প্রচ্ছদ / প্রশ্নোত্তর / নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাল্যকালে হাতের ইশারায় চাঁদ ড্যান্স করতো?

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাল্যকালে হাতের ইশারায় চাঁদ ড্যান্স করতো?

প্রশ্ন

বাংলাদেশের এক প্রসিদ্ধ বক্তা তার এক বয়ানে বলেন:

“আমেনা কানতেছে আব্দুল্লাহ নাই। সবাই জিজ্ঞাসা করতেছে। কী কারণ কী? বলছে আব্দুল্লাহ নাই। যদি আব্দুল্লাহ থাকতো। প্রথম বাচ্চা। তাইলে খেলনা নিয়া আসতো। তে আল্লাহ কানে কানে বলতেছে: আমেনা আব্দুল্লাহ কিসের খেলনা আনতো? মাটির? কাঠের? প্লাস্টিক? আতর পাথর? আমেনা, আব্দুল্লাহ নাইতো কী হইছে? তোর সাথে একটা সম্পর্ক আমার সাথে আরেকটা সম্পর্ক। তোরতো সন্তান, আমারতো বন্ধু। ডুবতে দে সূর্য আমেনা। ডুবতে দে ডুবতে দে। সূর্য ডুবতে দে। আমি চাঁদকে খেলানা বানায়া পাঠায়া দিবো। আব্দুল্লাহ থাকলেতো দুনিয়ার মাটি আর পাথর আর প্লাস্টিক আর কাঠের খেলনা আনতো। আমি আমার বন্ধুর জন্য চাঁদকে খেলনা বানায়া পাঠায়া দিবো।

আবু তালেব বলেন সূর্য ডুবছে। আমরা বাহিরে চৌকির উপর শুয়ায়া দিতে দেরী,

بدأ القمر أن يدنوا

চাঁদ নিচে আসতে দেরী করে নাই। দ্রুত গতিতে নিচে নামতে ছিল। নামতে নামতে যখন মাথার উপরে চইলা আসছে। তো আমি একটা চিৎকার দিয়া ফেলছি।

خشيت أن يقع عليك

তোমার উপর পইড়া না যায়। কিন্তু মাথার কাছে থাইমা গেছে। তুমি দশ থেকে বারো ঘন্টার বারো ঘন্টার বাচ্চা ছিলা। তুমি হাত পা নাড়তে ছিলা। তোমার হাতের পায়ের ইশারায় চাঁদ উপরে ডান্স করেতিছল ডান্স। ডান্স বুঝেন? ডান্স? কী? নাচতে ছিল, নাচতে। নৃত্য করতে ছিল। তো বলে চাচা! জানেন চাচা চাদ কী বলতেছিল? বলে, তাতো জানি না। বলে:

ان القمر يغنينى، ويحاكينى، ويمنعونى من البكاء

চাঁদ আমাকে ছন্দ শুনাইতেছিল। কান্না থেকে বিরত রাখতে ছিল। আমি যেন না কাঁদি। কাঁদলে আম্মার কষ্ট হবে। আর আল্লাহ চাঁদকে আমার জন্য খেলার জন্য পাঠায়া দিছেন। আমার খেলনা বানায়া পাঠায়া দিছেন।”

এ বর্ণনার বাস্তাবতা সম্পর্কে জানতে চাই।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

প্রথমে উক্ত বর্ণনাটি আরবীসহ দেখে নেই।

أَخْبَرَنَا أَبُو عَبْدِ اللهِ الْحَافِظُ، قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو الْعَبَّاسِ: مُحَمَّدُ بْنُ يَعْقُوبَ قَالَ حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ شَيْبَانَ الرَّمْلِيُّ، قَالَ: حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ الْحَلَبِيُّ، قَالَ: حَدَّثَنَا الْهَيْثَمُ بْنُ جَمِيلٍ، حَدَّثَنَا زُهَيْرٌ، عَنْ مُحَارِبِ بْنِ دِثَارٍ، عَنْ عَمْرِو بْنِ يَثْرِبِيٍّ، عَنِ الْعَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ، قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، دَعَانِي إِلَى الدُّخُولِ فِي دِينِكَ أَمَارَةٌ لِنُبُّوتِكَ، رَأَيْتُكَ فِي الْمَهْدِ ‌تُنَاغِي ‌الْقَمَرَ وَتُشِيرُ إِلَيْهِ بِأُصْبُعِكَ، فَحَيْثُ أَشَرْتَ إِلَيْهِ مَالَ. قَالَ: إِنِّي كُنْتُ أُحَدِّثُهُ وَيُحَدِّثُنِي، وَيُلْهِينِي عَنِ الْبُكَاءِ، وَأَسْمَعُ وَجْبَتَهُ حِينَ يَسْجُدُ تَحْتَ الْعَرْشِ

تَفَرَّدَ بِهِ هَذَا الْحَلَبِيُّ بإسناده وهو مجهول (دلائل النبوة للبيهقى-2/41-42، دلائل النبوة لابى نعيم-229، رقم-338، تاريخ دمشق-4/359-360، رقم-1110)

হযরত আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নবুওয়াতের একটি নিদর্শন আমাকে আপনার দ্বীনে দাখিল হতে আকৃষ্ট করেছে, আমি আপনাকে মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় দেখেছি আপনি চাঁদের সাথে কথা বলছেন। এবং চাঁদের দিকে হাতে ইশারা করছেন। আপনি যেদিকে ইশারা করেছেন চাঁদ সেদিকে হেলে পড়তো। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আমি তার সাথে কথা বলছিলাম, আর চাঁদ আমার সাথে কথা বলছিল। আর সে আমাকে কান্না থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করছিল। আর যখন সে আরশের নিচে সেজদা করতো, তখন আমি তার সেজদার আওয়াজও শুনতে পেতাম।

(বায়হাকী রহঃ) বলেন: হালবী এ সনদে মুতাফাররিদ তথা একক বর্ণনাকারী। আর হালবী একজন মাজহুল রাবী। [দালায়েলুন নবুওয়্যাহ লিলবায়হাকী-২/৪১-৪২, দালায়েলুন নবুওয়্যাহ লিআবী নুআইম-২২৯, বর্ণনা নং-৩৩৮, তারীখে দামেশক-৪/৩৫৯-৩৬০, বর্ণনা নং-১১১০]

ইমাম বায়হাকী রহঃ এ বর্ণনার সনদের রাবী হালবীকে মাজহুল তথা অপরিচিত বলেছেন।

কিন্তু তার পরিচয় পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ বের করেছেন।

তার নাম ছিল: আহমাদ বিন ইবরাহীম হালবী। যিনি আলী বিন আসেম এবং হায়ছাম বিন জামীল থেকে রেওয়ায়েত করে থাকেন। যার থেকে আহমাদ বিন শাইবান রেওয়ায়েত করেন।

জরাহ তা’দীলের কোন ইমাম উক্ত আহমাদ বিন ইবরাহীম হালবীকে নির্ভরযোগ্য বলে মন্তব্য করেননি।

তবে তার পূর্ণ পরিচয় জেনে ইমাম আবূ হাতেম কী মন্তব্য করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য।

قال ابن أبي حاتم: سألت أبي عنه، وعرضت عليه حديثه، فقال: لا أعرفه، وأحاديثه باطلة موضوعة كلها ليس لها اصول، يدل حديثه على أنه كذاب

ইমাম ইবনু আবী হাতেম রহঃ বলেন: আমি আমার বাবা (ইমাম আবূ হাতেম রহঃ) কে তার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করি এবং বাবার সামনে তার বর্ণিত হাদীস পেশ করি, তখন তিনি বলেন: আমি একে চিনি না। তবে তার সমস্ত হাদীস বাতিল এবং বানোয়াট। তার বর্ণিত সব বর্ণনাই ভিত্তিহীন। তার বর্ণনাগুলোই প্রমাণ করে যে, সে একটা মিথ্যুক। [আলজরহু ওয়াত তা’দীল-১/৪০, রাবী নং-৫]

ইমাম যাহাবী রহঃ মীযানুল ই’তিদালের ১/৮১ নং পৃষ্ঠা, রাবী নং-২৮৭ এ এবং আল মুগনী ফীয যুআফা এর ৩৩ পৃষ্ঠা, রাবী নং ২৩৪ এ হাফেজ আবূ হাতেম রহঃ এর মন্তব্য নকল করেই ক্ষান্ত হয়েছেন।

একইভাবে হাফেজ ইবনুল যাওজী রহঃ তার কিতাব “আয যুআফা ওয়াল মাতরূকীন” গ্রন্থের ১/৬৪, রাবী নং-১৫০ এ হাফেজ আবূ হাতেমের বক্তব্য নকল করে চুপ থেকেছেন।

ঠিক একই কাজ করেছেন ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ। লিসানুল মীযান-১/৩৯৬, রাবী নং-৩৭২।

সুতরাং ইমাম আবূ হাতেম রহঃ এর মন্তব্য যে, হালবী বর্ণিত সব হাদীসই ভিত্তিহীন জাল ও বানোয়াট। এবং হালবী নিজে একজন মিথ্যুক।

এমন একজন মিথ্যুক রাবীর বর্ণিত হাদীস যে জাল ও বানোয়াট এতে কোন সন্দেহ বাকি থাকে না।

এমন একটি জাল বর্ণনা মাওলানা আত্মবিশ্বাসের সাথে মজা করে বর্ণনা করার সাথে নিজের পক্ষ থেকে আরো বেশ কিছু কথা জুড়ে দিয়েছেন।  

মাওলানা নিজের পক্ষ থেকে বানিয়ে যেসব মিথ্যা বলেছেন:

আমেনা কাঁদছিল আর সবাই জিজ্ঞাসা করছিল কারণ কী?

কান্নার কারণ আব্দুল্লাহ বেঁচে থাকলে খেলনা নিয়ে আসতো।

আল্লাহ কানে কানে বলেছেন যে, আমেনা আব্দুল্লাহ কিসের খেলনা আনতো? মাটির? কাঠের? প্লাস্টিক? আতর পাথর? আমেনা, আব্দুল্লাহ নাইতো কী হইছে? তোর সাথে একটা সম্পর্ক আমার সাথে আরেকটা সম্পর্ক। তোরতো সন্তান, আমারতো বন্ধু। ডুবতে দে সূর্য আমেনা। ডুবতে দে ডুবতে দে। সূর্য ডুবতে দে। আমি চাঁদকে খেলানা বানায়া পাঠায়া দিবো। আব্দুল্লাহ থাকলেতো দুনিয়ার মাটি আর পাথর আর প্লাস্টিক আর কাঠের খেলনা আনতো। আমি আমার বন্ধুর জন্য চাঁদকে খেলনা বানায়া পাঠায়া দিবো।

আবু তালেব বলেন সূর্য ডুবছে। আমরা বাহিরে চৌকির উপর শুয়ায়া দিতে দেরী, بدأ القمر أن يدنوا চাঁদ নিচে আসতে দেরী করে নাই। দ্রুত গতিতে নিচে নামতে ছিল। নামতে নামতে যখন মাথার উপরে চইলা আসছে। তো আমি একটা চিৎকার দিয়া ফেলছি। خشيت أن يقع عليك তোমার উপর পইড়া না যায়। কিন্তু মাথার কাছে থাইমা গেছে। তুমি দশ থেকে বারো ঘন্টার বারো ঘন্টার বাচ্চা ছিলা।

কাঁদলে আম্মার কষ্ট হবে। আর আল্লাহ চাঁদকে আমার জন্য খেলার জন্য পাঠায়া দিছেন। আমার খেলনা বানায়া পাঠায়া দিছেন।

এই ৫টি বিষয় মাওলানা নিজের পক্ষ থেকে বানিয়ে বানিয়ে আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে বলেছেন।

বাকি মূল বর্ণনাটি যেখানে জাল। সেখানে সেই জালের সাথে নিজের পক্ষ থেকে আরো জাল কথা জুড়ে দেয়া কতটা মারাত্মক তা সহজেই অনুমেয়।

আল্লাহ তাআলা এসব জাল বানোয়াট বক্তার মিথ্যাচার থেকে এ দেশের সরলপ্রাণ মুসলমানদের ঈমান ও আমলকে হেফাজত করুন। আমীন।

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া ইসলামিয়া দারুল হক লালবাগ ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা: জামিয়াতুস সুন্নাহ কামরাঙ্গিরচর, ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা: কাসিমুল উলুম আলইসলামিয়া, সালেহপুর আমীনবাজার ঢাকা।

পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।

শাইখুল হাদীস: জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, সনমানিয়া, কাপাসিয়া, গাজীপুর।

ইমেইল[email protected]

0Shares

আরও জানুন

নামাযী ব্যক্তির কতটুকু সামনে দিয়ে অতিক্রম করা যাবে? নামাযী ব্যক্তির সামনে বসা ব্যক্তি কি সরে যেতে পারবে?

প্রশ্ন জনাব, আসসালামু আলাইকুম। হযরতের কাছে আমার প্রশ্ন হলঃ ১। নামাজী ব্যক্তির কতখানি সামনে দিয়ে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস