প্রচ্ছদ / অপরাধ ও গোনাহ / রোবট তৈরী ও পুতুলের বিধান

রোবট তৈরী ও পুতুলের বিধান

প্রশ্ন

আসসালামু আলাইকুম
নাম:মুজাহিদ ইসলাম রায়হান
রংপুর, বাংলাদেশl
প্রশ্ন :
১) বর্তমানে কিছু  রোবট  মানুষের আকৃতিতে তৈরী করা হচ্ছে♩এগুলো কি মুর্তির পর্যায়ে পরে? ঘরে রাখা যাবে?

2) শিশুদের খেলনা স্বরুপ যেসব পুতুল মানব  আকৃতির বা অন্য প্রানীর আকৃতির সেগুলোর সম্পর্কে বিধান কি?

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

রোবট মূলত একটি যন্ত্র। যদি সেটি যন্ত্রের পর্যায়ে রাখা হয়, তাহলে তা নির্মাণে কোন সমস্যা আছে বলে হচ্ছে না। কিন্তু যদি তাতে মানুষের আকৃতি দেয়া হয়, তাহলে অবশ্যই তা মূর্তির আওতাধীন হয়ে হারাম হয়ে যাবে।

বিষয়টি আরো পরিস্কার করে বললে বলা যায়, যদি রোবটের চেহারা তথা চোখ, কান নাক ইত্যাদির মাধ্যমে মুখের অবয়ব না দেয়া হয়, শুধুই শরীর ইত্যাদির আকৃতি প্রদান করা হয়, তাহলে তা পূর্ণ মানুষের আকৃতি পাচ্ছে না।

একটি হাদীসে প্রাণীর ছবির মাথা কেটে ফেললে তা বৈধতার পর্যায়ভূক্ত হয় বলে পরিস্কার এসেছে। সেই হিসেবে চেহারাহীন রোবটের বৈধতার অনুমতিই অনুমেয় হচ্ছে।

তবু বড় কোন মুফতীদের কাছে বিষয়টি আরো তাহকীক করে নেবার অনুরোধ থাকবে।

মানব বা প্রাণী আকৃতির পুতুল ঘরে ঢুকানো আর মূর্তি প্রবেশ করানো একই বিধান। এসবই হারাম।

বাচ্চাদের খেলনা স্বরূপও এসব মানব আকৃতি বা প্রাণীর পুতুল ব্যবহার বৈধ নয়।

দলীল

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা নগরীতে প্রবেশ করলেন তখন বাইতুল্লাহর আশে পাশে তিনশ ষাটটি মূর্তি বিদ্যমান ছিল। তিনি প্রত্যেক মূর্তির দিকে হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করছিলেন এবং বলছিলেন:

جاء الحق وزهق الباطل، إن الباطل كان زهوقا، جاء الحق وما يبدئ الباطل وما يعيد.

সত্য এসেছে, মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল। সত্য আগমন করেছে আর মিথ্যা না পারে কোনো কিছু সূচনা করতে, না পারে পুনরাবৃত্তি করতে। (সহীহ বুখারী হা. ২৪৭৮, ৪২৮৭, ৪৭২০; সহীহ মুসলিম হা. ১৭৮১)

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর বর্ণনায় এসেছে যে, লাঠির শুধু ইঙ্গিতের দ্বারাই মূর্তিগুলো ধরাশায়ী হচ্ছিল।

[সীরাতে ইবনে হিশাম খ  : ৭, পৃষ্ঠা : ১১৪ (আররওযুল উনুফ-এর সঙ্গে মুদ্রিত সংস্করণ) তারীখুল ইসলাম শামসুদ্দীন যাহাবী খ  : ২ পৃষ্ঠা : ৩১৮ ইবনে ইসহাকের উদ্ধৃতিতে, দি লাইফ অব মোহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অনুবাদে আলফ্রেড গিয়োম পৃ. ৫৫২]

এই কথাটা হযরত জাবির রা-এর হাদীসেরও এসেছে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা হাদীস : ৩৮০৬)

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইতুল্লাহ্য় প্রবেশ করে ইবরাহীম আ. ও মারইয়াম রা.-এর ছবি দেখলেন। তখন তিনি বললেন, এঁরা তো (যাদের চিত্র এই লোকেরা অঙ্কন করেছে) (আল্লাহর এই বিধান) শুনেছেন যে, ফেরেশতারা সে গৃহে প্রবেশ করেন না, যাতে কোনো চিত্র থাকে। (সহীহ বুখারী হা. ৩৩৫১;সহীহ ইবনে হিববান  হা. ৫৮৫৮)

হযরত আমর ইবনে আবাসা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে প্রেরণ করেছেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার, মূর্তিসমূহ ভেঙ্গে ফেলার এবং এক আল্লাহর ইবাদত করার ও তাঁর সঙ্গে অন্য কিছুকে শরীক না করার বিধান দিয়ে।’ (সহীহ মুসলিম হা. ৮৩২)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إن الذين يصنعون هذه الصور يعذبون يوم القيامة يقال لهم : أحيوا ما خلفتم.

‘যারা এই সব প্রতিকৃতি প্রস্ত্তত করে তাদেরকে কিয়ামতের দিন আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। তাদেরকে বলা হবে, যা তোমরা সৃষ্টি করেছিলে তাতে প্রাণ সঞ্চার কর।’ (সহীহ বুখারী হা. ৫৯৫১; সহীহ মুসলিম হা. ২১০৭)

মুসলিম ইবনে সুবাইহ্ বলেন- ‘আমি মাসরূকের সঙ্গে একটি ঘরে ছিলাম যেখানে মারইয়াম রা.-এর প্রতিকৃতি ছিল। মাসরূক জিজ্ঞাসা করলেন,এটা কি কিসরার প্রতিকৃতি? আমি বললাম, না, এটি মারইয়াম রা.-এর প্রতিকৃতি। তখন মাসরুক বললেন-

سمعت عبد الله ابن مسعود يقول : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : أشد الناس عذابا يوم القيامة المصورون.

আমি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে (রা.) বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, প্রতিকৃতি প্রস্ত্ততকারীরা কেয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন আযাবের মুখোমুখি হবে। (সহীহ মুসলিম হা. ২১০৯)

আবু যুরআ রাহ বলেন-

دخلت مع أبي هريرة في دار مروان، فرأى فيها التصاوير، فقال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : قال الله عز وجل : ومن أظلم ممن ذهب يخلق خلقا كخلقي فليخلقوا ذرة، وليخلقوا حبة، أو ليخلقوا شعيرة.

আমি আবু হুরায়রা রা.-এর সঙ্গে মারওয়ানের গৃহে প্রবেশ করলাম। সেখানে কিছু চিত্র তাঁর দৃষ্টিগোচর হল। তিনি তখন বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাআলা বলেন-

ومن أظلم ممن ذهب يخلق خلقا كخلقي

ওই লোকের চেয়ে বড় জালেম আর কে যে আমার সৃষ্টির মতো কোনো কিছু সৃষ্টি করতে চায়। (তাদের যদি সামর্থ্য থাকে তবে) সৃষ্টি করুক একটি কণা, একটি শষ্য কিংবা একটি যব! (সহীহ মুসলিম হা. ২১১১; সহীহ বুখারী হা. ৫৯৫৩)

হযরত আবু তলহা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لا تدخل الملائكة بيتا فيه كلب ولا تصاوير

 ‘ওই গৃহে ফেরেশতারা প্রবেশ করেন না যাতে কুকুর বা ছবি রয়েছে।’ (সহীহ বুখারী ৫৯৪৯; সহীহ মুসলিম হা. ২১০৬)

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لا تدخل الملائكة بيتا فيه تماثيل أو تصاوير

 ‘ফেরেশতারা ওই ঘরে প্রবেশ করেন না যাতে মূর্তি বা ছবি রয়েছে।’ (সহীহ মুসলিম ২১১২)

১০

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন-

سمعت محمدا صلى الله عليه وسلم يقول : من صور صورة في الدنيا كلف يوم القيامة أن ينفخ الروح وليس بنافخ.

আমি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, যে কেউ দুনিয়াতে কোনো প্রতিকৃতি তৈরি করবে তাকে কিয়ামতের দিন বাধ্য করা হবে যেন সে তাতে প্রাণ সঞ্চার করে, অথচ সে তা করতে সক্ষম হবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৫৯৬৩; সহীহ মুসলিম হা. ২১১০)

১১

সায়ীদ ইবনে আবুল হাসান রাহ. বলেন-

كنت عند ابن عباس إذ جاءه رجل، فقال : يا ابن عباس! إني رجل إنما معيشتي من صنعة يدي، وإني أصنع هذه التصاوير، فقال ابن عباس : لا أحدثك إلا ما سمعت من رسول الله صلى الله عليه وسلم، سمعته يقول : من صور صورة فإن الله معذبه حتى ينفخ فيه الروح، وليس بنافخ فيه أبدا، فربا الرجل ربوة شديدة وأصفر وجهه، فقال : ويحك، إن أبيت إلا أن تصنع فعليك بهذا الشجر، كل شيء ليس فيه روح.

আমি (হযরত আব্দুল্লাহ) ইবনে আববাস রা.-এর কাছে বসা ছিলাম। ইতিমধ্যে একজন লোক এসে তাঁকে বলল, হে ইবনে আববাস, আমি একজন হস্তশিল্পী, হাতে তৈরি প্রতিকৃতির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করি। (এই পেশা কি বৈধ?) হযরত ইবনে আববাস রা. বললেন, আমি শুধু তোমাকে সে কথাই বলব, যা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছ থেকে শুনেছি। আমি তাকে বলতে শুনেছি, ‘যে কেউ কোনো প্রতিকৃতি তৈরি করে আল্লাহ তাআলা তাকে আযাব দিবেন যে পর্যন্ত না সে তাতে প্রাণ দান করে, অথচ সে প্রাণ দান করতে পারবে না।’ একথা শুনে সে অস্থির হয়ে পড়ল এবং তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তখন হযরত ইবনে আববাস রা. বললেন, ‘প্রতিকৃতিই যদি তৈরি করতে হয় তবে প্রাণহীন বস্তুর প্রতিকৃতি তৈরি করবে। (সহীহ বুখারী হা. ২২২৫)

১২

হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন-

قدم رسول الله عليه وسلم من سفر، وقد سترت سهوة لي بقرام فيه تماثيل، فلما رأه رسول الله صلى الله عليه وسلم هتكه، وقال : أشد الناس عذابا يوم القيامة الذين يضاهون بخلق الله، قالت : فقطعناه فجعلناه وسادة أو وسادتين.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সফর থেকে ফিরলেন। আমি কক্ষের দ্বারে একটি পর্দা ঝুলিয়ে ছিলাম, যাতে ছবি অঙ্কিত ছিল। তিনি  তা খুলে ফেললেন এবং বললেন, কিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠিন আযাব দেওয়া হবে যারা আল্লাহর সৃষ্টি বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য গ্রহণ করে।’ উম্মুল মু’মিনীন বলেন, তখন আমরা তা কেটে ফেললাম এবং একটি বা দুইটি বালিশ বানালাম। (সহীহ বুখারী হা. ৫৯৫৪; সহীহ মুসলিম হা. ২১০৭)

১৩

আবু হুরায়রা রা. বলেন-

استأذن جبريل عليه السلام على النبي صلى الله عليه وسلم فقال : كيف أدخل وفي بيتك ستر فيه تصاوير، فإما أن تقطع رؤوسها أو تجعل بساطا يوطأ، فإنا معشر الملائكة لا تدخل بيتا في تصاوير.

একদিন জিব্রীল আ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসার অনুমতি চাইলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ভিতরে আসুন। জিব্রীল আ. বললেন, কীভাবে আসব, আপনার গৃহে ছবিযুক্ত পর্দা রয়েছে। আপনি হয়তো এই ছবিগুলোর মাথা কেটে ফেলুন কিংবা তা বিছানায় ব্যবহার করুন, যা পদদলিত হবে। কেননা,আমরা ফেরেশতারা ওই গৃহে প্রবেশ করি না যাতে ছবি থাকে।’ (সুনানে নাসায়ী হা. ৫৩৬৫; সহীহ ইবনে হিববান ৫৮৫৩)

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

মুহাদ্দিস-জামিয়া উবাদা ইবনুল জাররাহ, ভাটারা ঢাকা।

ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com

আরও জানুন

অগ্রীম বাসা ভাড়ার উপর বছর অতিক্রান্ত হলে যাকাত কে দিবে?

প্রশ্নঃ মুহতারাম, অমি প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা দেওয়ার শর্তে বাড়ি ভাড়া নেই। ভাড়া নেওয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস