প্রশ্ন
অধ্যক্ষ মুজ্জাম্মিল হক নামের এক ব্যক্তি। যার বাড়ি বরিশালের পিরোজপুরে। তিনি রাজশাহী এক মসজিদে জুমআর খুতবা দিয়ে থাকেন। সেখানে তিনি বেশ কিছু এমন ব্যক্তব্য প্রদান করে থাকেন, যে ব্যাপারে জনমনে বেশ বিভ্রান্তির সৃষ্টির হয়। যেমন, তিনি বুখারী শরীফে বর্ণিত হযরত আদম আলাইহিস সালামের ষাট হাত লম্বা হবার বিষয়কে অস্বিকার করেন। তিনি তার এক বয়ানে এ বিষয়ে বলেন:
“আদম আলাইহিস সালাম থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে আট হাজার বছর। তাহলে আদম আলাইহিস সালাম যদি ষাট হাত হয়, তাহলে এখন আমরা আছি চার হাত ধরেন। ছাপ্পান্ন হাত নাই। তাহলে চুয়ান্ন হাত কমলো কয় বছরে। এই আট হাজার বছরে। তাহলে বছরে সাত আটা ছাপ্পান্ন। তাহলে এক হাজার বছরে সাত হাত কমে। তাহলে আর এক হাজার বছর পর আপনার কোত্থেকে সাত হাত কমবে? কারণ, আপনি আছেন আর চার হাত।
তাহলে আপনি জিরো হবেন, তারপর মাইনাসে যাবেন। তাহলে এই সমস্ত কথা, যেগুলো যুক্তিতে আসে না, এই কথাগুলো দ্বারা আমাদের ইসলামকে এরা দুর্বল করে এবং শত্রুদেরকে ইসলামের সমালোচনা করার সুযোগ দেয়। আদম আলাইহিস সালাম কস্মিনকালেও ষাট হাত ছিলেন না। এই সব কিছুই অলীক”।
এ বিষয়ে হুজুরের ব্যাখ্যা জানতে চাই।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
হাদীস অস্বিকার করার জন্য এ ব্যক্তি যে মূলনীতি বানিয়েছেন তা হলো ‘যুক্তি যদি হাদীসের ভাষ্যের অনুকূল হয়, তাহলে মানবেন। আর যদি যুক্তিতে না ধরে, তাহলে তা তিনি মানবেন না’।
এর মানে নবীর কথা মানা ও না মানার মানদণ্ড বানিয়েছেন তার যুক্তিকে।
তিনি কি এতটুকু জানেন যে, যুক্তি কখনো এক সীমায় থাকে না। তা ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। কালে, সময়ে ও অবস্থানে পরিবর্তন হয়। কিন্তু পক্ষান্তরে আল্লাহ ও রাসূলের কথা অপরিবর্তনীয়। তা কখনো পরিবর্তন হয় না।
যুক্তি ও আকল ব্যক্তি অনুপাতেও পরিবর্তন হয়। আর কুরআন ও হাদীসের প্রয়োজন তখনি, যা কিছু আকল ও যুক্তি দিয়ে বুঝা সম্ভব নয় এমন বস্তুর ক্ষেত্রে। যদি সব কিছু আকল দিয়েই বুঝা যায়, তাহলে ওহী নাজিলের প্রয়োজন কোথায়? ওহীতো আসছেই যা কিছু মানুষের স্বাভাবিক আকল বুঝতে সক্ষম হয় না এমন বস্তুকে বিশ্বাস করানোর জন্য।
যেমন আখেরাত, মৃত্যুর পর জান্নাত ও জাহান্নাম হওয়া। আকল এসব মানুক বা না মানুক কুরআন ও হাদীসের এসব বিধান বান্দা মানতে বাধ্য। কারণ, আকল কখনোই চূড়ান্ত মানদণ্ড নয়। আকলের একটি সীমা আছে। সে তার সীমার অতিরিক্ত বুঝার ক্ষমতা রাখে না।
যেমন আজ থেকে প্রায় আটশত বছর আগে এক ফিরক্বা ছিল। যাদের নাম ছিল বাতেনী ফিরক্বা। এ ফিরক্বার এক প্রসিদ্ধ লিডার ছিল, যার নাম ছিল আব্দুল্লাহ হাসান কায়রাওয়ানী। সে তার অনুসারীদের বলতো যে, “আমার একথা বুঝে আসে না যে, লোকদের কাছে নিজের ঘরে একজন সুন্দরী ভদ্র মেয়ে বোনের আকৃতিতে বিদ্যমান আছে। সে ভাইয়ের মেজাজ মর্জিও ভালো বুঝে। তার সার্বিক বিষয়ে সম্মক অবগত। কিন্তু বেআক্কেল মানুষ তার এ বোনটাকে এক অপরিচিত ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়। যার ব্যাপারে এটা জানা নেই যে, তার সাথে সংসার ভালো হবে কি না? তার চালচলন অভ্যাস সম্পর্কে জানে কি জানে না? আর নিজের জন্য অনেক সময় এমন এক মেয়েকে নিয়ে আসে, যে সৌন্দর্য এবং ভদ্রতার দিক থেকেও কম। মনমর্জি বুঝার ক্ষেত্রেও বোনের সমকক্ষ নয়।
আমার বুঝে আসে না, এমন অযৌক্তিকতার কী মানে হয়? নিজের ঘরের সম্পদতো অন্যকে দিয়ে দিচ্ছে, আর নিজের জন্য এমন বস্তু নিয়ে আসছে, যা তার জন্য পুরাপুরি আরাম ও প্রশান্তিদায়ক নয়। এটা অযৌক্তিক ও বেআকলী কাজ। আকলের খেলাফ কর্ম। আমি আমার অনুসারীদের নসিহত করছি যে, তারা যেন এ অযৌক্তিক কাজ পরিহার করে। নিজের ঘরের সম্পদ নিজের ঘরেই রাখে। [আলগরকু বাইনাল ফারক্বি লিলবাগদাদী-২৯৭, বয়ানু মাযাহিবাল বাতিনিয়্যাহ, দায়লামীকৃত-৮১]
আরেক স্থানে লিখে যে, “এর কারণটা কী যে, এক বোন তার ভাইয়ের জন্য খানা পাকাতে পারে। তার পেটের ক্ষুধা দূর করতে পারে। তার আরামের জন্য তার কাপড় সেলাই করতে পারে। তার বিছানা ঠিক করে দিতে পারে। তাহলে সে কেন তার শারিরীক চাহিদা পূর্ণ করতে পারবে না? এর কারণ কী? এটাতো পরিস্কার যুক্তির খেলাফ”। [আলগরক্বু বাইনাল ফারক্ব লিলবাগদাদী-২৯৭, বয়ানু মাযাহিবিল বাতিনিয়্যাহ, দায়লামীকৃত-৮১]
এই হলো আকলপূজা আর যুক্তিপূজার হালত। আকলপূজারীরা সমকামিতাকে বৈধতা দেয়। হিরোশিমা নাগাশাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলা বিষয়ে আমেরিকানদের যুক্তি হলো, যদি তারা এ হামলা না করতো, তাহলে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতো, ফলে আরো কোটি মানুষ মারা যেতো। কোটি মানুষকে বাঁচানোর জন্য তারা হিরোশিমা ও নাগাশাকিতে এ পারমাণবিক হামলা চালিয়েছিল।
যেমন এক সময় বিজ্ঞান বলতো যে, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে। তারপর আসলো যে, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরে। এখন বলা হচ্ছে যে, পৃথিবী এবং সূর্য উভয়টাই তাদের আপন কক্ষপথে ঘুরে।
দেখুন। যদি মানদণ্ড আকলকেই বানানো হয়, তাহলে আপন বোনকে বিয়ে করাও যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করছে কেউ। জাপানে মানবতার চরম ধ্বংসাবলীলাকেও যুক্তি দিয়ে ভালো প্রমাণ করা হচ্ছে। সমকামিতার মত পশুবত মানোবৃত্তিকেও বৈধতার লেভেল দেয়া হচ্ছে।
তাই যুক্তি কখনোই আল্লাহ ও রাসূলের কথা মানার মানদণ্ড হতে পারে না।
অধ্যক্ষ সাহেবের এ মূলনীতি পুরো ইসলামকে অস্বিকার করারই একটি গভীর ষড়যন্ত্র বলে প্রতীয়মান হয়।
এবার আমরা উক্ত হাদীসটির দিকে একটু তাকাই:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ «خَلَقَ اللهُ آدَمَ وَطُولُهُ سِتُّونَ ذِرَاعًا ثُمَّ قَالَ اذْهَبْ فَسَلِّمْ عَلَى أُولَئِكَ مِنَ الْمَلَائِكَةِ فَاسْتَمِعْ مَا يُحَيُّونَكَ تَحِيَّتُكَ وَتَحِيَّةُ ذُرِّيَّتِكَ فَقَالَ السَّلَامُ عَلَيْكُمْ فَقَالُوا: السَّلَامُ عَلَيْكَ وَرَحْمَةُ اللهِ
فَزَادُوهُ وَرَحْمَةُ اللهِ فَكُلُّ مَنْ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ عَلَى صُورَةِ آدَمَ فَلَمْ يَزَلِ الْخَلْقُ يَنْقُصُ حَتَّى الْآنَ
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা‘আলা আদাম (আঃ)-কে সৃষ্টি করলেন। তাঁর দেহের দৈর্ঘ্য ছিল ষাট হাত। অতঃপর তিনি (আল্লাহ) তাঁকে (আদামকে) বললেন, যাও। ঐ ফেরেশতা দলের প্রতি সালাম কর এবং তাঁরা তোমার সালামের জওয়াব কিভাবে দেয় তা মনোযোগ দিয়ে শোন। কারণ সেটাই হবে তোমার এবং তোমার সন্তানদের সালামের রীতি। অতঃপর আদাম (আঃ) (ফেরেশতাদের) বললেন, ‘‘আস্সালামু ‘আলাইকুম’’। ফেরেশতামন্ডলী তার উত্তরে ‘‘আস-সালামু ‘আলাইকা ওয়া রহমাতুল্লাহ’’ বললেন। ফেরেশতারা সালামের জওয়াবে ‘‘ওয়া রহমাতুল্লাহ’’ শব্দটি বাড়িয়ে বললেন। যারা জান্নাতে প্রবেশ করবেন তারা আদাম (আঃ)-এর আকৃতি বিশিষ্ট হবেন। তবে আদাম সন্তানের দেহের দৈর্ঘ্য সর্বদা কমতে কমতে বর্তমান পরিমাপে এসেছে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩৩২৬, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৮৪১]
এটি মুত্তাফাক আলাই সহীহ হাদীস। এতে কোন মুহাদ্দিসগণের কালাম নেই।
এ হাদীস কুরআনের কোন আয়াতের মুখালিফ নয়। তাহলে শুধুমাত্র মুজ্জাম্মিল সাহেবের মাথামোটা বুদ্ধির যুক্তিতে ধরছে না বলেই এ হাদীসকে তিনি কী করে অস্বিকার করে দিলেন?
তার মাথামোটা যুক্তি হলো: পৃথিবীর বয়স নাকি হয়েছে সাড়ে আট হাজার বছর। আর প্রতি হাজার বছরে সাত হাত করে কমেছে মানুষের শরীর। আর মানুষ এখন মাত্র চার হাত। সেই হিসেবে আর এক হাজার বছর পরে আর কমবে কিভাবে? জিরো হয়ে যাবে!
আমাদের কথা হলো:
অধ্যক্ষ সাহেব আদম আলাইহিস সালাম আট হাজার বছর আগে আসছিলেন একথা তিনি কুরআনের কোন আয়াতে পেয়েছেন? এমন আজগুবি ও অলীক কথা তিনি কিভাবে বেধড়ক বলে দিলেন?
তার এমন গাঁজাখুরী দাবীর স্বপক্ষে কুরআনের একটি আয়াতও কি পেশ করতে পারবেন? না পারলে তার এমন আজগুবি কথার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও উম্মতকে বিভ্রান্ত করায় জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
দ্বিতীয়ত: কোন কিছু কমতে থাকলে সেটা শুধু কমতেই থাকে না। বরং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কমে। তারপর স্থির হয়ে যায়। যেমন কোন কিছু বাড়তে থাকলে সেটি শুধু বাড়তেই থাকে না, বরং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বেড়ে তা থেমে যায়।
এটাই চিরন্তন সত্য।
যেমন আমরা ছোটকালে যখন জন্ম নেই। আমাদের হাত পা ছোট থাকে, দাঁত থাকে না, শরীরের লোম ছোট ছোট থাকে। কিন্তু এগুলো আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। যতই বয়স বাড়ে, এসব বাড়তে থাকে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় গিয়ে বৃদ্ধি পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
হাত নির্দিষ্ট বয়সের পর আর বাড়ে না। পা নির্দিষ্ট বয়সের পর আর বাড়ে না। দাঁত নির্দিষ্ট বয়সের পর আর বাড়ে না। ব্যক্তির দৈর্ঘ নির্দিষ্ট বয়সের পর আর বাড়ে না।
এখন আমরা যদি কথিত অধ্যক্ষ সাহেবের মতই ঠাট্টা করে প্রশ্ন করি, এক বছর বয়সে মানুষটা ছিল এক ফুট। আর বর্তমানে বিশ বছর বয়সে হয়ে গেল পাঁচ ফুট। এর মানে উনিশ বছরে বাড়লো চার ফুট। তাহলে লোকটার বয়স যখন উনচল্লিশ হবে তখন তার লম্বা হতে হবে আট ফুট। আর যদি ঊনষাট বছর বাঁচে, তাহলে লোকটা লম্বা হবে বারো ফুট। যুক্তিতো তাই বলে! এভাবে বাড়তেই থাকবে। বাড়তে বাড়তে তালগাছের মগডাল পর্যন্ত বাড়তেই থাকার কথা।
এ যুক্তি দিয়ে কি তিনি ছোট মানুষ বয়স বাড়লে লম্বা হওয়াকে অস্বিকার করবেন? কারণ, তার বানানো যুক্তিতো তাই বলে!
যদি আদম আলাইহিস সালাম থেকে লম্বা হবার বিষয়টি ধীরে ধীরে কমে যাওয়া অযৌক্তিক হয় এই যুক্তিতে যে, সামনের এক হাজার বছরে আমরা জিরো হয়ে যাবো হিসাব করে, তাহলে একই যুক্তিতে প্রতিটি মানুষ বাড়তে বাড়তে তালগাছ ধরে ফেলার কথা। তা না হলে জন্মের পর থেকে ধীরে ধীরে বড় হবার বিষয়টিকে অস্বিকার করা উচিত? তাই নয় কি?
কিন্তু তা কেন বলেন না অধ্যক্ষ সাহেব? এখানে আপনার মোটা মাথার কুযুক্তি কী বলে?
যদি ঘিলু থাকে, তাহলে এটাই বলবেন যে, বাড়ার একটি নির্ধারিত সীমা দিয়েছেন আল্লাহ তাআলা। এরপর আর বাড়ে না। তেমনি কমারও নির্দিষ্ট সীমা দিয়েছেন আল্লাহ তাআলা। এরপর আর কমবে না।
সুতরাং আপনার বানোয়াট এ কুযুক্তি দিয়ে বুখারী মুসলিমের সহীহ হাদীস অস্বিকার করা একটি চরম ধৃষ্টতা এবং ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ ছাড়া কিছু নয়।
ভিডিওতে উত্তরটি দেখুন:
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।
ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com