প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / “হাদীস সহীহ হলেই তা আমার মাযহাব” ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর উক্ত কথার মানে কী?

“হাদীস সহীহ হলেই তা আমার মাযহাব” ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর উক্ত কথার মানে কী?

প্রশ্ন

মুফতি সাহেব , অনেকে বলে যে চার মাজহাবের ইমামগণই ঠিক কিন্তু তাদের সময়ে অনেক হাদিস তাদের সামনে ছিল না ।পরে সহিহ হাদিস পাওয়া গেছে ।আর যেহেতু ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) বলেছেন, কোনো সহিহ হাদিস পেলে সেটাই আমার মাজহাব ।কাজেই হানাফি মাজহাব মানতে গেলে এখন মাজহাব না মেনে সহিহ হাদিস মানতে হবে ।
আমার প্রশ্ন হল এ ধরনের কথা ঠিক কিনা ।আশা করি অতি শীঘ্রই জবাব দেবেন।

উত্তর:
بسم الله الرحمن الرحيم

চার ইমাম যেমন ফিকহশাস্ত্রের ইমাম তেমনি হাফিজুল হাদীস হিসেবেও গণ্য। শামসুদ্দীন যাহাবী রহ.-এর ‘তাযকিরাতুল হুফফায’ গ্রন্থে, যা হাফিযুল হাদীসগণের জীবনী বিষয়ে রচিত, উক্ত চার ইমামেরই জীবনী আলোচনা করা হয়েছে। একইভাবে তাঁদের বিশিষ্ট শাগরিদ এবং শাগরিদের শাগরিদগণ হাফিযুল হাদীসগণের মধ্যে গণ্য, যারা এই ইমামদের সংকলিত ফিকহ বিশদভাবে আলোচনা ও সংরক্ষণ করেছেন। হাদীসশাস্ত্রে ফিকহের ইমামগণের দক্ষতা ও পারদর্শিতা কেমন ছিল সে সম্পর্কে বিশদ জানা যাবে তাঁদের জীবনীতে এবং তাদের হাদীস বিষয়ক কর্ম ও রচনাবলি অধ্যয়নের মাধ্যমে। প্রসঙ্গত মনে রাখা উচিত, মুজতাহিদ ইমামগণও হাফিযুল হাদীস হয়ে থাকেন এবং হাদীস বিচারেও পারদর্শী হয়ে থাকেন।
উল্লেখ্য যে, কারো ফিকহে ইমাম হওয়ার জন্য হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তার শুধু যবত ও ইতকানই যথেষ্ট নয়, বরং তার হাদীস শাস্ত্রের অগাধ জ্ঞান থাকা, বিপুল সংখ্যক হাদীস ও আছার মুখস্থ থাকা, রেওয়ায়েতের বিচার-বিশ্লেষণ ও যাচাই-বাছাইয়ে ইমামের স্তরে উপনীত হওয়া জরুরী। এছাড়া কারো ‘মুজতাহিদ ইমাম’ হওয়া অসম্ভব।
সহজ ও সংক্ষেপে মানিত চার ইমাম সম্পর্কে কিছু কথা আরজ করা হলো-
চার মাযহাবের ইমামদের হাদীস সম্পর্কে প্রাজ্ঞতা
১.ইমাম আবু হানীফা রহ.
এক.ইমাম আবু হানীফা রহ.এর হাদীস শাস্ত্রের অতলস্পর্ষী অবস্থান নিয়ে বরেণ্য ইমামদের রয়েছে অনেক প্রাজ্ঞোচিত মন্তব্য। আমরা আজকের আলোচনায় সে সকল মন্তব্যের দিকে না গিয়ে বিষয়টি একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বোঝার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

এক.
হাদীস শাস্ত্রে ইমামে আ‘যম ইমাম আবু হনীফা রহ.এর পা-িত্য ও বুৎপত্তি কেমন ছিল তা বুঝার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়টি ভালভাবে বুঝতে হবে।
ইমাম আবু হনীফা রহ. যেমন হাদীস মুখস্থ-সংরক্ষণ, সংকলন এবং বর্ণনা করেছেন তেমনি সংকলন ও সংরক্ষণের পাশাপাশি সহীহ্ ও জয়ীফ নির্ণয়করণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত ও অপ্রমাণিত রেওয়ায়েতও চিহ্নিত করণের কাজও করেছেন। উল্লেখ্য যে,অনেক মুহাদ্দিসই হাদীস মুখস্থ-সংরক্ষণ, সংকলন স্তরে পৌঁছে থেমে যান। এর চেয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার হিম্মত ও তলব তাঁদের মধ্যে থাকে না। কিংবা তাঁরা তার সুযোগ পান না।
ইমাম আবু হনীফা রহ. প্রথম ও দ্বিতীয় স্তর অতিক্রম করে রাসুল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লামের হাদীস থেকে বিধি-বিধান ও মাসআলা-মাসায়েল উদ্ভাবন ও আহরণের অবিস্মরণীয় খেদমতেরও আন্জাম দিয়েছেন। জানা কথা এ স্তরে উপনীত হতে গেলে ইলম, আমল এবং অভিজ্ঞতার সুবিস্তৃত ময়দান অতিক্রম করা লাগে, আর এ ময়দান পার হওয়ার জন্য প্রতি পদক্ষেপে গভীর দৃষ্টি ও বিচক্ষণতার দরকার পড়ে। এ কারণে এ স্তরে উন্নীতদের সংখ্যা তুলনা মুলক কম হয়ে থাকে।
অতএব নি:শঙ্কোচ এবং নির্দ্বিধায় একথা বলা যায় যে, ইমামে আ‘যম আবু হনীফা রহ. উক্ত তিনও স্তরের একজন আকাশছোঁয়া ব্যক্তিত্ব। তিনি যেমন ছিলেন হাফেজে হাদীস তেমনি হাদীস বিচারকও। আবার সাথে সাথে ফিকহুল হাদীসেরও শীর্ষ আলেম। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম অনুচ্ছেদভিত্তিক সংকলিত অবিসংবাদিত হাদীস গ্রন্থ ‘কিতাবুল আছার’- ই তার উজ্জ্বল প্রমাণ।

দুই.
ইমাম আযম রহ. ছিলেন কুফার মনীষীগণের কাছে সংরক্ষিত ইলমের ধারক। শুধু তাই নয় হাদীস আছার এবং কুরআন -সুন্নাহর অন্যান্য শহরের অধিকাংশ ইলমেরও তিনি ধারক ছিলেন। এর প্রমাণ রয়েছে তাঁর কিতাবসমূহে, তাঁর সঙ্গীদের কাছে সংরক্ষিত তাঁর বর্ণনাসমূহে, কিতাবুস সালাত থেকে শুরু করে এক একটি অধ্যায় এবং প্রতি অধ্যায়ের এক একটি মাসআলা পাঠ করুন, তাহলেই দেখতে পাবেন, কীভাবে তিনি হাদীস ভিত্তিক জবাব দিয়ে চলেছেন এবং চিন্তা করে দেখুন, হাদীস ও সালাফের আছারের সাথে তার জবাবসমূহ কত সামঞ্জস্যপূর্ণ।

তিন.
হাদীসের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা রহ.এর যবত ও ইতকান এবং নির্ভরযোগ্যতা কেমন ছিল সে সম্পর্কে রয়েছে বরেণ্য ইমামদের বিভিন্ন নুসুস ও উদ্ধৃতি। এগুলোতো হলো ইমামদের মৌখিক স্বীকিৃতি ও স্বাক্ষ্য প্রদান। কিন্তু এ বিষয়টি যাচাই করার জন্য আমাদের জন্যও পথ খোলা রয়েছে। উদাহরণত কিতাবুল আছার এবং ইমাম আবু হানীফা রহ.থেকে বর্ণিত অন্যান্য আছারও হাদীসগুলোকে যদি আমরা অন্যান্য সিকাহ্ (নির্ভরযোগ্য) রাবীর বর্ণিত হাদীসসমূহের সাথে তুলনা করি তাহলে বিষয়টি বাস্তবিকভাবে আরো সুস্পষ্ট হবে। এজন্য নমুনা স্বরুপ আমরা ইমাম মুরতাজা যাবীদী রহ. কৃত

عقود الجواهر المنيفة فى ادلة مذهب الإمام أبى حنيفة مما وافق فيه الأئمة الستة أو أحدهم . গ্রন্থটি দেখতে পারি। এ গ্রন্থে আবু হানীফা রহ.এর বর্ণিত যে সকল হাদীসে কুতুবে সিত্তাহ্ এর যে সকল রাবী তাঁর মুতাবআত (তথা তাঁর অনুরূপ বর্ণনা) করেছেন সে সব হাদীসই কেবল উল্লেখ করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে বিষয়টি যাচাই করার নাম হলো ‘শাহাদাতে আমালিয়্যাহ’ বা বাস্তবিক ও প্রায়গিক স্বাক্ষ্য।
উদাহরণত ইমাম আবু হানীফা রহ.বর্ণিত হাদীসসমূহকে যদি আমরা কুতুবে সিত্তাহ্, মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, আব্দুর রাজ্জাক প্রভৃতি কিতাবের সাথে মিলায় তাহলে দেখতে পাব যে, কোথাও হাদীসটি আবু হানীফা রহ. যেরূপ শব্দে বর্ণনা করেছেন হুবহু তেমন রয়েছে। আবার কোথাও রয়েছে কাছাকাছি শব্দে।

চার.
ইমামে আযম রহ. এর রচনাবলীতে সত্তর হাজারের অধিক হাদীস
মুহাম্মাদ ইবনে সামাআ বলেন-
ان الامام ذكر فى تصانيفه نيفا وسبعين الف حديث وانتخب الاثار من أربعين ألف حديث .
‘ইমাম আবু হানীফা রহ. তাঁর রচনাবলীতে (তথা যে সকল মাসআলা মাসায়েলকে তিনি তাঁর শাগরেদবৃন্দকে ইমলা করিয়েছেন) সত্তর হাজারের অধিক হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে ‘কিতাবুল আছার’ নির্বাচিত করে সংকলন করেছেন’। (মোল্লা আলী কারী রহ.(১০১৪ হি.) সংকলিত ‘মানাকিবুল ইমামিল আ‘যম’ এ (পৃ. ৪৭৪)। এটি আল জাওয়াহিরুল মুযীআর (মীর মুহাম্মাদ কুতুবখানা, আরামবাগ করাচী ১৩৩২ হি.) পরিশিষ্টে মুদ্রিত হয়েছে।)
* মুহাম্মাদ ইবনে সামাআর বক্তব্যের যথার্থতা এবং ইমাম আ‘যমের হাদীস বর্ণনার পদ্ধতি
যফর আহমদ উসমানী রহ. মুহাম্মাদ ইবনে সামাআর উক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যায় বলেন –

ويدل على صحة هذا القول ما روى عنه أصحابه كمحمد بن الحسن فى كتبه الستة المعروفة ب”ظاهر الرواية ” وغيرها المعروفة ب “النوادر” وكأبى يوسف فى ” أماليه” و”كتاب الخراج ” له ،وكعبد الله بن المبارك فى كتبه ، ووكيع وغيرهم من أصحابه مسائل كثيرة لا يحصى عددها ولا يستقصى أمدها ، فإذا لخصت منها ما يوافق الأحاديث المرفوعة والآثار الموقوفة صراحة ودلالة ، سوى ما استنبطه باجتهاده لتجدنها نحو ذلك إن شاء الله تعالى.
فهذه المسائل كلها أحاديث ، رواها الإمام بطريق الإفتاء دون التحديث ،فإن موافقة اجتهاده لهذا القدر العظيم من الأحاديث والأثار من دون اطلاعه عليها : بعيد جدا.

ইমাম আবু হানীফা রহ.থেকে তাঁর শাগরেদ বৃন্দের বর্ণিত অসংখ্য অগণিত মাসআলা মাসায়েল-ই মুহাম্মাদ ইবনে সামাআর এ বক্তব্যের বিশুদ্ধতার প্রমাণ বহন করে। যেমন ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান তাঁর ছয় কিতাব যা, ‘জাহিরুর রেওয়ায়াহ্’নামে প্রসিদ্ধ এবং অন্যান্য কিতাব যা ‘আন-নাওয়াদির’ নামে প্রসিদ্ধ। এবং ইমাম আবু ইউসুফ তাঁর ‘আমালী’ এর মধ্যে এবং তাঁর ‘কিতাবুল খারাজে’ এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে মুবারক তাঁর গ্রন্থসমূহে এবং ওয়াকী ও অন্যান্য শাগরেদবৃন্দ আবু হানীফা রহ. থেকে অসংখ্য ও অগণিত মাসআলা-মাসায়েল বর্ণনা করেছেন। এসকল মাসআলা-মাসায়েলের মধ্য থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মারফু ও মাওকুফ হাদীসের সাথে মিল ও সামঞ্জস্য রয়েছে। এমন মাসআলা-মাসায়েলের সংক্ষিপ্ত সার জমা করলে-তাঁর ইস্তেম্বাতকৃত মাসআলা-মাসায়েল বাদে -অবশ্যই এমনটি পাবে ইনশাআল্লাহ্। মাসায়েলের এ বিশাল ভান্ডার সবই হাদীস, যা আবু হানীফা রহ. ফতওয়া প্রদান পদ্ধতিতে বর্ণনা করেছেন। হাদীস বর্ণনার পদ্ধতিতে বর্ণনা করেন নি। কেননা তাঁর ইজতিহাদ এত বিপুল সংখ্যক হাদীস ও আছারের সাথে এসব হাদীস ও আছার জানাশোনা ছাড়াই কাকতলীয়ভাবে মিলে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার ।
তিনি আরো বলেন-

ومع ذلك فما يوجد من أحاديث أبى حنيفة التى رواها بطريق الإسناد كثير أيضا : منها ما قد جمعه الحفاظ فى مسانيده، ومنها ما ذكره أصحابه : محمد بن الحسن فى “الآثار” و”الموطأ” و”الحجج” له وغيرها من كتبه، وأبو يوسف وابن المبارك والحسن بن زياد وغيرهم فى كتبهم ، ووكيع بن الجراح فى “مسنده” ، وابن أبى شيبة وعبد الرزاق فى “مصنفيهما” والحاكم فى “المستدرك” وغيره ، وابن حبان فى “صحيحه” وفى “الثقات” له وغيرهما، والبيهقى فى “سننه” وكتبه، والطبرانى فى “معاجمه الثلاثة”، والدارقطنى فى كتبه، وغيرهم فى غيرها، لو جمعنا تلك الأحاديث كلها فى مجلد واحد لكان كتابا ضخما.

এতদসত্বেও আবু হানীফার যে সকল হাদীস পাওয়া যায়। যা তিনি হাদীস বর্ণনার পদ্ধতিতে সনদসহ বর্ণনা করেছেন তাও সংখ্যায় অনেক। তন্মধ্যে কিছু হাদীস রয়েছে এমন যে সকল হাদীস হুফফাজে হাদীসগণ মুসনাদে আবু হানীফাতে সংকলন করেছেন। তন্মধ্যে কিছু হাদীস রয়েছে যা তাঁর শাগরেদবৃন্দ তথা মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান ‘কিতাবুল আছারে’, মুয়াত্তায় এবং ‘কিতাবুল হুজ্জাহ্ আলা আহলিল মাদীনাহ্’ সহ তাঁর আরো অন্যান্য গ্রন্থে, (যেমন মাবসুত,যিয়াদাত,জামে সগীর ও জামে কাবীর ইত্যাদি) এবং আবু ইউসুফ, ইবনুল মোবারক, হাসান ইবনে যিয়াদ, ও অন্যান্যরা তাঁদের গ্রন্থে, ওয়াকী ইবনুল জারারাহ্ তাঁর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে, আবদুর রাজ্জাক তাঁর ‘আল মুসান্নাফ’- এ উল্লেখ করেছেন। এবং ইবনে আবী শায়বা ও তাঁর ‘মুসান্নাফে’, হাকেম তাঁর ‘মুস্তাদরাকে’, ও মুস্তাদরাক ছাড়া অন্যান্য গ্রন্থে, ইবনে হিব্বান তাঁর ‘সহীহ্ ইবনে হিব্বানে’ ‘কিতাবুস সিকাতে’ ও এ গ্রন্থদ্বয় ছাড়া অন্যান্য গ্রন্থে, বায়হাকী তাঁর ‘সুনানে বায়হাকীতে’ ও অন্যান্য গ্রন্থে, তবরানী তাঁর তিন মু‘জামে (অর্থাৎ মু‘জামে কাবীর, মু‘জামে সগীর ও মু‘জামে আওসাত)। দারাকুতনী তাঁর গ্রন্থ সমূহে এবং অন্যান্য ইমামগণ তাঁদের বিভিন্ন গ্রন্থে ইমাম আবু হানীফার সূত্রে বর্ণিত হাদীস উল্লেখ করেছেন। যদি ইমাম আবু হানীফা থেকে বর্ণিত এসকল হাদীসকে আমরা একটি খন্ডে গ্রন্থিত করি তবে তা একটি বিশাল বড় ভলিয়াম হবে। (কাওয়ায়েদ ফি উলুমিন হাদীস, ৩১৬, ৩১৭।)
আল্লামা যাহেদ আল কাওসারী রহ. বলেন-

وأما كثرة حديثه فتظهر من حججه المسرودة فى أبواب الفقه ، والمدونة تلك المسانيد السبعة عشر،لكبار الأئمة من أصحابه ، وسائر الحفاظ.

অর্থাৎ ইমাম আবু হানীফার হাদীসের আধিক্যের বিষয়টি ফিকহী বিষয়ে তাঁর উপস্থাপিত ও উদ্ধৃত দলীল সমূহ থেকে এবং তাঁর শীর্ষ পর্যায়ের ইমাম শাগরেদবৃন্দ এবং অন্যান্য হাফিজুল হাদীসদের সংকলিত সতেরটি মুসনাদ গ্রন্থ থেকে সুস্পষ্ট হয়। (ফিকহু আহলিল ইরাক ওয়া হাদীসুহুম এর ‘তরীকাতু আবী হানীফা ফিত তাফকীহ’ শিরোনামের আলোচনার পরিশেষের দিকে দ্র.।)
সুতরাং আবু হানীফা রাহ. ফিকহে ইসলামীর ইমাম হওয়া যেমন মুতাওয়াতির তেমনি ইমাম হওয়ার যেসব অনিবার্য গুণ ও বৈশিষ্ট্য সেগুলো তাঁর মধ্যে বিদ্যমান থাকাও মুতাওয়াতির। যার অনিবার্য দাবি হল, তিনি শুধু যাবিত ও মুতকিন রাবীই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন হাদীস ও সুন্নাহর ইমাম, যাঁরা সাধারণ জরহ-তাদীলের ঊর্ধ্বে হয়ে থাকেন, তাঁরা বরং অন্যদের জরহ-তাদীল করেন।

ইমাম মালেক রহ. কর্তৃক সংকলিত হাদীসের ভা-ার হলো মুয়াত্তা মালিক। এই কিতাবে ৮২২টি মারফু এবং ২৪৪টি মুরসাল হাদীস রয়েছে। ইমাম ইয়াহইয়া আল কাত্তান রহ. তাঁর ব্যাপারে বলেন- كان إماما في الحديث. অর্থাৎ তিনি হাদীস শাস্ত্রের ইমাম ছিলেন। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ.ও তাঁর ব্যাপারে বলেছেন- هو إمام في الحديث، وفي الفقه.

(সিয়ারু আলামিন নুবালা ইমাম মালেক রহ.এর তরজামা)
ইমাম শাফেয়ী রহ.
ইমাম শাফেয়ী রহ. নিজেই নিজের ব্যাপারে বলেছেন-
حفظت ” الموطأ ” قبل أن أحتلم.
অর্থাৎ আমি বালেগ হওয়ার আগেই মুয়াত্তা হিফজ করেছি।
তাঁর ব্যাপারে ইমাম আবু দাউদ সিজিসতানী রহ. বলেন-
ما أعلم للشافعي حديثا خطأ.

অর্থাৎ ইমাম শাফেয়ী কোন হাদীসে ভুল করেছেন বলে জানি না।
এ মন্তব্য উল্লেখ করে ইমাম যাহাবী রহ. বলেন-
قلت: هذا من أدل شئ على أنه ثقة حجة حافظ.
(সিয়ারু আলামিন নুবালা ইমাম শাফেয়ী রহ. এর তরজামা)
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ.
জগতের মানিত চার ইমামের একজন। ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম এবং ইমাম আবু দাউদ সকলেই তাঁর ছাত্র। এক লাখের মতো হাদীস তাঁর মুখস্থ ছিল। হাদীসশাস্ত্রে তাঁর সংকলিত মুসনাদ অনন্য আকরগ্রন্থ হিসাবে সর্বজন বিদিত। সাত লাখ হাদীস থেকে বাছাই করে এই সংকলন সম্পাদনা করেছেন তিনি।
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. নিজেও ছিলেন উচ্চ মরতবার মুজতাহিদ। এবার তাঁর নিজের মুখেই আমরা শুনি মুজতাহিদ হওয়ার জন্য কী পরিমাণ হাদীস জানা থাকা দরকার।
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ .কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, একজন মুজতাহিদের জন্য এক লক্ষ হাদীসের জ্ঞান থাকলে কি যথেষ্ট হবে? তিনি উত্তর দিলেন ‘না’ । প্রশ্নকারী ২লাখ, ৩ লাখ , ৪ লাখ পর্যন্ত প্রশ্ন করলেও তিনি একই জবাব দিলেন। প্রশ্নকারী বলল, ৫ লাখ হাদীসের জ্ঞান থাকলে হবে? তখন তিনি বললেন,এই পরিমাণ হলে আশা করি কাজ চলবে। (আল ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ ২/ ১৬৩)
মোটকথা প্রিয় নবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ হতে তাবলীগে দ্বীনের দুটি প্রকার বর্ণিত আছে । ১.নবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র মুখনি:সৃত বাণী, কর্ম ও সমর্থিত বিষয় তথা হাদীস এর তাবলীগ। ২.ঐ হাদীসের মর্মার্থ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের তাবলীগ। এর মধ্যে প্রথম দায়িত্ব পালনকারীদেরকে মুহাদ্দিসীন, আর দ্বিতীয় দায়িত্ব সম্পন্নকারীদেরকে বলা হয় ফুকাহা। অন্যভাবে বললে প্রথম দলকে أصحاب رواية আর দ্বিতীয় দলকে أصحاب دراية বলে। চারো ইমাম এই উভয় দ্বায়িত্বই অত্যন্ত সুচারুরূপে পালন করেছেন।
উপরের আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্ট হলো যে, প্রশ্নে উল্লেখিত বিবরণ অনুযায়ী যারা এ জাতীয় মন্তব্য করে থাকেন তারা চিন্তাগত ও মৌলিক কিছু ভুলের শিকার। তন্মধ্যে একটি মৌলিক চিন্তাগত ভুল হলো পরবর্তীতে সংকলিত হাদীস গ্রন্থকে হাদীস জানা না জানার মানদ- স্থির করা। তাই এ সম্পর্কে কিছু কথা আরজ করা হলো-
ক.বিখ্যাত ছয় কিতাবের পূর্বেও গ্রন্থাকারে হাদীস সংরক্ষিত পঠিত ও পরিচিত ছিল। সেকালের হাদীসের ইমামগনের পাঠদানের ফলে মক্কা- মদীনা থেকে শুরু করে সুদূর মিশর পর্যন্ত হাদীসের চর্চা প্রাতাষ্ঠানিকতায় পৌঁছে গিয়েছিল। পরবর্তী কালের ইমাম ও মুহাদ্দিসগণ সেই আলোকেই নিজেদেরকে আলোকিত করার প্রয়াস পেয়েছেন।
খ. চার মাযহাবের প্রধান দুই ইমামের মৃত্যুর সময় ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের জন্ম হয় নি! সুতরাং তাঁদের কাল ও রচনা দিয়ে অন্তত ইমাম আবু হানীফা রহ. ও ইমাম মালেককে বিচার করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। বরং দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হলো- তাঁদের অবিরাম সাধনা যদি হাদীস ও ফিকাহকে প্রতিষ্ঠিত প্রাতিষ্ঠানিকতায় পৌঁছে না দিত তাহলে বুখারা নিশাপুরে জ্বলত না হাদীসের প্রদীপ!। উদাহরণত ইমাম মুহাম্মাদ রহ.এর শীর্ষ পর্যায়ের শিষ্য হলেন ইমাম আবু হাফস কাবীর হানাফী রহ.। জামে‘ সুফিয়ান সাওরীর মাধ্যমে যার কাছে ইমাম বুখারীর সর্বপ্রথম হাদীস শিক্ষার বিসমিল্লাহ হয় ।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বক্তব্য:
যারা মনে করেন প্রসিদ্ধ ছয় হাদীস গ্রন্থের আগের ইমামগণ হাদীস কম জানতের তাদের সম্পর্কে শুধু ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বক্তব্য উদ্ধৃতি করেই এ প্রসঙ্গের ইতি টানছি। তিনি বলেন-

بل الذين كانوا قبل جمع هذه الدواوين كانوا أعلم بالسنة من المتأخرين بكثير … فكانت دواوينهم صدورهم التي تحوي أضعاف ما في الدواوين, وهذا أمر لا يشك فيه من علم القضية.

(হাদীস ও সুন্নাহর) এই সব গ্রন্থ সংকলনের পূর্ববর্তী (ইমাম)গণ পরবর্তীদের তুলনায় হাদীস ও সুন্নাহ অনেক বেশি জানতেন…। তাদের গ্রন্থ তো ছিল তাদের সীনা, যাতে এইসব গ্রন্থের তুলনায় হাদীস ও সুন্নাহ অনেক অনেক গুণ বেশি পরিমাণে সংরক্ষিত ছিল। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অবগত কোনো ব্যক্তিই সন্দেহ পোষাণ করতে পারে না। (মাজম্উূল ফাতাওয়া ২০/২৩৯)
এ সন্দেহের গোড়া কর্তনে আসহাবুত তারজীহদের ভ’মিকা
ইমামদের কাছে অনেক হাদীস পৌঁছে নি বা তারা হাদীস কম জানতেন -আজকে যাদের মাথায় এ জাতীয় সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছে বহু পূর্বেই মনীষীগণ তাদের সে সন্দেহের গোড়া কেটে দিয়েছেন। হানাফী বড় বড় মুহাদ্দিস ও ফকীহ- যাদেরকে আসহাবুত তারজীহ (অগ্রগণ্য আখ্যা দেওয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ) বলা হয়-কোথাও কোথাও তাঁরা ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের মতকে- যা সহীহ হাদীস অনুসারে হওয়া প্রমাণিত- অগ্রগণ্য আখ্যা দিয়েছেন। কোথাও তাঁদের দুজনের কোন একজনের মতকে, কোথাও আবার ইমাম যুফার বা হাসান ইবনে যিয়াদের মতকে অগ্রগণ্য আখ্যা দিয়েছেন। অতএব ইমাম আবু হানীফার কাছে হাদীস পৌঁছে নি মর্মে হানাফী মাযহাবের প্রতি অনস্থা সৃষ্টির আর কোন সুযোগ তাঁরা বাকী রেখে যান নি।
ইমাম আবু হানীফার বিষয়টি আলোচনার আগে কিছু প্রসঙ্গিক আলোচনা করে নিই । তাহলে বিষয়টি বুঝতে আমাদের জন্য সোজা হবে।
সাহাবীদের ক্ষেত্রেও কখনো এমন ঘটেছে যে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের হাদীস তাঁদের কারো কারো পৌঁছেনি। নমুনা স্বরূপ নিম্নে একটি মাত্র ঘটনা উল্লেখ করা হলো।
ঘটনাটি জালুলা যুদ্ধের। আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. সা’দ বিন আবু ওয়াক্কাস রা.কে চামড়ার মোজার উপর মাসেহ করতে দেখে আশ্চার্যান্বিত হয়েছিলেন এবং আপত্তি করেছিলেন। (দেখুন কিতাবুল আছার হাদীস নং ৮) আব্দুল্লাহ্ বিন উমর রা. সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রা. এর মোজা মাসেহের ব্যাপারে আপত্তি করার কারণ হলো, তিনি অনেক আগে ইসলাম গ্রহণ করা সত্বেও এবং অনেক হাদীস বর্ণনা করা সত্বেও তাঁর কাছে মোজা মাসেহ্ সংক্রান্ত হাদীস পৌঁছে নি। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, এ হাদীসের মধ্যে এ শিক্ষা রয়েছে যে, প্রবীণ সাহাবীর কাছে শরীয়াতের সুষ্পষ্ট বিষয় কখনো কখনো জানা নাও থাকতে পারে। যে বিষয় অন্যের জানা রয়েছে। (দেখুন ফতহুল বারী -বাবুল মাসহি আলাল খুফফাইন )।
সালফে সালেহীনদের থেকে এরূপ কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা রয়েছে যে, কিছু কিছু বিষয়ের হাদীস তাঁদের কারো কারো কাছে পৌছে নি। তো এরূপ বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা দিয়ে ব্যক্তিকে মাপা যায় না। ব্যক্তিকে মাপতে হয় সামগ্রিক বিচারে।
ইমাম আবু হানীফার ক্ষেত্রেও বিষয়টি এভাবেই চিন্তা করতে হবে।
সামগ্রিক বিচারে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হানাফী বড় বড় মুহাদ্দিস ও ফকীহ্ – যাদেরকে আসহাবুত তারজীহ (অগ্রগণ্য আখ্যা দেওয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ) বলা হয়- চিহিৃত করেছেন যে, সেসব ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার নিকট সহীহ হাদীস পৌঁছেনি। এগুলো স্বল্প পরিসরের কিছু বিচ্ছিন্ন ও ব্যতক্রমী ঘটনা।
তবে এখানে আরেকটি বিষয়ও মনে রাখতে হবে। ইমাম ইবনে তায়মিয়া রহ.এর ভাষায়-

ولا يقولن قائل من لم يعرف الأحاديث كلها لم يكن مجتهدا لأنه ان اشترط فى المجتهد علمه بجميع ما قاله النبى وفعله فيما يتعلق بالأحكام فليس في الأمة مجتهد وانما غاية العالم أن يعلم جمهور ذلك ومعظمه بحيث لا يخفى عليه إلا القليل من التفصيل ثم انه قد يخالف ذلك القليل من التفصيل الذى يبلغه

(মাজম্উূল ফাতাওয়া ২০/২৩৯) যার মর্মানুবাদ হলো- মুজতাহিদের ক্ষেত্রে যদি এরূপ শর্তারোপ করা হয় যে, নবীজীর সব ইরশাদ এবং আহকামের সাথে সংশ্লিষ্ট সব আমলই মুজতাহিদের জানা থাকতে হবে, তাহলে এই উম্মতের মধ্যে এমন মুজতাহিদ পাওয়া যাবে না।… তবে এক্কা দুক্কা বাদে সিংহভাগ হাদীসই তাঁর জানা থাকতে হবে।

হাদীস সহীহ হলেই তা আমার মাযহাব-
এবার আলোচনা করা যাক আপনার প্রশ্নের শেষ অংশ নিয়ে। হাদীস সহীহ হলেই তা আমার মাযহাব- কথাটি প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় না যেয়ে সংক্ষিপ্ত কিছু কথা আরজ করছি-
এক শ্রেণীর লোক মানুষকে মাযহাব ছেড়ে হাদীসের উপর আমলের (তাদের ধারনায়) দাওয়াত দেওয়ার সময় এই বাক্যটি করে থাকেন। তারা বলেন, তোমাদের ইমামও বলেছেন, যখন হাদীস সহীহ প্রমাণিত হয় তো সেটিই আমার মাযহাব। সুতরাং তোমরা যদি তোমাদের মাযহাবের কিতাবে লিখিত মাসআলা ত্যাগ করে এই হাদীসের উপর আমল কর তাহলে হাদীসের উপরও আমল হবে। অন্যথায় না হাদীসের উপর আমল হবে, না মাযহাবের উপর।
তাদের এহেন বক্তব্য খুবই আশ্চর্যজনক! তাঁদের এ বক্তব্য নিয়ে আপনি নিজেও যদি চিন্তা করেন তাহলে বুঝতে পারবেন যে তা কত অন্তসারশ্যূ। তবুও কিছু কথা আরজ করছি।

১.
আমাদের মতো মুকাল্লিদদের যদি অনুমতি দেওয়া হয় যে, স্বীয় ইমামের মতের পরিপন্থী কোন হাদীস পেলে ইমামের পথ ও মাসলাক ছেড়ে দিয়ে হাদীসকে গ্রহণ করবে তাহলে সে ভয়ংকার গোমরাহীর শিকার হবে। কারণ, কুরআন- হাদীস গবেষণা, তার আলোকে মাসাইল আহরণ ও নির্ণয় এক সুবিস্তীর্ণ গভীর ও ব্যাপক বিষয়। পূর্ণ জীবন ও সাধনা বিলিয়ে দিয়েও মানুষ তার তীর স্পর্শ করতে পারে না। অনেক সময় একটি হাদীসের শব্দাবলী ও তার আভিধানিক অর্থের দিকে তাকালে তার একটা মর্ম দাঁড়ায়, আবার এ সম্পর্কিত অন্যান্য আয়াত ও হাদীসসমূহকে একত্রিত করে সামগ্রিক দৃষ্টিতে বিচার করলে ওই একই হাদীসের ভিন্ন মর্ম দাঁড়ায়- যা পূর্বেও মর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত। এতএব, যদি একজন সাধারণ মানুষ একটি হাদীসের বাহ্যিক মর্মের অনুসরণ করতে থাকে তাহলে সে নির্ঘাত বিভ্রান্ত হবে, গোমরাহীর কঠিন স্রোতে নিপতিত হবে।

২.
যারা হাদীস সহীহ হলেই তা আমার মাযহাব একথাটি অপপ্রয়োগ করেন তাদেরকে দেখা যায় যে তারা প্রসিদ্ধ মতভেদপূর্ণ মাসায়েলের ক্ষেত্রেই এথাটি ব্যবহার করেন। অথচ এসব ক্ষেত্রে সহীহ হাদীসগুলো ইমামদের নিকট পৌঁছেছে।

৩.
কোন কিছুর শুদ্ধাশিুদ্ধির জন্য যারা অনেক সময় ইলমুল ইসনাদের অপপ্রয়োগ করে থাকেন এবং এবং এ বিষয়ে সরগরম থাকেন এখানে তারা এখানে সনদের বিষয়ে নীরব কেন ? ইমাম আবু হানীফা রহ.এ কথা বলেছেন এর কোন অবিচ্ছিন্ন সহীহ সনদ তারা দেখাতে পারবেন কী ? এই কথা দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা যায় কিংবা তাদের মতলব চারতার্থ হয় বলেই কি সনদের প্রয়োজন নেই? তবে এ কথাটি ইমাম শাফেয়ী বলেছেন বলে প্রমাণিত আছে। কথা যার থেকেই প্রমাণিত থাকুক, কথাটি সত্য। এটাই ইমামগণের মনের কথা ও প্রতিষ্ঠিত নীতি। কিন্তু যারা এ কথাটি ব্যাবহার করছেন তাদের মতলব খারাপ। এজন্য কথাটির সঠিক অর্থ নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

4
সহীহ এ শব্দটি একটি পারিভাষিক শব্দ। যে পরিভাষা আল্লাহ বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্ধারিত পরিভাষা নয়। বরং অভিজ্ঞ মুহাদ্দিসদের নির্ধারণ করা পরিভাষা।
যা মুতাকাদ্দিমীনদের পরিভাষায় এক অর্থ ছিল। আর মুতাআখখিরীনদের পরিভাষায় ভিন্ন। অর্থাৎ বর্তমানে সহীহ বলা হয়, যা সাধারণতঃ সনদের সূত্রের রাবীগণ শক্তিশালী সেটি সহীহ।
আর মুতাকাদ্দিমীনদের পরিভাষায় সহীহ বলা হতো, যে বিষয়টির আমল উম্মত গ্রহণ করে নিয়েছে তথা যে বিষয়ের উপর উম্মতের উলামা ফুক্বাহাগণ আমল শুরু করে দিয়েছেন তা’ই সহীহ।
যেহেতু ইমাম আবু হানীফা রহঃ মুতাকাদ্দিমীন তথা পূর্ববর্তীদের অন্তর্ভুক্ত, তাই তার “সহীহ” বলার দ্বারা উদ্দেশ্য হল, যা উপর আমল উম্মতের মুহাদ্দিস, উলামাগণ জারি রেখেছেন তা সহীহ। অর্থাৎ যে হাদীসের উপর আমল জারি হয়ে সহীহ বলে স্বীকৃতি পেল, সেটিই তার মাযহাব। কিন্তু বর্তমানে যারা সনদের সূত্রে সহীহ দেখিয়ে উম্মতের জারিকৃত আমলের বিপরীত তা পেশ করেন। সেই সাথে ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর উক্তিটি পেশ করেন, তা পরিস্কার ধোঁকাবাজী ও প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিস্কার হবে। যেমন আমরা সাধারণত ডাইল বলে মুশুরী ডাল ইত্যাদি ডাল বুঝে থাকি।
কিন্তু নেশাখোররা ডাইল বলে ফেন্সিডিল বুঝে।
এখন একজন মুফতী সাহেব বললেন, ডাইল খাওয়া জায়েজ।
একথার উপর ভিত্তি করে নেশাখোররা বলতে শুরু করে দিল, মুফতী সাহেব ফাতওয়া দিয়েছেন যে, ফেন্সিডিল খাওয়া জায়েজ।
এমন কথা বলা যেমন তথ্য বিকৃতি এবং জালিয়াতি। তেমনি ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর বলা “সহীহ” শব্দকে সনদের বিচারে সহীহের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে তা ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর বক্তব্য বলাও চরম পর্যায়ের ধোঁকাবাজী ও প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।

কথাটির সঠিক অর্থ:
রেওয়ায়েত ও হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা রহ.তাঁর স্বীয় কর্মপদ্ধতি এভাবে উল্লেখ করেছেন-

انى أخذ بكتاب الله اذا وجدته ومالم أجده فيه أخذت بسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم و الأثار الصحاح عنه التى فشت فى أيدى الثقات .

অর্থ : আমি কিতাবুল্লায় বিধান পেলে তা সিদ্ধান্ত হিসাবে গ্রহণ করি। তাতে না পেলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ এবং তাঁর ঐ সকল সহীহ হাদীস থেকে যা নির্ভরযোগ্য রাবীদের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। (ছয়মারী, আখবারু আবী হানীফা ওয়া মানাকিবুহু)
অতএব এ হিসাবে ইমাম আবু হানীফা রহ. যত মাসআলার সমাধান দিয়েছেন, সহীহ হাদীস অনুসারেই দিয়েছেন। ‘হাদীস সহীহ হলেই তা আমার মাযহাব’ বাক্যটির এ মর্ম গ্রহণ করলে মতলববাজদের মতলব পূরণ হয় না।
বক্তব্যটির সম্বোধিত ব্যক্তি কারা?
এ বক্তব্যের সম্বোধিত ব্যক্তিগণ হলেন মুজতাহিদ পর্যায়ের আলেমগণ। অতএব যে ব্যক্তি মুজতাহিদ ইমামগণের মত ছেড়ে ঐ সহীহ হাদীস অনুসারে আমল করবেন তাকে অবশ্যই মুজতাহিদ পর্যায়ের আলেম হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে আরো অনেক কথা রয়েছে। আলোচনার দীর্ঘ সূত্রিতার আশংকায় আর সেদিকে গেলাম না।

আপনি প্রশ্নের শেষাংশে থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, মাযহাবের বিষয়টি আপনার কাছে পরিস্কার নয়। মাযহাবের বিষয়টি ভালভাবে বুঝার জন্য কোন বিজ্ঞ আলিমের শরাণাপন্ন হোন আর আপাতত পক্ষে ১.আল্লামা তাকী উসমানী বিরচিত ‘তাকলীদ কি শরঈ হায়ছিয়্যাত’ গ্রন্থের বাংলা তরজামা ‘তাকলী কি ও কেন ? ২. মালিবাগ জামিয়া থেকে প্রকাশিত ‘মাযহাব বুঝার সরল পথ’ গ্রন্থ দুটি অধ্যয়ন করতে থাকুন। ইনশাআল্লা বহুত ফায়দাজনক হবে।

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে
মাওলানা মুহসিনুদ্দীন খান
গবেষক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

নীরিক্ষক

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইমেইল- [email protected]

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …