প্রশ্ন
আসসালামু আলাইকুম
বিভিন্ন ধরনের জিজ্ঞাসার সন্তোষজনক জবাব প্রদান করে ইতিমধ্যেই আপনারা নিজেদের আলাদা উচ্চতায় দাখিল করিয়াছেন। আল্লাহ পাক আপনাদের আরও দীর্ঘ সময় দ্বীনের খেদমত করার তওফিক দান করুন। আমীন।
আমার নিম্নলিখিত জিজ্ঞাসার সঠিক জবাব প্রদান করলে বাধীত হইবো:
তাবলীগ জামাত সম্পর্কে কোন কোন আলেমের নাক সিটকানি ভাব দেখলে মনে হয় এটা একটা অন্যায় কাজ। অথচ অনেক বুজুর্গানে দ্বীনই এটার সাথে সংযুক্ত আছেন। তাবলীগ জামাতের বৈধতা সম্পর্কে কোরআন-হাদীসের আলোকে জানতে চাই।
ধন্যবাদান্তে
শামীম আহমেদ
জবাব
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
কুরআন হাদীসের দৃষ্টিতে তাবলীগ
তাবলীগ মুসলিম মিল্লাতের অতি পরিচিত একটি শব্দ। যার অর্থ প্রচার ও প্রসার। কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল বিশ্ব মানবের নিকট দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছাবার যে গুরু দায়িত্ব মুহাম্মদ সাঃ কর্তৃক সকল উম্মতে মুহাম্মদীর উপর অর্পিত হয়েছে, পরিভাষায় সেটাকেই তাবলীগ বলে।
মূলত রাসূল সাঃ বিশ্ব মানুষের কাছে দ্বীনের এ দাওয়াত পৌঁছাবার ও প্রচার-প্রসারের মহান দায়িত্ব নিয়েই পৃথিবীতে আগমণ করেছিলেন। যেমন আগমণ করেছিলেন রাসূল সাঃ এর পূর্বে ১ লক্ষ ২৪ হাজার নবী ও রাসূল। রাসূল সাঃ কে তাবলীগ করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-
{ يَاأَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ [المائدة:67]
হে রাসূল! আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা আপনি প্রচার করুন। যদি আপনি তা না করেন তাহলে আপনি আল্লাহর বার্তা প্রচার করলেন না। (সূরা মায়েদা : ৬৭)
রাসূল সাঃ হলেন সর্বশেষ নবী। তার পর পৃথিবীতে আর কোন নবী আসবে না। তাই বিদায় হজ্বের সময় রাসূল সাঃ বজ্র কণ্ঠের ঘোষণা فليبلغ الشاهد الغائب তথা “পস্থিত লোকেরা যেন দ্বীনের এ দাওয়াত অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌছে দেয়” এর মাধ্যমে সমস্ত উম্মতে মুহাম্মদীই তাবলীগ তথা দ্বীন প্রচারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল হয়ে যায়। যে ব্যক্তি দ্বীন সম্পর্কে যা জানে তা’ই অন্যের কাছে পৌছে দেয়ার দায়িত্বশীল করে রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন-আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও [মানুষের কাছে] পৌঁছে দাও। {তাহাবী শরীফ, হাদীস নং-৫৫৭০, সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩২৭৪, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৬২৫৬, সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-২৬৬৯}
সাহাবায়ে কিরাম রাসূল সাঃ এর উক্ত নির্দেশের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন যথাযথভাবে। পরবর্তীতে সর্বযুগেই উলামায়ে উম্মত “ওলামায়ে কিরামই হলেন নবীদের ওয়ারিস” হাদীসের সফল বাস্তবায়নের জন্য জীবন বাজী রেখে সংগ্রাম করেছেন।
উল্লেখিত আয়াত ও হাদীস ছাড়াও অসংখ্য আয়াত ও হাদীসে তাবলীগ তথা দ্বীন প্রচার ও প্রসারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:
ادْعُ إِلِى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ (النحل: ١٢٥(
আপনি আপনার প্রতিপালকের দিকে আহবান করুন হিকমত বা প্রজ্ঞা দ্বারা এবং সুন্দর ওয়াজ-উপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে উৎকৃষ্টতর পদ্ধতিতে আলোচনা-বিতর্ক করুন। (সূরা নাহল: ১২৫)
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন
وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (آل عمران: ١٠٤(
আর যেন তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহবান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম। (সূরা আলে ইমরান: ১০৪)
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَوْ آمَنَ أَهْلُ الْكِتَابِ لَكَانَ خَيْرًا لَّهُم مِّنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ وَأَكْثَرُهُمُ الْفَاسِقُونَ )آل عمران: ١١٠(
তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির (কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা ন্যায়কার্যে আদেশ এবং অন্যায় কার্যে নিষেধ কর এবং আল্লাহতে বিশ্বাস কর। (সূরা আলে ইমরান: ১১০)
আল্লাহ তাবারকা ওয়া তাআলা আরও বলেন:
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاء بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاَةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُوْلَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ (التوبة: ٧١ (
আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু, তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, আর তারা সালাত কায়েম করে, জাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এদেরকে আল্লাহ শীঘ্রই দয়া করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ পরক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সূরা তাওবা: ৭১)
সূরা তাওবার ১১২ আয়াতে, সূরা হজ্জের ৪১ আয়াতে, সূরা লুকমানের ১৭ আয়াতে ও অন্যান্য স্থানেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহর প্রকৃত মুমিন বান্দাদের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ।
এ দায়িত্বপালনকারী মুমিনকেই সর্বোত্তম বলে ঘোষণা করা হয়েছে পবিত্র কোরআনে।
মহান আল্লাহ বলেন:
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلاً مِّمَّن دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ )فصلت: ٣٣(
ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা কথায় কে উত্তম যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি তো মুসলিমদের একজন। ( সূরা ফুসসিলাত: ৩৩)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
الدِّيْنُ النَّصِيْحَةُ، قُلْنَا لِمَنْ قَالَ للهِ وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُولِهِ وَلِأئمَّةِ الْمُسْلِمِينَ وَعَامَّتهِمْ. (رواه مسلم)
দীন হলো নসিহত। সাহাবিগণ বললেন, কার জন্য ? বললেন, আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য, মুসলিমগণের নেতৃবর্গের জন্য এবং সাধারণ মুসলিমদের জন্য। (মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নসিহতের জন্য সাহাবিগণের বাইআত তথা প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতেন। বিভিন্ন হাদিসে জারির ইবনু আব্দুল্লাহ রা. মুগিরা ইবনু শুবা রা. প্রমুখ সাহাবি বলেন:
بَايَعْتُ رَسُوْل اللهِ صلى الله عليه وسلَّمَ عَلى إقَامَةِ الصَّلاةِ وَإيْتَاءِ الزَّكَاةِ وَالنُّصْحِ لِكُلِّ مسْلِمٍ (رواه البخاري)
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বাইয়াত বা প্রতিজ্ঞা করেছি, সালাত কায়েম, জাকাত প্রদান ও প্রত্যেক মুসলিমের নসিহত (কল্যাণ কামনা) করার উপর। (বোখারি)।
এ অর্থে তিনি সৎকার্যে আদেশ ও অসৎকার্যে নিষেধের বাইয়াত গ্রহণ করতেন। উবাদাহ ইবনু সামিত ও অন্যান্য সাহাবি রা. বলেন:
إنَّا بَايَعْنَاهُ عَلى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ ..وَعَلى الأمْرِ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهيِ عَنِ المُنْكَرِ وَ عَلى أنْ نَقُولَ في اللهِ تَبَارَكَ وَتَعَالى وَلا نَخَافُ لَومَةَ لائِمٍ فيهِ (أحمد صحيح)
আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে বাইয়াত করি আনুগত্যের… এবং সৎকর্মে আদেশ ও অসৎকর্মে নিষেধের এবং এ কথার উপর যে, আমরা মহিমাময় আল্লাহর জন্য কথা বলব এবং সে বিষয়ে কোন নিন্দুকের নিন্দা বা গালি গালাজের তোয়াক্কা করব না। (আহমাদ, বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য সনদে)।
এ সমস্ত আয়াত ও হাদীসের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েই সকল যুগে ওলামায়ে কিরাম আপন দায়িত্ব পালনে সজাগ সতর্ক ছিলেন। অবশ্য সকল যুগে দাওয়াত ও তাবলীগের পদ্ধতি বা ধারা একই ছিল এমনটি নয়। যুগ চাহিদার ভিত্তিতে ওলামায়ে কিরাম কুরআন ও হাদীস বর্ণিত মূলনীতির আলোকে সমাজ ও জাতির জন্য ফলপ্রসু ও কল্যাণকর নতুন পন্থা ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করে মানব জাতিকে রাহনুমায়ী করেছেন হিদায়েতের পথে। কখনো মক্তব-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে। কখনো ওয়াজ ও নসীহতের মাধ্যমে। কখনো লিখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে। কখনো সহীহ হাদীস একত্র করা ও প্রচারের মাধ্যমে। কখনো খানকাহ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। দাওয়াত ও তাবলীগের এ সকল পন্থাই কুরআন হাদীস সমর্থিত। সম্প্রতিকালে দারুল উলুম দেওবন্দ ভারতের কৃতি সন্তান হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহঃ এর কর্তৃক উদ্ভাবিত “দাওয়াত ও তাবলীগ” নামক দ্বীন প্রচারে এ পদ্ধতিটি সে ধারারই একটি কাজ। ইসলাম প্রচার ও প্রসারে এটি একটি নিরব বিপ্লব ও বটে। সুতরাং এ পদ্ধতিকে বিদআত বলা বিদআতের সংজ্ঞা সম্পর্কে অজ্ঞতা ছাড়ার আর কিছু নয়।
এ প্রশ্নোত্তরটিও পড়ুন- তাবলীগ জামাত ইসলাম ধর্মে একটি নতুন বিদআত?
আল্লাহ তাআলা হক্কানী এ জামাআতের কার্যক্রমকে কবুল করুন। বিরোধিতাকারীদের হেদায়াত নসীব করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।