প্রচ্ছদ / কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা / সৎ কাজের আদেশ দ্বারাই অসৎ কাজের নিষেধ হয়ে যায়?

সৎ কাজের আদেশ দ্বারাই অসৎ কাজের নিষেধ হয়ে যায়?

প্রশ্ন:

 তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি তোমাদেরকে বের করা হয়েছে মানুষের কল্যানের জন্য।

তোমরা সত্‍ কাজের আদেশ কর এবং অসত্‍ কাজ থেকে নিষেধ কর। [সুরা আলে ইমরান ১১০] আয়াতের আলোকে কয়েকটি প্রশ্ন:-

১। সৎ কাজের আদেশ দ্বারা উদ্দ্যেশ্য কি?
২। অসৎ কাজের নিষেধ দ্বারা উদ্দ্যেশ্য কি? সৎ কাজের আদেশ দ্বারাই কি অসৎ কাজের নিষেধ আদায় হবে? দুটো কি একই জিনিস,নাকি আলাদা,নাকি একটা আর একটার অধীনে?

উল্লেখ্য যে,বেশ কিছুদিন যাবত একটি বিষয় নিয়ে অস্বস্তিতে আছি। বিষয়টি হচ্ছে,অনেকেই বলে সৎ কাজের আদেশের দ্বারাই অসৎ কাজের নিষেধ আদায় হয়ে যায়। তারা উসুলে ফিক্বাহের বেশ কিছু নিয়ম নীতির আলোকে বিষয়টাকে এভাবে ব্যাখা করতে চায়! কিন্তু নিজের কম ইলমির কারনে বিষয়টি বুঝতেও পারছিনা। সুতরাং,নির্ভরযোগ্য দলীলের আলোকে বিস্তারিত সমাধান আশা করছি।

ফজলুল হক. হাটহাজারী মাদ্রাসা,চট্টগাম।

জবাব:

بسم الله الرحمن الرحيم

সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ মানে কি?

فى تفسير المظهرى- ويكون النهى عن المنكر واجبا على كل احد وأقله أن ينكر بقلبه يعنى كونوا (امة يدعون) الناس (إلى الخير) يعنى خير العقائد والأخلاق والأعمال التى فيها صلاح الدين والدنيا، أخرج ابن مردوية عن أبى جعفر محمد الباقر قال-قال رسول الله صلى الله عليه وسلم “الخير اتباع القرآن وسنتى” قال السيوتى- معضل عن عثمان أنه قرأ “وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ ۚ  ويسغيثون على ما أصابهم وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ” ، قلت : يعنى لدفع البلاء عن الناس “ويأمرون بالمعروف” أى ما عرف من الشرع حسنة واجبا كان أو مندوبا “وينهون عن المنكر” يعنى ما أنكره الشرع من المحرمات والممكروهات، ………..”وأؤلئك” يعنى الداعون إلى الخير والآمرون بالمعروف والناهون عن المنكر، هم “المفلحون” خاب وخسر من لم يفعل ذلك، عن ابى سعيد الخدرى قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ رواه مسلم، (تفسير المظهرى-2/116)

অনুবাদ-অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা প্রত্যেকের উপর ফরজ। অন্তত মন দিয়ে ঘৃণা করে হলেও। “তোমাদের মাঝে একদল থাকা উচিত যারা আহবান করবে সৎকর্মের প্রতি” মানে হল সঠিক আক্বায়েদ, নির্মল আখলাক ও সঠিক আমল, যাতে দুনিয়া আখেরাতের কল্যাণ নিহিত।

ইবনে মারদুইয়া আবু জাফর মুহাম্মদ আল বাকের থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-খায়র হল কুরআন ও আমার সুন্নাতের অনুসরণের নাম।

আল্লামা সুয়ুতী রহঃ বলেন-মুযাল উসমান থেকে বর্ণনা করেন-তিনি وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ الخ (আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি,নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে,আর তারাই হলো সফলকাম। }

এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন, আমি বলি, মানুষ থেকে বিপদ দূরিভূত করার জন্য, আর আমর বিল মারুফ মানে হল-ইসলামী শরীয়তে যা পূণ্যের কাজ, চাই তা আবশ্যক হোক, বা মুস্তাহাব হোক।

আর নাহি আনিল মুনকার মানে হল-হারাম ও মাকরূহ যেসব বস্তু ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে।>>>>> وأؤلئك তথা কল্যাণের দিকে আহবানকারী, এবং সৎকাজের আদেশদাতা, এবং অসৎকাজের নিষেধদাতা, তারাই المفلحونতথা সফলকাম। আর যারা এটা না করে,তারা ক্ষতিগ্রস্থ।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন। তোমাদের মাঝে যে ব্যক্তি কোন নিষেধকৃত কাজ দেখে, সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে, আর যদি সে এতে সক্ষম হয়, তাহলে সে যেন তা মুখ দিয়ে প্রতিহত করে, যদি তাতেও সক্ষম না হয়,তাহলে যে এটাকে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে, আর এটি ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৬} তাফসীরে মাজহারী-২/১১৬।

কুরআন হাদীসে বর্ণিত সফলতার চাবিকাঠি কয়টি?

وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ ۚ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ [٣:١٠٤

আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি,নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে,আর তারাই হলো সফলকাম। (সূরা আলে ইমরান-১০৪)

كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ ۗ وَلَوْ آمَنَ أَهْلُ الْكِتَابِ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ ۚ مِنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ وَأَكْثَرُهُمُ الْفَاسِقُونَ [٣:١١٠

তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত,মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। আর আহলে-কিতাবরা যদি ঈমান আনতো,তাহলে তা তাদের জন্য মঙ্গলকর হতো। তাদের মধ্যে কিছু তো রয়েছে ঈমানদার আর অধিকাংশই হলো পাপাচারী। (সূরা আলে ইমরান-১১০)

এছাড়া আরো অনেক আয়াতে এ নির্দেশ এসেছে। যেমন-

সূরা আরাফ: ১৫৭

সূরা আলে ইমরান: ১১৪

সূরা তাওবা: ৭১

এছাড়া সূরা তাওবার ১১২ আয়াতে, সূরা হজ্জের ৪১ আয়াতে, সূরা লুকমানের ১৭ আয়াতে ও অন্যান্য স্থানেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহর প্রকৃত মুমিন বান্দাদের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ।

رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ « مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ

হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন। তোমাদের মাঝে যে ব্যক্তি কোন নিষেধকৃত কাজ দেখে, সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে, আর যদি সে এতে সক্ষম হয়, তাহলে সে যেন তা মুখ দিয়ে প্রতিহত করে, যদি তাতেও সক্ষম না হয়,তাহলে যে এটাকে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে, আর এটি ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৬,সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৩০৭, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-১১৪২, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৪০১৩, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১১৪৬০, মুসনাদে তায়ালিসী, হাদীস নং-২১৯৬, মুসনাদে আব্দ বিন হুমাইদ, হাদীস নং-৯০৬, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদীস নং-৫৬৪৯, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৭১৫৩}

কুরআন হাদীসের অসংখ্য স্থানে সফলতার চাবিকাঠি দু’টি বস্তুকে সাব্যস্ত করা হয়েছে। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ। যা অসংখ্য আয়াতে কারীমায় ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সেই সাথে অসৎ কাজের নিষেধের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিও রাসূল সাঃ বাতলে দিয়েছেন। যা ইতোপূর্বের মুসলিম শরীফের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

সুতরাং এ ব্যাখ্যা করা যে, সৎকাজের আদেশ দিলেও অসৎকাজের নিষেধ হয়ে যায়, তাহলে আলাদাভাবে নাহি আনিল মুনকারের উল্লেখ করার কোন অর্থই থাকে না। সেই সাথে অসৎ কাজ বাধাদানের মুসলিম শরীফে বর্ণিত রাসূল সাঃ এর বলা পদ্ধতিটিও হয়ে পড়ে অর্থহীন।

শুধু তাই নয়, যদি শুধুমাত্র সৎকাজের আদেশ দিলেই দ্বীনের কাজ পূর্ণতা লাভ করতো্ তাহলে খোদ নবীজী সাঃ স্বশরীরে ২৭টি জিহাদে অংশগ্রহণ করে অসৎ কাজের নিষেধের নজীর পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করে যেতেন না।

তাই এ কথাটি কুরআন হাদীসের অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছু নয় যে, সৎ কাজের আদেশ দিলেই অসৎ কাজের নিষেধ হয়ে যাবে।

বিস্তারিত জানতে পড়ুন

১-তাফসীরে মাজহারী-২/১১৬

২-তাফসীরে ইবনে কাসীর -১/৩৪২-৩৪৩

৩-তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন-২/৪০-৪৫

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইমেইল- [email protected]

[email protected]

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *