প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / মুসলিমদের মাঝে অনৈক্যের বিষ বাষ্প ছড়াচ্ছে কথিত সহীহ হাদীস নামধারীরা

মুসলিমদের মাঝে অনৈক্যের বিষ বাষ্প ছড়াচ্ছে কথিত সহীহ হাদীস নামধারীরা

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

ওরা আসলে কী করছে?

ইংরেজদের শাসনভার এই উপমহাদেশে সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে বসার আগে এদেশগুলোতে কোন ধর্মীয় কোন্দল ছিল না। ছিল মুসলমানদের মাঝে পারস্পরিক সম্প্রীতি। শ্রদ্ধা-ভক্তির এক অনুপম দৃষ্টান্ত। বড়দের সম্মান, ছোটদের স্নেহ করার অপূর্ব উপমা ছিল মুসলমানরা। যেই নজরকাড়া আদর্শ দেখে দলে দলে হিন্দু-বৌদ্যরা ইসলামের সুশীতল ছায়ায় ভীর জমায়। ধর্মীয় কোন্দলের কেউ কল্পনাই করতো না। এক আলেম আরেক আলেমকে গালি দিবে, মসজিদে একদল মুসলিম আরেক দল মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাবে দেদার, এটা ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। সবাই ছিল ফিক্বহে হানাফীর বিশ্ব নন্দিত কুরআন সুন্নাহর মাকবুল ব্যক্ষার একনিষ্ট অনুসারী।

ইংরেজ পশুরা মুসলমানদের এই অনুপম ভ্রাতৃত্বকে নষ্ট করার ষড়যন্ত্র শুরু করল। দাঁড় করিয়ে দিল বেরেলবীর মাধ্যমে একদল মাজারপূজারী, পীরপূজারী ফিরক্বা। অপরদিকে কাদিয়ানী ফিরক্বা। সেই সাথে শত বছরের কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক গোটা পৃথিবীতে সমাদৃত ঐতিহ্যিক মাযহাব হানাফী মাযহাবকে কলুষিত করতে নামিয়ে দিল মুহাম্মদ হোসাইন বাটালবীকে।

বেদআতিরা শুরু করে দিল কুরআন সু্ন্নাহ রেখে শুধু ব্যক্তি পূজার আরাধনা। পীরকেই সকল বিষয়ের সমাধানদাতা বানিয়ে করতে লাগল শিরক। সাধারণ মানুষকে করতে লাগল বিভ্রান্ত।

অপরদিকে কথিত আহলে হাদীস গোষ্ঠিটি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের কুরআন সুন্নাহের ব্যাখ্যা রেখে অযুর ফরয, গোসলের ফরয না জানা মুসলমানদের শিখাতে লাগল কুরআন ও হাদীসের অনুবাদ পড়েই দ্বীন পালন করতে শুরু করে দাও।

এক কথায় বেদআতিরা ছেড়ে দিল আল্লাহ ও নবীর কিতাব। আর কথিত আহলে হাদীসরা ছেড়ে দিল আল্লাহর প্রিয় বান্দা তথা রিজালুল্লাহদের।

এই প্রান্তিক দুই ফিতনার মাঝামাঝি রাসূল সাঃ এর রেখে যাওয়া পথ, “কিতাবুল্লাহ বুঝতে হবে রিজালুল্লাহ এর নির্দেশনা অনুযায়ী” মত-ও পথের ধারক রয়ে গেলেন দারুল উলুম দেওবন্দের হাক্কানী ওলামায়ে কিরামগণ।

কুরআন কারীম কিতাবুল্লাহকে বুঝাতে আল্লাহ তায়ালা রিজালুল্লাহ নবী কারীম সাঃ কে পাঠিয়েছেন, তেমনি সাহাবাদের বানিয়েছেন রিজালুল্লাহ রাসূল সাঃ এর হাদীসকে বুঝানোর জন্য। ফুক্বাহায়ে কিরামকে নির্ধারিত করেছেন আল্লাহ তায়ালার কুরআনকে বুঝতে হাদীস দিয়ে, আর হাদীস বুঝতে সাহাবাদের আমল দিয়ে। এই সকল কিছুকে মন্থন করে তারা একত্র করলেন ইসলামী ফিক্বহের ভান্ডার।

তো একদিকে দাঁড়িয়ে গেল কিতাবুল্লাহকে অস্বিকারকারীদের দল। অপরদিকে দাঁড়াল রিজালুল্লাহকে অস্বিকারকারীদের দল। মাঝখানে মধ্যপন্থী ওলামায়ে দেওবন্দ রয়ে গেলেন সত্যের অকে প্রোজ্জ্বল আলোকবর্তীকা হিসেবে।

আহলে হাদীস গ্রুপটি নিজেদের ফিতনাবাজীর সরকারী আনুকূল্য পাওয়ার জন্য ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে ৩ ই ডিসেম্বর ১৮৮৬ ঈসাব্দে পাঞ্জাব গভর্ণমেন্টের কাছ থেকে রেজিষ্ট্রশন করে। আর সি.পি গভর্নমেন্টের কাছ থেকে ১৪ই জুলাই ১৮৮৮ ঈসাব্দে, আর ইউপি গভর্ণমেন্টের কাছ থেকে ২০ই জুলাই ১৮৮৮ ঈসাব্দ, বোম্বাই গভর্ণমেন্টের কাছ থেকে ১৪ই আগষ্ট ১৮৮৮ ঈসাব্দ, মাদ্রাজ গভর্ণমেন্টের কাছ থেকে ১৫ ই আগষ্ট ১৮৮৮ ঈসাব্দ ও মাদ্রাজ গভর্ণমেন্টের কাছ থেকে ১৫ ই আগষ্ট ১৮৮৮ ঈসাব্দ, এবং বঙ্গদেশ গভর্ণমেন্টের কাছ থেকে ১৮৯০ ঈসাব্দ তারিখে দরখাস্ত মঞ্জুরী করায়। (রদ্দে গায়রে মুকাল্লিদিয়্যাত-১১/৩২-৩৯}

সেই সময় থেকে ইংরেজদের সাপোর্ট নিয়ে শুরু করে ওদের ঘৃণ্য কার্যক্রম। শুরু করে মুসলমান নামাযীর মনে সন্দেহ সৃষ্টির নোংরা প্রচারণা। মুসলমানকে সন্দিহান করে চলে সে কি হানাফী না মুহাম্মদী? এই উদ্ভট প্রশ্ন দিয়ে। বে নামাযীর পিছনে কোন মেহনত নয়, বেদ্বীনের পিছনে কোন মেহনত নয়, বরং ঈমানদার, নামাযী ব্যক্তিদের মনে ইবাদতের প্রতি সন্দেহ সৃষ্টির নীল নকশা নিয়ে কাজ করতে থাকে। শুরু করে দেয়, মুসলমানদের মাঝে ধর্মীয় বিভক্তি, কোন্দলের এক ভয়ংকর খেলা। মসজিদে মসজিদে হাঙ্গামা, এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে মুশরিক, আকাবীরে ওলামা, যারা আজীবন মেহনত করে এই হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাকে জান্নাতী পরিবেশে রুপান্তরিত করে যাচ্ছেন নিরলস প্রচেষ্টা করে, সেই সকল আল্লাহওয়ালা মানুষদের প্রতি মানুষকে করতে থাকে বিতশ্রদ্ধ। নোংরা খাট করে উপস্থাপিত করতে থাকে দ্বীনের মশালবাহী ওলামায়ে কিরামদের।

এক কথায় ধর্মীয় কোন্দল আর মুসলমানদের মাঝে অনৈক্য সৃষ্টিই ইংরেজ সৃষ্ট এই কথিত আহলে হাদীসদের কাজ।

মুকাল্লিদ কাকে বলে? আর গায়রে মুকাল্লিদ কাকে বলে?

তাক্বলীদ কাকে বলে? সহজ ভাষায়-পৃথিবীতে যত মানুষ আছে তাদের কেউ নবী দেখেনি। আমরাও কেউ দেখিনি। কিন্তু আমাদের কাছে নবীর আনীত দ্বীন আছে। আমাদের কাছে দ্বীন পৌঁছানোর জন্য নবীজী সাঃ পর্যন্ত যত মাধ্যম আছে সবাই উম্মত। কেউ নবী নয়। তাদের মাধ্যমে আমাদের পর্যন্ত দ্বীন পৌঁছেছে। তো দ্বীন পৌঁছানোকারী ঐ জামাতকে স্বীকার করে তাদের উপর নির্ভর যারা করে তাদের নাম মুকাল্লিদ। আর যারা অস্বীকার করে তাদের নাম গায়রে মুকাল্লিদ।

হযরত মুহাম্মদ আমীন সফদর রহঃ বলতেন-এক রাষ্ট্রে দুই ধরণের ব্যক্তি থাকে। এক রাজা, দ্বিতীয় প্রকার হল প্রজা। এই প্রকার ছাড়া কেউ কোন রাষ্ট্রে থাকতে পারে না। এক রাষ্ট্রে রাতের বেলা এক ব্যক্তি গ্রেফতার হলে তাকে গ্রেফতার হলে পুলিশ তাকে জিজ্ঞেস করল-“তুমি কি প্রজা? সে বলল –“না”। পুলিশ জিজ্ঞেস করল-“তাহলে কি রাজা?” । সে বলল-“না”। তখন পুলিশ বলল-“তাহলে তুমি হলে রাষ্ট্রদ্রোহী! কারণ তুমি এদেশের অধিস্তও নও, আবার প্রশাসনেও নেই। তুমিতো রাষ্ট্রদ্রোহী”।  এমনি যারা নিজেরা মুজহাদিতও নয়, আবার কারো তাক্বলীদও করে না, ওরা হল গায়রে মুকাল্লিদ। রাষ্ট্রের পরিভাষায় পুলিশ যাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে তারা আমাদের ভাষায় হল গায়রে মুকাল্লিদ।

তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ী মানেই হল মুকাল্লিদ

সাহাবায়ে কিরামের পরের জামাতের নাম হল-তাবেয়ী। অর্থ হল অনুসারী। যারা পূর্বের অনুসারী। তাদের অনুসারী এই জন্য বলা হয়, যেহেতু তারা সাহাবাদের অনুসরণ করতেন। তারা যদি সাহাবাদের অনুসারী না হতেন, তাহলে তাদের নাম হত-মুহাক্কিকীন। কিন্তু তাদের নাম রাখা হয়েছে তাবেয়ীন, সুতরাং বুঝা গেল তারা মুকাল্লিদ ছিলেন গায়রে মুকাল্লিদ নয়।

এমনিভাবে তাবে তাবেয়ীন মানে হল-তাবেয়ীদের অনুসারী। তাদেরও বলা হয় তাবে তাবেয়ী এইজন্য যে, তারা তাবেয়ীদের মুকাল্লিদ ছিলেন। তারা গায়রে মুকাল্লিদ ছিলেন না।

আমরা সাহাবাদের উপর নির্ভর করি। করি তাবেয়ীর উপর। এমনিভাবে তাবে তাবেয়ীর উপর। এমনিভাবে মুজতাহিদদের উপর। এমনিভাবে যারা আমাদের পর্যন্ত দ্বীন পৌঁছিয়েন তাদের উপর নির্ভর করি। তাই আমরা মুকাল্লিদ। আর যারা তাদের উপর নির্ভর করেনা ওরা হল গায়রে মুকাল্লিদ। ওরা কাউকে মানে না। সাহাবীকেও নয়, তাবেয়ীকেও না, তাবে তাবেয়ীকেও না।

রাসূল সাঃ এর জমানায়ই তাকলীদে শখসী ছিল, ছিল ইজতিহাদও

ইসলামী রাজত্ব যখন বেড়ে গেল রাসূল সাঃ এর জমানায়, তখন রাসূল সাঃ বিভিন্ন এলাকায় সাহাবাদের মুজতাহিদ বানিয়ে প্রেরণ করে পাঠিয়েছেন। তাদের পাঠানো এলাকার লোকদের উপর সেই সাহাবীর তাকলীদ তথা মাযহাবের অনুসরণ করা আবশ্যক।

مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- لَمَّا أَرَادَ أَنْ يَبْعَثَ مُعَاذًا إِلَى الْيَمَنِ قَالَ « كَيْفَ تَقْضِى إِذَا عَرَضَ لَكَ قَضَاءٌ ». قَالَ أَقْضِى بِكِتَابِ اللَّهِ. قَالَ « فَإِنْ لَمْ تَجِدْ فِى كِتَابِ اللَّهِ ». قَالَ فَبِسُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم-. قَالَ « فَإِنْ لَمْ تَجِدْ فِى سُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- وَلاَ فِى كِتَابِ اللَّهِ ». قَالَ أَجْتَهِدُ رَأْيِى وَلاَ آلُو. فَضَرَبَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- صَدْرَهُ وَقَالَ « الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى وَفَّقَ رَسُولَ رَسُولِ اللَّهِ لِمَا يُرْضِى رَسُولَ اللَّهِ

রাসূল সাঃ যখন মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ কে ইয়ামানে পাঠাতে মনস্ত করলেন তখন মুয়াজ রাঃ কে জিজ্ঞেস করলেন-“যখন তোমার কাছে বিচারের ভার ন্যস্ত হবে তখন তুমি কিভাবে ফায়সাল করবে?” তখন তিনি বললেন-“আমি ফায়সালা করব কিতাবুল্লাহ দ্বারা”। রাসূল সাঃ বললেন-“যদি কিতাবুল্লাহ এ না পাও?” তিনি বললেন-“তাহলে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর সুন্নাত দ্বারা ফায়সালা করব”। রাসূল সাঃ বললেন-“যদি রাসূলুল্লাহ এর সুন্নাতে না পাও?” তখন তিনি বললেন-“তাহলে আমি ইজতিহাদ তথা উদ্ভাবন করার চেষ্টা করব”। তখন রাসূল সাঃ তাঁর বুকে চাপড় মেরে বললেন-“যাবতীয় প্রশংসা ঐ আল্লাহর যিনি তাঁর রাসূলের প্রতিনিধিকে সেই তৌফিক দিয়েছেন যে ব্যাপারে তাঁর রাসূল সন্তুষ্ট”। {সূনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৩৫৯৪, সুনানে তিরমিযী, হাদিস নং-১৩২৭, সুনানে দারেমী, হাদিস নং-১৬৮, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২২০৬১}

হাদীসটির ক্ষেত্রে মুহাদ্দীনদের মন্তব্য

মুহাদ্দিস ইবনে আব্দিল বার রহঃ বলেন- صحيح مشهورতথা সহীহ ও প্রসিদ্ধ। {জামেউ বয়ানিল ইলম-২/৮৪৪}

আল্লামা ইবনে কাসীর রহঃ বলেন- حسن مشهور وقد ذكرت له طرقا وشواهدহাদীসটি প্রসিদ্ধ হাসান, আর অনেক সূত্র অনেক স্বাক্ষ্য রয়েছে। {ইরশাদুল ফক্বীহ-২/৩৯৬}

ইমাম আবু দাউদ রহঃ হাদীসটি বর্ণনা করে কোন মন্তব্য করেননি। আর তার প্রসিদ্ধ পদ্ধতি হল যে হাদীসে তিনি চুপ থাকেন, এটি তার মতে সহীহ।

আল্লামা শাওকানী রহঃ বলেন- حسن لغيره، وهو معمول بهতথা এটি হাসান লিগায়রিহী, আর এটি আমলযোগ্য হাদীস। {আল ফাতহুর রাব্বানী-৯/৪৪৮৫}

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন- إسناده جيدতথা এর সূত্র খুবই চমৎকার।{মাজমুউল ফাতওয়া-১৩/৩৬৪}

ইমাম তাহাবী রহঃ বলেন-সহীহ। {শরহু মায়ানিল আসার}

আল্লামা ইবনুল আরাবী রহঃ বলেন-হাদীসটি সহীহ। {আহকামুল কুরআন-১/৫৭৪}

আল্লামা জাহাবী রহঃ বলেন-এর সনদটা হাসান, আর অর্থটা সহীহ। {তালখীসুল ইলালিল মুতানাহিয়াহ-২৬৯}

বিস্তারিত জানতে দেখুন-

http://www.dorar.net/enc/hadith?skeys=%D9%82%D8%A7%D9%84+%D8%A3%D8%AC%D8%AA%D9%87%D8%AF+%D8%B1%D8%A3%D9%8A%D9%8A&xclude=&degree_cat0=1

হযরত মুয়াজ রাঃ এ মুখে আমি ইজতিহাদ করব, একথা শুনে রাসূল সাঃ কিন্তু আস্তাগফিরুল্লাহ পড়েননি গায়রে মুকাল্লিদদের মত। অথচ মুয়াজ রাঃ নবীজী সাঃ এর জীবদ্দশায় ইজতিহাদ করার কথা বলেছেন। আর সেখানকার ইয়ামেনের লোকেরা হযরত মুয়াজ রাঃ এর ইজতিহাদের যেন তাক্বলীদ করে সেটারই পরোক্ষ নির্দেশ দিলেন “যাবতীয় প্রশংসা ঐ আল্লাহর যিনি তাঁর রাসূলের প্রতিনিধিকে সেই তৌফিক দিয়েছেন যে ব্যাপারে তাঁর রাসূল সন্তুষ্ট” বলার মাধ্যমে।

সুতরাং নবীজী সাঃ এর জমানায়ই মুয়াজ রাঃ ইজতিহাদ করতেন, আর সে এলাকার লোকেরা তাঁর তাক্বলীদ করতেন।

গায়রে মুকাল্লিদরা বিভ্রান্ত করার জন্য বলে থাকে-তাক্বলীদ বলতে কিছু ছিলনা নবীজী সাঃ এর জমানায়। আমরা বলি শব্দ না থাকাই কি বস্তু না থাকার দলিল? যদি তাই হয়, তাহলে বলুনতো-কুরআনে কি তাওহীদ শব্দ আছে? তাহলে কি কুরআন দ্বারা তাওহীদ প্রমাণিত নয়?

দ্বীনী বিষয়ে সাহাবাদের অনুসরণ আবশ্যক

রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين عضوا عليها بالنواجذতথা তোমাদের উপর আমার সুন্নাত পালন আবশ্যক। আর হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাতও আবশ্যক। এটাকে তোমরা মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রাখ। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৪৩, সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-২৬৭৬, তাহাবী শরীফ, হাদীস নং-৪৬৮}

এই হাদীসে লক্ষ্যনীয় হল-রাসূল সাঃ সুন্নাত বলেছেন, হাদীস বলেননি। খুলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাতের কথা বলেছেন মানতে হাদীসের কথা বলেন নি।

সুতরাং বুঝা গেল খুলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাত তথা আমল আমাদের জন্য পালন করার নির্দেশ নবীজী সাঃ নিজেই দিয়ে গেলেন। এ কারণেই একজন খলীফা যখন কোন দ্বীনী কাজের সূচনা করেন সেটাকে অন্য খলীফা বন্ধ করার কোন অধিকার রাখেন না। তাই হযরত ওমর রাঃ যেই পদ্ধতি জারী করেছেন সেটা হযরত উসমান রাঃ এবং হযরত আলী রাঃ কেউ বন্ধ করেন নি। এমনিভাবে যেই সুন্নাত হযরত উসমান রাঃ শুরু করেছেন সেটাকে হযরত আলী রাঃ বন্ধ করেননি।

একটি কথা ভাল করে বুঝতে হবে হযরত ওমর রাঃ ২০ রাকাত তারাবীহ শুরু করেন নি। বরং তিনি তারাবীহের জামাতের সুন্নাত শুরু করেছেন। হযরত ওমর রাঃ যখন দেখলেন যে, মসজিদে নবীবীতে মুসলমানরা একাকী ২০ রাকাত তারাবীহ পড়ছে, তখন তিনি তাদের সবাইকে একসাথে জামাতে পড়ার জন্য একত্র করে দিলেন। ২০ রাকাতের সুন্নাত তিনি জারী করেন নি, বরং ২০ রাকাতের জামাত জারী করেছেন। যেমনটি বর্ণিত আছে সহীহ বুখারীর ১/২৬৯, হাদীস নং-১৯০৬} দেখুন মূল হাদিস

عبد الرحمن بن عبد القاري أنه قال  : خرجت مع عمر بن الخطاب رضي الله عنه ليلة في رمضان إلى المسجد فإذا الناس أوزاع متفرقون يصلي الرجل لنفسه ويصلي الرجل فيصلي بصلاته الرهط فقال عمر إني أرى لو جمعت هؤلاء على قارئ واحد لكان أمثل ثم عزم فجمعهم على أبي بن كعب (صيح البخارى-كتاب صلاة التراويح، باب فضل من قام رمضان، رقم الحديث-1906)

সুতরাং বুঝা গেল-হযরত ওমর রাঃ দ্বীনের মাঝে বৃদ্ধি করেন নি। দ্বীনের মাঝে বৃদ্ধি করা নিষিদ্ধ। এই নিষিদ্ধ হযরত ওমর রাঃ করতে পারেন না। তিনি শুধু দ্বীনকে প্রয়োগ করেছেন কোন কিছু বৃদ্ধি করেন নি।

২০ রাকাত তারাবীহের যেই সুন্নাত হযরত ওমর রাঃ করেছেন তা হযরত উসমান রাঃ বন্ধ করেননি। করেননি হযরত আলী রাঃ ও।

এমনিভাবে জুমআর দুই আজানের সুন্নাত জারী করেছেন। যা পূর্বে ছিলনা। এই সুন্নাতকে হযরত আলী রাঃ জারী রেখেছেন। যা আজো জারী আছে। সে সময় কোন গায়রে মুকাল্লিদ ছিলনা। তাই হযরত উসমান রাঃ এর এজতিহাদী সীদ্ধান্তের বিরোধিতা কেউ করেনি। অথচ হযরত উসমান রাঃ তার এই কর্মের পক্ষে কোন কুরআন সুন্নাহর দলিল পেশ করেন নি। তারপরও সকল সাহাবায়ে বিনা বাক্যব্যয়ে তা মেনে নিয়েছেন। এরই নাম তাক্বলীদ। বুখারী শরীফে এসেছে-তখন এই বিষয়টি ধার্য হয়ে গেল। {বুখারী শরীফ, হাদীস নং-৮৭৪, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-১০৮৯}

সাহাবায়ে কেরাম সবাই মেনে নিলেন। সুতরাং আমরা কারা? যারা বলল যে, এটা মানিনা!

যারা বলে আমরা সাহাবাদের চেয়ে দ্বীন বেশি বুঝ ওরা বেদ্বীন

যারা বলে যে, আমরা সাহাবীদের চে’ দ্বীন বেশি বুঝি, সে বদদ্বীন। যেমন যে ব্যক্তি বলে যে, সে সাহাবীদের চে’ নবীজী সাঃ কে বেশি ভালবাসে, সে যেমন বদদ্বীন। এমনি যারা বলে যে, সাহাবাদের রেখে নবী থেকে দ্বীন বুঝতে চায় তারাও বদ দ্বীন। যে কাজটি করে থাকে গায়রে মুকাল্লিদরা। ওরা সাহাবাদের ব্যাখ্যা রেখে দ্বীনকে বুঝতে চায়।

নবীজী সাঃ দাড়িকে বড় রাখতে বলেছেন, কাটতে কোথাও বলেন নি। এর দ্বারা কি উদ্দেশ্য? হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাঃ এক মুষ্টির পর দাড়ির কেটে ফেলতেন। সুতরাং বুঝা গেল দাড়ি বড় রাখার সীমা হল এক মুষ্টি। সাহাবাদের আমল দলিল না হলে হাদীস মতে দাড়ি বড় রাখতে শুরু করলে সেটা মাটিতে গিয়ে পড়বে।

হযরত ওমর রাঃ এর ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে “নিশ্চয় শয়তান তোমাকে ভয় পায় হে ওমর!” {সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-৩৬৯০}  সুতরাং যেই মাসআলা হযরত ওমর রাঃ বলেন-সেই পথেও শয়তান নেই। হযরত ওমর রাঃ ২০ রাকাত তারাবীহের ফাতওয়া দিয়েছেন। সুতরাং এই মাসআলায় শয়তানের ওয়াসওয়াসা নাই। হযরত ওমর রাঃ যখন এক বারে তিন তালাক দিলে তিন তালাক পতিত বর্ণনা করেছেন তখন সেই মাসআলায় শয়তানের কোন দখল নাই। কারণ শয়তান হযরত ওমর রাঃ এর পথে আসার সাহস পায়না। রাসূল সাঃ আরো ইরশাদ করেছেন-যদি আমার পর কোন নবী হত তাহলে ওমর হত নবী। {সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-৩৬৮৬}

রাসূল সাঃ এর এসব নির্দেশনাই প্রমাণ করে হযরত ওমর রাঃ এর ফাতওয়া ও তার জারী করা সুন্নাতের গুরুত্ব কত বেশি।

ওরা সালাফী না খালাফী

গায়রে মুকাল্লিদরা নিজেদের সালাফী বলা ঠিক নয়। কারণ-সালাফ বলা হয় পূর্বসূরীকে যারা মানে। কিন্তু ওরা আসলে কোন সালাফকেই মানে  না। যেমন যদি বলা হয়-গায়রে মুকাল্লিদ আলেম আব্দুর রহমান মোবারকপুরী তুহফাতুল আহওয়াজীতে লিখেন-মোজার উপর মাসাহ করার হাদীস ঠিক নয়, ওরা বলে-আমরা ওকে মানি না”।

যদি বলা হয়-আপনাদের কিতাব আওনুল মাবুদে শামছুল হক আজিমাবাদী লিখেন-“পয়গম্বর স্বীয় কবরে জিবীত থাকেন, আর যে রুকু পায় সে ঐ রাকাত পেয়েছে বলে ধর্তব্য হবে”। ওরা বলবে-আমরা একে মানি না।

তারপর যদি বলেন-আল্লামা শাওকানী তার কিতাব নাইলুল আওতারে লিখেছেন-“রুকু যিনি পান, তিনি সেই রাকাত পেয়েছেন বলে ধর্তব্য হবে, এবং নবীরা কবরে জিবীত”। ওরা বলবে-আমরা তাকেও মানি না।

যদি বলা হয়-শায়েখ ইবনে তাইমিয়া-২০ রাকাত তারাবীকেই প্রাধান্য দিয়েছেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ মাজমুআ ফাতওয়া ইবনে তাইমিয়াতে। ওরা বলবে-আমরা তাকেও মানি না।

যদি আরো উপরে গিয়ে বলা হয় যে, ইমাম বুখারী ১ নং খন্ডে ৭৪১ পৃষ্ঠায় তিনি বলেছেন-এক মজলিশে ৩ তালাক দিলে ৩ তালাকই হয়, ওরা বলবে যে, আমরা তাকেও মানি না। আর হযরত ইমাম মুসলিম রহঃ বলেন-যখন কিরাত পড়া হয়, তখন চুপ থাক। ওরা বলবে যে, আমরা তাকেও মানি না।

যদি আরো উপরে গিয়ে বলা হয়-ইমাম আবু হানীফা রহঃ ইমাম শাফেয়ী মাসায়েল বলেছেন। ওরা বলবে-আমরা তাদেরও মানি না।

যদি বলা হয়, আরো উপরে গিয়ে হযরত ওমর রাঃ তারাবীহ ২০ রাকাত বলেছেন, এবং ৩ তালাককে ৩ তালাক বলে ফাতওয়া দিয়েছেন। ওরা বলবে-আমরা তাকেও মানি না।

এবার বলুনতো-পূর্ণ উম্মতের মাঝে সালাফ [পূর্ববর্তী] আছে কে? যাকে তারা মানে? ওরা সালাফী? না খালাফী [পরবর্তী]?

শুধু সহীহ হাদীস দেখলেই তা আমলযোগ্য হলে দ্বীন আর দ্বীন থাকবে না

শুধু হাদীস সহীহ হলেই তা আমলযোগ্য হয়ে যায় না। বরং এর মাঝে অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে হবে এ ব্যাপারে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী।

১-বুখারী মুসলিমে এসেছে যে, রাসূল সাঃ জুতাসহ নামায পড়তেন জুতা পরিহিত অবস্থায় কেন ওরা নামায পড়ে না?

২-সহীহ হাদীসে নেকাহে মুতআ জায়েজের কথা আছে।

মুর্খতার কারণে সহীহ দেখে যদি আমল করে তাহলে বলবে নেকাহে মুতআ জায়েজ।

৩-সহীহ হাদীসে কেবল দাড়ি লম্বা করার নির্দেশ আছে,কোথাও কাটার কথা নাই। যদি সহীহ হাদীস মানতে যান,তাহলে আপনি জীবনেও দাড়ি কাটতে পারবেন না। দাড়িতে হাত দেবার কোন অধিকার আপনার নেই সহীহ হাদীসের উপর আমল করতে চাইলে।

৪-সহীহ হাদীস দ্বারা প্রশ্রাব খাওয়া জায়েজ প্রমাণিত। শুধু চোখ বন্ধ করে সহীহ হাদীস মানলে প্রশ্রাব খাওয়া জায়েজ বলতে হবে।
এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে যা সহীহ বর্ণনায় এসেছে,কিন্তু তা আমলযোগ্য নয়।সবাইকে কুরআন সু্নাহ থেকে আমল করতে বললে কি অবস্থা হবে দ্বীনের একবার ভাবা যায়?

কথিত আহলে হাদীসের ঈমান নবীর উপর নাকি শর্তের উপর?

“কাফেররা নবীর উপর বিশ্বাস রাখেনি, রেখেছে তাদের দাবিকৃত বিষয়ের উপর। এমনিভাবে আপনারা মন থেকে এই কথা দূরিভূত করে দিন যে, গায়রে মুকাল্লিদদের ঈমান নবী সাঃ এর উপর। কখনোই নয়। বরং তাদের ঈমান হল ইমামদের শিখানো শর্তের উপর।

যেমন কাফেররা নবী সাঃ কে বলত যে, ‘যা আমরা বলছি, তা আল্লাহ তায়ালা থেকে বলিয়ে নাও। অথবা আল্লাহ তায়ালা থেকে করিয়ে নাও। যদি এমন করতে পার তাহলে তা মানব। নতুবা নয়। এমনিভাবে গায়রে মুকাল্লিদ কথিত আহলে হাদীসরা  একটি বিষয় উত্থাপন করে দেয়, আর বলে যে, এর হুবহু শব্দ আল্লাহর নবী সাঃ থেকে বলিয়ে নাও। তাহলে আমরা মানব। নতুবা এর আগে নবীজী সাঃ যা কিছু নিজে বলেছেন তা আমরা মানবনা”।

প্রিয় ভাইয়েরা! একবার খেয়াল করে দেখুন।গায়রে মুকাল্লদদের আপনি যতই সহীহ হাদীস দেখান না কেন।ওদের শর্ত অনুযায়ী না হলে তারা তা মানবে না।বলবে, বুখারীতে দেখাও, মুসলিমে দেখাও।নতুবা সিহাহ সিত্তায় দেখাও।নুতবা মানব না।যদিও হাদীসটি সহীহ হয়।

এর মানে এই দাঁড়ায় যে, ওরা যেন নবীজী সাঃ কে পরামর্শ দিচ্ছে যে, আপনি যদি এরকম শব্দে হাদীস বলেন, আর তা ইমাম বুখারী বা ইমাম মুসলিম বা সিহাহ সিত্তায় স্থান পায় তাহলে আমরা মানব, নতুবা আপনার কথা ডাষ্টবিনে নিক্ষেপ করব” নাউজুবিল্লাহ।

একটি ধোঁকাবাজী প্রশ্ন

ইংরেজদের দোসর গায়রে মুকাল্লিদরা মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রশ্ন করে থাকে যে,ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর মাযহাবের আগের মানুষ কোন মাযহাবের অনুসরণ করতো?

ওদের জিজ্ঞেস করুন-বুখারী শরীফ,মুসলিম শরীফ,আবু দাউদসহ সিহাহ সিত্তার কিতাব লিখার আগে কোন হাদীস ছিল? তখন কি সহীহ হাদীস ছিলনা? তখনকার মানুষ কি সহীহ হাদীসের উপর আমল করেন নি? যেই তিন জমানাকে রাসূল সাঃ শ্রেষ্ঠ জমানা বলেছেন, সেই তিন জমানায় সহীহ হাদীসের উপর আমল হয়নি? বুখারী মুসলিমসহ সিহাহ সিত্তাহ সংকলিত না হবার কারণে?

বুখারী মুসলিম সংকলিত হবার আগে যেমন তখনকার মানুষ বিক্ষিপ্ত সহীহ হাদীসের উপর আমল করতেন, তেমনি ইমাম আবু হানীফা রঃ, ইমাম শাফেয়ী রহঃ, ইমাম মালেক রহঃ, ইমাম আহমাদ রহঃ মাসায়েল সংকলিত করে সুবিন্যাস্ত করার আগে বিক্ষপ্ত মাসাআলাকে একত্র করেছেন।কোন নতুন মাসআলা বাড়াননি।

হযরত উসমান রাঃ এর আমলের আগে ৭ কিরাতে কুরআন পড়া হতো।যখন হযরত উসমান রাঃ এক কিরাতে কুরআন একত্র করলেন।তখন এটি আবশ্যক হয়ে গেল।গোটা পৃথিবীতে সেই একই পদ্ধতিতে কিরাত পড়া হয় কুরআনের।তো কি দাঁড়াল? বিক্ষিপ্ত কেরাতকে হযরত উসমান রাঃ এক করে দিলেন।

এমনি চার মাযহাবের অবস্থা।বিক্ষিপ্ত মাসায়েলকে একত্র করেছেন নতুন কোন বিষয় জারি করেন নি।

এখন সময় এসেছে ওদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলার।সোচ্চার হওয়ার।বয়কট করতে হবে ওদের সর্ব প্রকার সামাজিক অবস্থান থেকে।আল্লাহ তায়ালা আমাদের এই ভয়ংকর ফিতনা থেকে বাঁচার তৌফিক দান করুন।

আরও জানুন

আমাদের নবী কি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী নন?

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। কোন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস