লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
এবার নুতন জিগির তুলল ১ম লা মাযহাবীটি। বলতে লাগল, দেখুন আমরা এভাবে কথা বলতে থাকলে কোন সমাধানে যেতে পারবো না। তাই আসুন আমরা সুনির্দিষ্ট একটি মাসআলা নিয়ে কথা বলি।
আমি বললাম-“ আপনিতো কুরআন ও হাদীসই মূল কিতাব দেখে বুঝেন না। আপনি কি আলোচনা করবেন? আপনার পুরো ভিত্তিতিই আরেকজনের অনুবাদের উপর অন্ধ তাকলীদ।
আচ্ছা, বলুন, আপনার কাছে দলীল কয়টি?”
১ম লা-মাযহাবী- আপনার কাছে দলীল কয়টি?
আমি- আমার কাছে দলীল চারটি। যথা কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস। আর আপনার কাছে?
১ম লা-মাযহাবী- আমার কাছেও দলীল চারটি। কুরআন হাদীস ও ইজমা-কিয়াস। তবে যে ইজমা কুরআন ও হাদীসের খেলাফ হবে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
আমি- যে ইজমা ও কিয়াস কুরআন ও হাদীসের খেলাফ হবে তা যে গ্রহণযোগ্য নয় একথা বলার কোন প্রয়োজন নেই, যে ইজমা কিয়াস সম্পর্কে জানে সেই একথা জানে। যাইহোক, মজার কথা বললেন, তাহলে আপনি ইজমাও কিয়াসও মানেন?
১ম লা-মাযহাবী- কুরআন ও হাদীসের খেলাফ হলে মানি না।
আমি- আরে ভাই! আপনার মনে হয়, এক কথা বারবার বলার বদভ্যাস আছে নাকি? আমিতো স্পষ্ট বলেই দিলাম, কুরআন ও হাদীসের খেলাফ যে ইজমা ও কিয়াস হয়, সেটিকে আসলে শরয়ী ইজমা ও কিয়াস বলেই না। তাই এটি বারবার বলার কোন দরকারই নেই।
আচ্ছা, আপনি ইজমা ও কিয়াস মানলে বলুনতো বিশ রাকাত তারাবীহের ক্ষেত্রে কি হুকুম? এটিতো সাহাবায়ে কেরামের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। হযরত উমর রাঃ এর আমল থেকে চলে আসছে, যা আজো বাইতুল্লাহ ও মসজিদে নববীতে পড়া হচ্ছে।
২য় লা-মাযহাবী এবার মুখ খুলল। আগেই বলেছি এই লোক পুরো সময়টিতে যা কথা বলেছে, তা পুরোটাই অযথা কথন। কোন দলীল নেই। কোন যৌক্তিকতা নেই। শুধুই কথা বলার মানসিকতা। আর ১ম লা মাযহাবী যাকে সে নিজের গুরু বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই গুরু যখন কথায় আটকে যেতে দেখে তখনি কথা বলে উঠে। অহেতুক সব কথার ফুলঝুরি দিয়ে কথার মোড় ঘুরাতে অপচেষ্টা করে থাকে। এবার বলতে লাগল- বিশ রাকাত তারাবীহের ব্যাপারে ইজমা হয়েছে একথা কোথায় আছে? একথা কোথায় নেই। কুরআন ও হাদীসের বিপরীত উমর রাঃ এর কথার কোন ধর্তব্যতা থাকে?
১ম লা মাযহাবীকে উদ্দেশ্য করে বললাম- আপনি বলুনতো, কুরআন ও সহীহ হাদীসের কোথাও আট রাকাতের তারাবীহের কথা আছে?
১ম লা মাযহাবী- আসলে আমি তারাবীহ বলতে নারাজ। এটি আসলে কিয়াম। যার নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা নেই। যত ইচ্ছে পড়া যায়। রাসূল সাঃ দুই দুই রাকাত করে পড়তেন। তাই আট রাকাত বিশ রাকাত বলা ঠিক না।
আমি- কুরআন ও হাদীস মূল উৎস থেকে না বুঝেও অনুবাদের অনুমানের উপর নির্ভর করে আপনিও তাহলে শরয়ী বিষয়ের সমাধান দিতে জানেন। যাইহোক, তাহলে আপনি যে বললেন, ইজমা গ্রহণযোগ্য। সেই হিসেবে বিশ রাকাত তারাবীহ যে হযরত উমর রাঃ চালু করলেন। {সুনানে আবু দাউদ-১/১৪২, সিয়ারু আলামিন নুবালা-৩/১৭৬}
কোন সাহাবী এর প্রতিবাদ করেননি। আজো তা বাইতুল্লাহ ও মসজিদে নবুবীতে চলছে। তা কি ইজমা হয়নি?
২য় লা-মাযহাবী- ইজমা যে হয়েছে এর কোন দলীল আছে। হয়তো কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছেন। আর হাদীসের বিপরীত হযরত উমর রাঃ এর কথার কি দাম আছে?
আমি বললাম- সেই প্রতিবাদটা কে করেছেন? নামটি বলুনতো। আর আপনার ভাষায় হযরত উমর রাঃ রাসূল সাঃ এর সুন্নতের খেলাফ একটি বিদআতি পদ্ধতি চালু করেছেন। আর তখনকার সাহাবা জমানা থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত বাইতুল্লাহ ও মসজিদে নববীতে সেই বিদআত চালু আছে?
১ম লা-মাযহাবী- আসলে যেহেতু আপনি যেমন বলছেন বিশ রাকাত তারাবীহ সাহাবাগণের ইজমা দ্বারা প্রমানিত। তাই আমাদের কথা হচ্ছে, বিশ রাকাত পড়া উত্তম। আর আট রাকাত পড়া জায়েজ।
আমি- জায়েজ মানে জানেনতো?
১ম লা-মাযহাবী- এ ব্যাপারে ফুক্বাহায়ে কেরাম যা বলেছেন তাই হবে।
আমি – ফুক্বাহায়ে কেরামতো লিখেছেন- জায়েজ হল এমন বিষয়, যা করলে সওয়াব নেই, না করলে গোনাহ নেই। তাহলে আপনার বক্তব্য অনুপাতে আট রাকাত পড়লে সওয়াব নেই, না পড়লে গোনাহ নেই?
১ম লা-মাযহাবী- না, না বিষয়টি এমন না। আসলে বিশ রাকাত পড়াই উত্তম। যেহেতু সাহাবাগণ বিশ রাকাত পড়ে আসছেন।
আমি এবার ২য় লা-মাযহাবীর দিকে ফিরলাম। আপনার কি মনে হয়? ২য় লা-মাযহাবটি কট্টর হওয়ার সাথে সাথে বেশ বেআদব বলেও মনে হয়েছে আমার কাছে। একজন লা-মাযহাবী লা-মাযহাবী হওয়ার জন্য প্রাথমিক যেসব বদগুণ থাকা দরকার তার মাঝে বেদআদবী এবং অহংকার হল প্রধানতম বদগুণ। যা গায়রে মুকাল্লিদ মাত্র সবার মাঝেই বিদ্যমান। এ দু’টি বদগুণ না থাকলে এ ভ্রান্ত মাযহাবের অন্তর্ভূক্তি পূর্ণতা পায় না।
যাইহোক, ১ম লা-মাযহাবী বিশ রাকাত তারাবীহকে উত্তম বললেও ২য় লা মাযহাবী তা মানতে নারাজ। তিনি হযরত উমর রাঃ বিদআতি আমল জারি করেছেন মর্মে বলতেও পারছে না। আবার ইজমা হয়নি তাও প্রকাশ করতে পারছে না। আবার আট রাকাতের ভুতটি মাথা থেকে নামাতেও পারছে না। এ ত্রিশঙ্কু হালাতে শুধু আস্তে আস্তে খিস্তি আউড়াতে শুনলাম।
আমি এবার ১ম লা-মাযহাবীর দিকে মনোনিবেশ করলাম- তাহলে বিশ রাকাত তারাবীহ যারা পড়ে তারা উত্তম কাজ করে থাকে। সামনের রমজানে আপনারা বিশ রাকাত তারাবী পড়ে সেই উত্তম কাজটি করবেন? নাকি আপনার ভাষায় যা করলে সওয়াব নেই আবার না করলে গোনাহ নেই এমন আট রাকাত তারাবীহ পড়বেন?
১ম লা-মাযহাবী- উত্তম কাজইতো করা উচিত হবে। আমরা আসলে এভাবে কথা না বলে চলুন। সুনির্দিষ্ট একটি বিষয় নিয়ে কথা বলি। রফয়ে ইয়াদাইন নিয়ে কথা বলি। এই বিষয়টি পরিস্কার হলে আস্তে আস্তে আস্তে অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলবো।
আমি- আচ্ছা, ভাল কথা। চলুন একটি মাসআলা নিয়েই কথা বলি। আপনি আগে এক ধরণের নামায পড়তেন বলেছেন। আর এখন ভিন্ন পদ্ধতিতে নামায পড়ে থাকেন তাও বলেছেন। তো আমাকে পরিস্কার করুন কিছুক্ষণ পর আমরা আসরের নামায পড়বো। আর আসরের নামায যেহেতু চার রাকাত। সেই হিসেবে এই চার রাকাতের কত স্থানে আপনি রফয়ে ইয়াদাইন করবেন?
১ম লা-মাযহাবী- এইতো, তাকবীরে তাহরীমার সময়। তারপর রুকুতে যেতে আসতে। আর তৃতীয় রাকাতের শুরুতে।
আমি- তাহলে আপনি চার রাকাত নামাযে মোট ১০ স্থানে রফয়ে ইয়াদাইন করেন তাই না?
২য় লা-মাযহাবী- আপনি পেঁচাইতাছেন কেন? ওনিতো পরিস্কার করেই বলল। [বেশ রেগে গিয়ে কথাগুলো বললেন ২য় লা-মাযহাবিটি]
আমি- আপনি ক্ষেপতেছেন কেন? আমিতো পেঁচাচ্ছি না। বরং ১ম লা-মাযহাবিটি ভাইয়ের বলা বক্তব্যটি পরিস্কার হচ্ছি। আচ্ছা, তো আপনার বক্তব্য অনুপাতে আপনি আসরের চার রাকাত নামাযে ১০ স্থানে রফয়ে ইয়াদাইন করে থাকেন। আর বাকি ১৮ স্থানে করেন না। মানে দ্বিতীয় ও চতুর্থ রাকাতের শুরুতে এবং চার রাকাতের আট সেজদায়ে গমণ এবং উঠতে। এই ১৮ স্থানে আপনারা কখনোই রফয়ে ইয়াদাইন করেন না তাই না?
১ম লা-মাযহাবী- আমতা আমতা করে বললেন- হ্যাঁ, ঠিক আছে। কিন্তু আপনি সেজদার সময়ের রফয়ে ইয়াদাইনের কথা কেন বলছেন? এটিতো হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়।
আমি- তাই নাকি? আপনি মনে হয় সুনানে নাসায়ী উঠিয়ে কখনোই দেখেননি। সেখানে পরিস্কার ভাষায় সেজদায় গমণ ও উঠার সময় রফয়ে ইয়াদাইনের কথা উল্লেখ আছে। যা সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন আপনাদের কাছে মান্যবর শায়েখ আলবানী রহঃ।
১ম লা-মাযহাবী- সেই হাদীস জঈফ। আলবানী বললেই তা সহীহ হয়ে যায় না। তিনি তার কিতাবে অনেক হাদীসকে সহীহ বলেছেন অথচ তা সহীহ নয়।
আমি- আচ্ছা, এই তাহলে আলবানী সাহেবের অবস্থা। তাহলেতো আলবানী রহঃ এর সহীহ জঈফ বলার কথা উল্লেখ করাই বেকার। এরকম অবিশ্বস্ত ব্যক্তির কথা না বলাই ভালো। আচ্ছা, আপনিতো বলছেন সেই হাদীস জঈফ। ঠিক আছে। কি কারণে জঈফ আর কে সেই জঈফ বলেছে সেটি একটু বলতে পারবেন? আল্লাহ বা রাসূল সাঃ জঈফ বলেছেন? না কোন গ্রহণযোগ্য মুহাদ্দিস জঈফ বলেছেন?
১ম লা-মাযহাবী- দেখুন আমরা উসুলে হাদীসের সব বিষয় নিয়ে কথা বললে আসলে কোন ফায়দা হবে না। আমাদের উচিত একটি বিষয়ে ঠিক থাকা। সেটি হল এখানে রুকুতে আসতে যেতে রফয়ে ইয়াদাইন।
আমি- আলোচ্য বিষয় কিন্তু আপনিই নির্ধারণ করেছেন। সেটি ছিল রফয়ে ইয়াদাইন। রুকুতে আসতে যেতে রফয়ে ইয়াদাইন একথা কিন্তু বলা হয়নি। আর রুকুতে আসতে যেতে রফয়ে ইয়াদাইনের আলোচনা হলে সেজদাতে আসতে যাওয়ার রফয়ে ইয়াদাইন নিয়ে কথা বলতে আপনার বাঁধতে কেন?
ফাঁদে পড়ে এবার ক্ষিপ্ত হল ২য় লা-মাযহাবী। বলতে লাগল- “অধিকাংশ মুহাদ্দিসরা সেজদার ক্ষেত্রে রফয়ে ইয়াদাইনকে ছেড়ে দিয়েছেন। তাই আমরাও ছেড়ে দেই।”
আকুল দরিয়ায় যেন খড়কোটা খুঁজে পেল ১ম লা-মাযহাবী। ২য় লা-মাযহাবীর সাথে সুর মিলিয়ে সেও বলতে লাগল- হ্যাঁ, হ্যাঁ, অধিকাংশ ফক্বীহ ও মুহাদ্দিসরা তা ছেড়ে দিয়েছে। তাই আমরা ছেড়ে দিচ্ছি।
আমি- “অধিকাংশ ব্যক্তি কোন সুন্নত ছেড়ে দিলে আপনারাও সুন্নত ছেড়ে দিবেন। এই আপনাদের মূলনীতি? অথচ আপনারাই সারাদিন বলে বেড়ান
وَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِي الأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ إِن يَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُونَ (116
অর্থাৎ যদি তুমি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথামত চল, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দিবে। {সূরা আন’আম-১১৬}
তাহলে আপনারা অধিকাংশের কথার উপর নির্ভর করে এ সুন্নত ছেড়ে দিয়ে কুরআনের ভাষায় কি কাজ করছেন ভেবে দেখেছেন?”
প্রচন্ড ধুর্ত ১ম লা-মাযহাবী ভাইটি এবার প্রসঙ্গ পরিবর্তনে মত্ত হলেন। যা গায়রে মুকাল্লিদীনদের পুরাতন অভ্যাস। হুট করে প্রশ্ন করে বসল-“আপনারা কিভাবে সহীহ জঈফ নির্ধারণ করেন?”
আমি বুঝে গেলাম। কিয়ামত আসলেও সেজদার সময়ের রফয়ে ইয়াদাইন বিষয়ে কুরআন ও হাদীস ভিত্তিক সঠিক জবাব পৃথিবীর সমস্ত গায়রে মুকাল্লিদ মিলিয়েও দিতে পারবে না ইনশাআল্লাহ। তাই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে পালাতে চাচ্ছে এ বিষয় থেকে। আমিও সুযোগ দিলাম। নিজের অবস্থান পরিস্কার করার জন্য বললাম- “আমাদের অবস্থা পরিস্কার ও খুব সহজ। আমরা যখন কোন বিপরীতমুখী হাদীস দেখি। তখন তাকিয়ে দেখি হাদীসটি সহীহ জঈফ নাকি অন্য কিছু সে ব্যাপারে আল্লাহ ও রাসূল সাঃ কোন কিছু বলেননি।
আর মুহাদ্দিসীনদের মাঝে সহীহ এর সংজ্ঞা নিয়ে বিস্তর মতবিরোধ। ইমাম বুখারীর সহীহ এর সংজ্ঞার সাথে ইমাম মুসলিম রহঃ এর সহীহ এর মিল নেই। অনেক হাদীস ইমাম মুসলিমের কাছে সহীহ। কিন্তু বুখারীর কাছে সহীহ নয়। কারণ দুইজনের সহীহ এর সংজ্ঞা ভিন্ন। আবার ইমাম তিরমিজীর সহীহ এর সংজ্ঞার সাথে অন্যের মিল নেই। মিল নেই ইবনে হিব্বান ও ইবনে খুজাইমা রহঃ এর সহীহ এর সংজ্ঞার সাথে অন্য কারো।
এই এক সহীহ শব্দের সংজ্ঞা নিয়ে বিস্তর মতভেদ। আমি কার কথা মেনে কোন হাদীসকে সহীহ বলবো? কার সহীহ এর সংজ্ঞা সঠিক? এ ব্যাপারে কোন স্পষ্ট বক্তব্য না আল্লাহ তাআলা থেকে আছে না রাসূল সাঃ থেকে আছে। এই দ্বিধান্বিত হালাতে আমি যখন রাসূল সাঃ এর হাদীসের দিকে তাকাই তখন দেখি আল্লাহর নবী সাঃ কয়েকটি জমানাকে শ্রেষ্ঠতম তথা অনুসরণীয় সাব্যস্ত করে গেছেন। ইরশাদ হচ্ছে- خَيْرُ أُمَّتِي الْقَرْنُ الَّذِينَ يَلُونِي، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، তথা শ্রেষ্ঠ উম্মত হল যারা আমার নিকটবর্তী তথা সাহাবাগণ। তারপর যারা তাদের নিকটবর্তী তথা তাবেয়ীগণ। তারপর যারা তাদের নিকটবর্তী তথা তাবে তাবেয়ীগণ। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৫৩৩}
যেহেতু সহীহ জঈফের সংজ্ঞা নিয়ে এমন সময়কারের ব্যক্তিগণ মতভেদ করছেন যাদের জমানার শ্রেষ্ঠত্ব ও অনুসরণীয় হওয়ার কোন সার্টিফিকেট আল্লাহ ও রাসূল সাঃ থেকে নেই। তাই আল্লাহ ও রাসূল সাঃ কর্তৃক অননোমোদিত কারো কথায় কোন হাদীসকে সহীহ জঈফ বলাকে আমরা নিরাপদ মনে করি না। এ কারণে আমরা ফিরে গেছি সেই জমানার মুহাদ্দিসও মুজতাহিদের দিকে। যিনি রাসূল সাঃ এর বক্তব্য দ্বারা অনুসরণীয় শ্রেষ্ঠ জমানার ব্যক্তিত্ব। রাসূল সাঃ যে জমানাকে শ্রেষ্ঠ জমানা বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। যে জমানার ব্যাপারে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন সেই শ্রেষ্ট জমানার পৃথিবী বিখ্যাত গ্রহণযোগ্য মুহাদ্দিস ও ফক্বীহগণের দিকে। তারা যেটিকে সহীহ বলেছেন আমরা সেটিকে সহীহ বলি। তারা যেটিকে জঈফ সাব্যস্ত করেছেন আমরা সেটিকে জঈফ সাব্যস্ত করি।
আর আর সহীহ জঈফ পরিভাষা যেহেতু অনেক পরের সৃষ্টি। যা ৫০০ শতাব্দীর আগে কেউ ব্যবহারই করতো না। আর শব্দ যেহেতু মাকসাদই নয়, তাই আমরা যে হাদীসের উপর চার ইমামের ফক্বীহগণ একমত পোষণ করে আমলী বলে সাব্যস্ত করেছন আমরা সে হাদীসকে সর্বসম্মত সহীহ বলে বিশ্বাস করি। আর যে হাদীস নিয়ে মুজতাহিদ ইমামগণের মাঝে মতভেদ হয়ে গেছে সেক্ষেত্রে আমরা উক্ত হাদীসের সহীহ নিয়ে মতভেদ আছে বলে বিশ্বাস করি। আর হাদীসের সহীহ নিয়ে মতভেদ আছে সময়কার আমরা প্রাধান্য দেই আমাদের ইমাম আবূ হানীফা রহঃ এর প্রাধান্য দেয়া মতটিকে। তিনি যে হাদীসের উপর ভিত্তি করে মাসআলা বলেছেন সেটিকে সহীহ বিশ্বাস করি। আর যে হাদীসকে ছেড়ে দিয়েছেন সেটিকে মারজূহ তথা অপ্রাধান্য পাওয়া হাদীস বলে মেনে নেই।
আরো পরিস্কার করে বলছি, কোন হাদীস সহীহ কোন হাদীস জঈফ? তা আল্লাহ ও রাসূল সাঃ বলে যাননি। তাই আমরা আল্লাহ ও রাসূল সাঃ এর শ্রেষ্ঠত্বের সার্টিফিকেট দেয়া জমানার ব্যক্তিদের কথায় হাদীস সহীহ জঈফ মানি। রাসূল সাঃ এর বলা ফিতনার যুগের কোন মুহাদ্দিসের কথায় হাদীসকে সহীহ জঈফ বলে সর্বক্ষেত্রে আমল করাকে নিরাপদ মনে করি না।
আরেকটি বিষয়, ইমাম ইমাম আবূ হানীফা রহঃ এর ইন্তেকালের ৪৪ বছর পর জন্ম লাভ করেছে ইমাম বুখারী রহঃ।
ইমাম মুসলিম রহঃ এর জন্ম গ্রহণ করেছেন ৫৪ বছর পর।
ইমাম তিরমিজী রহঃ জন্ম গ্রহণ করেছেন ৬০ বছর পর।
ইমাম আবু দাউদ রহঃ জন্ম লাভ করেছেন ৫২ বছর পর।
ইমাম ইবনে মাজাহ রহঃ জন্ম গ্রহণ করেছেন ৫৯ বছর পর।
ইমাম নাসায়ী রহঃ জন্ম গ্রহণ করেছেন ৬৫ বছর পর।
সুতরাং যে হাদীস রাসূল সাঃ এর বলা শ্রেষ্ঠ যুগের মুহাদ্দিস ও মুজতাহিদ ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর কাছে সহীহ। আর সহীহ না হয়ে উপায়ও নেই, তিনি নিজে তাবেয়ী হলে পরবর্তীই সাহাবী। আর কোন সূত্রই নেই। আর যদি তাবে তাবেয়ী ধরি, তাহলে মাঝখানে হল শুধু তাবেয়ী। আর এরা সবাই শ্রেষ্ঠ যুগের ব্যক্তিত্ব। সুতরাং হাদীস জাল ও জঈফ হবার কোন সুযোগই নেই। কিন্তু ঐ হাদীসটিই ৪৪ বছর পর জন্ম নেয়া ইমাম বুখারী, ৫৪ বছর পর জন্ম নেয়া ইমাম মুসলিম, ৬০ বছর পর জন্ম নেয়া ইমাম তিরমিজী, ৫২ বছর পর জন্ম নেয়া আবু দাউদ, ৫৯ বছর পর জন্ম নেয়া ইবনে মাজাহ এবং ৬৫ বছর পর জন্ম নেয়া ইমাম নাসায়ীর জমানার সময় জঈফ এবং জালও হয়ে যেতে পারে।
কারণ, আমরা জানি হাদীস জঈফ ও জাল হবার একটি মৌলিক কারণ হল, রাবী জঈফ বা মিথ্যুক হওয়া।
এ কারণে শ্রেষ্ঠ যুগের মুজতাহিদ ও মুহাদ্দিস যে হাদীসকে আমলযোগ্য সাব্যস্ত করে ফেলেছেন সেটিকে আমরা সহীহ বিশ্বাস করাকে নিরাপদ মনে করি ফিতনার যুগের কোন মুহাদ্দিসের সহীহ বলা কথার উপর আমল করার চেয়ে।
তাহলে আমাদের সহীহ জঈফের সারমর্ম দাঁড়াচ্ছে। আল্লাহ ও রাসূল সাঃ কোন হাদীসকে সহীহ জঈফ না বলায় আমরা বাধ্য হয়ে নবীজী সাঃ এর বলা শ্রেষ্ঠ যুগের মুহাদ্দিস ও মুজতাহিদের হাদীসের উপর আমলকরণ ও আমল বর্জনের আলোকে হাদীসকে সহীহ ও জঈফ সাব্যস্ত করি। ফিতনার যুগের কোন মুহাদ্দিসের বক্তব্যের আলোকে সকল মাসআলার সমাধানে হাদীসকে সহীহ জঈফ বলাকে নিরাপদ পন্থা বলে মনে করি না। যেহেতু তাদের ব্যাপারে আল্লাহ ও রাসূল সাঃ এর কোন নির্ভরযোগ্যতার সার্টিফিকেট নেই।
এই হল, আমাদের সহীহ জঈফ বলার পদ্ধতি।”
এবার গজগজ করে উঠল উভয় লা মাযহাবী একসাথে। বলতে লাগল। একজনকে মানার নির্দেশ কে দিয়েছে? ইমাম আবু হানীফা রহঃ সব সঠিক বলেছেন একথা কে বলেছে? ইমাম আবু হানীফাতো নিজেই বলেছেন তার কথা যাচাই করে মানতে।”
দুই লা মাযহাবী একই সাথে শুধু বলতেই আছে, বলতেই আছে। থামার কোন লক্ষণ নেই। ২য় লা মাযহাবীটি বলার সাথে সাথে বেশ রাগও দেখাল। আস্তে আস্তে কি গালি দিল কি না? তা বুঝতে পারিনি। তবে মুখ নড়ছিল খুব।
থামানোর চেষ্টা করলাম। অনেক বলার পর থামল দু’জন। বললাম, “আরে ভাই! পয়েন্টওয়ারী কথা বলুন। এভাবে শুধু বলতেই থাকলে কিভাবে আলোচনা ফলপ্রসু হবে?
আপনাদের অভিযোগ অনেক একেকটি করে আলোচনা করুন। এভাবে কলকলিয়ে উঠলেতো কথা চলতে পারবে না। আমার পূর্বে বলা বিষয়টি বুঝলে আসলে আপনারা এসব প্রশ্ন করতেন না। আমি কিন্তু বলিনি। শুধু আবু হানীফা রহঃ কেই মানতে হবে। আমি প্রথমত বলেছি শ্রেষ্ঠ যুগের মুহাদ্দিস ও মুজতাহিদকে মানতে হবে। দ্বিতীয় বিষয় হল আমরা ইমাম আবূ হানীফা রহঃ কে প্রাধান্য দেই তিনি সবার আগের। তাঁর এবং হাদীসের মূল রাবীর মাঝের দূরত্ব একদম নেই বললেই চলে। আর হাদীসের সহীহ জঈফের বিষয়টি আল্লাহ ও রাসূল সাঃ সুনির্দিষ্ট করে যাননি। তাই হাদীসের মুল রাবীর নিকটবর্তী এবং রাসূল সাঃ এর বলা শ্রেষ্ঠ যুগের ব্যক্তিত্বের কথাকে প্রধান্য দেই হাদীসের সহীহ জঈফ বিষয়ে মতভেদপূর্ণ হালাতে। মতভেদহীন হালাতে অন্যরাও প্রাধান্য পায়। কিন্তু মতভেদপূর্ণ হালাতে যেহেতু কাউকে নির্দিষ্ট করে মানার নির্দেশ নেই। একজনকে বাদ দিয়ে আরেকজনকে মানার কুরআন ও হাদীসের কোন দলীল বিদ্যমান নেই। তাই রাবীর নিকটবর্তী এবং পৃথিবী বিখ্যাত ও স্বীকৃতি মুহাদ্দিস ও মুজতাহিদ ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর সহীহ সাব্যস্ত করণকে সহীহ সাব্যস্ত করি। আর যেটিকে তিনি বাদ দিয়েছেন সেটিকে জঈফ বা এক্ষেত্রে আমলহীন সাব্যস্ত করে থাকি। তাহলে আপনারা যে কাজটি করছে ফেতনার যুগের মুহাদ্দিস দিয়ে, আমি সেকাজটিই করছি শ্রেষ্ঠ যুগের ব্যক্তি দিয়ে। তথা আপনারা হাদীস সহীহ জঈফ বলছেন ফেতনার যুগের বক্তব্যের আলোকে আর আমরা হাদীস সহীহ জঈফ বলছি শ্রেষ্ঠ যুগের মুহাদ্দিস সেই সাথে মুজতাহিদের বক্তব্যের আলোকে। এই হল আপনাদের আর আমাদের সহীহ জঈফ বলার মাঝে মূল পার্থক্য।”
১ম লা-মাযহাবী- ইমাম আবু হানীফাতো তার কথা দলীল ছাড়া মানতে নিষেধ করেছেন। তো?
আমি- কাকে নিষেধ করেছেন? আপনার আমার মত মুর্খকে? না মুজতাহিদ ইমাম আবু ইউসুফকে? ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর উক্ত বক্তব্যটি কাকে উদ্দেশ্য করে বলা?
১ম লা মাযহাবী- আবু ইউসুফকে। কিন্তু……..
২য় লা-মাযহাবী- “অন্ধ তাকলীদ। একেই বলে অন্ধ তাকলীদ। আপনারাতো অন্ধ তাকলীদ করছেন।” বেশ তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন তিনি।
১ম লা মাযহাবী- হ্যাঁ, ঠিকই অন্ধ তাকলীদ। অন্ধের মত তাকলীদ করা।
আমি- “একটু থামেন না ভাই। কথা শুধু বলেই যাচ্ছেন।” দ্বিতীয় লা মাযহাবীকে উদ্দেশ্য করে বললাম- অন্ধ তাকলীদ কাকে বলে বলুনতো।”
২য় লা-মাযহাবী- এটা আবার কে না জানে। কারো কথা অন্ধভাবে মেনে নেয়াকে অন্ধ তাকলীদ বলে।
আমি- আপনার ভুলটাতো এখানেই। আপনি অন্ধ তাকলীদ বলে চিল্লাচ্ছেন কিন্তু অন্ধ তাকলীদ কি জিনিস তা জানলেন না। অন্ধ তাকলীদ হচ্ছে, অন্ধ অন্ধের পিছনে ছোটা। এক অন্ধ আরেক অন্ধের পিছনে ছোটার নাম অন্ধ তাকলীদ।
২য় লা-মাযহাবী- অন্ধ মানে কি? চোখ নষ্ট?
আমি- আপনি যে আমাকে অন্ধ তাকলীদ করি বলছিলেন এর দ্বারা কি আপনি আমার চোখ নষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েছিলেন?
২য় লা-মাযহাবী- অন্ধ তাকলীদ বিষয়টি বুঝিয়ে কনতো!
আমি- “যেমন ধরুন আপনি একটি অন্ধ চোখে দেখেন না। আমি আরেক অন্ধ। এখন আমাদের রাস্তা পাড় হতে হবে। আমি অন্ধ আপনি অন্ধের কাছে গিয়ে বললাম আমাকে রাস্তা পাড় করে দিন। আপনি নিজেই চোখে দেখেন না, আমাকে কি রাস্তা পাড় করে দিবেন? এই হল, অন্ধ তাকলীদ। মানে অন্ধের পিছনে অন্ধ ছোটা। যেমন বর্তমানে আপনারা যারা কুরআন ও হাদীস দেখে পড়তেই জানেন না, তারা আবার একজন আরেকজনকে গুরু বানিয়ে তার কথা অনুপাতে কুরআন ও সহীহ হাদীসের অনুসারী দাবি করে আলেম উলামাদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হতে চলে আসেন। এরকম এক জাহিল আরেক জাহিলকে গুরু মেনে পথ চলার নাম অন্ধ তাকলীদ।
একজন চক্ষুসমান ব্যক্তিকে এক অন্ধ অনুসরণ করলে সেটিকে অন্ধ অনুসরণ বলে না। যেমন একজন জ্ঞানী মুজতাহিদকে জাহিল ব্যক্তি যদি অনুসরণ করে তাকেও অন্ধ তাকলীদ বলবে না। এতো জ্ঞানীর পিছনে জাহিলের অনুসরণ। জাহিলের পিছনে জাহিলের অনুসরণ নয়। জাহিলের পিছনে জাহিলের অনুসরণের নাম অন্ধ তাকলীদ। এবার বলুন আমরা অন্ধ তাকলীদ করি? না আপনারা?”