প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / মসজিদে ইতিকাফ না করলে মহিলাদের ইতিকাফ হবে না? ডাঃ জাকির নায়েকের ভ্রান্ত বক্তব্যের জবাব

মসজিদে ইতিকাফ না করলে মহিলাদের ইতিকাফ হবে না? ডাঃ জাকির নায়েকের ভ্রান্ত বক্তব্যের জবাব

প্রশ্ন

আসসালামু আলাইকুম।

আপনাদের আহলে হক মিডিয়ার ওয়েব পেইজ পড়ে অনেক কিছু জানতে পারছি। এই ঋণ শোধ করার কোন উপায় নেই। আল্লাহ আপনাদের এই দ্বীনী খিদমাতের বিনিময়ে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। এই দুআ করি।

আমি জাকির নায়েকের লেকচান শুনি। তবে উদ্দেশ্য হল উনি দ্বীনে ইসলামের ব্যাপারে কী কী ভুল মাসায়েল দিচ্ছেন এ বিষয়ে জানার জন্য।

গত কিছুদিন আগে উনার একটা লেকচারে জানতে পারলাম, উনি লেকচারে ফাইনাল ষ্টেইটম্যান বলছেন যে, মহিলারা বাসায় ইতিকাফ করতে পারবে না।

এতেকাফের জন্য মসজিদ একটা শর্ত।

মহিলা সাহাবী বিশেষ করে হযরত আয়শা রাঃ এর হাদীস। সহীহ বুখারী ৩য় খন্ডের, ইতিকাফ অধ্যায়, হাদীস নং ২০২৬ এবং পবিত্র কুরআনের বাকারা ১৮৭।

কুরআন ও হাদীসের আলোকে জানতে চাচ্ছি। দয়া করে একটু সময় করে উত্তর জানাবেন।

[ইংরেজী শব্দে করা প্রশ্নটি বুঝার সুবিধার্তে হুবহু বাংলা শব্দে পরিবর্তন করে দেয়া হল। কর্তৃপক্ষ]

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الريحم

আল্লাহ তাআলা আপনাকেও কবুল করুন। আমাদের প্রতি আপনার দ্বীনের জন্য ভালবাসা উভয়ের নাজাতের উসিলা হোক। আমীন।

জাকির নায়েক সাহেবের উপরোক্ত বক্তব্য সঠিক নয়। মহিলাদের মসজিদে ইতিকাফ করার চেয়ে বাড়িতে তার নিজের ঘরে ইতিকাফ করাই সর্বোত্তম। যদিও মসজিদে পর্দার সাথে ইতিকাফ করলেও আদায় হবে।

তবে মহিলাদের ইতিকাফের সর্বোত্তম স্থান হল নিজের আপন ঘর। যেমন মহিলাদের নামাযের উত্তম স্থান হল নিজের আপন ঘর। মসজিদ নয়।

জাকির নায়েক সাহেব দাবী করলেন, মহিলাদের ইতিকাফ মসজিদে হওয়াই শর্তারোপ করেছেন। তার এ দাবীর পক্ষে যে দু’টি দলীল দিয়েছেন। আমরা প্রথমে তা দেখে নেই। প্রথমে আয়াতটি দেখিঃ

أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَىٰ نِسَائِكُمْ ۚ هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ ۗ عَلِمَ اللَّهُ أَنَّكُمْ كُنتُمْ تَخْتَانُونَ أَنفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنكُمْ ۖ فَالْآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ ۚ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ۖ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ ۚ وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ ۗ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَقْرَبُوهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ [٢:١٨٧]

রোযার রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ অবগত রয়েছেন যে, তোমরা আত্নপ্রতারণা করছিলে, সুতরাং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন এবং তোমাদের অব্যাহতি দিয়েছেন। অতঃপর তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর এবং যা কিছু তোমাদের জন্য আল্লাহ দান করেছেন, তা আহরন কর। আর পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত। আর যতক্ষণ তোমরা এতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে বর্ণনা করেন আল্লাহ নিজের আয়াত সমূহ মানুষের জন্য, যাতে তারা বাঁচতে পারে। [সূরা বাকারা-১৮৭]

উপরোক্ত আয়াতের কোন অংশ দিয়ে জাকির নায়েক সাহেব মহিলাদের ইতিকাফ শুদ্ধ হবার জন্য মসজিদকেই আবশ্যক বানালেন?

উক্ত আয়াতের কোথাও কি মহিলাদের মসজিদে ইতিকাফের কথা এসেছে?

আয়াতে রোযাদারের বিধান, এবং ইতিকাফকারীর বিধান বলা হয়েছে। ইতিকাফকারীর ক্ষেত্রে এসেছে, তোমরা ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিশো না।

অর্থাৎ ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করতে নিষেধ করা হয়েছে।

আর এ মেলামেশার জন্য মহিলাদের মসজিদে ইতিকাফ করার কী প্রয়োজন? এছাড়া কী হতে পারে না?

সহজ কথায়, উক্ত আয়াতে কারীমার কোথায় মহিলাদের ইতিকাফ শুদ্ধ হতে হলে মসজিদেই থাকতে হবে, এমন কোন কথা বর্ণিত হয়নি।

সুতরাং জাকির নায়েক সাহেব তার একটি ভ্রান্ত দাবী করে উক্ত আয়াতকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করে একটি প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন মাত্র।

এবার আমরা তার রেফারেন্স দেয়া বুখারীর বর্ণনাটি দেখে নেই।

عَنْ عَائِشَةَ  رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، – زَوْجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -: «أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، كَانَ يَعْتَكِفُ العَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ، ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ»

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মিণী আম্মাজান হযরত আয়শা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন। তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-২০৩৬]

প্রথমত “মসজিদ ছাড়া মহিলাদের ইতিকাফ হবে না” এমন কথা উক্ত হাদীসের কোথাও নেই।

দ্বিতীয়ত “মহিলাদের মসজিদেই ইতিকাফ করতে হবে” এমন কোন নির্দেশনাও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে উক্ত হাদীসে বিদ্যমান নেই।

তৃতীয়ত নবীজীর বিবি আমাদের আম্মাজনগণ মসজিদেই ইতিকাফ করেছিলেন এই বিষয়টিও উক্ত হাদীসে পরিস্কার নয়।

তাহলে উক্ত হাদীস পেশ করে “মহিলাদের মসজিদেই ইতিকাফ করতে হবে,এছাড়া তাদের ইতিকাফ শুদ্ধ হবে না” এমন দাবী করা অজ্ঞতা বৈ আর কী হতে পারে?

এবার আমরা বুখারী শরীফে উপরোক্ত হাদীসের পর بَابُ اعْتِكَافِ النِّسَاءِ তথা মহিলাদের ইতিকাফ অধ্যায় শিরোনামে যে অধ্যায় আনা হয়েছে, সেখানে বর্ণিত হাদীসটি আমরা দেখে নেই!

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، قَالَتْ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَعْتَكِفُ فِي العَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ، فَكُنْتُ أَضْرِبُ لَهُ خِبَاءً فَيُصَلِّي الصُّبْحَ ثُمَّ يَدْخُلُهُ، فَاسْتَأْذَنَتْ حَفْصَةُ عَائِشَةَ أَنْ تَضْرِبَ خِبَاءً، فَأَذِنَتْ لَهَا، فَضَرَبَتْ خِبَاءً، فَلَمَّا رَأَتْهُ زَيْنَبُ ابْنَةُ جَحْشٍ ضَرَبَتْ خِبَاءً آخَرَ، فَلَمَّا أَصْبَحَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى الأَخْبِيَةَ، فَقَالَ: «مَا هَذَا؟» فَأُخْبِرَ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَلْبِرَّ تُرَوْنَ بِهِنَّ» فَتَرَكَ الِاعْتِكَافَ ذَلِكَ الشَّهْرَ، ثُمَّ اعْتَكَفَ عَشْرًا مِنْ شَوَّالٍ

‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,রমযানের শেষ দশকে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফ করতেন। আমি তাবু তৈরী করে দিতাম। তিনি ফজরের সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করে তাতে প্রবেশ করতেন। (নবী সহধর্মিণী) হাফসা (রাঃ) তাঁবু খাটাবার জন্য ‘আয়িশা (রাঃ) এর কাছে অনুমতি চাইলেন। তিনি তাঁকে অনুমতি দিলে হাফসা (রাঃ) তাবুঁ খাটালেন। (নবী সহধর্মীণী) যয়নাব বিনতে জাহশ (রাঃ) তা দেখে আরেকটি তাবু তৈরি করলেন। সকালে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুঁগুলো দেখলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন এগুলো কি? তাকে জানানো হলে তিনি বললেনঃ তোমরা কি মনে কর এগুলো দিয়ে নেকি হাসিল হবে? এ মাসে তিনি ইতকিাফ ত্যাগ করলেন এবং পরে শাওয়াল মাসে ১০ দিন (কাযা স্বরুপ) ইতিকাফ করেন। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-২০৩৩, ইফাবা, হাদীস নং-১৯০৫]

হাদীসটি পড়ুন। ভাল করে পড়ুন। মনযোগ দিয়ে দেখুনতো কী এসেছে হাদীসে?

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দেখলেন হযরত হাফসা রাঃ এবং হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ রাঃ মসজিদে ইতিকাফ করতে তাবু টানালেন। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্ষিপ্ত হয়ে বললেনঃ তোমরা কি মনে কর এগুলো দিয়ে নেকি হাসিল হবে?

এরপর তিনি রাগ করে সেই বছর রমজানে ইতিকাফই করেননি।

এর মানে কী? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কী শিক্ষা দিলেন? মহিলারা মসজিদে ইতিকাফ করলে নবীজী এতে রাজী? নাকি অসন্তুষ্ট?

মহিলারা মসজিদে ইতিকাফ করলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতটাই ক্ষিপ্ত হয়েছেন যে, তিনি সে বছর ইতিকাফই ছেড়ে দিয়েছেন।

শুধু কি তাই? তিনি প্রশ্ন করেছেন এভাবে মহিলারা মসজিদে ইতিকাফ করলে কি সওয়াবের ভাগিদার হবে? অর্থাৎ মসজিদে ইতিকাফ করলে বেশি সওয়াব হবার যে অলীক ধারণা করা হয়েছিল তা ভুল। বরং বাড়িতে ইতিকাফ করলেই মহিলাদের জন্য বেশি সওয়াব হয়।

তাহলে বুখারীর হাদীস আমাদের কাছে পরিস্কার। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদের মসজিদে ইতিকাফকে মারাত্মকভাবে অপছন্দ করেছেন। সেই সাথে একাজ সওয়াবের কাজ নয় মর্মেও সতর্ক করেছেন।

সুতরাং মহিলাদের মসজিদে ইতিকাফ করা জায়েজ হলেও মোটেও উত্তম নয়। বরং বাড়িতে, নিজের ঘরে ইতিকাফ করাই অধিক সওয়াবের মাধ্যম। সেই সাথে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ মান্য করা হয়। তাই মসজিদে নয়। মহিলাদের আপন ঘরেই ইতিকাফ করা উচিত।

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com

আরও জানুন

অগ্রীম বাসা ভাড়ার উপর বছর অতিক্রান্ত হলে যাকাত কে দিবে?

প্রশ্নঃ মুহতারাম, অমি প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা দেওয়ার শর্তে বাড়ি ভাড়া নেই। ভাড়া নেওয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস