প্রশ্ন
শ্রদ্ধেয় মুফতী সাহেব।
বাংলাদেশের এক প্রসিদ্ধ বক্তা তার এক বয়ানে বলেন:
“আলেমরা যেটা বলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়ে আল্লাহর পর যার স্থান এটা আমি মানি। কিন্তু সাথে সাথে আমি এটাও বলি, কুরআন যখন দেখি তো দেখি, [হাত দিয়ে নিজের চেয়ারের পাশ ইশারা করে]। আল্লাহর পাশে যার স্থান। قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَىٰ
ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّىٰ
فَأَوْحَىٰ إِلَىٰ عَبْدِهِ مَا أَوْحَىٰ
যে চলতে চলতে চলতে চলতে চলতে পাশে যেয়ে কাছে হতে হতে হতে হতে আল্লাহর পাশে যেয়ে বইসা গেছে। আরশের উপর। অথচ যেটা নূরের জগত। নূরীদের সর্দার, নূরীদের! জিবরীল নূরের ফেরেশতা, নূরের তৈরী, জিবরীল আলাইহিস সালাম নূরীদের সর্দার, ওনিই সেদরাতুল মুনতাহায় যায়া বলতাছেন, আগে যাওয়া যাবে না। বলছে কেন? বলছে: এক তো হলো অনুমতি নাই, দ্বিতীয় হলো শরীরে ফিটনেস নাই।
لو قدمت شبرا لحترقت بنور ربى একটু আগে গেলেই শেষ। যেইখানে ওনি আগে যাইতে পারেন না। ওইখানে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ যাইতে, যাইতে যাইতে যাইতে যাইতে যাইতে যাইতে আরশের নিচ, ওইখান থেকে আরশের উপর, ঐখান থেকে আসতে আসতে
قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَىٰ
ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّىٰ
فَأَوْحَىٰ إِلَىٰ عَبْدِهِ مَا أَوْحَىٰ
বিলকুল আল্লাহর পাশে বইসা পড়ছে”। উপরোক্ত শব্দে তিনি বয়ান করেছেন।
বয়ানের ক্লিপটি সংযুক্ত করে দেয়া হলো।
এ বয়ান সম্পর্কে কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে জানতে চাই। এ বয়ান ঠিক আছে?
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
উপরোক্ত বয়ানে মোটা দাগে কতগুলো মারাত্মক ভুল ও গোমরাহী বিষয় রয়েছে। যেমন:
১
কুরআন অনুপাতে নবীজীর স্থান আল্লাহর পাশে?!
এটি একটি পরিস্কার গোমরাহী ও শিরকের সমূহ সম্ভাবনামূলক একটি শব্দ। নৈকট্যে আল্লাহর পাশে হওয়া, আর ‘আল্লাহর পাশে যার স্থান’ এ দু’টি কথার মোটা দাগের পার্থক্য আশা করি জ্ঞানীরা বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়।
কারো নিকটবর্তী হওয়া, আর তার পাশাপাশি হয়ে যাওয়ার মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য।
একজন সাধারণ মানুষ বাদশার পাশাপাশি হতে পারে, কিন্তু তার কাছের স্থান দখল করতে পারেন না।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা। তিনি আল্লাহর সবচে’ প্রিয় বান্দা। আল্লাহর পরেই পুরো সৃষ্টি জগতে মর্যাদায় তিনিই প্রথম।
কিন্তু তিনি কখনো আল্লাহর সমকক্ষ বা পাশের নন। আল্লাহর পাশের স্থানও তাঁর নয়। তিনি আল্লাহর বান্দা। সমমানের বা পাশে নন।
وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ [١١٢:٤]
এবং তার সমতুল্য কেউ নেই। [সূরা ইখলাস-৪]
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ﴿الشورى: ١١
কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সব শুনেন, সব দেখেন। [সূরা শুরা-১১]
তাই এহেন বক্তব্য দেয়া শিরকের সম্ভাবনাময়। যা থেকে তওবা করা এবং সকলকে নিজের ভুল বক্তব্য বিষয়ে জানিয়ে দেয়া জরুরী।
২
আয়াতের অপব্যাখ্যা
কুরআনে কারীমের সুরা নজমের ৮, ৯ ও ১০ নং আয়াতের কোথাও আল্লাহর পাশে নবীজীর স্থান এমন কথা বলা হয়নি। বরং আল্লাহর নিকটবর্তী হবার কথা এসেছে।
উক্ত আয়াতের বিশুদ্ধ তাফসীর হলো:
عَنْ مَسْرُوقٍ قَالَ: «قُلْتُ لِعَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا: فَأَيْنَ قَوْلُهُ: {ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى} قَالَتْ: ذَاكَ جِبْرِيلُ كَانَ يَأْتِيهِ فِي صُورَةِ الرَّجُلِ وَإِنَّهُ أَتَاهُ هَذِهِ الْمَرَّةَ فِي صُورَتِهِ الَّتِي هِيَ صُورَتُهُ فَسَدَّ الْأُفُقَ
মাসরূক রহঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আয়শা রাঃ কে আল্লাহর বাণীঃ “এরপর তিনি তাঁর নিকটবর্তী হলেন, অতি নিকটবর্তী। ফলে তাদের মধ্যে দু’ ধনুকের ব্যবধান অথবা তার চেয়েও কম। (সূরা নজম ৮, ৯)-এর মর্মার্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, তিনি জিবরীল (আলাইহিস সালাম) ছিলেন। তিনি স্বভাবত মানুষের আকৃতিতে তাঁর কাছে আসতেন। কিন্তু এবার তিনি কাছে এসেছিলেন তাঁর মূল আকৃতি ধারণ করে। তখন তিনি আকাশের সম্পূর্ণ দিগন্ত ঢেকেছিলেন। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩২৩৫]
أَبُو إِسْحَاقَ الشَّيْبَانِيُّ قَالَ «سَأَلْتُ زِرَّ بْنَ حُبَيْشٍ عَنْ قَوْلِ اللهِ تَعَالَى {فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى} قَالَ: حَدَّثَنَا ابْنُ مَسْعُودٍ أَنَّهُ رَأَى جِبْرِيلَ لَهُ سِتُّمِائَةِ جَنَاحٍ
আবূ ইসহাক শায়বানী (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি যির ইবনু হুবাইশ (রাঃ)-কে মহান আল্লাহর এ বাণীঃ ‘‘অবশেষে তাদের মধ্যে দুই ধনুকের দূরত্ব রইল অথবা আরও কম। তখন আল্লাহ স্বীয় বান্দার প্রতি যা ওয়াহী করার ছিল, তা ওয়াহী করলেন’ (আন্-নাজম ৯-১০)। এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, ইবনু মাস’ঊদ (রাঃ) আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিব্রাঈল (আঃ)-কে দেখেছেন। তাঁর ছয়শ’টি ডানা ছিল। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩২৩২]
তাহলে এ আয়াতের সাহাবা রাঃ কর্তৃক তাফসীর হলো: আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া নয়, বরং জিবরাইল আলাইহিস সালামের নিকটবর্তী হওয়া।
অর্থাৎ জিবরাইল আঃ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটবর্তী হয়েছেন তাঁর আসল সূরতে।
তবে আরেকটি ব্যাখ্যা হলো: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার নিকটবর্তী হয়েছেন।
ثُمَّ عَلاَ بِهِ فَوْقَ ذَلِكَ بِمَا لاَ يَعْلَمُهُ إِلاَّ اللَّهُ، حَتَّى جَاءَ سِدْرَةَ الْمُنْتَهَى وَدَنَا الْجَبَّارُ رَبُّ الْعِزَّةِ فَتَدَلَّى حَتَّى كَانَ مِنْهُ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى فَأَوْحَى اللَّهُ فِيمَا أَوْحَى
তারপর (জিবরীল আঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নিয়ে এত ঊর্ধ্বে আরোহণ করেন যে, যা সম্পর্কে আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জানে না। অবশেষে তিনি সিদরাতুল মুনতাহায় আগমন করলেন। এখানে প্রবল পরাক্রমশালী আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তী হলেন। অতিনিকটবর্তীর ফলে তাঁদের মধ্যে দু’ধনুকের ব্যবধান রইল অথবা তারও কম। তখন আল্লাহ তার প্রতি ওহী পাঠালেন। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৭৫১৭]
কিন্তু কারো নিকটবর্তী হওয়া মানে তার পাশে স্থান হয়ে যাবার দাবীটি অজ্ঞতার চূড়ান্ত মানসিকতা ছাড়া আর কী হতে পারে?
আল্লাহর নিকটবর্তীতো ফেরেশতারা আছেন। আরশ বহনকারী ফেরেশতা। এমন কি জিবরীল আলাইহিস সালামও তো আল্লাহর অতি নিকটবর্তী। এর মানে কি তিনি আল্লাহর পাশের স্থানে? নাউজুবিল্লাহ।
তাই উক্ত আয়াত দিয়ে এমন ভুল ব্যাখ্যা পরিস্কার কুরআনের অপব্যাখ্যা। এমন অপব্যাখ্যা পৃথিবীর কোন গ্রহণযোগ্য তাফসীরকার করেননি । তাই এটি পরিস্কার তাফসীর বির রায়। যা একটি পরিস্কার ভুল ও বিভ্রান্তি। যা থেকে ভুল স্বীকার এবং ভবিষ্যতে সতর্ক নিজে থাকা এবং অতীত ভুল বিষয়ে শ্রোতাদের জানানো জরুরী।
৩
সিদরাতুল মুনতাহার পর জিবরীল আলাইহিস সালাম আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের সঙ্গ পরিত্যাগ করেছেন মর্মের দাবীটিও বিশুদ্ধ বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত নয়।
قال القاضي عياض رحمه الله تعالى: وذكر النقاش عن ابن عباس: في قصة الإسراء عنه صلى الله عليه وسلم في قوله تعالى: ( ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى ) قال: فارقني جبريل، فانقطعت الأصوات عني فسمعت كلام ربي وهو يقول: ليهدأ روعك يا محمد، ادن ادن (كتاب الشفا بتعريف حقوق المصطفى، للقاضي عياض بن موسى اليحصبي السبتي المغربي، الباب الثالث فيما ورد من صحيح الأبار ومشهورها ويعظم قدره عن دربه الخ، الفصل السادس مناجته لربه صلى الله عليه وسلم-1/242)
قال الذهبي رحمه الله تعالى:
” النقاش العلامة الرحال الجوال أبو بكر محمد بن الحسن بن محمد بن زياد الموصلي ثم البغدادي المقرئ المفسر أحد الأعلام: كنت قد أهملته لوهنه ، ثم رأيت أن أذكره ، وأذكر عجره وبجره…ومع جلالته ونبله فهو متروك الحديث، ….
وأما طلحة بن محمد بن جعفر فقال: النقاش يكذب في الحديث والغالب عليه القصص.
وقال البرقاني: كل حديثه منكر.
وقال اللالكائي: تفسيره إشفاء الصدور، لا شفاء الصدور. قلت: يعني مما فيه من الموضوعات. وقال الخطيب: في حديثه مناكير بأسانيد مشهورة تذكرة الحفاظ-3/82-83)
وقال الخطيب البغدادي رحمه الله تعالى:
” سألت أبا بكر البرقاني، عن النقاش، فقال: كل حديثه منكر.
وَحَدَّثَنِي من سمع أبا بكر ذكر تفسير النقاش، فقال: ليس فيه حديث صحيح، (تاريخ بغداد-2/606)
৪
আরশ কি আল্লাহর বসার স্থান? নাউজুবিল্লাহ।
নিজের হাত দিয়ে ইশারায় পাশের চেয়ার দেখিয়ে এভাবে বলা যে, যেতে যেতে আরশের উপর আল্লাহর পাশে গিয়ে বসে গেছেন। এমনভাবে ব্যক্ত করা হয়, যেন আল্লাহ তাআলা নিজে আরশে বসে আছেন।
আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও আরশের উপর উঠে আল্লাহর পাশে বসে গেছেন।
এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার আরশে বসার মতো পরিস্কার গোমরাহী দাবী প্রমাণিত হচ্ছে। অথচ এটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা নয়।
আল্লাহ তাআলা স্থান ও কাল থেকে পবিত্র। তাই এহেন গোমরাহী আকীদা প্রচার করা কোনভাবেই জায়েজ নেই।
ولا يتمكن فى مكان ولا يجرى عليه زمان (شرح عقائد، ياسر نديم ديوبند-39، نبراس-114)
من حمله (أى كون الله فى السماء) على ظاهره فهو ضال من الضالين (المفهم، بيروت-2/145)
ان الله ليس بجسم فلا يحتاج الى مكان يستقر فيه فقد كان ولا مكان (عمدة القارى، كتاب التوحيد، باب قول الله تعالى تعرج الملائكة والروح اليه، بيروت-12/117، فتح البارى، كتاب التوحيد، باب وكان عرشه على الماء، مكة مكرة-15/372)
الله تعالى منزه عن المكان كما هو منزه على الزمان (المفهم، كتاب الصلاة، باب نسخ الكلام فى الصلاة-2/143)
قال البغوى اهل السنة يقولون الاستواء على العرش صفة الله (تفسير خازن-2/95، سورة اعراف تحت الآية-45)
৫
দুইবার সূরা নজমের ৮, ৯ ও ১০ নং আয়াত তিলাওয়াত করা হয়েছে। দুইবারই আয়াতের তারতীব উলট পালট করে তিলাওয়াত করা হয়েছে। যা ইচ্ছেকৃতভাবে করা মারাত্মক গোনাহের কাজ।
আশা করি এটি ইচ্ছেকৃত হয়নি। তাই এটি গোনাহের পর্যায়ভূক্ত হবে না। বাকি আয়াত তিলাওয়াতে সতর্কতা কাম্য।
এ বক্তার উচিত কোন বিজ্ঞ আলেমের তত্বাবধানে এসব বিষয়গুলো সংশোধন করে নেয়া।
আর এমন বক্তব্য দেয়ার কারণে তওবা করার সাথে সবার সামনে নিজের ভুল স্বীকার করা। ভবিষ্যতে সতর্ক থাকা।
এসব বিষয়ে তওবা ও সতর্ক করা ব্যতীত উক্ত বক্তার এমন সব স্পর্শকাতর বিষয়ে ওয়াজ করা যেমন সমীচিন নয়, তার বয়ান শোনাও উচিত নয়।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া ইসলামিয়া দারুল হক লালবাগ ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা: জামিয়াতুস সুন্নাহ কামরাঙ্গিরচর, ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা: কাসিমুল উলুম আলইসলামিয়া, সালেহপুর আমীনবাজার ঢাকা।
পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।
শাইখুল হাদীস: জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, সনমানিয়া, কাপাসিয়া, গাজীপুর।
ইমেইল– [email protected]