পরিবারের মাঝে দ্বীনী পরিবেশ কায়েম করে দিন। অতীত গোনাহ থেকে সাচ্চা দিলে তওবা করে খাটি মুসলমান হবার তৌফিক দান করুন। আমীন।

المجلس ( إلا إذا زاد ) في قوله طلقي نفسك وأخواته ( متى شئت أو متى ما شئت أو إذا شئت أو إذا ما شئت ) فلا يتقيد بالمجلس ( ولم يصح رجوعه ) لما مر (رد المحتار-كتاب الطلاق، باب تفويض الطلاق-4/452)

وَلاَ تَنكِحُواْ مَا نَكَحَ آبَاؤُكُم مِّنَ النِّسَاء إِلاَّ مَا قَدْ سَلَفَ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَمَقْتًا وَسَاء سَبِيلاً (22)حُرِّمَتْ عَلَيْكُمْ أُمَّهَاتُكُمْ وَبَنَاتُكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ وَعَمَّاتُكُمْ وَخَالاَتُكُمْ وَبَنَاتُ الأَخِ وَبَنَاتُ الأُخْتِ وَأُمَّهَاتُكُمُ اللاَّتِي أَرْضَعْنَكُمْ وَأَخَوَاتُكُم مِّنَ الرَّضَاعَةِ وَأُمَّهَاتُ نِسَآئِكُمْ وَرَبَائِبُكُمُ اللاَّتِي فِي حُجُورِكُم مِّن نِّسَآئِكُمُ اللاَّتِي دَخَلْتُم بِهِنَّ فَإِن لَّمْ تَكُونُواْ دَخَلْتُم بِهِنَّ فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْكُمْ وَحَلاَئِلُ أَبْنَائِكُمُ الَّذِينَ مِنْ أَصْلاَبِكُمْ وَأَن تَجْمَعُواْ بَيْنَ الأُخْتَيْنِ إَلاَّ مَا قَدْ سَلَفَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَّحِيمًا (سورة النساء-23)

আর তোমরা ঐ সমস্ত নারীকে বিবাহ করো না, যাদেরকে তোমাদের পিতারা [বাপ-দাদা বা নারা] বিবাহ করেছেন। কিন্তু যা অতীত হয়েছে, নিশ্চয় তা অত্যন্ত নির্লজ্জতা ও খুব ঘৃণার বিষয় এবং খুব নিকৃষ্ট প্রথা। তোমাদের প্রতি হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতৃগণ এবং তোমাদের কন্যাগণ এবং তোমাদের বোনগণ এবং তোমাদের ফুপুগণ, এবং তোমাদের খালাগণ এবং ভ্রাতৃ কন্যাগণ এবং বোন কন্যাগণ এবং তোমাদের ঐ বোনগণ যারা দুধ পানের দরুন [বোন] হয়েছে , এবং তোমাদের স্ত্রীদের মাতৃগণ এবং তোমাদের স্ত্রীদের কন্যাগণ, যারা তোমাদের প্রতিপালনে রয়েছে এরূপ স্ত্রী থেকে, যাদের সাথে তোমরা শারিরিক সম্পর্ক করেছ। আর যদি তোমরা ঐ স্ত্রীদের সাথে শারিরিক সম্পর্ক না করে থাকো, তবে তোমাদের কোন গোনাহ হবে না। আর তোমাদের ঐ পুত্রগণের স্ত্রীগণ যারা তোমাদের ঔরসজাত। আর এটাও নিষিদ্ধ যে, দুই বোনকে একত্রে [বিবাহে] রাখবে। কিন্তু যা [এই হুকুমের] পূর্বে হয়েছে [তা মাফ]। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহা ক্ষমাপরায়ন, অতীব করুণাময়। {সূরা নিসা-২২-২৩}

فى الدر المختار- ( و ) شرط ( حضور ) شاهدين ( حرين ) أو حر وحرتين ( مكلفين سامعين قولهما معا ) (الدر المختار ، كتاب النكاح،-3/9)

فى الفتاوى الهندية- لَا يَجُوزُ لِلرَّجُلِ أَنْ يَتَزَوَّجَ زَوْجَةَ غَيْرِهِ وَكَذَلِكَ الْمُعْتَدَّةُ، كَذَا فِي السِّرَاجِ الْوَهَّاجِ. (الفتاوى الهندية، كِتَابُ النِّكَاحِ وَفِيهِ أَحَدَ عَشَرَ بَابًا، الْبَابُ الثَّالِثُ فِي بَيَانِ الْمُحَرَّمَاتِ وَهِيَ تِسْعَةُ أَقْسَامٍ، الْقِسْمُ السَّادِسُ الْمُحَرَّمَاتُ الَّتِي يَتَعَلَّقُ بِهَا حَقُّ الْغَيْرِ-1/280، بدائع الصنائع، كتاب النكاح عدم جواز منكوحة الغير-2/547، زكريا، البحر الرائق، كتاب النكاح، فصل فى المحرمات-3/108)

وفى رد المحتار- اما نكاح منكوحة الغير ومعتدة لم يقل احد بجوازه فلم ينعقد اصلا (رد المحتار، كتاب النكاح، باب العدة، مطلب فى النكاح الفاسد والباطل-5/197، 4/274، قاضى خان على الهندية-1/366)

فى الفتاوى الهندية- وَلَوْ تَزَوَّجَ بِمَنْكُوحَةِ الْغَيْرِ وَهُوَ لَا يَعْلَمُ أَنَّهَا مَنْكُوحَةُ الْغَيْرِ فَوَطِئَهَا؛ تَجِبُ الْعِدَّةُ، وَإِنْ كَانَ يَعْلَمُ أَنَّهَا مَنْكُوحَةُ الْغَيْرِ لَا تَجِبُ حَتَّى لَا يَحْرُمَ عَلَى الزَّوْجِ وَطْؤُهَا، كَذَا فِي فَتَاوَى قَاضِي خَانْ.. (الفتاوى الهندية، كِتَابُ النِّكَاحِ وَفِيهِ أَحَدَ عَشَرَ بَابًا، الْبَابُ الثَّالِثُ فِي بَيَانِ الْمُحَرَّمَاتِ وَهِيَ تِسْعَةُ أَقْسَامٍ، الْقِسْمُ السَّادِسُ الْمُحَرَّمَاتُ الَّتِي يَتَعَلَّقُ بِهَا حَقُّ الْغَيْرِ-1/280، قاضى خان على هامش الهندية1/366، خلاصة الفتاوى، كتاب الطلاق، الفصل الثامن فى العدة-2/118

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

ইমেইল- [email protected]

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …