প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / অপবাদের কবলে ফাযায়েলে আমাল [পর্ব-৪] জনৈক বুযুর্গের কয়েকদিন যাবত পেশাব পায়খানা না করার ঘটনা

অপবাদের কবলে ফাযায়েলে আমাল [পর্ব-৪] জনৈক বুযুর্গের কয়েকদিন যাবত পেশাব পায়খানা না করার ঘটনা

প্রশ্ন

ফাযায়েলে জিকিরের মাঝে আছে যে, একজন বুযুর্গ কয়েকদিন পর্যন্ত পেশাব পায়খানার জন্য যেতে পারতেন না। যেখানেই যেতেন সেখানেই আল্লাহর নূর দেখতে পাইতেন।

কত বড় জঘন্য কথা। তাহলে কী দেওবন্দীদের আকিদা হল, আল্লাহ তাআলা নাউজুবিল্লাহ নাপাক স্থানেও আছেন?

এ বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই।

উত্তর

بسم الله الحمن الرحيم

ভূমিকাঃ

কিছু কথা এমন আছে যা আমরা সংক্ষেপ কথা বলতে পারি। কিন্তু তা বিস্তারিত বলতে পারি না। বিস্তারিত বলা যায় না।

যদি বিস্তারিত বলা হয়, তাহলে বেদআদবী বা নোংরামী হয়ে যায়।

যেমন, আমরা বলি যে, আল্লাহ তাআলা সব কিছুকে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের পূর্ণ শরীর এক আল্লাহ তাআলাই সৃষ্টি করেছেন।

একথা আমরা সংক্ষেপ কথায় বলতে পারি। কিন্তু বিস্তারিতভাবে তথা ওমুক অঙ্গ, তমুক অঙ্গ, এভাবে আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি অঙ্গের নাম বলে সৃষ্টি করেছেন বলতে গেলে আর আদব থাকে না, বরং তা বেআদবীর দিকে চলে যায়।

তেমনি একজন পিতা যখন তার কন্যা সন্তানকে স্বামীর হাতে তুলে দেয়, তখন বলে যে, “আমার কন্যার সকল হকের দিকে খেয়াল রেখো”। একথা সংক্ষেপ কথা বলা যায়।

কিন্তু যদি বিস্তারিত বলতে যাই, শারীরিক হক ইত্যাদি আলাদা আলাদা উল্লেখ করে তা ব্যাখ্যা করলে, তা আর শোভনীয় থাকে না। বরং তা অশুভনীয়  কথা হয়ে যায়।

তেমনি অনেক বিষয় আছে, যা আমরা সংক্ষেপ কথায় প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু তা বিস্তারিত বলা যায় না। বলা ঠিক না।

এবার আমরা মূল বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করি।

শায়েখ জাকারিয়া রহঃ তার কিতাবে কী লিখেছেন?

“আমাদের হযরত মাওলানা আব্দুর রহীম রায়পুরী রহঃ এর এক খাদেমের অবস্থা এমন হইয়াছিল যে, কয়েকদিন পর্যন্ত তিনি পায়খানা-পেশাবখানায় যাইতে পারিতেন না। কারণ, যেখানেই যাইতেন সেখানেই তিনি নূর দেখিতে পাইতেন। [ফাযায়েলে আমাল-৫৫২ পৃষ্ঠা, ফাযায়েলে যিকির-২৪৬ পৃষ্ঠা, দারুল কিতাব প্রকাশনী, উর্দু ফাযায়েলে আমাল ১ম খন্ড, ফাযায়েলে জিকির-৪৫১]

এবার আমরা দেখি সর্বত্র আল্লাহর নূর আছে কি না?

আল্লাহ তাআলার নূর আসমান জমিন ব্যাপৃত। যেমন কুরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছেঃ

اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ [٢٤:٣٥

আল্লাহ তাআলা নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের জ্যোতি। [সূরা আননূর ২৪: ৩৫]

আল্লামা ইবনে কাসীর রহঃ ইমাম সুদ্ধী রহঃ এর বক্তব্য নকল করেন যে,

قال السدي في قوله: {اللَّهُ نُورُ السَّمَوَاتِ وَالأرْضِ} : فبنوره أضاءت السموات وَالْأَرْضُ

আল্লাহ তাআলার নূরে আসমানও জমিন আলোকিত। [তাফসীরে ইবনে কাসীর-১০/২৩৫, ভিন্ন ছাপা-৬/৫৩]

ইমাম তাবারী রহঃ বলেন,

وقال آخرون: بل عنى بذلك النور الضياء. وقالوا: معنى ذلك: ضياء السماوات والأرض.

একদল মুহাক্কিকগণ বলেন, এ নূর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, জ্যোতি। এ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, [আল্লাহ] আসমান ও জমিনের জ্যোতি। [তাফসীরে তাবারী-১৭/২৯৬]

ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহঃ লিখেনঃ

أخرج البُخَارِيّ وَمُسلم وَالنَّسَائِيّ وَابْن ماجة وَالْبَيْهَقِيّ فِي الْأَسْمَاء وَالصِّفَات عَن ابْن عَبَّاس قَالَ: كَانَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم إِذا تهجد فِي اللَّيْل يَدْعُو اللَّهُمَّ لَك الْحَمد أَنْت رب السَّمَوَات وَالْأَرْض وَمن فِيهِنَّ وَلَك الْحَمد أَنْت نور السَّمَوَات وَالْأَرْض وَمن فِيهِنَّ

ইমাম বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ এবং ইমাম বায়হাকী ‘আসমা ওয়াসসিফাত’ এ ইবেন আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাহাজ্জুদ পড়তেন রাতে বেলা, তখন দুআ করতেন, হে আল্লাহ তোমারই সকল প্রশংসা, তুমি আসমানও জমিন এবং এর মাঝের সকল কিছুর রব। তোমারই সকল প্রশংসা, তুমি আসমান ও জমিন এবং এর মাঝের সব কিছুর নূর। [আদদুররুল মানছূর-১১/৫৭, ভিন্ন ছাপা-৬/১৯৫]

এ বর্ণনা হাদীসের কিতাবে পাওয়া যায়,

বুখারী, হাদীস নং-১১২০।

ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৩৫৫।

সুনানে দারামী, হাদীস নং-১৫২৭।

মুসনাদুল হুমায়দী, হাদীস নং-৫০৩।

সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং-১৬১৯।

সহীহ ইবনে খুজাইমা, হাদীস নং-১১৫১।

মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৮১৩।

এ আয়াতও হাদীস দ্বারা এ আক্বিদা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তাআলার নূর আসমান ও জমিনে বিদ্যমান।

সুতরাং ফাযায়েলে আমালে যে ঘটনাটি বিদ্যমান তা সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ঘটনা। এতে সন্দেহ করার কী আছে?

আল্লাহ তাআলা নূর সর্বত্র বিরাজমান। কিন্তু সবার চোখে তা ধরা পড়ে না। কিন্তু তা আছে। আল্লাহ তাআলা কোন বুযুর্গের সামনে তা কিছুদিনের জন্য প্রকাশ করে দেয়া এতে আশ্চর্য হবার কী আছে?

আল্লাহর নূর সর্বত্র আছে একথাতো কুরআনের আয়াত ও হাদীস দ্বারা পরিস্কার। কিন্তু কোথায় কোথায় আছে? তা আমরা বিস্তারিত বলি না। কারণ এর দ্বারা বেআদবী হয়।

ময়লা আবর্জনায় আছে নাউজুবিল্লাহ। এভাবে আমরা বিস্তারিত বলি না। কারণ তখন বেআদবী হয়ে যায়। আল্লাহর শানে গুস্তাখী হয়ে যায়। কিন্তু ইজমালী তথা সংক্ষেপে আমরা বলি যে, আল্লাহর নূর সর্বত্র রয়েছে।

যে সমস্ত লা-মাযহাবী বন্ধুরা উপরোক্ত বিষয়টিকে ময়লা আবর্জনায় আছে বলে বিস্তারিত ব্যাখ্যায় গিয়ে বিষয়টিকে ঘোলাটি করার অপচেষ্টা করছেন। তাদের কাছে আমাদের প্রশ্ন

আহলে হাদীস/লা-মাযহাবীরা কি আল্লাহ তাআলা সব কিছুর স্রষ্টা বিশ্বাস করেন? নিশ্চয় বিশ্বাস করেন। এখন উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত করার ব্যাখ্যায় গিয়ে তাদের শরীরের বিশেষ অঙ্গের স্রষ্টাও আল্লাহ এভাবে উল্লেখ করে করে মানুষের সামনে বর্ণনা করেন? ময়লা আবর্জনা, নোংরা বস্তু সব কিছুর আলাদা নাম নাম উল্লেখ করে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন বলে বর্ণনা করা কি আদবী থাকে?

যখন লা-মাযহাবী ব্যক্তিরা তাদের মেয়েকে স্বামীর হাতে তুলে দেন, তখনতো সংক্ষেপে বলেন যে, আমার মেয়ের হকের দিকে খেয়াল রেখো। তখনি তার প্রতিটি হককে আলাদা আলাদা উল্লেখ করে স্বামীকে বলেন?

যদি বলে থাকেন, তাহলে তারা কি নির্লজ্জ ও বেহায়ী কাজ করেন না?

এ দু’প্রশ্নের যে জবাব হবে, ঠিক একই জবাব হবে, পায়খানা, পেশাবখানা ইত্যাদিতে বিস্তারিতভাবে আল্লাহর নূর থাকার দাবি করা।

আমরা আল্লাহর নূর সর্বত্র থাকার কথাটি সংক্ষেপে বলি। বিস্তারিত বলি না। তা বলা শোভা পায় না।

মূল বিষয়, শায়েখ জাকারিয়া রহঃ তার কিতাবে রায়পুরী রহঃ এর খাদিমের যে কথা উল্লেখ করেছেন, সেখানে আল্লাহর নূর থাকার পরিস্কারভাবে উল্লেখ করেননি, বরং শুধু লিখেছেন নূর দেখতে পাইতেন।

কারণ আল্লাহর নূর দেখতে পাইতেন, বললে তা বিস্তারিত বলা হয়ে যেতো, ফলে তা বেআদবী ও গোস্তাখীর শামিল হতো। এ কারণে তা বলা হয়নি।

কিন্তু লা-মাযহাবী বন্ধুরা চূড়ান্ত বেআদবীর পরিচয় দিয়ে কুরআন ও হাদীস সমর্থিত একটি বিষয়কে ঘোলাটে করার অপচেষ্টা করেছেন।

আল্লাহ তাআলা তাদের ষড়যন্ত্র থেকে মুসলিম উম্মাহকে হিফাযত করুন। আমীন।

অপবাদের কবলে ফাযায়েলে আমাল [পর্ব-৩]

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা-ইমাম আবূ হানীফা ইসলামী রিসার্চ সেন্টার পিরোজপুর।

ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com

আরও জানুন

অগ্রীম বাসা ভাড়ার উপর বছর অতিক্রান্ত হলে যাকাত কে দিবে?

প্রশ্নঃ মুহতারাম, অমি প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা দেওয়ার শর্তে বাড়ি ভাড়া নেই। ভাড়া নেওয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস