প্রচ্ছদ / কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা / মসজিদে খেলাধুলা করার হুকুম কী?

মসজিদে খেলাধুলা করার হুকুম কী?

প্রশ্ন

সম্প্রতি সিলেটের একটি আহলে হাদীস মসজিদে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আহলে হাদীস ভাইয়েরা বলছেন যে, এভাবে মসজিদে খেলাধুলা করা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। অপরদিকে একদল আলেম উলামা এর তীব্র প্রতিবাদ করছেন। তাদের বক্তব্য হলো, এভাবে মসজিদে খেলাধুলা করা জায়েজ নেই।

এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে সঠিক সমাধান জানালে কৃতার্থ হবো।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

মসজিদকে সম্মান করা এবং সকল প্রকার অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় কাজ নোংরা বিষয় এবং খেলাধুলা থেকে মসজিদকে মুক্ত রাখা জরুরী। এসব করা মসজিদকে অসম্মান করা।

মসজিদের সম্মান রক্ষায় কেবল তাতে আল্লাহর ইবাদত করা যাবে মর্মে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَن تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ [٢٤:٣٦]

আল্লাহ যেসব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন, সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে; [সূরা নূর-৩৬]

হযরত আনাস রা.থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إِنَّ هَذِهِ الْمَسَاجِدَ لَا تَصْلُحُ لِشَيْءٍ مِنْ هَذَا الْبَوْلِ، وَلَا الْقَذَرِ إِنَّمَا هِيَ لِذِكْرِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَالصَّلَاةِ وَقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ

অর্থাৎ মসজিদ প্রসাব,নাপাকী ও আবর্জনার উপযুক্ত নয়। বরং মসজিদ হল আল্লাহ তাআলার যিকির ও কুরআন তেলাওয়াতের জন্য। {মুসলিম শরীফ হাদীস নং-২৮৫}

সুতরাং বুঝা গেল যে, মসজিদে খেলাধুলা করা জায়েজ নেই। এর দ্বারা মসজিদকে অসম্মান করা হয়। যে কারণে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে, সেই ইবাদত ব্যতীত অন্য কাজে তা ব্যবহার করা গর্হিত অন্যায় ও মারাত্মক গোনাহের কাজও বটে।

তাই যারা এহেন কাজ করেছে, তাদের অচিরেই আল্লাহর ঘরকে অসম্মান করায় তওবা করা উচিত।

বাকি রইলো হাবশার কয়েকজন ব্যক্তি ঈদের দিন মসজিদে নববীতে খেলাধুলা করেছেন মর্মে হাদীস। যেটির উপর ভ্রান্ত কিয়াস করে কথিত আহলে হাদীস ভাইয়েরা মসজিদে ফুটবল খেলাকে জায়েজ করছেন। তা নিতান্তই ভুল ইস্তিদলাল।

উপরোক্ত হাদীসটি প্রথমে আমরা দেখে নেই:

وَقَالَتْ عَائِشَةُ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَسْتُرُنِي، وَأَنَا أَنْظُرُ إِلَى الْحَبَشَةِ، وَهُمْ يَلْعَبُونَ فِي الْمَسْجِدِ فَزَجَرَهُمْ ‏(‏عُمَرُ‏)‏ فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏”‏ دَعْهُمْ أَمْنًا بَنِي أَرْفَدَةَ ‏”‏‏.‏ يَعْنِي مِنَ الأَمْنِ‏

আয়শা (রাঃ) বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিলেন আর আমি হাবশীদের খেলা দেখছিলাম। মসজিদে তারা খেলা করছিল। এমন সময় ‘উমার (রাঃ) এসে তাদেরকে ধমক দিলেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে ‘উমার! তাদেরকে বানূ আরফিদাকে নিরাপদ ছেড়ে দাও। [বুখারী, হাদীস নং-৩৫৩০, ৯৮৮]

قَالَتْ عَائِشَةُ وَاللَّهِ لَقَدْ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُومُ عَلَى بَابِ حُجْرَتِي – وَالْحَبَشَةُ يَلْعَبُونَ بِحِرَابِهِمْ فِي مَسْجِدِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم – يَسْتُرُنِي بِرِدَائِهِ لِكَىْ أَنْظُرَ إِلَى لَعِبِهِمْ ثُمَّ يَقُومُ مِنْ أَجْلِي حَتَّى أَكُونَ أَنَا الَّتِي أَنْصَرِفُ ‏.‏ فَاقْدُرُوا قَدْرَ الْجَارِيَةِ الْحَدِيثَةِ السِّنِّ حَرِيصَةً عَلَى اللَّهْوِ

আয়শা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখলাম, তিনি আমার হুজরার দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন আর হাবশীরা তাদের অস্ত্র দ্বারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাসজিদে নবাবীতে তাদের যুদ্ধের কলাকৌশল দেখাচ্ছে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তার চাদর দ্বারা আড়াল করে দিচ্ছেন যাতে আমি তাদের খেলা দেখতে পারি। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকলেন, যতক্ষণ আমি নিজে ফিরে না আসি। অতএব অল্পবয়স্কা বালিকাদের খেল-তামাশার প্রতি যে লোভ রয়েছে তার মূল্যায়ন কর (তার সখ পূর্ণ কর)। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৯৪৯, ইফাবা-১৯৩৪]

উপরোক্ত হাদীসগুলোতে কয়েকটি বিষয় পরিস্কার:

১ খেলাটি ছিল যুদ্ধকৌশল সম্পর্কিত।

২ খেলেছেন কতিপয় হাবশীরা। বড় কোন সাহাবী এমন খেলায় অংশগ্রহণ করেননি।

৩ এভাবে মসজিদে খেলাধুলা করাকে অপছন্দনীয় হওয়ার বিষয়টি হযরত উমর রাঃ এর ধমকের দ্বারা বুঝা যায়।

উপরোক্ত কারণে মুহাদ্দিসীনে কেরাম উপরোক্ত হাদীস দ্বারা আমভাবে মসজিদে খেলাধুলা করাকে বৈধ বলাকে ভুল আখ্যায়িত করেছেন।

মুহাদ্দিসীনে কেরামের মতে উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা হলো:

১ মসজিদে যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের উপরোক্ত বৈধতা রহিত হয়ে গেছে। কারণ, পরবর্তীতে কোন সাহাবী এমন আমল করেছেন মর্মে পাওয়া যায় না।

২ ঈদের দিন এমন আনন্দ করাকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিয়েছেন, তাদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য। এ কারণেই মসজিদে এভাবে খেলাধুলা কোন বড় সাহাবী থেকে প্রমাণিত নয়।

৩ আসলে তারা মসজিদের ভিতরে খেলাধুলা করেনি। বরং মসজিদের আঙ্গিনায় খেলাধুলা করেছে। আঙ্গিনা যেহেতু মসজিদের লাগোয়া হয়ে থাকে, তাই হাদীসে ‘মসজিদে’ বলে তা উদ্ধৃত করা হয়েছে।

৪ এটি ছিল যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কিত। যেহেতু ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে যু্দ্ধ প্রশিক্ষণ নেয়াটাও ইবাদতের অন্তর্ভূক্ত। তাই যুদ্ধ কৌশল সংক্রান্ত খেলা মসজিদে উপরোক্ত  হাদীস দ্বারা বুঝা যায়। আম অন্য খেলা এর মাঝে অন্তর্ভূক্ত হবে না।

উপরোক্ত ব্যাখ্যার আলোকে বুঝা যায়, উপরোক্ত হাদীসের উপর কিয়াস করে মসজিদে ফুটবল খেলাকে বৈধতা দেয়া হাদীস সম্পর্কে চূড়ান্ত অজ্ঞতার পরিচায়ক।

বুখারী শরীফে সম্মিলিত মুনাজাত সম্পর্কিত একটি পরিস্কার আছে। সেটি হলো:


أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ، قَالَ: أَتَى رَجُلٌ أَعْرَابِيٌّ مِنْ أَهْلِ البَدْوِ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ الجُمُعَةِ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، هَلَكَتِ المَاشِيَةُ، هَلَكَ العِيَالُ هَلَكَ النَّاسُ، «فَرَفَعَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدَيْهِ، يَدْعُو، وَرَفَعَ النَّاسُ أَيْدِيَهُمْ مَعَهُ يَدْعُونَ

হযরত আনাস বিন মালিক রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা একজন গ্রাম্য সাহাবী রাসূল সাঃ এর কাছে আসলেন জুমআর দিন। এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! জিনিস পত্র, পরিবার, মানুষ সবই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একথা শুনে রাসূল সাঃ তার উভয় হাত উত্তলোন করলেন দুআর উদ্দেশ্যে। উপস্থিত সবাই রাসূল সাঃ এর সাথে দুআর জন্য হাত উত্তোলন করলেন। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১০২৯}

উক্ত হাদীসে বৃষ্টির জন্য সাহাবায়ে কেরামগণকে নিয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মিলিত মুনাজাত করেছেন। এর উপর ভিত্তি করে আমরা বলি, যে কোন প্রয়োজনে আল্লাহর কাছে সম্মিলিত মুনাজাত করাতে কোন সমস্যা নেই।

কিন্তু লা মাযহাবী বন্ধুরা উপরোক্ত হাদীসকে শুধু ইস্তিস্কার সাথে খাস করে বলেন, শুধু পানির জন্য সম্মিলিত মুনাজাত করা যাবে। অন্য কিছুর জন্য করা বিদআত।

আমাদের প্রশ্ন হলো: বৃষ্টির জন্য সম্মিলিত মুনাজাতের উপর কিয়াস করে অন্য প্রয়োজনে সম্মিলিত মুনাজাত বৈধতার কিয়াস যদি বাতিল হয়, বিদআত হয়, তাহলে বর্শা ও যুদ্ধ প্রশিক্ষণের খেলাধুলার উপর কিয়াস করে ফুটবল খেলা বৈধতার প্রমাণ করা কেন বিদআত ও ভ্রান্ত নয়?

আসলে কথিত আহলে হাদীস মতবাদ মূলত কুরআন ও হাদীসের উপর আমল নয়, বরং নিজের খেয়ালখুশি আর মনের পূজার করার নামই। নতুবা মসজিদের মতো একটি পবিত্র স্থানের হুরমত নষ্ট করে সেটারকে খেলার মাঠ বানানোর মতো ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে, সেটাকে আবার হাদীস থেকে প্রমাণের ঘৃণ্য চেষ্টা করতো না।

আল্লাহ তাআলা আমাদের লা মাযহাবী ভ্রান্ত ফিরক্বা থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

وحكى ابن التين عن أبي الحسن اللخمي: أن اللعب بالحراب في المسجد منسوخ بالقرآن والسنة: أما القرآن فقوله تعالى: في بيوت أذن الله أن ترفعوأما السنة فحديث: جنبوا مساجدكم صبيانكم ومجانينكم (فتح البارى، باب اصحاب الحراب فى المسجد، تحت رقم الحديث-454-1/549)

وحكى عن مالك أن لعبهم كان خارج المسجد، قال القارى: فى المسجد: أى فى رحبة المسجد المتصلة به، وكانت تنظر من باب الحجرة، وذلك من داخل المسجد، فقالت “فى المسجد” لاتصال الرحبة به، أو دخلوا المسجد لتضياق الموضع بهم، وإنما سومحوا فيه لأن لعبهم بالحراب كان يعد من عدة الحرب مع أعداء الله تعالى، فصار عبادة بالقصد، كالرمى، قال تعالى جل جلاله: “واعدوا لهم ما استطعتم من قوة” (سورة الأنفال-60) (مسوعة فتح الملهم بشرح صحيح مسلم، كتاب الصلاة، صلاة العيدين-5/413)

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

প্রধান মুফতী: জামিয়াতুস সুন্নাহ লালবাগ, ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া ইসলামিয়া দারুল হক লালবাগ ঢাকা।

পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।

ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com 

আরও জানুন

মুসলমানদের জন্য হিন্দু পরিচয় দিয়ে ইসকনের মিছিলে শরীক হওয়ার হুকুম কী?

প্রশ্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ইসকনের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক মিছিলে যেসব মুসলমান শরীক হয়, নিজেদের হিন্দু পরিচয় দেয় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *