প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / উম্মাহের ঐক্য পথ ও পন্থাঃ মতভিন্নতার মাঝেই সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতিতে সহাবস্থানের উদাত্ব আহবান

উম্মাহের ঐক্য পথ ও পন্থাঃ মতভিন্নতার মাঝেই সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতিতে সহাবস্থানের উদাত্ব আহবান

আল্লামা মুফতী আব্দুল মালিক হাফিজাহুল্লাহ

মুসলিম উম্মাহ পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং নিজেদের একতা ও সংহতি রক্ষা করা ইসলামের একটিমৌলিক ফরয। তেমনি সুন্নাহর অনুসরণ তথা  আল্লাহর রাসূলের শরীয়ত এবং তাঁর উসওয়াহ ওআদর্শকে সমর্পিত চিত্তে স্বীকার করা এবং বাস্তবজীবনে চর্চা করা তাওহীদ ও ঈমান বিল্লাহর পরইসলামের সবচেয়ে বড় ফরয।

সুতরাং সুন্নাহর অনুসরণ যে দ্বীনের বিধান উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষা এবং বিভেদ ও অনৈক্য থেকেবেঁচে থাকাও সেই দ্বীনেরই বিধান। এ কারণে এ দুইয়ের মাঝে বিরোধ ও সংঘাত হতেই পারে না।সুতরাং একটির কারণে অপরটি ত্যাগ করারও প্রশ্ন আসে না। কিন্তু এখন আমরা এই দুঃখজনকবাস্তবতার সম্মুখীন যে, হাদীস অনুসরণ নিয়ে উম্মাহর মাঝে বিবাদ-বিসংবাদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। উম্মাহরঐক্য ও সংহতির প্রশ্নে মুজতাহিদ ইমামগণকে এবং তাদের সংকলিত ফিকহী মাযহাবসমূহকে দায়ীকরা হচ্ছে। অথচ ফিকহের এই মাযহাবগুলো হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর বিধিবিধানেরই ব্যাখ্যা এবং তারসুবিন্যস্ত ও সংকলিত রূপ। মূলে তা ফকীহ ও মুজতাহিদ সাহাবীগণের মাযহাব, যা উম্মাহর অবিচ্ছিন্নকর্মপরম্পরা তথা তাওয়ারুছের মাধ্যমে চলে এসেছে।

এই অবস্থা প্রমাণ করে, আমাদের অনেকে সুন্নাহ অনুসরণের মর্ম ও তার সুন্নাহসম্মত পন্থা এবং সুন্নাহরপ্রতি আহবানের সুন্নাহসম্মত উপায় সম্পর্কে দুঃখজনকভাবে উদাসীন। তদ্রূপ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ওসংহতির সঠিক উপলব্ধি এবং ঐক্যবিনাশী বিষয়গুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তির শিকার।

সুন্নাহর অনুসরণ এবং উম্মাহর ঐক্য দুটো বিষয়ই অনেক দীর্ঘ এবং উভয় ক্ষেত্রে আমাদের সমাজেচলমান অবহেলা ও ভুল ধারণা ব্যাপক। সবকটি দিক নিয়ে এ প্রবন্ধে আলোচনা করা সম্ভব নয়।এখানে শুধু প্রবন্ধের শিরোনাম (মতভিন্নতার মাঝেও সম্প্রীতি রক্ষা; সুন্নাহসম্মত পন্থায় সুন্নাহর প্রতিআহবান)-এর সাথে সম্পৃক্ত কিছু মৌলিক বিষয় আলোচনা করা উদ্দেশ্য।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক কথা বলার এবং ইখলাস ও ইতকানের সাথে উপস্থাপন করারতাওফীক দান করুন। আমীন।

ঐক্য সংহতি এবং সৌহার্দ্য সম্প্রীতির গুরুত্ব

ইসলাম তাওহীদের দ্বীন এবং ঐক্যের ধর্ম। এখানে শিরকের সুযোগ নেই এবং অনৈক্য ও বিভেদেরঅবকাশ নেই। ইসলামে ঐক্যের ভিত্তি হচ্ছে তাওহীদ-এক আল্লাহর ইবাদত, এক আল্লাহর ভয়।

এই তাওহীদের সমাজকে ইসলাম আদেশ করে সীরাতে মুস্তাকীম ও সাবীলুল মুমিনীনের উপরএকতাবদ্ধ থাকার, নিজেদের ঐক্য ও সংহতি এবং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি রক্ষা করার, ইজমা ও সাবীলুলমুমিনীনের বিরোধিতা পরিহার করার এবং এমন সব কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার, যা উম্মাহর একতানষ্ট করে এবং সম্প্রীতি বিনষ্ট করে।

সাবীলুল মুমিনীন থেকে বিচ্যুত হওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে কুফর এবং পরস্পর কলহ-বিবাদে লিপ্ত হওয়াহারাম ও কবিরা গুনাহ।

কথাগুলো যদিও দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট এবং উম্মাহর সর্ববাদীসম্মত আকীদা তবুও পুনস্মরণের স্বার্থেকিছু আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করা হচ্ছে।

(এ প্রসঙ্গে মূল প্রবন্ধে আটটি সূরার সর্বমোট ২৭টি আয়াত রয়েছে। এখানে আরবী পাঠ ও তরজমাসহকয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হল।

إِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ ۞ وَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ كُلٌّ إِلَيْنَا رَاجِعُونَ ۞

(তরজমা) ‘নিশ্চিত জেনো, এই তোমাদের উম্মাহ, এক উম্মাহ (তাওহীদের উম্মাহ) এবং আমিতোমাদের রব। সুতরাং আমার ইবাদত কর। কিন্তু তারা নিজেদের দ্বীনকে নিজেদের মাঝে টুকরা টুকরাকরে ফেলেছে। (তবে) সকলেই আমার কাছে ফিরে আসবে।-সূরাতুল আম্বিয়া (২১) : ৯২-৯৩

وَإِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاتَّقُونِ ۞ فَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ زُبُرًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ ۞ فَذَرْهُمْ فِي غَمْرَتِهِمْ حَتَّى حِينٍ ۞

(তরজমা) ‘নিশ্চিত জেনো, এই তোমাদের উম্মাহ, এক উম্মাহ (তাওহীদের উম্মাহ) এবং আমিতোমাদের রব। সুতরাং আমাকে ভয় কর। এরপর তারা নিজেদের দ্বীনের মাঝে বিভেদ করে বিভিন্নদলে বিভক্ত হয়ে গেল। প্রত্যেক দল (নিজেদের খেয়ালখুশি মতো) যে পথ গ্রহণ করল তাতেই মত্তরইল। সুতরাং (হে পয়গাম্বর!) তাদেরকে এক নির্ধারিত সময় পর্যন্ত মূর্খতায় ডুবে থাকতে দাও।-সূরামুমিনুন (২৩) : ৫২-৫৩

উপরের দোনো জায়গায় নবীগণ যে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন তা বর্ণনা করার পর বলা হয়েছে,আল্লাহর কাছে উম্মত একটিই। আর তা হচ্ছে তাওহীদের উম্মত। সূরা ইউনুস (১০ : ১৯) ও সূরাবাকারায় (২ : ২১৩) বলা হয়েছে যে, আদিতে সকল মানুষ এ সমাজেই ছিল। পরে লোকেরা কুফর ওশিরক অবলম্বন করে আলাদা উম্মত, আলাদা সমাজ বানিয়ে নিয়েছে।

তাই উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে তাওহীদ। تَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُم (তারা নিজেদেরদ্বীনকে নিজেদের মাঝে টুকরা টুকরা করে ফেলেছে) বাক্যে আকীদায়ে তাওহীদ এবং দ্বীনের অন্যান্যমৌলিক ও অকাট্য আকীদা ও বিধানসমূহ (জরুরিয়াতে দ্বীনের) অস্বীকার বা অপব্যাখ্যার মাধ্যমেআলাদা মিল্লাত ও আলাদা উম্মত সৃষ্টির নিন্দা করা হয়েছে।

شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اللَّهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيبُ ۞ وَمَا تَفَرَّقُوا إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ وَلَوْلَا كَلِمَةٌ سَبَقَتْ مِنْ رَبِّكَ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ وَإِنَّ الَّذِينَ أُورِثُوا الْكِتَابَ مِنْ بَعْدِهِمْ لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مُرِيبٍ ۞ فَلِذَلِكَ فَادْعُ وَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَقُلْ آَمَنْتُ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنْ كِتَابٍ وَأُمِرْتُ لِأَعْدِلَ بَيْنَكُمُ اللَّهُ رَبُّنَا وَرَبُّكُمْ لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ لَا حُجَّةَ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ اللَّهُ يَجْمَعُ بَيْنَنَا وَإِلَيْهِ الْمَصِيرُ ۞

 

(তরজমা) তিনি তোমাদের জন্য সেই দ্বীনই স্থির করেছেন, যার হুকুম দিয়েছিলেন নূহকে এবং (হেরাসূল!) যা আমি ওহীর মাধ্যমে তোমার কাছে পাঠিয়েছি এবং যার হুকুম দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ওঈসাকে; যে, কায়েম রাখ এই দ্বীন এবং তাতে সৃষ্টি করো না বিভেদ। (তা সত্ত্বেও) মুশরিকদের তুমি যেদিকে ডাকছ তা তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুভার মনে হয়। আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা বাছাই করেনিজের দিকে আকৃষ্ট করেন এবং যে আল্লাহর দিকে রুজু হয় তাকে নিজ দরবার পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্যদান করেন।

এবং মানুষ যে বিচ্ছিন্ন হয়েছে তা হয়েছে তাদের কাছে নিশ্চিত জ্ঞান আসার পরই, পারস্পরিক শত্রুতারকারণে। তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে যদি একটি কথা নির্ধারিত কাল পর্যন্ত পূর্বেই স্থির না থাকততবে তাদের বিষয়ে ফয়সালা হয়ে যেত। তাদের পর যারা কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়েছে তারা এসম্পর্কে এক বিভ্রান্তিকর সন্দেহে পড়ে আছে।

‘সুতরাং (হে রাসূল!) তুমি ঐ বিষয়ের দিকেই মানুষকে আহবান কর এবং অবিচল থাক, যেরূপতোমাকে আদেশ করা হয়েছে। এবং তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না। বল, আল্লাহ যে কিতাবনাযিল করেছেন আমি তার প্রতি ঈমান এনেছি এবং আমি আদিষ্ট হয়েছি তোমাদের মাঝে ন্যায়বিচারকরতে। আল্লাহ আমাদের রব এবং তোমাদেরও রব। আমাদের কর্ম আমাদের, তোমাদের কর্মতোমাদের। আমাদের ও তোমাদের মাঝে কোনো তর্ক নেই। আল্লাহ আমাদের সকলকে একত্র করবেনএবং তাঁরই কাছে সকলের প্রত্যাবর্তন।-সূরাতুশ শূরা (৪২) : ১৩-১৫

দ্বীনের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির অর্থ, তাওহীদ বা অন্য কোনো মৌলিক বিষয় সরাসরি অস্বীকার করে কিংবাতাতে অপব্যাখ্যা করে তাওহীদের উম্মাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া।

হক সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান আসার পর এ বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা কেবল জিদ ও হঠকারিতার কারণেই হয়েথাকে। শাখাগত বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর দলিলভিত্তিক যে মতপার্থক্য তা এখানে উদ্দেশ্য হতে পারেনা। কারণ অনেক শাখাগত বিধানের ক্ষেত্রে স্বয়ং নবীগণের শরীয়তেও বিভিন্নতা ছিল। অথচ তাঁদেরসবার দ্বীন ছিল এক। তাঁরা সবাই ছিলেন তাওহীদপন্থী এবং অভিন্ন।

অন্য অনেক আয়াতের মতো উপরের আয়াতগুলোতেও স্পষ্ট নির্দেশনা আছে যে, দ্বীনের মৌলিকবিষয়ে মতভেদ হতে পারে না। এখানে মতভেদ অর্থই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা।

আর এই বিভেদের দায় ঐ মতভেদকারীকেই বহন করতে হবে। যারা হকপন্থী, তাদেরকে নয়। কারণঐক্যের ভিত্তি হচ্ছে তাওহীদ ও মৌলিক আকিদা ও বিধান। যারা এর উপর আছে তারা তো মূল পথেইরয়েছে। যারা মতভেদ করেছে তারা এই পথ থেকে সরে গেছে এবং বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার জন্মদিয়েছে। আর এ কথা বলাই বাহুল্য যে, তাওহীদের বিষয়ে বা দ্বীনের অন্য কোনো মৌলিক বিষয়ে হকথেকে বিচ্যুত হওয়া বা সন্দেহ-সংশয় পোষণ করা খেয়ালখুশির অনুগামিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এখানে ইসলামের অতুলনীয় ও ন্যায়সঙ্গত শিক্ষাটিও লক্ষণীয় যে, যারা মৌলিক বিষয়ে মতভেদ করেবিচ্ছিন্ন হল তাদের সাথেও জুলুম-অবিচার করা যাবে না; তাদের সাথেও ন্যায়বিচার করতে হবে।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ ۞ وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آَيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ ۞ وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ۞ وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ ۞ يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ أَكَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ ۞ وَأَمَّا الَّذِينَ ابْيَضَّتْ وُجُوهُهُمْ فَفِي رَحْمَةِ اللَّهِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ۞

 

(তরজমা) ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে সেভাবে ভয় কর যেভাবে তাকে ভয় করা উচিৎ। এবং(সাবধান) তোমাদের মৃত্যু যেন এ অবস্থায়ই আসে যে, তোমরা মুসলিম।

তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভেদ করো না। স্মরণ কর যখন তোমরাএকে অন্যের শত্রু ছিলে তখন আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। তিনি তোমাদের অন্তরসমূহএকে অপরের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছ। তোমরা তোছিলে অগ্নিকুন্ডের প্রান্তে। আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের মুক্ত করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তাঁরবিধানসমূহ  সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যেন তোমরা পথপ্রাপ্ত হও।

‘তোমাদের মধ্যে যেন এমন একটি দল থাকে, যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে, সৎকাজেরআদেশ করবে  এবং মন্দ কাজে বাধা দিবে। আর এরাই তো সফলকাম।

‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা বিচ্ছিন্ন হয়েছিল এবং মতভেদ করেছিল তাদের নিকট সুস্পষ্টবিধানসমূহ পৌঁছার পর। এদের জন্যই রয়েছে ভীষণ শাসিত্ম।

‘যেদিন কতক মুখ উজ্জ্বল হবে আর কতক মুখ কালো হয়ে যাবে। যাদের মুখ কালো হবে তাদেরকেবলা হবে, তোমরা কুফরি করলে ঈমান আনার পর?! সুতরাং স্বীয় কুফরির দরুণ শাস্তির স্বাদ গ্রহণ কর।

‘পক্ষান্তরে যাদের মুখ উজ্জ্বল হবে তারা আল্লাহর রহমতের মধ্যে থাকবে। সেখানে তারা অনন্তকালথাকবে।’-সূরা আলে-ইমরান (৩) : ১০২-১০৭

‘হাবলুল্লাহ’-আল্লাহর রজ্জু অর্থ আলকুরআন এবং আল্লাহর সাথে কৃত বান্দার সকল অঙ্গিকার, যারমধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গিকারটি এই যে, আমরা শুধু রবেরই ইবাদত করব, অন্য কারো নয়।আল্লাহ তাআলা বলেন, এই তাওহীদ ও কুরআনকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর। তাওহীদ ত্যাগ করে কিংবাকুরআনের কোনো বিধান থেকে বিমুখ হয়ে বিভেদ করো না। তো এখানেও ঐ কথা-ঐক্যের ভিত্তিতাওহীদ ও কুরআন।

আরো বোঝা গেল যে, তাওহীদপন্থী উম্মাহর পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি আল্লাহ তাআলার অনেকবড় নেয়ামত। আর এ নেয়ামত হাসিল হবে সর্বপ্রকার ‘আসাবিয়াত’ থেকে মুক্ত হয়ে শুধু এবং শুধুইসলামের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ এবং ইসলামী বিধিবিধানের আনুগত্যের দ্বারা। আউস ও খাযরাজেরদৃষ্টান্ত  স্মরণ করুন, এই নেয়ামতে তাঁরা এতই সৌভাগ্যশালী হয়েছিলেন যে, তাঁদের গোত্রীয় পরিচয়ছাপিয়ে গেল এবং দ্বীনী পরিচয়ে-‘আনসার’ নামেই তাঁরা প্রসিদ্ধ হয়ে গেলেন।

‘বাইয়িনাত’ অর্থ কিতাব-সুন্নাহর অকাট্য ও সুস্পষ্ট দলিল, যা থেকে বিমুখ হয়ে মতভেদ করার অর্থইহল এ বিষয়ে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করা, যা সম্পূর্ণ গর্হিত ও বর্জনীয়। যেমন ঈমানদার ওতাওহীদপন্থীদের সাথে কাফির-মুশরিকদের মতভেদ। কট্টর বিদআতীদের মতভেদও অনেক সময়এই সীমানায় প্রবেশ করে। এই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শাস্তি আখেরাতে মুখ কালো হওয়া।

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. এ আয়াতের তাফসীরে বলেছেন-

تبيض وجوه أهل السنة والجماعة، وتسود وجوه أهل البدعة والفرقة

অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর মুখ উজ্জ্বল হবে এবং আহলুল বিদআহ ওয়ালফুরকার মুখ কালো হবে।-তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/৫৮৪

এ থেকে বোঝা যায়, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর অনুসারীগণ ‘আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করার এবংবিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন না হওয়ার’ আদেশ পালন করছেন, যার পুরস্কার তারা দুনিয়াতে পেয়ে থাকেনপরস্পর সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মাধ্যমে। আর আখিরাতের পুরস্কার এই হবে যে, তাদের চেহারা উজ্জ্বলহবে। পক্ষান্তরে যারা কালিমা পাঠ করেও সুন্নাহ ছেড়ে বিদআ অবলম্বন করবে কিংবা উম্মাহর ঐক্যেআঘাত করে ‘আলজামাআ’ এর নীতি থেকে বিচ্যুত হবে তাদেরও আশঙ্কা আছে আয়াতের কঠিনহুঁশিয়ারির মাঝে পড়ে যাওয়ার।

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামদের মাঝে শাখাগত বিষয়ে দলিলের ভিত্তিতে যে মতপার্থক্য, তাযেমন বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা নয় তেমনি এ আয়াতের হুঁশিয়ারিরও আওতাভুক্ত নয়। কারণ এ জাতীয়মতপার্থক্যের পরও তাঁরা একতাবদ্ধ ছিলেন এবং তাঁদের মতপার্থক্য-আল্লাহর পানাহ-স্পষ্ট বিধানথেকে বিমুখতার কারণেও ছিল না। তা তো ছিল ‘বাইয়্যিনাত’-এর উপর ইজমা ও ইত্তিহাদের পর কিছুশাখাগত বিষয়ে দলিলভিত্তিক ইখতিলাফ। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসছেইনশাআল্লাহ।

وَلَقَدْ آتَيْنَا بَنِي إِسْرَائِيلَ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ ۞ وَآتَيْنَاهُمْ بَيِّنَاتٍ مِنَ الْأَمْرِ فَمَا اخْتَلَفُوا إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ إِنَّ رَبَّكَ يَقْضِي بَيْنَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ ۞ ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَى شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ۞ إِنَّهُمْ لَنْ يُغْنُوا عَنْكَ مِنَاللَّهِ شَيْئًا وَإِنَّ الظَّالِمِينَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَاللَّهُ وَلِيُّ الْمُتَّقِينَ ۞ هَذَا بَصَائِرُ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ ۞

(তরজমা) ‘আমি তো বনী ইসরাইলকে কিতাব, রাজত্ব ও নবুওয়ত দান করেছিলাম। তাদেরকে উত্তমরিযিক প্রদান করেছিলাম এবং জগদ্বাসীর উপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম।

‘আমি তাদেরকে দ্বীনের সুস্পষ্ট বিধানাবলি দান করেছিলাম। অতপর তারা যে মতভেদ করল তাতাদের কাছে ইলম আসার পরই করেছিল শুধু পরস্পর বিদ্বেষবশত। তারা যে বিষয়ে মতভেদ করততোমার প্রতিপালক কিয়ামতের দিন সে বিষয়ে তাদের মাঝে ফয়সালা করে দিবেন।

‘এরপর আমি তোমাকে দ্বীনের এক বিশেষ শরীয়তের উপর রেখেছি। সুতরাং তা অনুসরণ কর,অজ্ঞদের খেয়ালখুশির অনুসরণ করো না।

‘আল্লাহর মুকাবিলায় তারা তোমার কিছুমাত্রও কাজে আসবে না। বস্ত্তত জালিমরা একে অপরের বন্ধু।আর আল্লাহ বন্ধু মুত্তাকীদের।

‘এটি (কুরআন) সকল মানুষের জন্য প্রকৃত জ্ঞানের সমষ্টি এবং দৃঢ়বিশ্বাসীদের জন্য গন্তব্যে পৌঁছারমাধ্যম ও রহমত।’-সূরা জাছিয়া (৪৫) : ১৬-২০

‘বাইয়িনাত’ তথা অকাট্য ও সুস্পষ্ট দলিল দ্বারা হকের নিশ্চিত জ্ঞান অর্জিত হয়। যে তা থেকে বিমুখহয়ে মতভেদ করে তার মতভেদের ভিত্তি হঠধর্মিতা ও সীমালঙ্ঘন। এই মতভেদ হচ্ছে বিভেদ ওবিচ্ছিন্নতা।

এ আয়াতে এ কথাও দ্ব্যর্থহীনভাবে আছে যে, তাওহীদের সাথে শরীয়তের আনুগত্যও অপরিহার্য।শরীয়তকে মেনে নেওয়া প্রকৃতপক্ষে ‘তাওহীদ ফিততাশরী’ তথা বিধানদাতা একমাত্র আল্লাহ-এবিশ্বাসেরই বহিঃপ্রকাশ। সূরা মায়েদা (৫) : ৪৮ এবং অন্য অনেক জায়গায় সাবধান করা হয়েছে যে, ‘শরয়ে মুনাযযাল তথা আল্লাহর পক্ষ হতে নাযিলকৃত সুস্পষ্ট বিধানাবলির কোনো একটি বিধানেরবিরোধিতাও হারাম ও কুফর।

বস্ত্তত জালিমরা একে অপরের বন্ধু আর আল্লাহ বন্ধু মুত্তাকীদের-এ বাক্যে ولاء  ও براء বা موالاة  ও معاداةতথা বন্ধুতা ও শত্রুতার নীতি বলা হয়েছে। ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি এই যে, ‘মুয়ালাত’ বাবন্ধুত্বের মানদন্ড হচ্ছে ঈমান ও ইসলাম। আর ‘মুআদাত’ বা শত্রুতার মানদন্ড হচ্ছে শিরক ও কুফর।যে কেউ শরীয়তের দৃষ্টিতে মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত সে কেবল তার ঈমান ও ইসলামের কারণেই,অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য ছাড়াই, মুয়ালাত ও বন্ধুত্বের এবং সকল ইসলামী অধিকার পাওয়ার হক রাখে।আর যে এই মানদন্ডে উত্তীর্ণ নয়, অর্থাৎ যে শিরক বা কুফরে লিপ্ত (প্রত্যেক কুফর শিরকেরই বিভিন্নপ্রকার) তার সাথে ‘মুয়ালাত’ বা বন্ধুত্ব হারাম; বরং তা কুফরের আলামত।

(এরপর এ বিষয়ে চারটি সূরা : সূরায়ে তাওবা (৯) : ৩, ২৩-২৪, ৭১; সূরা লুকমান (৩১) : ১৪-১৫;সূরা মুমতাহিনা (৬০) : ১, ৪; সূরা মুজাদালা (৫৮) : ১৪-২২ আয়াতের তরজমা উদ্ধৃত করা হয়েছে।সূরায়ে মুজাদালার (৫৮) : ১৪-২২ আয়াতগুলো উদ্ধৃত করার পর প্রবন্ধকার বলেন-)

দল মূলত দুটি :

১. হিযবুল্লাহ বা আল্লাহর দল

২. হিযবুশ শয়তান বা শয়তানের দল।

যার অন্তরে ঈমান আছে এবং মুমিনদের সাথে মুয়ালাত ও হৃদ্যতা পোষণ করে আর কাফির-মুশরিকদের থেকে বারাআত ও সম্পর্কহীনতা প্রকাশ করে সে হিযবুল্লাহর অন্তর্ভুক্ত। তাকে হিযুবল্লাহথেকে খারিজ করা কিংবা হিযবুশ শয়তানের দিকে নিসবত করা সম্পূর্ণ হারাম। হিযবুল্লাহর মাপকাঠিহচ্ছে ঈমান, মুমিনদের প্রতি মুয়ালাত ও হৃদ্যতা এবং আহলে কুফর ও শিরকের সাথে মুআদাত ওশত্রুতা।

মুয়ালাত ও বারাআতের এই ইসলামী নীতি থেকে পরিষ্কার হয় যে, ঐক্যের অর্থ ঈমান ও ইসলামেরসূত্রে একতাবদ্ধ থাকা। ঐক্যের ভিত্তি হবে তাওহীদ। তাওহীদ ত্যাগ করে এবং দ্বীনের মূলনীতিবিসর্জন দিয়ে কোনোরূপ ঐক্য গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ তা করলে সে আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহঘোষণা করে এবং তাওহীদ ও ইত্তিহাদ দুটোই তার হাতছাড়া হয়।

وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ وَاصْبِرُوا إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ

এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। পরস্পর বিবাদ করো না তাহলে দুর্বল হয়ে পড়বে এবংতোমাদের প্রভাব বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্য্য ধারণ কর। নিশ্চিত জেনো, আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথেআছেন।-সূরা আনফাল (৮) : ৪৬

এ আয়াতে ‘তাওহীদ ফিততাশরী’ তথা একমাত্র আল্লাহকেই বিধানদাতা বলে বিশ্বাস করার আদেশআছে। শর্তহীন আনুগত্য একমাত্র আল্লাহর এবং আল্লাহর আদেশে তাঁর রাসূলের। অন্য সকলেরআনুগত্য এ আনুগত্যের অধীন। সাথে সাথে কলহবিবাদ থেকে বিরত থাকার আদেশ করা হয়েছে এবংএর বড় দুটি কুফল সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে : এক. এর দ্বারা উম্মাহ শক্তিহীন হয়ে পড়বে, দুই.তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি লোপ পাবে।

বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, রাসূলের আনুগত্য তথা সুন্নাহর অনুসরণের আদেশের সাথে ঐক্য ও সংহতিরক্ষা এবং কলহবিবাদ থেকে আত্মরক্ষার তাকীদ করা হয়েছে।

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ۞ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَى أَنْ يَكُونُوا خَيْرًا مِنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِنْ نِسَاءٍ عَسَى أَنْ يَكُنَّ خَيْرًا مِنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوا أَنْفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَالِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ۞ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ ۞ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ ۞

(তরজমা) ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মাঝে  মীমাংসা করেদাও। আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও।

‘হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর পুরুষকে উপহাস না করে। সে (অর্থাৎ যাকে উপহাস করাহচ্ছে) তার চেয়ে উত্তম হতে পারে। এবং কোনো নারীও যেন অপর নারীকে উপহাস না করে। সে(অর্থাৎ যে নারীকে উপহাস করা হচ্ছে) তার চেয়ে উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অন্যকে দোষারোপকরো না এবং একে অন্যকে মন্দ উপাধিতে ডেকো না। ঈমানের পর ফিসকের নাম যুক্ত হওয়া কতমন্দ! যারা এসব থেকে বিরত হবে না তারাই জালেম।

‘হে মুমিনগণ! অনেক রকম অনুমান থেকে বেঁচে থাক। কোনো কোনো অনুমান গুনাহ। তোমরা কারোগোপন ত্রুটি অনুসন্ধান করবে না এবং একে অন্যের গীবত করবে না। তোমাদের কেউ কি তার মৃতভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? এটা তো তোমরা ঘৃণা করে থাক। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ইতিনি বড় তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।

‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে এবং তোমাদের মাঝে বিভিন্নসম্প্রদায় ও গোত্র বানিয়েছি। যাতে একে অন্যকে চিনতে পার। নিশ্চিত জেনো, তোমাদের মধ্যেআল্লাহর কাছে সেই সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী। নিশ্চয়ইআল্লাহ সব কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন।’-সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১০-১৩

এই আয়াতগুলোতে মুমিনদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের চেতনা জাগ্রত করা হয়েছে এবং মুমিনের কাছেমুমিনের প্রাপ্য অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই আয়াতগুলো থেকে প্রমাণ হয়, ভ্রাতৃত্বের মানদন্ডশুধু ঈমান। সুতরাং উল্লেখিত অধিকারগুলো মুমিনমাত্রেরই প্রাপ্য তার মুমিন ভাইয়ের কাছে।

ঈমানী ভ্রাতৃত্বের রয়েছে অনেক দাবি। এ আয়াতে বিশেষভাবে এমন কিছু দাবি উল্লেখ করা হয়েছে,যেগুলো পূরণ না করার কারণে সমাজে কলহ-বিবাদ সৃষ্টি হয়। তেমনি কলহ-বিবাদ সৃষ্টি হলে এইবিষয়গুলো আরো বেশি লঙ্ঘিত হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, দ্বীনী-দুনিয়াবী মতভেদের ক্ষেত্রে একেঅপরকে উপহাস ও তাচ্ছিল্য করা, গীবত করা, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া, কুধারণা পোষণ করা, কটুক্তিকরা, খারাপ নামে বা মন্দ উপাধিতে ডাকা-এই সব বিষয়ের চর্চা হতে থাকে। লোকেরা যেন ভুলেইযায় যে, কুরআন মজীদে এ বিষয়গুলোকে হারাম করা হয়েছে। প্রত্যেকের আচরণ থেকে মনে হয়,প্রতিপক্ষের ইজ্জত-আব্রু নষ্ট করা হালাল! মতভেদের কারণে তার কোনো ঈমানী অধিকার অবশিষ্টনেই। অথচ এ তো শুধু মুমিনের হক নয়, সাধারণ অবস্থায় মানুষমাত্রেরই হক। একজন মানুষ অপরএকজন মানুষের কাছে এই নিরাপত্তাটুকু পাওয়ার অধিকার রাখে। এমনকি যদি সে মুসলিমও না হয়।

হায়! বিরোধ ও মতভেদের ক্ষেত্রে যদি আমরা প্রতিপক্ষকে অন্তত একজন মানুষ মনে করে তার গীবত-শেকায়েত থেকে, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া থেকে, উপহাস-বিদ্রূপ করা থেকে ও মন্দ নামে ডাকা থেকেবিরত থাকতাম! আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহয় তো জীবজন্তু, এমনকি জড় বস্ত্তরও হক ও অধিকার বর্ণিতহয়েছে। তো মতভেদকারী আর কিছু না হোক একজন প্রাণী তো বটে!!

লক্ষ্য করুন, আল্লাহ তাআলা কী বলেছেন-

بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ

অর্থাৎ এই সকল হক যে ব্যক্তি রক্ষা করে না সে সমাজ ও শরীয়ত উভয়ের দৃষ্টিতে ফাসিক উপাধিরউপযুক্ত হয়ে যায়। একজন মুমিনের জন্য তা কত বড় লজ্জা ও দুর্ভাগ্যের বিষয়?

তো দ্বীনী মতভেদের ক্ষেত্রে যদি এইসব আচরণ করা হয় এবং এ কারণে দ্বীনের পক্ষ হতেই ঐ‘খাদিমে দ্বীনে’র নামের সাথে ফাসিক উপাধি যুক্ত হয় তাহলে তা দ্বীন ও শরীয়তের কেমন খেদমত তাখুব সহজেই অনুমেয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন।

শেষ আয়াতে সমগ্র মানবজাতির জন্য ন্যায় ও সাম্যের এই গুরুত্বপূর্ণ নীতি ঘোষণা করা হয়েছে যে,বংশীয়, গোত্রীয় বা আঞ্চলিক পরিচিতি মর্যাদা ও শরাফতের মাপকাঠি নয়। মর্যাদার মাপকাঠি হচ্ছেতাকওয়া ও খোদাভীরুতা। সকল মানুষ এক পুরুষ ও এক নারীর সন্তান। এরপর আল্লাহ তাআলাতাদেরকে আলাদা আলাদা কওম, গোত্র বা খান্দানের পরিচয় এজন্য দান করেননি যে, এরই ভিত্তিতেতারা একে অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করবে; বরং এই বৈচিত্রের একমাত্র উদ্দেশ্য, তাদেরকে ছোটছোট শ্রেণীতে ভাগ করা, যাতে অসংখ্য আদমসন্তানের মাঝে পারস্পরিক পরিচিতি সহজ হয়।

ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও অঞ্চল এসব ছিল আরব জাহিলিয়াতে একতা ও জাতীয়তার মানদন্ড। আধুনিকজাহিলিয়াতে এসবের সাথে আরো যোগ হয়েছে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন দর্শন ওমতবাদকেন্দ্রিক একতা ও জাতীয়তা। এভাবে অসংখ্য বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়ে একতা শব্দটিএকটি অসার শব্দে পরিণত হয়েছে।

প্রাচীন ও আধুনিক উভয় জাহিলিয়াতে মর্যাদা ও শরাফতের মাপকাঠি ধরা হয়েছে আপন আপনপসন্দের নিসবত ও সম্বন্ধকে। এর বিপরীতে ইসলামের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা-ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু তাওহীদ,উম্মাহর জাতীয়তা ইসলাম, আর মর্যাদা ও শরাফতের মাপকাঠি তাকওয়া। এভাবে শ্রেষ্ঠত্বের সকলজাহেলী মাপকাঠিকে ইসলাম বাতিল সাব্যস্ত করেছে এবং সব ধরনের আসাবিয়ত, অহংকার ওসাম্প্রদায়িকতাকে হারাম ঘোষণা করেছে।

আয়াতের উপরোক্ত শিক্ষা থেকে এ নীতিও প্রমাণিত হয় যে, পরিচিতির জন্য বংশীয় ও গোত্রীয় সম্বন্ধছাড়া আরো যে সকল জায়েয সম্বন্ধ ব্যবহার করা হয় সেগুলোকেও মর্যাদার মাপকাঠি মনে করা কিংবাসেসবের ভিত্তিতে মুয়ালাত ও বারাআত তথা বন্ধুত্ব ও শত্রুতার আচরণ করা হারাম। মর্যাদার মাপকাঠিতাকওয়া। মুয়ালাত ও বন্ধুত্বের মানদন্ড ঈমান আর কারো থেকে বারাআত ও সম্পূর্ণরূপেসম্পর্কহীনতা ও দায়মুক্ততার কারণ শুধু শিরক ও কুফরই হতে পারে।

এ সকল জায়েয সম্বন্ধের মাঝে জন্মস্থান বা আবাসস্থলের সম্বন্ধ, ফিকহী মাযহাবের সম্বন্ধ, সুলুক ওইহসানের তরীকাসমূহের সম্বন্ধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্বন্ধ সবই অন্তর্ভুক্ত। কেউ যদি তার শিক্ষাকেন্দ্রেরহিসাবে নামের সাথে মাদানী, আযহারী, নদভী বা দেওবন্দ্বী/কাসেমী লেখে তাহলে তা  নাজায়েয নয়।তেমনি ফিকহী মাযহাবের হিসাবে মালেকী, হাম্বলী, হানাফী বা শাফেয়ী লিখলে, কিংবা বিশেষমাসলাক ও মাশরাব হিসাবে সালাফী বা আছারী লিখলে অথবা সুলূক ও ইহসানের তরীকা হিসাবেকাদেরী বা নকশবন্দী লিখলে তা নাজায়েয নয়। কিন্তু এই সম্বন্ধগুলোকেই মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বেরমাপকাঠি মনে করা, এসবের ভিত্তিতে বিভক্ত হওয়া, এসবের প্রতি আসাবিয়াত ও অন্যায় পক্ষপাতলালন করা, নিজের সম্বন্ধের, প্রতিষ্ঠানের, মাযহাব-মাশরাবের এবং তরীকার কোনো বিষয় সুস্পষ্টদলিল দ্বারা ভুল প্রমাণিত হলেও তার উপর জিদ করা এবং ঈমানী ভ্রাতৃত্বের দাবি পূরণের ক্ষেত্রেএসকল সম্বন্ধকে মাপকাঠি ও মানদন্ড মনে করা সম্পূর্ণ হারাম ও ফাসেকী।

হকের মানদন্ড হচ্ছে শরীয়তের দলিল, যাতে সীরাত ও আছারে সাহাবাও অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর কাছেমর্যাদার মাপকাঠি তাকওয়া। ঈমানী ভ্রাতৃত্ব ও তার হকসমূহের মানদন্ড ঈমান। ঈমানের অতিরিক্তঅন্য কোনো নিসবত বা সম্বন্ধের উপর এই সব  হকের কোনোটিকে মওকুফ মনে করা কিংবা মওকুফরাখা ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী।

হাদীস

কুরআন মজীদের আয়াতের পর আলোচ্য বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কিছু হাদীসপেশ করছি। প্রথমে ঈমানী ভ্রাতৃত্বের বিষয়ে কিছু হাদীস উল্লেখ করব। এরপর ঐক্যের অপরিহার্যতাএবং অনৈক্যের বর্জনীয়তা সম্পর্কে কিছু হাদীস উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ।

(ঈমানী ভ্রাতৃত্বের বিষয়ে মূলপ্রবন্ধে সর্বমোট দশটি হাদীস রয়েছে। তন্মধ্যে দুটি হাদীস উল্লেখ করাহল।)

عن أبي هريرة رضي الله تعالى عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إياكم والظن، فإن الظن أكذب الحديث، ولا تَحَسَّسُوا، ولا تَجَسَّسُوا، ولا تَنَافَسُوا، ولا تَحَاسَدُوا، ولا تَبَاغَضُوا، ولا تَقَاطَعُوا، وَلا تهجروا، ولا تَدَابروا، ولا تناجشوا، ولا يبع بعضكم على بيع بعض، وكونوا كما أمركم الله عباد الله إخوانا.

المسلم أخو المسلم، لا يظلمه ولا يخذله ولا يحقره، التقوى ههنا، ويشير إلى صدره، ثلاث مرات.

بحسب امرئ من الشر أن يحقر أخاه المسلم، إن الله لا ينظر إلى أجسادكم، ولكن ينظر إلى قلوبكم، وأشار بأصابعه إلى صدره.

كل المسلم على المسلم حرام دمه وماله وعرضه.

رواه البخاري ومسلم، والسياق مأخوذ من مجموع رواياتهما.

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা ধারণাথেকে বেঁচে থাক। কারণ ধারণা হচ্ছে নিকৃষ্টতম মিথ্যা। তোমরা আঁড়ি পেতো না, গোপন দোষ অন্বেষণকরো না, স্বার্থের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ো না, হিংসা করো না, বিদ্বেষ পোষণ করো না, সম্পর্কচ্ছেদকরো না, পরস্পর কথাবার্তা বন্ধ করো না, একে অপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিও না, দাম-দস্ত্তরেপ্রতারণা করো না এবং নিজের ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের মাঝে ক্রয়-বিক্রয়ের চেষ্টা করো না। হেআল্লাহর বান্দারা! আল্লাহ যেমন আদেশ করেছেন, সবাই তোমরা আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়েযাও।’-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫১৪৩, ৬০৬৪, ৬০৬৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৬৩/২৮, ২৯, ৩০ও ২৫৬৪/৩২, ৩৩

عن أبي برزة الأسلمي قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : يا معشر من آمن بلسانه ولم يدخل الإيمان قلبه لا تغتابوا المسلمين ولا تتبعوا عوراتهم فإنه من يتبع عورة أخيه يتبع الله عورته حتى يفضحه في بيته.

رواه أحمد وأبو داود، وهو صحيح لغيره، ومن شواهده حديث ثوبان عند أحمد برقم : ٢٢٤٠٢ وحديث ابن عمر عند الترمذي برقم :٢١٥١ وابن حبان في صحيحه برقم : ٥٧٦٣

আবু বারযা আলআসলামী রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ওহে যারা মুখে মুখে ঈমান এনেছ, কিন্তু ঈমান তাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি তারা শোন, মুসলমানেরগীবত করো না এবং তাদের দোষত্রুটি অন্বেষণ করো না। কারণ যে তাদের দোষ খুঁজবে স্বয়ং আল্লাহতার দোষ খুঁজবেন। আর আল্লাহ যার দোষ খুঁজবেন তাকে তার নিজের ঘরে লাঞ্ছিত করবেন।’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৯৭৭৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৮৮০

এ সকল হাদীসের শিক্ষা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য এক হাদীসে এক বাক্যেইরশাদ করেছেন-

المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده

অর্থ : মুসলিম সে, যার মুখ ও হাত থেকে সকল মুসলিম নিরাপদ থাকে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১০

অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর হক আদায়ের সাথে বান্দার হকও আদায় করে সে-ই প্রকৃত মুসলিম।

ইমাম নববী রাহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন-

فيه جمل من العلم، ففيه الحث على الكف عما يؤذي المسلمين، بقول أو فعل، بمباشرة أو سبب، وفيه الحث على الإمساك عن احتقارهم، وفيه الحث على تألُّف قلوب المسلمين واجتماع كلمتهم، واستجلاب ما يُحصّل ذلك. قال القاضي عياض : والألفة إحدى فرائض الدين وأركان الشريعة، ونظام شَمْل الإسلام.

‘‘এ হাদীসে রয়েছে অনেক ইলম : যেমন-নিজের কথা বা কাজের মাধ্যমে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেকোনো মুসলিমকে কষ্ট না দেওয়ার আদেশ, কোনো মুসলিমকে উপহাস ও তাচ্ছিল্য না করার আদেশ,মুসলমানদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠার এবং এর জন্য সহায়ক সকল পন্থা অবলম্বনের আদেশ ইত্যাদি।

কাযী ইয়ায রাহ. বলেছেন, ‘সম্প্রীতি দ্বীনের অন্যতম ফরয, শরীয়তের অন্যতম রোকন এবং বৈচিত্রেপূর্ণ মুসলিমসমাজকে একতাবদ্ধ করার উপায়’।’’-শরহু সহীহ মুসলিম ২/১০, বৈরুত

এই সকল হাদীসে যে হকগুলো বর্ণিত হয়েছে তা মুসলমানের সাধারণ হক। তা পাওয়ার জন্য মুমিন ওমুসলিম হওয়া ছাড়া আর কোনো শর্ত নেই। সুতরাং দুজন মুসলিমের মাঝে বা দুই দল মুসলমানেরমাঝে কোনো দ্বীনী বা দুনিয়াবী বিষয়ে মতভেদ হলে সেখানেও এ সকল হক রক্ষা করতে হবে এবংশরীয়তের এ সকল বিধান মেনে চলতে হবে।

কোনো হাদীসে বলা হয়নি যে, দুই মুসলিমের মাঝে মতভেদ হলে তখন আর এ সকল হক রক্ষা করতেহবে না; বরং সেটিই তো আসল ক্ষেত্র এই হকগুলো রক্ষা করার। সাধারণত মতপার্থক্য দেখা দিলেইএই হকগুলো বিনষ্ট করা হয়। সুতরাং ঐ ক্ষেত্রেই যদি সকলে তা রক্ষায় সতর্ক না হয় তাহলে আরসুন্নাহর অনুসরণ এবং হাদীস মোতাবেক আমলের কী অর্থ থাকে?

ইত্তিবায়ে সুন্নতের বিষয়ে এ হাদীস সবাই জানি-

من أحب سنتي فقد أحبني، ومن أحبني كان معي في الجنة.

‘যে আমার সুন্নতকে ভালবাসে সে আমাকে ভালবাসে। আর যে আমাকে ভালবাসে সে আমার সাথেজান্নাতে থাকবে।’

কিন্তু এটি একটি দীর্ঘ হাদীসের অংশ। পূর্ণ হাদীসটি এই-

عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال : قال لي رسول الله صلى الله عليه و سلم : يا بني إن قدرت أن تصبح وتمسي وليس في قلبك غش لأحد فافعل، ثم قال لي : يا بني وذلك من سنتي ومن أحيا سنتي فقد أحبني ومن أحبني كان معي في الجنة.

رواه الترمذي في كتاب العلم، وقال: هذا حديث حسن غريب من هذا الوجه.

আনাস রা.কে সম্বোধন করে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘বেটা! সকাল-সন্ধ্যায় যদি এমনভাবে থাকতে পার যে, তোমার মনে কারো প্রতি বিদ্বেষ নেই তাহলে এমনভাবেইথাক। বেটা! এটি আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নতকে যিন্দা করে সে আমাকে ভালবাসে। আর যেআমাকে ভালবাসে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।’-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৬৭৮

এই সুন্নতের সম্পর্ক যেহেতু অন্তর্জগতের সাথে, তাই এর আলোচনা কম হয়ে থাকে। আমাদের কর্তব্য,ইত্তিবায়ে সুন্নতের সময় এ সুন্নতটি যেন না ভুলি এবং হাদীস অনুসরণের আহবানের সময় এ হাদীসটিযেন বিস্মৃত না হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

এবার আমরা ঐক্য ও সম্প্রীতির অপরিহার্যতা এবং কলহ-বিবাদের বর্জনীয়তা সম্পর্কে কিছু হাদীসউল্লেখ করছি। (এ বিষয়েও হাদীসের বিভিন্ন কিতাব থেকে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। শুধুএকটি হাদীস তুলে দেওয়া হল।)

عن النعمان بن بشير رضي الله تعالى عنه قال : قال النبي صلى الله عليه وسلم  على المنبر : من لم يشكر القليل لم يشكر الكثير، ومن لم يشكر الناسَ لم يشكر الله عز وجل، والتحدُّث بنعمة شكر، وتركها كفر، والجماعة رحمة، والفرقةُ عذاب.

قال المنذري في الترغيب : بإسناد لا بأس به.

নুমান ইবনে বাশীর রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বারের বয়ানে বলেছেন, যে অল্পকিছুর উপর শোকরগোযারী করে না সে অনেক কিছুর উপরও শোকরগোযারি করে না। যে মানুষেরশোকর করে না সে আল্লাহরও শোকর করে না। নেয়ামত পেয়ে তা বর্ণনা করাও শোকরগোযারি আরতা না করা নেয়ামতের না-শোকরী। জামাআ হল রহমত আর বিচ্ছিন্নতা হচ্ছে আযাব।-যাওয়াইদুলমুসনাদ, হাদীস : ১৮৪৪৯, ১৯৩৫০; কিতাবুস সুন্নাহ, ইবনু আবী আসিম, হাদীস : ৯৩

মুসলমানের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য অনেক নীতিও বিধান দেওয়া হয়েছে। ইসলামের এ সকল বিধানের উপর সংক্ষেপে নজর বুলিয়ে গেলেও পরিষ্কারহয়ে যায়, বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা পরিহার করা ইসলামের দৃষ্টিতে কত গুরুত্বপূর্ণ।

পরিবারে পুরুষকে কর্তা বানানো হয়েছে এবং স্ত্রী ও সন্তানদেরকে তার অনুগত থাকার আদেশ করাহয়েছে। আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে বলা হয়েছে। জাতির সকল শ্রেণীর হক ও অধিকার নির্ধারণকরে এককে অপরের সাথে যুক্ত করা হয়েছে এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে-

كلكم راع وكلكم مسؤول عن رعيته

প্রত্যেকেই তোমরা দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার অধীনস্তদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।

অন্যদিকে একে অপরকে সালাম দেওয়া, অসুস্থকে দেখতে যাওয়া এবং এ জাতীয় সাধারণ হকসম্পর্কে সচেতন করে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বীজ বপন করা হয়েছে।

সফরে বের হলে একজনকে আমীর বানানোর আদেশ করা হয়েছে। সুলতান ও তার স্থলাভিষিক্ত, যারাউলূল আমরের অন্তর্ভুক্ত, তাদের অনুগত থাকার জোরালো আদেশ করা হয়েছে। তবে এখানেশরীয়তের এ বিধানও আছে যে-

لا طاعة لمخلوق في معصية الله عز وجل

অর্থ : আল্লাহর অবাধ্য হয়ে মাখলুকের আনুগত্য বৈধ নয়।

ছোট ব্যক্তি, বড় ব্যক্তি, ক্ষুদ্র সমাজ, বৃহৎ সমাজ সবার আনুগত্যের ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য।

মসজিদের জামাতে ইমামের অনুসরণ জরুরি। তার আগে দাঁড়ানো বা তার আগে কোনো রোকনআদায় করা নিষেধ। কাতার সোজা করা ওয়াজিব। কাতার বাঁকা হলে আছে মনের ঐক্য অন্তর্হিতহওয়ার হুঁশিয়ারি।

দ্বীন-দুনিয়ার যে কোনো যৌথ কাজে আছে শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের বিধান এবং উম্মাহর সকল শ্রেণীরজন্য রয়েছে এই গুরম্নত্বপূর্ণ নীতি- وأمرهم شورى بينهم ও

تعاونوا على البر والتقوى، ولا تعاونوا على الإثم والعدوان

কওমকে বলেছে আলিমের কাছে যাও এবং মাসাইল জিজ্ঞাসা করে সে অনুযায়ী চল। আরো বলাহয়েছে, দ্বীনদার, নেককার মানুষের সাহচর্য গ্রহণ কর। তালিবানে ইলমকে বলা হয়েছে উস্তাদেরসোহবত ও সান্নিধ্য গ্রহণ কর। সর্বোপরি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে-

ليس منا من لم يُجِلُّ كبيرنا، ويَرْحَمْ صغيرنا، ويَعْرِف لعالمنا.

قال الهيثمي في المجمع : 8/14 : رواه أحمد والطبراني، وإسناده حسن.

অর্থাৎ যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের দয়া করে না এবং আলিমের (হক) অনুধাবনকরে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।-শরহু মুশকিলিল আছার, হাদীস : ১৩২৮; মুসনাদে আহমদ,হাদীস : ২২৭৫৫

قال الهيثمي في المجمع : رواه أحمد والطبراني، وإسناده حسن.

-মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/১৪

উম্মাহর প্রত্যেক ব্যক্তিকে এই দীক্ষা দেওয়া হয়েছে যে-

الدين النصيحة، لله ولرسوله ولكتابه ولأئمة المسلمين وعامتهم.

অর্থাৎ দ্বীন হল ওফাদারি-আল্লাহর সাথে, আল্লাহর রাসূলের সাথে, মুসলমানদের নেতৃবৃন্দের সাথেএবং সাধারণ মুসলমানদের সাথে।

মোটকথা, যৌথ ও সামাজিক জীবনের বিধিবিধান এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে, যেন সকল ক্ষেত্রেঐক্য, সম্প্রীতি এবং পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার এক শান্তিময় পরিবেশ বিরাজ করে। গোটাসমাজ যেন হয় এ হাদীসের জীবন্ত নমুনা-

المسلمون كرجل واحد، إن اشتكى عينه اشتكى كله، وإن اشتكى رأسه اشتكى كله.

অর্থাৎ মুসলিমেরা সকলে মিলে একটি দেহের মতো, যার চোখে ব্যথা হলে গোটা দেহের কষ্ট হয়,মাথায় ব্যথা হলেও গোটা দেহের কষ্ট হয়।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৮৬/৬৭

এই সুশৃঙ্খল ও শান্তিময় জীবনের সকল উপাদান সংরক্ষণ করতে হবে। কলহ-বিবাদেরউপাদানগুলোকে ক্রিয়াশীল হতে দেওয়া যাবে না এবং শান্তির সমাজে অশান্তির আগুন জ্বলতে দেওয়াযাবে না। এটি ঐ হাদীসের দাবি, যাতে বলা হয়েছে, ‘জামাআ হচ্ছে রহমত আর ফুরকা হচ্ছে আযাব।’নববী ও কাযী ইয়াযের যে কথাগুলো ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে তাতেও এদিকে ইঙ্গিত রয়েছে।

জামাআতে শামিল থাকার বিষয়ে অনেক হাদীস ও আছার রয়েছে, যা পাওয়া যাবে হাদীসগ্রন্থেরকিতাবুল ফিতান, কিতাবুল ইমারাহ, কিতাবুল ইতিসাম বিলকিতাবি ওয়াস সুন্নাহ প্রভৃতি অধ্যায়ে।

এসকল হাদীস সামনে রেখে চিন্তা করলে প্রতীয়মান হয়, আলজামাআ শব্দে নিমেণাক্ত বিষয়গুলোশামিল আছে :

১. আমীরুল মুমিনীন বা সুলতানের কতৃত্ব স্বীকারকারীদের সঙ্গে থাকা এবং শরীয়তসম্মত বিষয়ে তারআনুগত্য বর্জন না করা। (দ্রষ্টব্য : ফাতহুল বারী ১৩/৩৭, হাদীস : ৭০৮৪-এর আলোচনায়)

২. শরীয়তের আহকাম ও বিধানের ক্ষেত্রে উম্মাহর ‘আমলে মুতাওয়ারাছ’ তথা সাহাবা-তাবেয়ীন যুগথেকে চলে আসা কর্মধারা এবং উম্মাহর সকল আলিম বা অধিকাংশ আলিমের ইজমা ও ঐক্যেরবিরোধিতা না করা। (দ্রষ্টব্য : উসূলের কিতাবসমূহের ইজমা অধ্যায়)

৩. হাদীস-সুন্নাহ এবং ফিকহের ইলম রাখেন, এমন উলামা-মাশাইখের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখা।ইমাম তিরমিযী রাহ. আহলে ইলম থেকে আলজামাআর যে ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছেন তা এই-

أهل الفقه والعلم والحديث

অর্থাৎ জামাআ হচ্ছে ফিকহ ও হাদীসের ধারক আলিম সম্প্রদায়। (কিতাবুল ফিতান, বাবু লুযুমিলজামাআ, হাদীস : ২১৬৭-এর আলোচনায়)

৪. মুসলিমসমাজের ঐক্য, সংহতি এবং ঈমানী ভ্রাতৃত্বের উপাদানসমূহের সংরক্ষণ এবং অনৈক্য,বিবাদ ও হানাহানির উপকরণসমূহ থেকে সমাজকে মুক্ত করার প্রয়াস, যে সম্পর্কে ইতিপূর্বে বলাহয়েছে।

এখানে যে চারটি বিষয় উল্লেখ করা হল সাধারণত আলজামাআর ব্যাখ্যায় এগুলোকে আলাদা আলাদামত হিসেবে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এদের মাঝে কোনো সংঘর্ষ নেই। প্রত্যেকটি হচ্ছেআলজামাআর বিভিন্ন দিক। একেকজন একেকটি দিক আলোচনা করেছেন।

একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা

এখানে যে কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা এই যে, উপরোক্ত হাদীসসমূহে ‘আলজামাআ’র বিপরীতেএসেছে ‘আলফুরকা’; ‘আলইখতিলাফ’ নয়। অনেকে ফুরকা বা বিচ্ছিন্নতা শব্দের তরজমা করে ফেলেনইখতিলাফ বা মতভেদ। এই তরজমা আপত্তিকর। সামনে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আসবেইনশাআল্লাহ।

মতভেদ কখন বিভেদ হয়

উল্লেখিত আয়াত ও হাদীস থেকে ঐক্য ও সম্প্রীতির গুরুত্ব যেমন বোঝা যায় তেমনি বোঝা যায়, সকলমতভেদ বিভেদ নয়। কারণ কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট বর্ণনা অনুযায়ী নবী ও রাসূলদের মাঝে কোনোবিভেদ ছিল না। তারা পরস্পর অভিন্ন ছিলেন। যদিও শরীয়তের বিধিবিধান সবার এক ছিল না,পার্থক্য ও বিভিন্নতা ছিল। কিন্তু তা ছিল দলিলভিত্তিক, খেয়ালখুশি ভিত্তিক -নাউযুবিল্লাহ- ছিল না।সুতরাং বোঝা গেল, ফুরূ বা শাখাগত বিষয়ে দলিলভিত্তিক মতপার্থক্য বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা নয়।

সবাই জানেন, দাউদ আ. ছিলেন আল্লাহর নবী। তাঁর পুত্র সুলায়মান আ.ও নবী ছিলেন। একমোকদ্দমার রায় সম্পর্কে দুজনের মাঝে ইজতিহাদগত মতপার্থক্য হল। আল্লাহ তাআলা কুরআনমজীদে তাদের মতপার্থক্যের দিকে ইঙ্গিত করেছেন এবং সুলায়মান আ.-এর ইজতিহাদ যে তাঁরমানশা মোতাবেক ছিল সেদিকেও ইশারা করেছেন। তবে পিতাপুত্র উভয়ের প্রশংসা করেছেন। তোএখানে ইজতিহাদের পার্থক্য হয়েছে, কিন্তু বিভেদ হয়নি। এই পার্থক্যের আগেও যেমন পিতাপুত্র দুইনবী এক ছিলেন, তেমনি পার্থক্যের পরও।

(দেখুন : সূরা আম্বিয়া (২১) : ৭৮-৭৯)

তাফসীরে ইবনে  কাসীর, তাফসীরে কুরতুবী (১১/৩০৭-৩১৯) ও অন্যান্য তাফসীরের কিতাব দেখেনেওয়া যায়।

তো বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার ছূরতগুলো ভালোভাবে জেনে নেওয়া চাই। আর তা এই-

১. দ্বীন ইসলামে দাখিল না হওয়া, ইসলামের বিরোধিতা করা বা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া-এগুলো সর্বাবস্থায় দ্বীনের ক্ষেত্রে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা।

তাওহীদ এবং দ্বীনের অন্যান্য মৌলিক বিষয়, যেগুলোকে পরিভাষায় ‘জরূরিয়াতে দ্বীন’ বলে, তারকোনো একটির অস্বীকার বা অপব্যাখ্যা হচ্ছে ইরতিদাদ (মুরতাদ হওয়া), যা দ্বীনের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতারজঘন্যতম প্রকার। এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় দ্বীন ইসলামকে মনে প্রাণে গ্রহণ করা।

২. দ্বীনে ইসলাম গ্রহণের পর কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী আকীদাসমূহ বোঝার ক্ষেত্রে খেয়ালখুশিরঅনুসরণ করে সাহাবীগণের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া। এটাও বিচ্ছিন্নতা। হাদীস শরীফে কঠিন ভাষায়এর নিন্দা করা হয়েছে এবং তা থেকে বাঁচার জন্য দুটি জিনিসকে দৃঢ়ভাবে ধারণের আদেশ করাহয়েছে : ‘আসসুন্নাহ’ এবং ‘আলজামাআ’। এ কারণে যে জামাত সিরাতে মুসতাকীমের উপর অটলথাকে তাদের নাম ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ।’

তাদের পথ থেকে যারাই বিচ্যুত হয়েছে তারাই এই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়েছে। অতপরকোনো দল ও ফের্কার জন্ম দিলে তা তো আরো মারাত্মক।

৩. আলজামাআর ব্যাখ্যায় উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির প্রসঙ্গে প্রথম যে বিষয়ের কথা বলা হয়েছে তারকোনো একটি ভঙ্গ করা কিংবা কোনো একটি থেকে বিচ্যুত হওয়া পরিষ্কার বিচ্ছিন্নতা।

আর ‘আলজামাআর’ ব্যাখ্যায় উল্লেখিত চতূর্থ বিষয়টি অর্থাৎ মুসলিম সমাজের ইজতিমায়ী রূপরেখাবিনষ্ট করা বা এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে তা বিনষ্ট হয় তাও বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শামিল।

ফুরূয়ী মাসাইল বা শাখাগত বিষয়ে মুজতাহিদ ইমামগণের যে মতপার্থক্য, যাকে ফিকহী মাযহাবেরমতপার্থক্য বলে, তা দ্বীনের বিষয়ে বিচ্ছিন্নতা নয়। আগেও এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কারণফিকহের এই মাযহাবগুলো তো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামগণেরই মাযহাব। এগুলো‘বিচ্ছিন্নতা নয়; বরং গন্তব্যে পৌঁছার একাধিক পথ, যা স্বয়ং গন্তব্যের মালিকের পক্ষ হতে স্বীকৃত ওঅনুমোদিত। ফির্কা ও ফিকহী মাযহাবের পার্থক্য বুঝতে ব্যর্থ হওয়া খুবই দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনকবিষয়।

সাহাবায়ে কেরামের যুগেও ফিকহের মাযহাব ও ফিকহের মতপার্থক্য ছিল, অথচ তাঁরা খেয়ালখুশিরমতভেদ কখনো সহ্য করতেন না। তাদের কাছে এ জাতীয় মতভেদকারীদের উপাধি ছিল ‘আহলুলআহওয়া’, ‘আহলুল বিদা ওয়াদ দ্বলালাহ’ এবং ‘আহলুল বিদআতি ওয়াল ফুরকা’।

সাহাবায়ে কেরামের যুগে ফিকহের মাযহাব

এ সম্পর্কে ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর বিবরণ শুনুন :

ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. (১৬১ হি.-২৩৪ হি.) ছিলেন ইমাম বুখারী রাহ.-এর বিশিষ্ট উস্তাদ।তিনি সাহাবায়ে কেরামের সেসব ফকীহের কথা আলোচনা করেছেন, যাদের শাগরিদগণ তাঁদের মত ওসিদ্ধান্তগুলো সংরক্ষণ করেছেন, তা প্রচার প্রসার করেছেন এবং যাদের মাযহাব তরীকার  উপরআমল ফতওয়া জারি ছিল। আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. এই প্রসঙ্গে বলেছেন, সাহাবায়ে কেরামেরমধ্যে এমন ব্যক্তি ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. (মৃত্যু : ৩২ হিজরী), যায়েদ ইবনে ছাবিত রা. (জন্ম : হিজরতপূর্ব ১১ ও মৃত্যু : ৪৫ হিজরী) ও আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. (জন্ম : হিজরতপূর্ব ৩ ওমৃত্যু : ৬৮ হিজরী)।

তাঁর আরবী বাক্যটি নিমণরূপ-

ولم يكن في أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم من له صُحَيْبَةٌ، يذهبون مذهبه، ويفتون بفتواه ويسلكون طريقته، إلا ثلاثة : عبد الله بن مسعود وزيد بن ثابت وعبد الله بن عباس رضي الله عنهم، فإن لكل منهم أصحابا يقومون بقوله ويفتون الناس.

এরপর আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. তাঁদের প্রত্যেকের মাযহাবের অনুসারী ও তাঁদের মাযহাব মোতাবেকফতওয়া দানকারী ফকীহ তাবেয়ীগণের নাম উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদরা.-এর যে শাগরিদগণ তাঁর কিরাত অনুযায়ী মানুষকে কুরআন শেখাতেন, তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ীমানুষকে ফতওয়া দিতেন এবং তাঁর মাযহাব অনুসরণ করতেন তারা হলেন এই ছয়জন মনীষী :আলকামাহ (মৃত্যু : ৬২ হিজরী), আসওয়াদ (মৃত্যু : ৭৫ হিজরী), মাসরূক (মৃত্যু : ৬২ হিজরী),আবীদাহ (মৃত্যু : ৭২ হিজরী), আমর ইবনে শুরাহবীল (মৃত্যু : ৬৩ হিজরী) ও হারিস ইবনে কাইস (মৃত্যু: ৬৩ হিজরী)।

ইবনুল মাদীনী রাহ. বলেছেন, ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. (৪৬-৯৬ হিজরী) এই ছয়জনের নাম উল্লেখকরেছেন।

ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর উপরোক্ত বিবরণের সংশ্লিষ্ট  আরবী পাঠ নিমণরূপ-

الذين يقرؤن الناس بقراءته ويفتونهم بقوله وبذهبون مذهبه …

এরপর আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. লিখেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর (ফকীহ) শাগরিদদেরসম্পর্কে এবং তাঁদের মাযহাবের বিষয়ে সবচেয়ে বিজ্ঞ ছিলেন ইবরাহীম (নাখায়ী) (৪৬-৯৬ হিজরী)এবং আমের ইবনে শারাহীল শাবী (১৯-১০৩ হিজরী)। তবে শাবী মাসরূক রাহ.-এর মাযহাব অনুসরণকরতেন।

আরবী পাঠ নিমণরূপ-

وكان أعلم أهل الكوفة بأصحاب عبد الله ومذهبهم إبراهيم والشعبي إلا أن الشعبي كان يذهب مذهب مسروق.

এরপর লিখেছেন-

وكان أصحاب زيد بن ثابت الذين يذهبون مذهبه في الفقه ويقومون بقوله هؤلاء الاثنى عشر …

অর্থাৎ যায়েদ ইবনে ছাবিত রা.-এর যে শাগরিদগণ তাঁর মাযহাবের অনুসারী ছিলেন এবং তাঁর মত ওসিদ্ধান্তসমূহ সংরক্ষণ ও প্রচার প্রসার করতেন তাঁরা বারো জন।

তাঁদের নাম উল্লেখ করার পর ইবনুল মাদীনী রাহ. লেখেন, এই বারো মনীষী ও তাদের মাযহাবেরবিষয়ে সবচেয়ে বিজ্ঞ ছিলেন ইবনে শিহাব যুহরী (৫৮-১২৪ হিজরী), ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ আনসারী(মৃত্যু : ১৪৩ হিজরী), আবুয যিনাদ (৬৫-১৩১ হিজরী) এবং আবু বকর ইবনে হাযম (মৃত্যু ১২০হিজরী)।

এদের পরে ইমাম মালেক ইবনে আনাস রাহ. (৯৩-১৭৯ হিজরী)।

এরপর ইবনুল মাদীনী রাহ. বলেছেন-

‘তদ্রূপ আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর যে শাগরিদগণ তাঁর মত ও সিদ্ধান্তসমূহ সংরক্ষণ ও প্রচারকরতেন, সে অনুযায়ী ফতওয়া দিতেন এবং তার অনুসরণ করতেন, তাঁরা ছয়জন।

وكما أن أصحاب ابن عباس ستة الذين يقومون بقوله ويفتون به ويذهبون مذهبه.

এরপর তিনি তঁদের নাম উল্লেখ করেন।

ইমাম ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর পূর্ণ আলোচনা তাঁর ‘কিতাবুল ইলালে’ (পৃষ্ঠা : ১০৭-১৩৫, প্রকাশ :দারুবনিল জাওযী রিয়ায, ১৪৩০ হিজরী।) বিদ্যমান আছে এবং ইমাম বায়হাকী রাহ.-এর‘আলমাদখাল ইলাস সুনানিল কুবরা’তেও (পৃষ্ঠা : ১৬৪-১৬৫) সনদসহ উল্লেখিত হয়েছে। আমিউক্তিটি দোনো কিতাব সামনে রেখেই উদ্ধৃত করেছি। এই কথাগুলো আলোচ্য বিষয়ে এতই স্পষ্ট যে,কোনো টীকা-টিপ্পনীর প্রয়োজন নেই। সুতরাং মনে রাখতে হবে, ইমামগণের ফিকহী মাযহাবের যেমতপার্থক্য তাকে বিভেদ মনে করা অন্যায় ও
বাস্তবতার বিকৃতি এবং সাহাবায়ে কেরামের নীতি ও ইজমার বিরোধিতা। আর এ পার্থক্যের বাহানায়মাযহাব অনুসারীদের থেকে আলাদা হয়ে তাদের নিন্দা-সমালোচনা করা সরাসরি বিচ্ছিন্নতা, যা দ্বীনেরবিষয়ে বিভেদের অন্তর্ভুক্ত।

মাযহাবকে আসাবিয়াতের কারণ বানানো

তেমনি ফিকহী মাযহাবের অনুসারী কোনো ব্যক্তি বা দল যদি মাযহাবকে জাহেলী আসাবিয়াত ওদলাদলির কারণ বানায় তাহলে তার/তাদের এই কাজও নিঃসন্দেহে ঐক্যের পরিপন্থী এবং বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শামিল।

দেখুন, ‘মুহাজিরীন’ ও ‘আনসার’ কত সুন্দর দুটি নাম এবং কত মর্যাদাবান দুটি জামাত। উভয়জামাতের প্রশংসা কুরআন মজীদে রয়েছে। কিন্তু এক ঘটনায় যখন এ দুই নামের ভুল ব্যবহার হয়েছেতখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে সঙ্গে তাম্বীহ করেছেন।

জাবির রা. থেকে বর্ণিত, এক সফরে এক মুহাজির তরুণ ও এক আনসারী তরুণের মাঝে কোনোবিষয়ে ঝগড়া হয়। মুহাজির আনসারীকে একটি আঘাত করল। তখন আনসারী ডাক দিল, يا للأنصار! হেআনসারীরা!; মুহাজির তরুণও ডাক দিল-يا للمهاجرين! হে মুহাজিররা!; আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আওয়াজ শোনামাত্র বললেন-ما بال دعوى الجاهلية এ কেমন জাহেলী ডাক! কীহয়েছে?

ঘটনা বলা হল।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এমন জাহেলী ডাক ত্যাগ কর। এ তোদুর্গন্ধযুক্ত ডাক!

অন্য বর্ণনায় আছে, এতে তো বিশেষ কিছু ছিল না। (কেউ যদি কারো উপর জুলুম করে তাহলে)সকলের কর্তব্য, তার ভাইয়ের সাহায্য করা। সে জুলুম করুক বা তার উপর জুলুম করা হোক। জালিমহলে তাকে বাধা দিবে। এটাই তার সাহায্য। আর মাজলুম হলে তার সাহায্য করবে (জুলুম থেকে রক্ষাকরবে)।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪৯০৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৮৪/৬২, ৬৩

হাদীসের অর্থ হচ্ছে, কারো উপর জুলুম হতে থাকলে সাহায্যের জন্য ডাকতে বাধা নেই। কিন্তু ডাকবেসব মুসলমানকে। যেমন উপরোক্ত ঘটনায় আনসারী মুহাজিরদেরকেও ডাকতে পারতেন এবং মুহাজিরআনসারীদেরকে ডাকতে পারতেন। কিংবা ভাইসব! মুসলমান ভাইরা! বলেও ডাকা যেত। কিন্তু এমনকোনো ডাক মুসলমানের জন্য শোভন নয়, যা থেকে আসাবিয়ত ও দলাদলির দুর্গন্ধ আসে। কারণ তাছিল জাহেলী যুগের প্রবণতা। ঐ সময় সাহায্য ও সমর্থনের ভিত্তি ছিল বংশীয় বা গোত্রীয় পরিচয়।ইসলামে সাহায্যের ভিত্তি হচ্ছে ন্যায় ও ইনসাফ। ইরশাদ হয়েছে-

وتعاونوا على البر والتقوى، ولا تعاونوا على الإثم والعدوان

এ কারণে ইসলামের নিয়ম, জালিমকে আটকাও সে যেই হোক না কেন। হাদীসে আছে-

ليس منا من دعا إلى عصبية، وليس منا من قاتل عصبية، وليس منا من مات على عصبية

‘ঐ ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আসাবিয়তের দিকে ডাকে, সেও আমাদের দলভুক্ত নয়, যেআসাবিয়তের কারণে লড়াই করে এবং সে-ও নয়, যে আসাবিয়তের উপর মৃত্যুবরণ করে।’-সুনানেআবু দাউদ, হাদীস : ৫১২১

অন্য হাদীসে আছে-

يا رسول الله! ما العصبية؟ قال : أن تعين قومك على ظلم.

‘আল্লাহর রাসূল! আসাবিয়ত কী? বললেন, নিজের কওমকে তার অন্যায়-অবিচারের বিষয়ে সাহায্যকরা।’-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫১১৯

তো ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এই যে, ‘মুহাজির’ ও ‘আনসার’ দুটি আলাদা নাম, আলাদাজামাত, আলাদা পরিচয়-এতে আপত্তির কিছু নেই। আপত্তি তখনই হয়েছে যখন নাম দুটি এমনভাবেব্যবহার করা হল, যা থেকে আসাবিয়তের দুর্গন্ধ আসে। এ শিক্ষা ফিকহি মাযহাবের ভিত্তিতে আলাদাজামাত ও আলাদা পরিচয় কিংবা অন্য কোনো বৈধ বা প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে শ্রেণী ওপরিচয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।  এ নীতি সব ক্ষেত্রেই মনে রাখা উচিত।

কথা দীর্ঘ হয়ে গেল। আমি আরজ করছিলাম, ফুরূয়ী ইখতিলাফকে দ্বীনের বিষয়ে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতারমধ্যে দাখিল করা এবং ফিকহী মাযহাবের অনুসরণকে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা সাব্যস্ত করা জায়েয নয়।

যে বিষয়গুলো ঐক্যের পরিপন্থী নয়

উপরোক্ত আলোচনায় ঐ বিষয়গুলো সামনে এসেছে, যা উম্মাহর ঐক্যের পরিপন্থী। সংক্ষেপে ঐবিষয়গুলোও উল্লেখ করে দেওয়া প্রয়োজন, যেগুলোকে কোনো লোক ঐক্যের পরিপন্থী মনে করতেপারে অথচ তা উম্মাহর ঐক্য রক্ষার জন্যই জরুরি। যেমন :

১. আহলে কুফর ও আহলে শিরক থেকে আলাদা থাকা। তাদের বাতিল বিষয়াদিতে সঙ্গ না দেওয়া।তাদের জাতীয় নিদর্শন ও সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকা। তাদের সাথে অন্তরঙ্গতা না রাখা। রাজনৈতিকপ্রয়োজনে (মুসলিম উম্মাহর রাজনীতি হবে সর্বদা দ্বীনের অধীন) তাদের সাথে সন্ধির প্রয়োজন হলে তাশরীয়তের বিধান মোতাবেক হতে পারে।

২. ‘আহলুল বিদআ ওয়াল ফুরকা’র সাথে তাদের বিদআত ও বিচ্ছিন্নতার বিষয়ে একমত না হওয়া।তালীম-তরবিয়ত, সুলুক ও তাযকিয়ার প্রয়োজনে তাদের সাহচর্য গ্রহণ না করা। কারণ সাহচর্যের দ্বারামানুষ প্রভাবিত হয়। ‘আহলুল আহওয়া’র সাহচর্য গ্রহণ করার বিষয়ে সাহাবা-তাবেয়ীন নিষেধকরেছেন।

৩. প্রকাশ্যে ফিসক-ফুজুরে লিপ্ত ব্যক্তিদের সংশ্রব থেকে দূরে থাকা।

৪. অন্যায় ও ভুল কাজে কারো সাহায্য না করা। আসাবিয়ত ও দলাদলির ক্ষেত্রে কাউকে সঙ্গ নাদেওয়া।

৫. ‘যাল্লাত’( যেসব ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে ভুল হয়েছে এমন) ক্ষেত্রে আকাবির ও মাশাইখের তাকলীদ নাকরা।

৬. জালিমকে জুলুম থেকে বিরত রাখা।

৭. ওয়াজ-নসীহত

৮. শরীয়তের নীতি ও বিধান অনুযায়ী আমর বিল মারুফ ও নাহী আনিল মুনকার করা।

৯. ইলমী আদব রক্ষা করে মতবিনিময়ের উদ্দেশ্যে মতভেদপূর্ণ ইজতিহাদী বিষয়াদিতে দলিলেরভিত্তিতে আলোচনা-পর্যালোচনা করা।

১০. কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনে শরীক না হওয়া, কিংবা বলুন, পশ্চিমাদের পদ্ধতিতেরাজনীতিকারী কোনো সংগঠনে শামিল না হওয়া।

শাখাগত মতভেদের ক্ষেত্রে সুন্নাহ অনুসরনের সুন্নাহসম্মত পন্থা

ইতিপূর্বের আলোচনায় সম্ভবত স্পষ্ট হয়েছে যে, শরীয়তের শাখাগত বিষয়ে মুজতাহিদ ইমামগণেরমতভিন্নতাকে বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা মনে  করা ভুল। কুরআন-সুন্নাহয় যে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতাকে নিষিদ্ধকরা হয়েছে এবং বাইয়িনাত তথা কিতাব-সুন্নাহর অকাট্য ও সুস্পষ্ট দলিল থাকার পরও মতভেদকরার যে নিন্দা করা হয়েছে মুজতাহিদ ইমামগণের মতপার্থক্যকে তার অন্তর্ভুক্ত করা প্রকৃতপক্ষে জেনেকিংবা না জেনে  উপরোক্ত নুসূসেরই অপব্যাখ্যা। কেননা এসব নুসূসের উদ্দেশ্য নিষিদ্ধ মতভেদ, যাস্পষ্টত বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা। যে সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

তবে কোনো ব্যক্তি বা দল যদি শাখাগত মতভিন্নতার ক্ষেত্রে শরীয়তের নীতি ও বিধান অনুসরণ নাকরে উম্মাহর মাঝে কলহ-বিবাদ ছড়ায় তাহলে সে উম্মতের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির অপরাধে অপরাধীসাব্যস্ত হবে। তাই আমাদেরকে এসব নীতি ও বিধান জানতে হবে এবং শাখাগত মতভিন্নতার ক্ষেত্রেসুন্নাহ অনুসরণের এবং সুন্নাহর প্রতি দাওয়াতের মাসনুন ও মুতাওয়ারাছ তথা সুন্নাহসম্মত ও অনুসৃতপন্থা জানতে হবে। যেন ঐসব নীতি ও বিধানের বিরোধিতার কারণে বিচ্ছিন্নতার শিকার না হয়ে যাই।

অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, কোনো কোনো বন্ধু বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার আয়াত ও হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েআহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামদের ফিকহী মাযহাবের উপর বিচ্ছিন্নতা ও বিভক্তির আপত্তিতুলছেন তারা একটুও চিন্তা করছেন না যে, নির্ভরযোগ্য ফিকহি মাযহাবের মতভিন্নতা সম্পূর্ণ বৈধ ওশরীয়তসম্মত। এটি নিষিদ্ধ বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার আওতাভুক্ত নয়। অন্যদিকে তারা হাদীস ও সুন্নহারব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকারী ফিকহের মাযহাবগুলোকে হাদীসের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে তার সম্পর্কেলোকদেরকে বিরূপ করে এবং বৈধ মতভিন্নতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তারা নিজেরাই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতায়লিপ্ত। এজন্য প্রথমে শাখাগত বিষয়ে ফিকহের ইমামগণের মতভিন্নতার প্রকার ও বিধান সম্পর্কেআলোচনা করা উচিত।

ফিকহি মাসায়েলের প্রকারসমূহ

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর যে কোনো ফিকহী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করলেদেখা যাবে, সকল মাসায়েল মৌলিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত : ১. ঐ সকল মাসাইল, যার বিধান সকলমাযহাবে এক ও অভিন্ন। যেমন-পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয, সর্বমোট সতের রাকাত নামায ফরয, প্রতিরাকাতে একটি রুকু ও দুইটি সিজদা, তাকবীরে তাহরীমার মাধ্যমে নামায শুরু হয় এবং সালামেরমাধ্যমে শেষ হয় ইত্যাদি। ইবাদত থেকে মীরাছ পর্যন্ত শত শত নয়; হাজার হাজার মাসআলা আছে, যা‘মুজমা আলাইহি’। অর্থাৎ এসব মাসআলায় গোটা উম্মাহর; বা বলুন, মুজতাহিদ ইমামগণের ইজমারয়েছে। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর কোনো নির্ভরযোগ্য কিতাবে ভিন্ন বিধান পাওয়া যাবে না।

এসব বিষয়ে ইজমা এ কারণেই হয়েছে যে, এই বিধানগুলো হয়তো কোনো আয়াত বা মুতাওয়াতিরসুন্নাহয় সরাসরি বিদ্যমান আছে। কিংবা এমন কোনো সহীহ হাদীসে আছে, যা উসূলে হাদীসেরমানদন্ডে দলিলযোগ্য হওয়ার বিষয়ে হাদীস বিচারক মুহাদ্দিসদের মাঝে কোনো মতভিন্নতা নেই।অথবা সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগে কিংবা পরবর্তী ফকীহগণের মাঝে ঐ বিষয়ে ইজমা সংগঠিতহয়েছিল।

২. ঐ সকল মাসাইল, যাতে ইমামগণের মাঝে মতভিন্নতা রয়েছে।

এই মতভিন্নতা সম্পর্কে কিছু মানুষের মাঝে এই কু-ধারণা লক্ষ্য করা যায় যে, এ মতভিন্নতার সূচনাহয়েছে খায়রুল কুরুনের পর। আর তা হয়েছে হাদীস বিষয়ে ইমামগণের অজ্ঞতা কিংবা হাদীসঅনুসরণে অনীহার কারণে। অথচ ইসলামী ফিকহের ইতিহাস যারা পড়েছেন এবং মুজতাহিদইমামগণের মর্যাদা, ইলম-আমল ও খোদাভীরুতা সম্পর্কে যারা অবগত অথবা অন্তত ফিকহের দীর্ঘ ওদলিল-প্রমাণের আলোচনা সম্বলিত কিতাবাদি অধ্যয়নের সুযোগ যাদের হয়েছে তারা জানেন, এইকুধারণা কত জঘণ্য ও অবাস্তব।

বাস্তবতা এই যে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ফিকহের নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহে যেসব মাসআলায়মতভিন্নতা পাওয়া যায় তার অধিকাংশেই সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের যুগ থেকেই মতভিন্নতা চলেআসছে কিংবা বিষয়টিই এমন যাতে কোনো আয়াত বা সহীহ হাদীস নেই, এমনকি এ বিষয়ে সাহাবায়েকেরামের ইজমা অথবা কোনো আছারও পাওয়া যায় না। মুজতাহিদ ইমামগণ শরঈ কিয়াসের ভিত্তিতেইজতিহাদ করে এসব সমাধান বের করেছেন।

হ্যাঁ, ফিকহের কিতাবসমূহে হাতে গোনা কিছু মাসআলা পাওয়া যাবে, যেগুলোকে ‘যাল্লাহ’ (বিচ্যুতি),শায, কিংবা আলইখতিলাফু গায়রুস সায়েগ (অগ্রহণযোগ্য মতভেদ) বলা হয়। এসব মাসআলায়কোনো মুজতাহিদ থেকে নিশ্চিত ভ্রান্তি হয়ে গেছে। এজন্য উসূলে ফিকহ ও উসূলে ইফতার সর্বসম্মতসিদ্ধান্ত এই যে, এসব মাসআলা ‘মামুল বিহী ফিকহ’ (আমলযোগ্য ফিকহ) ও ‘মুফতা বিহী কওল’ (ফতওয়া প্রদানযোগ্য সিদ্ধান্ত) নয়। কোনো মাযহাবের দায়িত্বশীল কোনো মুফতী এসব মাসআলাঅনুযায়ী ফতওয়া প্রদান করেন না। এ ধরনের হাতে গোনা কিছু মাসআলা ছাড়া ফিকহের সকলমতভেদপূর্ণ মাসআলা তিন প্রকারে বিভক্ত।

প্রথমে তিন প্রকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পেশ করব। এরপর প্রত্যেকটির উপর বিস্তারিত আলোচনাকরব ইনশাআল্লাহ।

. সুন্নাহর বিভিন্নতার ক্ষেত্রে মতভেদ

অর্থাৎ কোনো ইবাদতের পদ্ধতি (যেমন-নামায, হজ্ব ইত্যাদি) সম্পর্কিত এমন কিছু পার্থক্য, যারাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগেও ছিল এবং খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়েকেরামের যুগেও ছিল। কারণ এসব ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেই একাধিকসুন্নাহ বা পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। আর সাহাবায়ে কেরামের মাঝেও উভয় পদ্ধতি অনুসারেই কমবেশিআমল হয়েছে। এভাবে পরবর্তী যুগেও উভয় পদ্ধতি অনুযায়ী আমল হয়েছে। এ ধরনের মতভিন্নতারঅপর নাম ‘ইখতিলাফুত তানাওউ’ অর্থাৎ সুন্নাহর বিভিন্নতার কারণে মতভিন্নতা। আরেক নাম‘আলইখতিলাফুল মুবাহ’ অর্থাৎ এমন মতপার্থক্য, যার উভয় পদ্ধতি সকল মুজতাহিদের নিকট বৈধ।

. দলিলের মর্মোদ্ধার, গ্রহণযোগ্যতা বিচার দলিলসমূহের পরস্পর বিরোধের ক্ষেত্রে মতভেদ

অর্থাৎ কোনো বিষয়ের বিধান কোনো আয়াত বা হাদীস থেকে গ্রহণ করা যায়, তবে ঐ আয়াত বাহাদীসটি ঐ সিদ্ধান্তের জন্য ‘নসসে মুহকাম’ নয়। অর্থাৎ আরবী ভাষার নিয়ম-কানুন ও মর্মোদ্ধারেরনীতিমালা, এক শব্দে বললে, উসূলে ফিকহের নীতিমালা অনুযায়ী এ আয়াত বা হাদীসে একাধিকঅর্থের বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণে মুজতাহিদ ইমাম কিংবা ফকীগণের মাঝে মতভিন্নতা সৃষ্টিহয়েছে।

আবার এমনও হয় যে, মাসআলার বিধান সম্পর্কে কোনো হাদীস আছে, কিন্তু ইলমুল ইসনাদ বা উসূলেহাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী তা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত কি না;পারিভাষিক শব্দে বললে, ঐ হাদীসটি সহীহ বা দলিলযোগ্য কি না-এ বিষয়ে হাদীস বিচারকমুহাদ্দিসগণের মাঝে মতভিন্নতা আছে।

প্রসঙ্গত মনে রাখা উচিত, মুজতাহিদ ইমামগণও হাফিযুল হাদীস হয়ে থকেন এবং হাদীস বিচারেওপারদর্শী হয়ে থাকেন।

হাদীসটি যেহেতু এমন যে, ইলমুল হাদীসের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সহীহ, অন্য সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যয়ীফবা মালুল কিংবা শায ও মুনকার তাই যে ইমাম হাদীসটি সহীহ মনে করেছেন তিনি এই মাসআলায়এক ধরনের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আর যিনি একে দলিল হওয়ার যোগ্য মনে করেননি তিনি অন্য কোনোদলিল দ্বারা, যেমন-কোনো সাহাবী বা তাবেয়ীর আছর দ্বারা কিংবা শরঈ কিয়াস দ্বারা ইজতিহাদ করেসমাধান দিয়েছেন এবং তার সিদ্ধান্ত ভিন্ন হয়েছে।

তো সারকথা এই যে, এই প্রকারের মাসআলায় কুরআন-হাদীসের দলিল বিদ্যমান থাকার পরওমতভেদ হয়েছে। কারণ সংশ্লিষ্ট আয়াতটি নসসে মুহকাম নয়। আর হাদীসটি হয়তো সর্বসম্মত সহীহনয় অর্থাৎ তার সহীহ হওয়ার বিষয়টি স্বয়ং হাদীস বিচারকদের মাঝেই মতভেদপূর্ণ। অথবা তা নসসেমুহকাম নয়। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট মাসআলায় তা দ্ব্যর্থহীন নয়, একাধিক অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে।

দলিলের বিশুদ্ধতা বা অর্থের ক্ষেত্রে যেখানে মতভেদের অবকাশ রয়েছে সেখানে মুজতাহিদ ইমাম ওফকীহগণকে সংশ্লিষ্ট সমস্যার সমাধান ইজতিহাদের মাধ্যমেই করতে হয়।

এরচেয়েও জটিল বিষয় হল বিভিন্ন দলিলের বিরোধ। অর্থাৎ যেসব মাসআলায় মুজতাহিদ ফকীহ তারসামনে বিদ্যমান দলিলসমূহের মাঝে বিরোধ অনুভব করেন সেখানে মাসআলার বিধান নির্ণয়ের জন্যতাঁকে ঐ বিরোধ নিরসন করতে হয়। আর এর জন্য যে কাজগুলো করতে হয় তার পারিভাষিক নামএই :

১. الجمع বা التطبيق (সমন্বয়)।

২. الترجيح বা معرفة الراجح والمرجوح (অগ্রগণ্য নির্ণয়)।

৩. النسخ বা معرفة الناسخ والمنسوخ (নাসিখ-মানসূখ নির্ণয়)।

দলিলসমূহের বিশ্লেষণ ও তা থেকে বিধান গ্রহণের সময় এই তিনটি কাজ একজন মুজতাহিদ ফকীহকেকরতে হয়। আর কাজ তিনটি করা হয় ইজতিহাদের ভিত্তিতে। যার দরুণ মুজতাহিদ ফকীগণের মাঝেএই কাজগুলো সম্পন্ন করে মাসআলার বিধান নির্ধারণের ক্ষেত্রে মতভিন্নতা হয়ে থাকে।

এটি অতি দীর্ঘ ও গভীর একটি বিষয়। সংক্ষিপ্ত আলোচনার জন্যও দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রয়োজন। এখানে শুধুইঙ্গিত করা হল।

. রায় কিয়াসের বিভিন্নতাজনিত মতভেদ

অর্থাৎ ঐ সকল নতুন সমস্যা, যা নবী-যুগ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগের পরে সৃষ্টি হয়েছে, যারসমাধান না কোনো আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে, না কোনো হাদীসে, আর না এ বিষয়ে পূর্ববর্তীফকীগণের ইজমা আছে। এক্ষেত্রে যা আছে তা হল, কোনো সাহাবীর আছর বা কোনো তাবেয়ীরকোনো ফতওয়া এবং তাতেও দুই মত অথবা এর সমাধান কোনো সাহাবী বা বড় তাবেয়ীর আছরেওপাওয়া যায় না। এ ধরনের বিষয়ে মুজতাহিদ ইমামগণকে ‘রায়’ ও শরঈ কিয়াসের দ্বারা ইজতিহাদকরতে হয়েছে। আর ইজতিহাদের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

উপরোক্ত উভয় প্রকারের মাসআলাকে (অর্থাৎ যেসব মাসআলায় দলিলের গ্রহণযোগ্যতা বিচার কিংবামর্মোদ্ধার কিংবা বাহ্যত অনুমেয় বিরোধ নিষ্পত্তিজনিত মতপার্থক্য হয়েছে এবং যেসব মাসআলায় রায়ও কিয়াসের বিভিন্নতাজনিত মতপার্থক্য হয়েছে) ইলমুল ফিকহের পরিভাষায় ‘মাসাইলুল ইজতিহাদ’বা ‘ইজতিহাদী মাসাইল’ বলে। যদিও একাধিক সুন্নাহ সম্বলিত বিষয়েও ইজতিহাদের কিছু প্রয়োজনহয় তবে পরিভাষায় সাধারণত শেষোক্ত দুই প্রকারকেই ‘মাসাইলুল ইজতিহাদ’ বলা হয়। এ প্রকারেরমাসআলায় ইমামগণের মাঝে মতভিন্নতা কেন হয়েছে তা উপরোক্ত আলোচনা থেকেই অনুমান করাযায়। এ সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা  بيان أسباب اختلاف الفقهاء ‘ফকীহগণের মতভিন্নতার কারণ’ শীর্ষককিতাবসূমহে পাওয়া যাবে।

সুন্নাহর বিভিন্নতা সম্বলিত বিষয়ে মতপার্থক্যের ধরন

এ বিষয়ে শুধু শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. (৭২৮ হি.)-এর কিছু কথা উল্লেখ করছি।

১. শায়খ ইবনে তাইমিয়া রাহ.বলেন, এক্ষেত্রে আমাদের নীতিই সর্বাধিক সঠিক যে, ইবাদতের বিষয়েএকাধিক পদ্ধতি যদি গ্রহণযোগ্য বর্ণনায় পাওয়া যায় তবে কোনো পদ্ধতিকেই মাকরূহ বলা যাবে না;বরং সবগুলো শরীয়তসম্মত হবে। যেমন-সালাতুল খাওফের বিভিন্ন পদ্ধতি; তারজীসহ আযান ওতারজীবিহীন আযান; ইকামতের শব্দাবলি একবার করে উচ্চারণ করা বা দুবার করে উচ্চারণ করা;তাশাহহুদের বিভিন্ন প্রকার; নামাযের শুরুতে পড়ার বিভিন্ন দুআ; কুরআন মজীদের বিভিন্ন কিরাত;ঈদের নামাযে অতিরিক্ত তাকবীরের বিভিন্ন নিয়ম; জানাযার নামায ও সিজদায়ে সাহুর বিভিন্ন তরীকা;রাববানা লাকাল হামদ বা রাববানা ওয়া লাকাল হামদ বলা ইত্যাদি সব বিষয়ে আমরা এটাই বলেথাকি। তবে কখনো কোনো একটি নিয়ম মুস্তাহাব হিসেবে বিবেচিত হয় এবং  দলিলের কারণেঅপরটির উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। তবে এক্ষেত্রেও অপরটিকে মাকরূহ বলা যায় না।-মাজমূউলফাতাওয়া ২৪/২৪২-২৪৩; আরো দেখুন : আলফাতাওয়াল কুবরা ১/১৪০

এ প্রকার ইখতিলাফ সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রাহ. অন্য কিতাবে লেখেন, ইখতিলাফে তানাওউ কয়েকপ্রকার : তন্মধ্যে একটি হচ্ছে এমন মতভেদ, যেখানে প্রত্যেক বক্তব্যই সঠিক এবং প্রত্যেক আমলইশরীয়তসম্মত। যেমন ঐ সমস্ত কিরাত (যেগুলো ‘সাবআতু আহরুফে’র অন্তর্ভুক্ত। তথাপি মূল বিষয়টিজানার পূর্বে) সাহাবায়ে কেরামের মাঝে (কোনো কোনোটি) নিয়ে বিবাদ হয়েছিল। তখন রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে এ নিয়ে ঝগড়া করতে নিষেধ করলেন এবং বললেন,তোমাদের উভয়ের পড়া সঠিক।

‘এমনভিাবে আযান-ইকামতের পদ্ধতি; নামাযের শুরুতে পড়ার দুআ, তাশাহহুদ, সালাতুল খাওফ,জানাযা ও ঈদের নামাযের তাকবীর সংক্রান্ত ইখতিলাফ, যেখানে সব পদ্ধতিই শরীয়তসম্মত। যদিওকিছু পদ্ধতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

‘অনেক লোককে দেখা যায়, ইকামতের শব্দ একবার বলা-দুইবার বলা বা এ ধরনের বিষয় নিয়েঝগড়ায় লিপ্ত হয়। এটা একেবারেই হারাম। আর কেউ কেউ এ পর্যায়ে না পৌঁছলেও দেখা যায়, তারাকোনো একটি পদ্ধতির প্রতি অন্যায় পক্ষপাত পোষণ করে এবং অপরটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।কিংবা মানুষকে তা  গ্রহণ করতে নিষেধ করে। ফলে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিষেধের আওতায় এসে যায়। (অর্থাৎ তারা ঐ বিবাদে লিপ্ত হল, যা থেকে রাসূল নিষেধ করেছেন।কারণ তিনি বৈধ মতভিন্নতাকে বিবাদের ভিত্তি বানাতে নিষেধ করেছেন।)-ইকতিযাউস সিরাতিলমুসতাকীম ১/১৩২-১৩৩

তিনি আরো বলেন-

وهذا القسم الذي سميناه اختلاف التنوع كل واحد من المختلفين مصيب فيه
بلا تردد، لكن الذم واقع على من بغى على الآخر فيه، وقد دل القرآن على حمد كل واحدة من الطائفتين في مثل ذلك إذا لم يحصل بغي.

আর এ প্রকার মতভেদ, যাকে আমরা বলছি-اختلاف التنوع বা আমলের পদ্ধতির বিভিন্নতার ইখতিলাফকোনোরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়া প্রত্যেকেই সঠিক। কিন্তু এ ধরনের ইখতিলাফের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি অন্যেরউপর বাড়াবাড়ি করে সে নিন্দিত। কারণ কুরআন মজীদ থেকে বুঝে আসে যে, এ ধরনের ইখতিলাফেরক্ষেত্রে উভয় পক্ষই প্রশংসনীয়। যদি এক পক্ষ অপর পক্ষের উপর বাড়াবাড়ি না করে।’-ইকতিযাউসসিরাতিল মুসতাকীম ১/১৩৫; আরো দেখুন : মাজমূউল ফাতাওয়া ২৪/২৪৫-২৪৭

মাসাইলুল ইজতিহাদে মতভিন্নতার ধরন তার শরঈ বিধান

ইজতিহাদী মাসআলায় মতভিন্নতার ধরন সম্পর্কে প্রথমে বর্তমান যুগের প্রায় সব মাযহাবের বড় বড়মনীষী, যাদেরকে সমগ্র ইসলামী বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবে ‘রাবেতাতুল আলামিল ইসলামী’রআলমাজমাউল ফিকহী (ফিকহী বোর্ড)- এ এই বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ করা হয়েছিলতাদের মতামত উল্লেখ করছি।

ঐ মজলিসের সিদ্ধান্তের সারকথা হল, আকীদা ও বিশ্বাসগত বিষয়ে মতভেদ হচ্ছে يجب أن لا يكون অর্থাৎ তা না হওয়া অপরিহার্য। আর আহকাম ও বিধানের বিষয়ে যে মতভেদ তা لا يمكن أن لا يكونঅর্থাৎ তা না হওয়া অসম্ভব।

(মূল প্রবন্ধে দীর্ঘ সিদ্ধান্তটির আরবী পাঠ ও তরজমা উল্লেখিত হয়েছে।)

এই সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  এতে শায়খ ইবনে বায রাহ. (১৪২০ হি.) ও শায়খ আবদুল্লাহ উমরনাসীফ-এর স্বাক্ষরও আছে। ইজতিহাদী বিষয়ে মতভিন্নতার এই পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য যদি প্রত্যেকেরস্মরণ থাকে তাহলে এর ভিত্তিতে পরস্পর কলহ-বিবাদে লিপ্ত হওয়ার সুযোগই হবে না।

পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে ইজতিহাদী মাসায়েলের পরিচয় সম্পর্কে এবং তাতে মতপার্থক্যহওয়ার কারণ সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণার নিরসন প্রয়োজন। পূর্বের আলোচনা থেকে এ বিষয়টি বোঝাগেলেও আরো স্পষ্ট করার জন্য আলাদা শিরোনামে কিছু কথা আরজ করছি।

ইমামগণের মতভিন্নতার বড় কারণ কি হাদীস না জানা কিংবা না মানা?

অনেকে মনে করেন, অধিকাংশ বিষয়ে মতভিন্নতার মৌলিক কারণ হল, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রতিপক্ষেরহাদীস সম্পর্কে অবহিত না থাকা বা সহীহ হাদীস পরিত্যাগ করে যুক্তি বা কিয়াসের আশ্রয় গ্রহণ করা।অথচ আইম্মায়ে দ্বীন ও উলামায়ে হকের যে মতভিন্নতা সে সম্পর্কে এ ধারণা মোটেও সঠিক নয়।কেননা তাদের কেউ কিয়াস বা যুক্তিকে হাদীসের উপর প্রাধান্য দেন না। তাদের কোনো কোনোফতওয়া যদিও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের হাদীসের ব্যাপারে অবগতি না থাকার কারণে প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তুএর সংখ্যা নিতান্তই কম।

আহলে হক উলামায়ে কেরামের মধ্যে বিদ্যমান মতভিন্নতার অধিকাংশের মূলেই ইখতিলাফে মাহমুদবা ইখতিলাফে মাশরূ-এর শরীয়ত স্বীকৃত বাস্তবিক কারণ বিদ্যমান রয়েছে। এজন্য হাদীসেরইমামগণের মধ্যেও বহু বিষয়ে ইখতিলাফ হয়েছে। ইমাম আহমদ, ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী,ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিযী, ইবনে খুযাইমা, ইবনে হিববান,দাউদ জাহেরী, ইবনে হাযম জাহেরী তাদের ব্যাপারে হাদীসের বিরোধিতা বা হাদীসের ব্যাপারেঅনবগতির অভিযোগ কি কেউ করতে পারে?

শুধু তাই নয়, পরবর্তী যুগের এবং বর্তমানের ঐসব আলেমের মধ্যেও ইখতিলাফ হয়েছে, যারা আহলেহাদীস বা সালাফী নামে পরিচিত। এদের ব্যাপারে সকল আহলে হাদীস বা সালাফী বন্ধু একমত যে,এরা সবাই হাদীসবিশারদ এবং হাদীসের অনুসারী ছিলেন। তাঁদের মতপার্থক্যের কিছু উদাহরণ তুলেধরছি।

প্রথম উদাহরণ

মিসরের প্রসিদ্ধ শায়খ সাইয়েদ সাবেক রাহ. (১৩৩৩-১৪২৫ হি.) ‘ফিকহুস সুন্নাহ’ নামে একটি বেশবড়, সহজ ও ভালো কিতাব রচনা করেছেন-আল্লাহ তাআলা তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন-যামাশাআল্লাহ নতুন প্রজন্মের মাঝে খুবই প্রসিদ্ধ ও সমাদৃত। অনেক তরুণ-যুবক এটিকে মুতাওয়ারাছফিকহী কিতাবের উত্তম বিকল্প মনে করে বরণ করে নিয়েছে! তাফাক্কুহ ফিদ দ্বীনের স্বল্পতার কারণেঅনেকে এমনও মনে করে যে, ফিকহের কিতাবগুলোতে আছে ইমামদের ফিকহ আর এই কিতাবেআছে হাদীস ও সুন্নাহর ফিকহ! অথচ মূল বিষয় এই যে, হাদীস ও সুন্নাহর ফিকহ সেটাও এবং এটাও।পার্থক্য শুধু এই যে, এখানে ফকীহ ও লেখক হলেন শায়খ সাইয়েদ সাবেক আর ওখানে ফকীহ হলেনখায়রুল কুরূন বা তার নিকটতম যুগের মুজতাহিদ ইমাম আর লেখক হলেন পরবর্তী সময়ের কোনোফকীহ বা আলেম।

যাই হোক, আমি যা বলতে চাই তা হচ্ছে, এ কিতাবের শুরুতে লেখক লেখেন-

أما بعد! فهذا الكتاب “فقه السنة” يتناول مسائل من الفقه الإسلامي مقرونة بأدلتها من صريح الكتاب وصحيح السنة، ومما أجمعت عليه الأمة …

والكتاب في مجلداته مجتمعة يعطي صورة صحيحة للفقه الإسلامي الذي بعث الله به محمدا صلى الله عليه وسلم، ويفتح للناس باب الفهم عن الله وعن رسوله، ويجمعهم على الكتاب والسنة، ويقضي على الخلاف وبدعة التعصب للمذاهب، كما يقضي على الخرافة القائلة : بأن باب الاجتهاد قدسد.

উপরোক্ত কথায় যে চিন্তাগত বিচ্ছিন্নতা রয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকু বলছি যে,তাঁর দাবি, এই কিতাবের মাসআলাগুলো সরাসরি কুরআনের আয়াত, সহীহ সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মাহরদলিলনির্ভর।

এ কিতাবটি যখন বর্তমান যুগের একজন প্রসিদ্ধ আলেম শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ. (১৩৩২-১৪২০ হি.)-এর সামনে এল, যিনি চিন্তা-চেতনায় সাইয়েদ সাবেকের থেকে আলাদা নন,একই ঘরানার। শায়খ আলবানীর কিতাবাদি; বিশেষত ‘ছিফাতুস সালাহ’র ভূমিকা পাঠ করলেই তাবোঝা যাবে। তিনি যখন এই কিতাবটি অধ্যয়ন করলেন তখন এর উপর টীকা লেখার প্রয়োজন অনুভবকরলেন এবং ‘তামামুল মিন্নাহ ফিততালীকি আলা ফিকহিস সুন্নাহ’ নামে তা লিখলেন। পৃষ্ঠাসংখ্যা চারশরও অধিক। এর পঞ্চম সংস্করণ (১৪২৬ হি.) আমার সংগ্রহে আছে।

এতে তিনি ফিকহুস সুন্নাহর মাত্র সিয়াম অধ্যায়-পর্যন্ত টীকা লিখেছেন, যা মূল কিতাবের চার ভাগেরএক ভাগ। ১ রজব ১৪০৮ হিজরীর তথ্য অনুযায়ী তিনি শুধু এটুকুরই টীকা লিখতে পেরেছেন। অবশিষ্টঅংশের টীকা লেখার জন্য দুআ করেছেন।

শায়খ আলবানী রাহ. ‘তামামুল মিন্নাহ’র ভূমিকায় ‘ফিকহুস সুন্নাহ’র ভুল-ত্রুটির প্রকার সম্পর্কে একটিসংক্ষিপ্ত সূচি উল্লেখ করেছেন, যাতে চৌদ্দটি প্রকার রয়েছে। নিমেণ তার কিছু উল্লেখ করা হল :

১. সাইয়েদ সাবেক অসংখ্য যয়ীফ হাদীস সম্পর্কে নীরব থেকেছেন।

২. অন্যদিকে অনেক ‘ওয়াহী’ (মারাত্মক যয়ীফ) হাদীসকে শক্তিশালী বলেছেন।

৩. কিছু হাদীসকে যয়ীফ বলেছেন, অথচ তা সহীহ।

৪. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের উদ্ধৃতিতে হাদীস উল্লেখ করেছেন অথচ তাতে সে হাদীস নেই।

৫. এমন কিছু হাদীস উল্লেখ করেছেন, যা হাদীসের কোনো কিতাবেই নেই।

৬. যাচাই বাছাই ছাড়া কোনো কিতাবের উদ্ধৃতিতে কোনো হাদীস উল্লেখ করেছেন অথচ খোদ ঐকিতাবের লেখকই তাতে হাদীসটি সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেছেন, যা তার সহীহ হওয়াকে প্রশ্নবিদ্ধকরে।

৭. কখনো কখনো দলিল ছাড়া মাসআলা উল্লেখ করেছেন, কখনো কিয়াসের ভিত্তিতে মাসআলা প্রমাণকরেছেন। অথচ সে বিষয়ে সহীহ হাদীস বিদ্যমান। আবার কখনো সাধারণ দলিল উল্লেখ করেছেন,অথচ সেই মাসআলার সুনির্দিষ্ট দলিল রয়েছে।

৮. কখনো কখনো এমন মত বা সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিয়েছেন, যার প্রমাণ দুর্বল। অথচ বিপরীত মতটিরদলিল শক্তিশালী।

৯. সবচেয়ে আপত্তিকর কাজ এই যে, যে কিতাব সুন্নাহ মোতাবেক আমলের প্রতি দাওয়াত দেওয়ারজন্য লেখা হয়েছে তাতে এমন অনেক মাসআলা আছে, যা সহীহ হাদীসের বিপরীত। অথচ ঐ সহীহহাদীসগুলোর বিরোধী কোনো হাদীসও নেই।

শায়খ আলবানী রাহ.-এর সব আপত্তি সঠিক নাও হতে পারে। তবে তার গবেষণা ও বিশ্লেষণ অনুযায়ীতো ‘ফিকহুস সুন্নাহ’য় এ ধরনের অনেক ভুল রয়েছে।

তামামুল মিন্নাহ প্রকাশিত হওয়ার পরও শায়খ সাইয়েদ সাবেক রাহ. দীর্ঘ সময় জীবিত ছিলেন। কিন্তুদু’/চারটি স্থান ব্যতীত তিনি ‘ফিকহুস সুন্নাহ’য় কোনো পরিবর্তন করেননি। এর দ্বারা বোঝা যায়, তারদৃষ্টিতে শায়খ আলবানী রাহ.-এর এই আপত্তিগুলো সঠিক নয়। কিংবা তা গ্রহণ করা অপরিহার্য নয়।

এই দুই ব্যক্তিত্বের কেউই হানাফী নন। অন্য কোনো মাযহাবেরও অনুসারী নন। তারা ছিলেন (অনুসৃতফিকহের সাহায্য ছাড়াই সরাসরি) সুন্নাহর অনুসরণ ও হাদীস অনুযায়ী আমলের প্রতি আহবানকারীনিষ্ঠাবান দুই ব্যক্তি। দুজনই ছিলেন হাদীসের আলেম এবং নির্ঘণ্ট ও কম্পিউটার যুগের আলেম। তারাউভয়েই উম্মতের সামনে (তাদের ভাষায়) ‘ফিকহুল মাযাহিব’-এর স্থলে  ‘ফিকহুস সুন্নাহ’ পেশ করতেচেয়েছেন।

প্রশ্ন এই যে, ফিকহি মতভিন্নতার প্রধান কারণ যদি শুধু এই হয় যে, যাদের মাঝে মতভিন্নতা হয়েছেতাদের একজন হয়তো হাদীস জানতেন না কিংবা হাদীস মানতেন না, অন্তত ঐ মাসআলার হাদীসটিতিনি জানতেন না তাহলে এই দুই শায়খের মাঝে এত বড় বড় এবং এত অধিক মাসআলায় মতভেদকেন হল?

দ্বিতীয় উদাহরণ

সম্প্রতি ১৪৩০ হি., মোতাবেক ২০০৯ ঈ. সালে ড. সাদ ইবনে আবদুল্লাহ আলবারীকের দুই খন্ডেরএকটি কিতাব প্রকাশিত হয়েছে, যার নাম

الإيجاز في بعض ما اختلف فيه الألباني وابن عثيمين وابن باز رحمهم الله تعالى

কিতাবটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮ শ’র অধিক।

কিতাবটির নাম থেকেই বোঝা যায়, এই কিতাবে তিনি এমন কিছু মাসআলা উল্লেখ করেছেন, যেসবমাসআলায় এ যুগের তিনজন সম্মানিত সালাফী আলেম : শায়খ আবদুল আযীয বিন আবদুল্লাহ বিনবায রাহ. (১৩৩০-১৪২০ হি.), শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ ইবনে উছাইমীন রাহ. (১৪২১ হি.) ওশায়খ (মুহাম্মাদ ইবনে নূহ) নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ. (১৩৩২-১৪২০ হি.)-এর মাঝে মতভেদহয়েছে।

কিতাবের নাম থেকে এ বিষয়টিও স্পষ্ট যে, তিনজনের মাঝে যেসব মাসআলায় মতপার্থক্য হয়েছেতার সবগুলো লেখক এখানে উল্লেখ করেননি। তাছাড়া তিনি শুধু ‘কিতাবুর রাযাআ’ দুগ্ধপান অধ্যায় পর্যন্ত মাসআলাগুলো এখানে এনেছেন। এরপরও এতে মাসআলার মোট সংখ্যা দঁড়িয়েছে ১৬৬। আকীদা সংক্রান্ত কিছু মাসআলাও এতে রয়েছে, যেগুলো আকীদার মৌলিক নয়, শাখাগত মাসআলা এবং যার কিছু নমুনা উদ্ধৃতিসহ

البشارة والإتحاف بما بين ابن تيمية والألباني في العقيدة من الاختلاف

নামক পুস্তিকায়ও রয়েছে।

জেনে রাখা দরকার যে, ‘আলইজায’ কিতাবে ‘মাসাইলুল ইজতিহাদে’র উভয় প্রকারের মাসআলাই উল্লেখিত হয়েছে। অর্থাৎ কিছু মাসআলা এমন, যার কোনো শরঈ নস নেই অথবা শরঈ নস পাওয়া গেলেও তা থেকে সংশ্লিষ্ট মাসআলার বিধান আহরণ করতে হলে ইজতিহাদ প্রয়োজন।

তৃতীয় উদাহরণ

ড. বকর ইবনে আবদুল্লাহ আবু যায়েদ রিয়ায-এর পুস্তিকা ‘লা-জাদীদা ফী আহকামিস সালাহ’। ইন্টারনেট সংস্করণ (তৃতীয় সংস্করণ) অনুযায়ী এতে তিনি নামাযের এমন আটটি মাসআলা উল্লেখ করেছেন, যে সম্পর্কে কিছু সালাফী আলেমের ফতওয়া বা আমল তার দৃষ্টিতে প্রমাণহীন ও সুন্নাহবিরোধী।

চতুর্থ উদাহরণ

ড. ইউসুফ কারযাবী-হাফিযাহুল্লাহু তাআলা ওয়া রাআহু-এর কিতাব ‘আলহালাল ওয়াল হারাম ফিলইসলাম’-এর সাথে ড. সালেহ ফাওযানের পুস্তিকা ‘আলই’লাম বিনাকদি কিতাবিল হালালি ওয়াল হারাম’ এবং শায়খ আলবানী রাহ.-এর কিতাব ‘গায়াতুল মারাম ফী তাখরজি আহাদীসিল হালালি ওয়াল হারাম’ অধ্যয়ন করা যেতে পারে।

হাদীসের শরণাপন্ন হলে কি মতপার্থক্য দূর হয়, না বিবাদ? 

কারো কারো ধারণা, সবাই যদি কুরআন ও হাদীসের অনুসরণের ব্যাপারে সম্মত হয়ে যায় তাহলেইখতিলাফ দূর হয়ে যাবে। ইখতিলাফ শুধু এ জন্যই হয় যে, এক পক্ষ কুরআন-হাদীস অনুসরণ করে,অপর পক্ষ কুরআন-হাদীস অনুসরণ করে না। এ প্রসঙ্গে তারা নিমেণাক্ত আয়াতটিও উল্লেখ করেথাকে-

فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا

(তরজমা) যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হও তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের নিকট পেশকর। যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিবসের উপর ঈমান রাখ। এটা উত্তম ও এর পরিণাম সুন্দর।-সূরানিসা (৫) : ৫৯

অথচ উপরোক্ত আয়াতে এ কথা বলা হয়নি যে, ‘কুরআন-হাদীসের শরণাপন্ন হলে ইখতিলাফ দূর হয়েযাবে।’ বরং বলা হয়েছে, ‘বিবাদের ক্ষেত্রসমূহে কুরআন-হাদীসের শরণাপন্ন হও।’ এর অর্থ হলতাহলে বিবাদ মিটে যাবে। এরা বিবাদ মিটে যাওয়াকে ইখতিলাফ মিটে যাওয়ার সমার্থক ধরে নিয়েছেএবং এখানেই ভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছে। কেননা বিবাদ মিটে যাওয়া ও ইখতিলাফ মিটে যাওয়াএককথা নয়। অনেক ক্ষেত্রে ইখতিলাফ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বিবাদ মিটে যায়। পক্ষান্তরে অনেকক্ষেত্রে ইখতিলাফ ও বিবাদ দু’টোই মিটে যায়।

যেমন বিবাদরতদের মাঝে এক পক্ষ জালিম, অপর পক্ষ মাজলূম। এক পক্ষ হকের উপর, অন্য পক্ষ বাতিলের উপর। তারা যদি কিতাব-সুন্নাহর শরণাপন্ন হয় এবং কুরআন-সুন্নাহর ফয়সালা মেনে নেয়তাহলে বিবাদও দূর হবে, মতভেদও থাকবে না। পক্ষান্তরে  যেখানে শরীয়তের দলীলের ভিত্তিতেএকাধিক মত হয়েছে কিংবা সুন্নাহর বিভিন্নতার ক্ষেত্রে একজন এক সুন্নাহ অন্যজন  অন্য সুন্নাহঅনুসরণ করছে-এ ধরনের ক্ষেত্রে যদি পরস্পর বিবাদ সৃষ্টি হয় এবং উপরোক্ত আয়াতের নির্দেশনাঅনুযায়ী তারা কিতাব-সুন্নাহর শরণাপন্ন হয় তাহলে কিতাব-সুন্নাহ তাদেরকে এই নির্দেশনাই দিবে যে,বিবাদ করো না। কারণ তোমরা উভয়ে সঠিক পথে আছ। কারো অধিকার নেই অন্যের উপর আক্রমণকরার। তো এখানে মতপার্থক্য বহাল থাকা সত্ত্বেও বিবাদ দূর হবে।

সহীহ বুখারীর ঐ হাদীস কারো অজানা নয়, যাতে হযরত উমর রা. ও হযরত হিশাম ইবনে হাকীম রা.-এর মধ্যকার বিরোধের কথা বর্ণিত হয়েছে। যা সাময়িক ঝগড়ার রূপ ধারণ করেছিল। মতবিরোধটিহয়েছিল কুরআনের কিরাত নিয়ে। হযরত উমর রা. হযরত হিশাম রা.কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম-এর নিকট হাজির করে তার বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেকের পড়া শুনলেন। এরপর প্রত্যেককেই বললেন-

هكذا أنزلت

অর্থাৎ এভাবে কুরআন নাযিল হয়েছে।-সহীহ বুখারী ৮/৬৩৯-৬৪০ (ফাতহুল বারী)

এ ধরনের আরেকটি ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বলেছেন-

كلاكما محسن، فاقرآ

তোমাদের দুজনই ঠিক পড়েছ। তাই পড়তে থাক।-সহীহ বুখারী ৮/৭২০ (ফাতহুল বারী)

বনু কুরাইজার ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীর মর্ম বোঝার ক্ষেত্রেসাহাবায়ে কেরামের মাঝে মতভেদ হয়েছিল। উভয় দল হাদীসের মর্ম যা বুঝেছেন সে অনুযায়ী আমলকরেছেন। এরপর সরাসরি আল্লাহর রাসূলের শরণাপন্ন হয়েছেন। কিন্তু তিনি কোনো দলকে তিরস্কারকরেননি। বিস্তারিত ঘটনা উদ্ধৃতিসহ সামনে আসছে।

তো দেখুন, প্রথম ঘটনা ছিল কিরাআতের পার্থক্য সংক্রান্ত, যা সুন্নাহর বিভিন্নতার মধ্যে শামিল। এইমতভেদের ক্ষেত্রে যখন আল্লাহর রাসূলের শরণ নেওয়া হল তিনি বিবাদ মিটিয়ে দিলেন, কিন্তুইখতিলাফ বহাল রাখলেন এবং বললেন, উভয় পদ্ধতি সঠিক।

দ্বিতীয় ঘটনাটি ছিল রায় ও ইজতিহাদের মতপার্থক্য। এখানে প্রত্যেক পক্ষ হাদীস থেকে যা বুঝেছেনসে অনুযায়ী আমল করেছেন। এখানে তাদের মাঝে কোনো বিবাদ হয়নি। এরপরও তাঁরা বোধ হয়এজন্যই আল্লাহর রাসূলকে জিজ্ঞাসা করেছেন যে, তাঁর আদেশের সঠিক অর্থ জানবে না। কিন্তুহাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী, আল্লাহর রাসূল তা বলেননি। শুধু এটুকু করেছেন যে, কোনো পক্ষকেইতিরস্কার করেননি। তাহলে এখানে তিনি ইজতিহাদ এবং সঠিক প্রেরণা তথা হাদীস অনুসুরণের প্রেরণাথেকে প্রকাশিত সিদ্ধান্তকে বহাল রেখেছেন। এই শ্রেণীর মতভেদকে তিনি বাতিল করেননি। তাহলেইখতিলাফে মাহমূদ বা ইখতিলাফে মাশরূ, যে নামই দেওয়া হোক, কুরআন-সুন্নাহর সামনে উপস্থাপনকরা হলে বিলুপ্ত হবে না। কারণ এ তো কুরআন-সুন্নাহর দলিলের ভিত্তিতেই হয়েছে। হ্যাঁ, এসব বিষয়েকেউ যদি বিবাদে লিপ্ত হয় সে কুরআন-সুন্নাহর শরণাপন্ন হলে বিবাদ থেকে ফিরে আসবে। কারণকুরআন তাকে বলবে-

وكلا آتينا حكما وعلما

অর্থ : আর তাদের প্রত্যেককে দিয়েছি প্রজ্ঞা ও জ্ঞান।

এবং হাদীস তাকে বলবে-

كلاكما محسن فاقرءا  এবং فما عنف واحدا من الفريقين

হ্যাঁ, ইখতিলাফে মাযমুম বা নিন্দিত মতভেদের ভিত্তি যেহেতু দলিল-প্রমাণের বিরোধিতা অথবা মূর্খতাও হঠকারিতা কিংবা প্রবৃত্তি ও দুর্বল ধারণার অনুসরণ তাই এ ধরনের ইখতিলাফ কুরআন-হাদীসেরদিকে প্রত্যাবর্তন ও অনুসরণের দ্বারা মিটে যায়।

পক্ষান্তরে ইখতিলাফে মাহমুদ বা ইখতিলাফে মাশরূ হয়েই থাকে কুরআন ও হাদীসের উপর অটলথাকার কারণে। তাই কুরআন-হাদীসের দিকে প্রত্যাবর্তনের কারণে এ ইখতিলাফ মিটে যাওয়ারকোনো অবকাশ নেই। এজন্য এ ধরনের ইখতিলাফ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন ওআইম্মায়ে দ্বীনের মাঝেও হয়েছে এবং পরবর্তীতে আহলে হাদীস ও সালাফী উলামায়ে কেরামেরমাঝেও হয়েছে।

যারা ‘আসবাবে ইখতিলাফে ফুকাহা’ এবং ‘ফিকহে মুকারান’-এর কিতাবসমূহের সঠিক ধারণা রাখেনতাদের নিকট বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট ও বাস্তব সত্য, তবে কিছু কিছু মানুষ নিজের অজ্ঞতার কারণে এধরনের ইখতিলাফকে হাদীস মানা বা না মানার ইখতিলাফ বলে মানুষকে বিশ্বাস করাতে চায়।

ইজতিহাদী বিষয় একাধিক সুন্নাহ সম্বলিত বিষয়ে সুন্নাহর প্রতি আহবানের সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি

আলহামদুলিল্লাহ এ শিরোনামের বেশ কিছু জরুরি কথা বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন শিরোনামের আলোচনায়এসে গেছে। কিছু কথা সামনের শিরোনামগুলোতেও আসবে। তবে গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতার কারণেকিছু কথা আলাদা শিরোনামেও নিবেদন করছি।

ইখতিলাফুত তানাওউ বা একাধিক সুন্নাহ সম্বলিত বিষয়ে আহবানের বিধান

প্রথমে ‘ইখতিলাফুত তানাওউ’ সম্পর্কে আলোচনা করছি। যেহেতু এখানে মতপার্থক্যের ক্ষেত্র এমনবিষয়, যাতে একাধিক সুন্নাহ রয়েছে, তাই এক্ষেত্রে নিমেণাক্ত নীতিমালা অনুসরণ করা কর্তব্য।

১. যেহেতু সুন্নাহ মোতাবিক আমল হওয়াই উদ্দেশ্য তাই যে এলাকায় যে সুন্নাহর উপর আমল হচ্ছেএবং যে মসজিদে যে সুন্নাহর অনুসরণ হচ্ছে সেখানে তা-ই বহাল থাকতে দেওয়া উচিত। ঐ এলাকায়,ঐ মসজিদে সাধারণ মানুষকে দ্বিতীয় সুন্নাহর দিকে দাওয়াত দেওয়া মোটেই উচিত নয়। এ দাওয়াতখাইরুল কুরূন তথা সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগে ছিল না।  যেসব ক্ষেত্রে সুন্নাহ একটি সেখানে সেইসুন্নাহর বিষয়ে অবহেলা করা হলে সুন্নাহর দিকে দাওয়াত দিতে হবে। তদ্রূপ কেউ সুন্নাহ ছেড়েবিদআতে লিপ্ত হলে তাকে বাধা দিতে হবে এবং সুন্নাহর দিকে আসার দাওয়াত দিতে হবে। এদাওয়াত সালাফের যুগে ছিল।

সুন্নাহর বিভিন্নতার ক্ষেত্রগুলোতে বেশির চেয়ে বেশি এই তো হবে যে, আপনার বা আপনার উস্তাদেরগবেষণা অনুযায়ী, কিংবা আপনার প্রিয় মুহাদ্দিস বা প্রিয় ইমামের গবেষণা অনুযায়ী যে সুন্নাহমোতাবেক আপনি আমল করছেন তা অপর সুন্নাহ থেকে অগ্রগণ্য বা সুন্নত হওয়ার দিকটি তাতে বেশিস্পষ্ট। তো এটুকু অগ্রগণ্যতা সাধারণ মানুষকে সেদিকে আহবান করার জন্য যথেষ্ট নয়। নতুবা একইকথা অন্য পক্ষেরও বলার অবকাশ থাকবে। তো উভয় পক্ষ যখন নিজেদের দিকে আহবান করতেথাকবে তখন ফলাফল কী হবে? সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে সাধারণ মানুষের মাঝে অস্থিরতা ছড়ানো হবেনা কি?

এ শ্রেণীর মতভেদকে তো ইসলাম ও কুফর কিংবা সুন্নাহ ও বিদআর মতো বিভেদ-বিচ্ছিন্নতারমতভেদ সাব্যস্ত করা যায় না। এখানে অন্য পক্ষের মতামতের দালিলিক ভিত্তি স্বীকার করতে হবে(যদি ইনসাফ ও ন্যায়নিষ্ঠা থাকে)। তাহলে একের দৃষ্টিতে যে প্রাধান্য ও অগ্রগণ্যতা তা অন্যের উপরকেন আরোপ করা হবে?

২. এ ধরনের বিষয়ে সর্বোচ্চ যা হতে পারে তা এই যে, আলিমগণ নিজেদের মাঝে আলোচনা করতেপারেন এবং পারস্পরিক মতবিনিময় ও চিন্তার আদান-প্রদান হতে পারে। এ জাতীয় বিষয়ে সালাফেরফকীহ ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিদের থেকে এটুকুই পাওয়া যায়।

৩. এই বিষয়গুলোকে ‘নাহি আনিল মুনকারে’র আওতায় নিয়ে আসা এবং কোনো একটি পন্থার উপরমুনকার কাজের মতো প্রতিবাদ করা, সেই পন্থার অনুসারীদের নিন্দা-সমালোচনা করা, তাদেরকেসুন্নাহবিরোধী ও হাদীসবিরোধী আখ্যা দেওয়া সম্পূর্ণ নাজায়েয ও সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ।

এই কথাগুলোর দলিল এই-

ক. যেহেতু দুটো পন্থাই নির্ভরযোগ্য হাদীস বা আছার দ্বারা প্রমাণিত তাই কোনো একটি পন্থার উপরযদি ‘আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারে’র বিধান প্রয়োগ করা হয় তাহলে দ্বিতীয় পন্থাটিকে,যা শরীয়তের দলিল দ্বারা প্রমাণিত, প্রত্যাখ্যান করা হয়, যা ভুল।

খ. এর দ্বারা ‘ইবতালুস সুন্নাহ বিল হাদীস’ বা ‘ইবতালুস সুন্নাহ বিস সুন্নাহ’ অর্থাৎ হাদীসের দ্বারাসুন্নাহকে বাতিল করা, কিংবা এক সুন্নাহ দ্বারা অন্য সুন্নাহকে বাতিল করা হয়। এ তো ঐ ক্ষেত্রেও বৈধনয়, যেখানে দলিলসমূহের মাঝে বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। ঐ ক্ষেত্রেও তো একটি দলিলকে প্রাধান্যদেওয়া হয়, অন্য দলিলকে বাতিল করা হয় না। তাহলে যে ক্ষেত্রে বিরোধ নয়, সুন্নাহর বিভিন্নতা,সেক্ষেত্রে কীভাবে তা বৈধ হতে পারে?

গ. আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানায় একটি ঘটনায় যখন তাঁর আদেশেরমর্ম বোঝার ক্ষেত্রে সাহাবীদের মাঝে মতপার্থক্য হল, আর তা হল ফরয নামায কাযা করার  মতোকঠিন বিষয়ে, এরপর এ মতপার্থক্য আল্লাহর রাসূলের দরবারে পেশ করা হল তখন তিনি কোনোপক্ষকেই কিছু বলেননি। সুন্নাহর বিরোধিতার অভিযোগ তো দূরের কথা। অথচ আদেশটি (হাদীসটি)তাঁরই ছিল। সুতরাং আদেশের উদ্দেশ্যও তাঁর নিশ্চিতভাবেই জানা ছিল। এরপরও কোনো পক্ষকেআদেশ পালনে ব্যর্থ ঘোষণা করেননি। আল্লাহর রাসূল কি উম্মতের জন্য আদর্শ নন? তাহলে উম্মতকীভাবে সুন্নাহর বিভিন্নতার ক্ষেত্রে এ ঘোষণা দিয়ে দেয়?

ঘ. উম্মাহর সালাফ-খালাফ তথা আগের পরের মনীষীগণের ইজমা এই যে-‘লা ইনকারা ফী মাসাইলিলইজতিহাদ’ অর্থাৎ ‘ইজতিহাদী বিষয়ে প্রতিবাদ নয়’। তাহলে যেসব ক্ষেত্রে সুন্নাহর বিভিন্নতামূলকমতপার্থক্য সেখানে প্রতিবাদ করা কীভাবে বৈধ হয়?

ঙ. আর বিশেষভাবে একাধিক সুন্নাহ সম্বলিত ক্ষেত্রগুলোতে সাহাবা-যুগ থেকে সালাফের নীতি ওঅবস্থান ‘তাওয়াতুর’ তথা উম্মাহর অবিচ্ছিন্ন কর্মধারার মাধ্যমে প্রমাণিত। তাঁরা এ জাতীয় বিষয়েএকে অন্যের প্রতিবাদ করতেন না। আলিমগণ নিজেদের মাঝে আলোচনা করতেন।

উল্লেখিত দলিল-প্রমাণের আলোকে যে কথাগুলো নিবেদন করা হল বড় বড় আলিম ও মনীষীগণও তাবলেছেন। তাদের কিছু উদ্ধৃতি সামনে আসছে। আপাতত আমি দুটি কিতাবের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণকরছি।

১. রিসালাতুল উলফা বাইনাল মুসলিমীন (শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর কিছু পুস্তিকা ওফতোয়ার সমষ্টি)।

সংকলনটি হালাবের মাকতাবুল মাতবূআতিল ইসলামিয়া থেকে শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহরাহ.-এর সম্পাদনায় ও তাঁর টীকা সহকারে প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রচ্ছদে লেখা আছে-

وفيها أمر الإسلام بالتوحد والائتلاف وحظره التنازع والتفرق عند الاختلاف.

অর্থাৎ এ পুস্তিকায় আলোচনা করা হয়েছে যে, ইসলাম তার অনুসারীদেরকে ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধনেআবদ্ধ থাকার আদেশ করে এবং মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শিকার হতে নিষেধ করে।

সংকলনটিতে তানাওউয়ে সুন্নাহ বা সুন্নাহর বিভিন্নতা সম্পর্কেও শায়খ ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর একটিপুস্তিকা আছে। তাতে তিনি ইজমা ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, একাধিক সুন্নাহর ক্ষেত্রে যেমতপার্থক্য তাতে উপরোক্ত  কর্মপন্থাই অনুসরণীয়।

তিনি লেখেন, ‘প্রথমত সালাফের ইজমা আছে যে, এ ধরনের একাধিক সুন্নাহ সম্বলিত ক্ষেত্রগুলোতেহাদীস-সুন্নাহয় বর্ণিত প্রতিটি পন্থাই জায়েয ও বৈধ। দ্বিতীয়ত এসব বিষয়ের হাদীস ও আছার থেকেওএই প্রশস্ততা প্রমাণিত হয়।’

দ্বিতীয় পুস্তিকাটি শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে জইফুল্লাহ আররুহাইলী লিখিত। হিজাযের ভালো আলিমদেরমাঝে তাঁকে গণ্য করা হয়। তিনি ফকীহও এবং মুহাদ্দিসও। তাঁর এই সারগর্ভ ও দলিল সম্বলিতপুস্তিকাটির নাম- دعوة إلى السنة في تطبيق السنة منهجا وأسلوبا

অত্যন্ত দরদের সাথে পুস্তিকাটি লেখা হয়েছে। তাই সেরকম দরদের সাথেই তা পাঠ করা উচিত।আমার সামনে এ পুস্তিকার প্রথম সংস্করণ রয়েছে, যা দারুল কলম বৈরুত থেকে ১৪১০ হিজরীতেপ্রকাশিত হয়েছে।

এতে তিনি উলামা-তালাবা ও দায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, ‘আমরা সুন্নাহর অনুসরণ করতেচাই, সুন্নাহর দিকে আহবান করতে চাই, কিন্তু আমাদের এ কাজও তো সুন্নাহ অনুসারেই হতে হবে।সুন্নাহর অনুসরণ করতে গিয়ে, সুন্নাহর দিকে দাওয়াত দিতে গিয়ে কোনো কাজ যদি সুন্নাহবিরোধী হয়েযায় তাহলে কেমন হবে?’

পুস্তিকার শুরুতে তেরোটি আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করেছেন এবং তার আলোকে সর্বমোট ২৪টি বিষয়েপাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এরপর بعض مظاهر المخالفة للسنة ‘সুন্নাহ-বিরোধিতার কিছু দৃষ্টান্ত’শিরোনামে এমন কিছু সুন্নাহ-বিরোধী কাজ চিহ্নিত করেছেন, যেগুলো সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করতেগিয়ে এবং সুন্নাহর দিকে দাওয়াত দিতে গিয়ে করা হয়। এরপর বিভিন্ন শিরোনামে বিস্তারিত ওদালিলিক আলোচনা করেছেন। দীর্ঘ আলোচনা করেছেন একাধিক সুন্নাহর ক্ষেত্রগুলোতে নিজের কাছেঅগ্রগণ্য পন্থার দিকে দাওয়াত দেওয়ার বিধান সম্পর্কে। এ পুস্তিকাটিও আদ্যোপান্ত পড়ার মতো। আমিশুধু প্রাসঙ্গিক কিছু কথা তুলে দিচ্ছি।

الإشارة إلى خطأ في مفهومنا لمعنى الالتزام بالكتاب والسنة

وخطأ آخر من أخطائنا في هذا العصر، ارتكبناه في سبيل الدعوة إلى السنة وإلى الاحتكام إلى الكتاب والسنة، وهذا الخطأ هو الجمود باسم الاتباع. لا شك في أن الاتباع للكتاب والسنة واجب، وأن الخضوع والتسليم لهما لازم لكل مسلم، ولا خيرة للمسلم أمام حكم الله وحكم رسوله، كما أنه لا يصْلُحُ أن يتقدم بين يدي الله ورسوله بالقول أو التشريع والحكم، هذا أمر لا جدال فيه، ولكن الخطأ والجناية على الكتاب والسنة هما في الحرص على الجمود، وعدم الفقه وسعة البصيرة في فهم الكتاب والسنة في ضوء نصوصهما ومقاصدهما الشرعية.

فترى فينا :

_ من يتسرع إلى القول بالتحريم

_ ومن يميل إلى التشديد في فهم الأحكام

_ من يتجه إلى القول الواحد دائما في المسائل، وإبطال ما عداه.

_ ومن ينظر إلى المستحبات النظر إلى الواجبات.

_ ومن يتوهم أن السنة في كل الأمور ليست إلا شيئا واحدا. فيحجر المرء بهذا واسعا. في حين أن السنة في مسألة ما قد تكون على وجهين. وليست وجها واحدا، أو يكون الأصل في بعض الأمور أن السنة فيه الإطلاق، وليس التقييد والتحديد.

সংক্ষিপ্ত তরজমা

কিতাবসুন্নাহর অনুসরণের অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের একটি ভুল

এ যুগের একটি ভুল, যা কিতাব ও সুন্নাহর দিকে দাওয়াত দিতে গিয়ে আমরা করে থাকি তা হচ্ছেইত্তিবার নামে স্থবিরতা। কিতাব ও সুন্নাহ যে অবশ্যঅনুসরণীয় এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এরজন্য তো জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাগবে এবং কিতাব ও সুন্নাহ সঠিকভাবে বুঝতে হবে। আজ আমাদের ভুলএখানেই যে, আমরা ইত্তিবা ও অনুসরণের নামে জুমুদ ও স্থবিরতার আশ্রয় নিয়েছি। সঠিকভাবে বোঝাছাড়াই নিজের বুঝের দিকে দাওয়াত দিচ্ছি।

– কারো কারো প্রবণতা এই যে, কোনো কিছুকে হারাম বলার আগে পর্যাপ্ত চিন্তা-ভাবনা করে না।

– কেউ শরীয়তের বিধান বোঝার ক্ষেত্রে কাঠিন্য ও কড়াকড়ির দিককে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

– কেউ ইখতিলাফী মাসায়েলের ক্ষেত্রে সর্বদা একটি মতই স্বীকার করে এবং অন্যসব মত প্রত্যাখ্যানকরে।

– কেউ মুস্তাহাব বিষয়ের সাথে ওয়াজিবের মতো আচরণ করে

– কেউ মনে করে, সকল বিষয়ে সুন্নাহ ও পদ্ধতি কেবল একটিই হয়। এভাবে একটি প্রশস্ত ক্ষেত্রকেতারা সংকীর্ণ বানিয়ে ফেলে। অথচ কোনো কোনো বিষয়ে সুন্নাহর দুটি পন্থা থাকে (অর্থাৎ উভয় পন্থাসুন্নাহসম্মত হয়)। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু মূল বিষয়টি সুন্নাহ হয়ে থাকে, বিশেষ কেনো পন্থা নয়।(পৃ. ৫০-৫১)

তিনি আরো বলেছেন-

الإشارة إلى مسلك خاطئ في فهمنا لمسائل الخلاف الفرعية وطريقة دعوتنا إلى الراجح فيها

لقد ابتليت الأمة الإسلامية في هذا العصر بظهور شيء من الروح الجدلية لدى كثير من المسلمين الصالحين مع نزعة إلى الشدة والغِلظة والفظاظة في طريقة الدعوة وفي الحوار الموقف حتى في المسائل الفقهية الخلافية.

وقد ترتب على هذه الطريقة كثير من المفاسد التي لا يقرها الإسلام، ومن ذلك :

_ تفرق الصف الإسلامي على مسائل فرعية، ففي سبيل الحماس لها والأخذ بالصواب فيها نسِيَتْ بعض الأصول في كثير من الأحيان في سبيل التمسك بالصواب في المسائل الخلافية في تلك الفروع!

_ وترتب على ذلك ظهور التعصبات والتحيّزات التي يرافقها الجهل والظلم، بدعوى الحرص على الحق والصواب في تلك الأمور الخلافية من المسائل الفرعية والأساليب والوسائل!!.

_وترتب على ذلك تجرؤ كثير من صغار الطلاب على الاجتهاد والفتيا وآداب العلم و”المشيخة” أو “الزعامة” العلمية أو الدعوية من قِبَل هؤلاء الصغار، الذين لم يأتوا بجديد سوى الخلاف والفُرْقة والابتعاد عن الجادة، وكان يسعهم الحرص على الخير في منهج وسط يبعدهم عن كل هذه الأنواع من الشر!.

_ لقد نَتَجَ عن هذه المسالك الخاطئة في الدعوة وفي طلب العلم والتفقه في الدين والتعامل مع المخالفين تضخيم بعض الأحكام الفرعية والغلوّ في السنن والمستحبات، وذلك أمر لا يقره الدين، لأن السنن والمستحبات هي من الدين وينبغي أن تؤخذ على أنها كذلك، ولا يجوز أن يتجاوز بها قدرها، كما أنه لا يجوز أن تنقص عن قدرها الذي وضعها الله فيه، والدين بين الغالي والجافي والمُفْرِط والمفرّط، ونتج عن هذا الخلل _ كما قلت _ الوقوع فيما نهى الله تعالى عنه من التفرق في الدين والتفرق في الصف، وآيات الله تعالى أعظم شاهد في نهي الله تعالى أشد النهي عن الأمرين كليهما، وكذا سيرة الرسول صلى الله عليه وسلم وسيرة فقهاء هذه الأمة : أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم ومن تبعهم بإحسان من أئمة السلف، فمن تأمل ذلك كله أدرك الحق في هذه المسألة.

وإن المصلِحَ الحق هو ذلك الذي يسعى في الإصلاح من غير أن يرافق إصلاحه إفساد، أو من غير أن يتلبس إصلاحه بإفساد يعْلَمُهُ أو لا يَعْلَمُهُ!.

তার আলোচনার মূল আরবী পাঠ উল্লেখ করা হয়েছে। শাখাগত বিষয়ে নিজের কাছে অগ্রগণ্য মতেরদিকে আহবান করার উপর তিনি কঠিন ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন।

তিনি বলেন, এর দ্বারা মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। এ সকল বিষয়ের পিছনে পড়েউম্মাহর ঐক্য ও সংহতির বিষয়টি ভুলে যাওয়া হয়েছে; বরং শাখাগত মাসাইলের পিছনে পড়ে কিছুমৌলিক বিষয়ও চিন্তা থেকে অন্তর্হিত হয়েছে।

– এসব বিষয়ে বাহাস-বিতর্কের পন্থা অনুসরণ করে সময়ের অপচয় করা হয়েছে। ঈমানী মহববতখতম করা হয়েছে। শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছে, যা  কোনো মুসলিম তার মুসলিম ভাইয়ের প্রতিপোষণ করতে পারে না।

– (যে মতপার্থক্য শরীয়তসম্মত ছিল তাতে মতপার্থক্যের নীতি ও বিধান ত্যাগ করে ভুল পন্থা অনুসরণকরার ফলে) মানুষের মাঝে অন্যায় পক্ষপাত ও দলীয় চেতনা সৃষ্টি হয়েছে, যার অনিবার্য ফল হচ্ছে,মূর্খতা ও অবিচার।

– এই কর্মপদ্ধতির কারণে ছোট ছোট তালিবুল ইলমও নিদ্বির্ধায় ইজতিহাদ ও ফতোয়ার ময়দানেপ্রবেশ করেছে, যা বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা ছাড়া নতুন কোনো সুফল দিতে সক্ষম হয়নি।

– এই ভুল কর্মপন্থার কারণে শাখাগত বিষয়গুলোকে বড় বানিয়ে পেশ করা, সুন্নত-মুস্তাহাবের ক্ষেত্রেবাড়াবাড়ি করা এবং এমনসব বিষয় পয়দা হচ্ছে, যা ইসলামে বৈধ নয়। সুন্নত-মুস্তাহাবকে না তারঅবস্থান থেকে উপরে তোলা যাবে, না নীচে নামানো যাবে। দ্বীনের মাঝে কোনো প্রকারের প্রান্তিকতাইবৈধ নয়।

কর্মপন্থার ভুলে দ্বীনের বিষয়ে বিভেদ ও উম্মাহর মাঝে বিবাদ সৃষ্টি হয়েছে, যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহতাআলার আয়াতসমূহই সাক্ষ্য দেয়, কত কঠিনভাবে তিনি তা নিষেধ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সীরাত, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের সীরাতও এ বিষয়ে সাক্ষী।

সত্যিকারের সংস্কারক তো তিনিই, যার সংস্কার-কর্মে ধ্বংসের উপাদান থাকে না।-পৃ. ৪৮-৪৯

আমার ধারণা, একাধিক সুন্নাহ বিষয়ে যে মতপার্থক্য সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার জন্য এটুকু আলোচনাইযথেষ্ট ইনশাআল্লাহ।

ইজতিহাদী মাসাইল বা ফূরুয়ী মাসাইলে মতভিন্নতার ক্ষেত্রে সঠিক কর্মপন্থা

ইজতিহাদী মাসাইল কাকে বলে তা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। এর অপর নাম আলফূরু’ বা ফুরূয়ীমাসাইল। এসকল মাসআলায় দলিলের ধরনই এমন যে, আলিম ও গবেষকদের মাঝে মতপার্থক্যহতে পারে এবং হয়েছে। তাই এই মতপার্থক্য বিলুপ্ত করার চেষ্টা কোনো সমাধান নয়; এতে মতভেদআরো বাড়বে। এখানে করণীয় হচ্ছে, ইখতিলাফের নীতি ও বিধান কার্যকর করে ইখতিলাফকে তারসীমায় আবদ্ধ রাখা; একে কলহ-বিবাদের কারণ হতে না দেওয়া।

আজ মুসলিম উম্মাহর ট্রাজেডি এই যে, শাখাগত বা অপ্রধান বিষয়কে কেন্দ্র করে তারা কলহ-বিবাদেলিপ্ত হচ্ছে এবং নিজেদের শক্তি খর্ব করছে। যেন কুরআন মজীদের নিষেধ-

ولا تنازعوا فتفشلوا

এর বাস্তব দৃষ্টান্ত। বিষয়টা আরব-আজমের সংবেদনশীল উলামা-মাশাইখকে অস্থির করে রেখেছে।তাঁরা এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন এবং দিয়ে যাচ্ছেন।

গত শতাব্দীতে আরবের কিছু ব্যক্তি তাকলীদের বিরুদ্ধে এত বলেছেন এবং ফূরূয়ী মাসাইলের ক্ষেত্রেএত কড়াকড়ি করেছেন যে, যুবশ্রেণীর মাঝে দ্বীনের বিষয়ে স্বেচ্ছাচার ও লাগামহীনতার
বিস্তার ঘটেছে, যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সেখানের বড়দেরকে রীতিমতো পরিশ্রম করতে হয়েছে। তোএখানেও ঐ তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায় না থেকে আগেভাগেই আমাদের সতর্কহওয়া উচিত।

আমি প্রথমে সালাফে সালেহীনের কিছু ঘটনা ও নির্দেশনা উল্লেখ করছি। এরপর ইনশাআল্লাহ বর্তমানযুগের আরব-আজমের কয়েকজন মুরববী আলিমের নির্দেশনা তুলে ধরব।

১. ইমাম দারিমী রাহ. (১৮১-২৫৫ হি.) তাঁর কিতাবুস সুনানে বর্ণনা করেছেন যে, (তাবেয়ী) হুমাইদআততবীল (আমীরুল মুমিনীন) উমার ইবনে আবদুল আযীয রাহ.কে বললেন, ‘আপনি যদি সকলমানুষকে এক বিষয়ে (এক মাযহাবে) একত্র করতেন তাহলে ভালো হত।’ তিনি বললেন, ‘তাদেরমাঝে মতপার্থক্য না হলে আমি খুশি হতাম না।’ এরপর তিনি ইসলামী শহরের গভর্ণরদের উদ্দেশেফরমান পাঠালেন-

ليقض كل قوم بما اجتمع عليه فقهاءهم

প্রত্যেক কওম যেন ঐ সিদ্ধান্ত মোতাবেক ফায়সালা করে, যে বিষয়ে তাদের ফকীহগণ (আলিমগণ)একমত।-সুনানুদ দারিমী, পৃষ্ঠা : ১৩৪

২. ইমাম ইবনে আবী হাতেম ইমাম মালেক থেকে বর্ণনা করেন যে, খলীফা আবু জাফর মানসুর আগ্রহপ্রকাশ করলেন যে, আমি চাই গোটা মুসলিম সাম্রাজ্যে এক ইলমের (অর্থাৎ মুয়াত্তা মালিকের)অনুসরণ হোক। আমি সকল এলাকার কাযী ও সেনাপ্রধানের নিকট এ ব্যাপারে ফরমান জারি করতেচাই।

ইমাম মালেক রাহ. বললেন, ‘জনাব! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ উম্মতের মাঝেছিলেন। তিনি বিভিন্ন জনপদে সেনাদল প্রেরণ করেছেন, কিন্তু ইসলামের দিগ্বিজয়ের আগেই তাঁরওফাত হয়ে গেছে। এরপর আবু বকর খলীফা হয়েছেন। তাঁর আমলেও বেশি কিছু রাজ্য বিস্তার হয়নি।এরপর উমর খলীফা হয়েছেন। তাঁর সময়ে প্রচুর শহর ও জনপদ বিজিত হয়েছে। তিনি সেসব বিজিতএলাকায় শিক্ষা-দীক্ষার জন্য সাহাবীগণকে প্রেরণ করেছেন। সেই সময় থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত(প্রত্যেক জনপদে সাহাবীগণের শিক্ষাই) এক প্রজন্ম থেকে অপর প্রজন্ম পর্যন্ত পৌঁছেছে।

‘অতএব আপনি যদি তাদেরকে তাদের পরিচিত অবস্থান থেকে অপরিচিত কোনো অবস্থানে ফেরাতেচান তবে তারা একে কুফরী মনে করবে। সুতরাং প্রত্যেক জনপদকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দিনএবং নিজের জন্য এই ইলমকে (মুয়াত্তা মালেক) গ্রহণ করুন।’

আবু জাফর তাঁর কথা মেনে নিলেন।’-তাকদিমাতুল জারহি ওয়াত তাদীল ২৯

ইবনে সা’দের বর্ণনায় ইমাম মালেকের বক্তব্যে উল্লেখ আছে যে-

يا أمير المؤمنين! لا تفعل هذا، فإن الناس قد سبقت إليهم أقاويل، وسمعوا أحاديث، ورووا روايات، وأخذ كل قوم بما سبق إليهم وعملوا.

ইয়া আমীরাল মুমিনীন! এমনটি করবেন না। কেননা, লোকেরা (সাহাবীগণের) বক্তব্য শুনেছে, হাদীসশুনেছে, রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছে এবং প্রত্যেক জনগোষ্ঠী তাই গ্রহণ করেছে, যা তাদের নিকটপৌঁছেছে এবং তদনুযায়ী আমল করেছে।’-আততবাকাত ৪৪০

(القسم المتمم)

খতীব বাগদাদীর বর্ণনায় আছে, ইমাম মালেক  বলেন-

يا أمير المؤمنين! إن اختلاف العلماء رحمة من الله تعالى على هذه الأمة، كل يتبع ما صح عنده، وكل على هدى، وكل يريد الله تعالى.

ইয়া আমীরাল মুমিনীন! নিঃসন্দেহে আলেমগণের মতপার্থক্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এ উম্মতের জন্যরহমত। প্রত্যেকে তাই অনুসরণ করে, যা তার নিকট সহীহ সাব্যস্ত হয়েছে, প্রত্যেকেই হেদায়েতেরউপর প্রতিষ্ঠিত এবং প্রত্যেকেই আল্লাহর (সন্তুষ্টি) কামী।’-কাশফুল খাফা, আলআজলূনী ১/৫৭-৫৮;উকূদুল জুমান, আসসালেহী ১১

বিচক্ষণ ব্যক্তিদের জন্য এই দুটি ঘটনায় জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অনেক উপাদান আছে।

বর্তমান যুগের আকাবির মাশাইখ

. মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. (১৩১৪ হি.-১৩৯৬ হি.)

জাওয়াহিরুল ফিকহের প্রথম খন্ডে হযরতের দুটি রিসালা আছে। দুটোই মূলত আলিমদের সমাবেশেদেওয়া বক্তব্য : ১. ওয়াহদাতে উম্মত, ২. ইখতিলাফে উম্মত পর এক নজর আওর মুসলমানোঁ কেলিয়ে রাহে আমল।

দুটো রিসালাই আমাদের পাঠ করা উচিত।

প্রথম পুস্তিকার শেষে হযরত বলেন, দায়িত্বশীল আলিমদের প্রতি ব্যথিত নিবেদন-‘রাজনীতি ওঅর্থনীতির অঙ্গনে এবং পদ ও পদবীর প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে যে বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন তার প্রতিকারতো আমাদের সাধ্যে নেই। কিন্তু দ্বীনী ও ধর্মীয় কাজে নিয়োজিত দলগুলোর নীতি ও কর্মপন্থার যেবিরোধ তা বোধ হয় দূর করা সম্ভব। কারণ সবার লক্ষ্য অভিন্ন। আর লক্ষ্য অর্জনে সফলতার জন্য তাঅপরিহার্য। যদি আমরা ইসলামের বুনিয়াদী উসূল ও মৌলনীতি সংরক্ষণের এবং নাস্তিকতা ওধর্মহীনতার স্রোত মোকাবেলাকে সত্যিকার অর্থে মূল লক্ষ্য মনে করি তাহলে এটিই সেই ঐক্যের বিন্দু,যেখানে এসে মুসলমানদের সকল ফের্কা ও সব দল একত্রিত হয়ে কাজ করতে পারে আর তখনই এইস্রোতের বিপরীতে কোনো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ কার্যকর হতে পারে।

কিন্তু বাস্তব অবস্থার দিকে তাকালে বলতে হয়, এই মূল লক্ষ্যটিই আমাদের দৃষ্টি থেকে গায়েব হয়েগেছে। এ  কারণে আমাদের সমস্ত সামর্থ্য এবং জ্ঞান ও গবেষণার সমুদয় শক্তি নিজেদের ইখতিলাফিমাসআলায় ব্যয় হচ্ছে। ওগুলোই আমাদের ওয়াজ, জলসা, পত্রিকা ও বই-পুস্তকের আলোচ্য বিষয় হয়েদাঁড়িয়েছে। আমাদের এমন কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষ এ কথা মনে করতে বাধ্য হচ্ছে যে, ইসলাম ধর্মকেবল এই দুই-চার জিনিসেরই নাম। আরো আক্ষেপের বিষয় এই যে, ইখতিলাফী মাসআলাসমূহেযেই দিকটি কেউ অবলম্বন করেছে তার বিপরীতটিকে গোমরাহী এবং ইসলামের শত্রুতা আখ্যা দিচ্ছে।ফলে আমাদের যে শক্তি কুফুরি, নাস্তিকতা, ধর্মহীনতা এবং সমাজে বাড়তে থাকা বেহায়াপনারমোকাবেলায় ব্যয় হতে পারত তা এখন পরস্পর কলহ-বিবাদে ব্যয় হচ্ছে। ইসলাম ও ঈমানআমাদেরকে যে ময়দানে লড়াই ও আত্মত্যাগের আহবান জানায় সেই ময়দান শত্রুর আক্রমণের জন্যখালি পড়ে আছে। আমাদের সমাজ অপরাধ ও অন্যায়ে ভরপুর, আমল-আখলাক বরবাদ, চুক্তি ওলেনদেনে ধোঁকাবাজি, সুদ, জুয়া, মদ, শূকর, অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা ও অপরাধপ্রবণতা আমাদেরজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মিশে গেছে।

প্রশ্ন হল, আম্বিয়া কেরামের উত্তরসূরী এবং দেশ ও ধর্মের প্রহরীদের নিজেদের মধ্যেকার মতপার্থক্যেরবেলায় যতটা সংক্ষুব্ধ হতে দেখা যায় তার অর্ধেকও কেন সেসব খোদাদ্রোহীদের বেলায় দেখা যায় না?এবং  পরস্পর চিন্তাগত মতপার্থক্যের বেলায় যেমন ঈমানী জোশ প্রকাশ পায় তা ঈমানের এইগুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কেন প্রকাশ পায় না? আমাদের বাকশক্তি এবং লেখনীশক্তি যেমন শৌর্যবীর্যের সাথেনিজেদের ইখতিলাফি মাসআলায় লড়াই করে তার সামান্যতম অংশও কেন ঈমানের মৌলিক বিষয়েরউপর আসা হুমকির মোকাবেলায় ব্যয় হয় না? মুসলমানদেরকে মুরতাদ বানানোর প্রচেষ্টার বিরুদ্ধেআমরা সকলে কেন সিসাঢালা প্রাচীরের মতো রুখে দাঁড়াই না?  সর্বোপরি আমরা এ বিষয়ে কেন চিন্তাকরি না যে, নবী প্রেরণ ও কুরআন নাযিলের ঐ মহান উদ্দেশ্য, যা পৃথিবীতে বিপ্লব সৃষ্টি করেছে এবংযা পরকে আপন বানিয়ে নিয়েছে, যা আদম
সন্তানদেরকে পশুত্ব থেকে মুক্ত করে মানবতার মর্যাদা দিয়েছে এবং যা সমগ্র দুনিয়াকে ইসলামেরআশ্রয়কেন্দ্র বানিয়েছে তা কি শুধু এই সব বিষয়ই ছিল, যার ভিতর আমরা লিপ্ত হয়ে আছি। এবংঅন্যদেরকে হেদায়েতের পথে আনার তরীকা ও পয়গম্বরসুলভ দাওয়াত দেওয়ার কি এটাই ছিল ভাষা,যা আজ আমরা অবলম্বন করেছি?

এখনো কি সময় হয়নি যে, ঈমানদারদের অন্তরগুলো আল্লাহর স্মরণ ও তার  নাযিলকৃত সত্যের সামনেঅবনত হবে …

শেষ পর্যন্ত তাহলে ঐ সময় কবে আসবে যখন আমরা শাখাগত বিষয়আশয় থেকে কিছুটা অগ্রসর হয়েইসলামের মৌলিক নীতিমালার সংরক্ষণ এবং অবক্ষয়প্রাপ্ত সমাজের সংশোধনকে নিজেদের আসলকর্তব্য মনে করব। দেশের মধ্যে খৃস্টবাদ ও কমিউনিজমের সর্বগ্রাসী সয়লাবের খবর নিব।কাদিয়ানীদের হাদীস অস্বীকার ও ধর্ম বিকৃতির জন্য কায়েম করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পয়গম্বরসুলভদাওয়াত ও এসলাহের মাধ্যমে মোকাবেলা করব।

আর যদি আমরা এগুলো না করি এবং হাশরের ময়দানে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামআমাদেরকে এ প্রশ্ন করেন যে, আমার দ্বীন ও শরীয়তের উপর এই হামলা হচ্ছিল, ইসলামের নামেকুফরি বিস্তার লাভ করছিল, আমার উম্মতকে আমার দুশমনের উম্মত বানানোর ধারাবাহিক প্রচেষ্টাচলছিল, কুরআন ও সুন্নাহর প্রকাশ্য বিকৃতি ঘটছিল, আল্লাহ ও রাসূলের প্রকাশ্য নাফরমানি করাহচ্ছিল তখন তোমরা ইলমের দাবীদারেরা কোথায় ছিলে? তোমরা এর মোকাবেলায় কতটা মেহনতএবং ত্যাগ স্বীকার করেছ? কতজন বিপথগামী ব্যক্তিকে পথে এনেছ? তো আমাদের ভেবে দেখা উচিতসেদিন আমাদের উত্তর কী হবে?

কর্মপন্থা

এজন্য জাতির প্রতি সংবেদনশীল এবং ঈমান ও ইসলামের উসূল ও মাকসাদসমূহের প্রতি সচেতনউলামায়ে কেরামের কাছে আমার ব্যথাভরা নিবেদন-মাকসাদের গুরুত্ব ও নাযুকতাকে সামনে রেখেসবার আগে মন থেকে এই অঙ্গীকার করুন যে, নিজেদের ইলমী ও আমলী যোগ্যতা এবং কথা ওকলমের শক্তিকে বেশির থেকে বেশি ঐ ময়দানে নিয়োজিত করবেন, যার সংরক্ষণের জন্য কুরআন ওহাদীস আপনাদের ডাকছে।

১. সম্মানিত ওলামা! এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিন এবং প্রতিজ্ঞা করুন যে, এ কাজের জন্য নিজের বর্তমানব্যস্ততার মধ্য থেকে বেশির থেকে বেশি সময় বের করবেন।

২. পরস্পর মতপার্থক্য ও ইজতিহাদী বিরোধকে কেবল নিজেদের দরস এবং লেখালেখি ও ফতওয়াপর্যন্ত সীমিত রাখবেন। আম জলসা, পত্রপত্রিকা, বিজ্ঞপ্তি, পরস্পর বিতর্ক ও ঝগড়া-বিবাদের মাধ্যমেতাকে বড় করবেন না। নবীদের মতো দাওয়াত ও ইসলাহের নীতির অধীনে কষ্টদায়ক ভাষা, নিন্দা,উপহাস, আক্রমণ ও বাক্যচালনা থেকে বিরত থাকবেন।

৩. সমাজে ছড়িয়ে পড়া ব্যধিসমূহের প্রতিকারের জন্য হৃদয়গ্রাহী শিরোনামে সেণহ ও আন্তরিকতাপূর্ণভাষা ও আঙ্গিকে কাজ শুরু করুন।

৪. নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতা এবং কুরআন-সুন্নাহর বিকৃতির মোকাবেলার জন্য পয়গম্বরদের দাওয়াতেরনীতি অনুসারে প্রজ্ঞাপূর্ণ কৌশল,
আন্তরিকতাপূর্ণ আলোচনা এবং হৃদয়গ্রাহী দলিল প্রমাণের মাধ্যমে وجادلهم بالتي هي أحسن এর সাথেনিজের মুখের ভাষা ও কলমের শক্তিকে ওয়াকফ করে দিন।’

এ ধরনের আরেক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘যে দেশকে একদিকে খৃস্টান মিশনারীরা নিজেদের পূর্ণ শক্তিএবং পার্থিব জাকজমকের সাথে খৃস্টান-রাজ্য বানানোর স্বপ্ন দেখছে আরেকদিকে প্রকাশ্যে আল্লাহরবান্দা এবং তাদের শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে উপহাস করা হচ্ছে, অন্যদিকে কুরআন ও ইসলামের নামে ঐসবকিছু করা হচ্ছে, যাকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই কুরআন ও ইসলাম এসেছিল, সে দেশেকেবল শাখাগত মাসাইল এবং তার বিচার-পর্যালোচনা ও প্রচারণার চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে ঐ মৌলিকবিষয়াদি থেকে যারা উদাসীন রয়েছি তাদের প্রতি যদি আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম -এর তরফ থেকে প্রশ্ন করা হয়-তোমাদের দ্বীনের বিষয়ে যখন এই সকল বিপর্যয় দেখাদিয়েছিল তোমরা তার জন্য কী করেছিলে, তখন আমাদের কী জবাব হবে? আমার বিশ্বাস, কোনোফের্কা, কোনো জামাত যখন বিভেদ-বিতর্ক থেকে উপরে উঠে এ বিষয়ে চিন্তা করবে তখন তার বর্তমানকাজকর্মের জন্য অনুশোচনা হবে এবং তার তৎপরতার রোখ বদলে যাবে। যার
ফলে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ নিশ্চয়ই হ্রাসপ্রাপ্ত হবে।

. শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ছালিহ আলউছাইমীন (১৪২১ হি.)

তিনি এ বিষয়ে অনেক বলেছেন এবং অনেক লিখেছেন। আমরা এখানে তার কয়েকটি কথা নকলকরছি :

ক) ‘‘এ যুগের কিছু কিছু সালাফী, বিরোধীদেরকে গোমরাহ  বলে থাকে, তারা হকপন্থী হলেও। আরকিছু কিছু লোক তো একে বিভিন্ন ‘ইসলামী’ দলের মত একটি দলীয় মতবাদে পরিণত করেছে। এটামোটেও গ্রহণযোগ্য নয়, অবশ্যই এর প্রতিবাদ করতে হবে। তাদেরকে বলতে হবে, সালাফেসালেহীনের কর্মপদ্ধতি লক্ষ করুন, ইজতিহাদগত মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে তাদের নীতি কী ছিল এবংতাঁরা কেমন উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁদের মাঝে তো অপেক্ষাকৃত বড় বড় বিষয়েও মতভেদহয়েছে, কোনো কোনো (শাখাগত) আকীদা বিষয়েও মতভেদ হয়েছে : দেখুন, আল্লাহর রাসূল তাঁররবকে দেখেছেন কিনা-এ বিষয়ে কেউ বললেন, দেখেননি; কেউ বললেন, দেখেছেন। কেয়ামতের দিনআমল কীভাবে ওজন করা হবে-এ বিষয়ে কেউ বলেছেন, আমল ওজন করা হবে। কেউ বলেছেন,আমলনামা ওজন করা হবে; তেমনি ফিকহের মাসাইল- নিকাহ, ফারাইয, ইদ্দত, বুয়ূ  (বেচাকেনা)ইত্যাদি বিষয়েও তাঁদের মাঝে মতভেদ হয়েছে,  কিন্তু তাঁরা তো একে অপরকে গোমরাহ বলেননি।

‘সুতরাং যাদের বিশ্বাস, ‘সালাফী’ একটি সম্প্রদায়, যার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট রয়েছে, অন্যরা সবাইগোমরাহ, প্রকৃত সালাফী আদর্শের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সালাফী মতাদর্শের অর্থ হচ্ছে,আকিদা-বিশ্বাস, আচরণ- উচ্চারণ, মতৈক্য-মতানৈক্য এবং পরস্পর সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির ক্ষেত্রেসালাফে সালেহীনের পথে চলা। যেমনটি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন;প্রীতি, করুণা ও পরস্পরের প্রতি অনুরাগে মুমিনগণ যেন একটি দেহ, যার এক অঙ্গ অসুস্থ হলে গোটাদেহ জ্বর ও নিদ্রাহীনতায় আর্তনাদ করতে থাকে। এটিই হচ্ছে প্রকৃত সালাফী মতাদর্শ।’ [লিকাআতুলবাবিল মাফতূহ, প্রশ্ন : ১৩২২]

খ) শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ছালিহ উছাইমিন রাহ. জামেয়া ইসলামিয়া মদীনা মুনাওয়ারায়২১/১২/১৪১১ হিজরী তারিখে একটি মুহাযারা (বক্তৃতা) পেশ করেছিলেন। তাতে তিনি বিশেষভাবেবলেছেন-

سب العالم سبب لانتهاك السنة النبوية وسبب لانتهاك العلم الشرعي.

‘আলিমকে কটুক্তি করা সুন্নাহর অমর্যাদা ও শরয়ী ইলমের অমর্যাদার কারণ হয়ে থাকে।’

গ. ‘যখন আলিমদের দিক (তাদের মান-মর্যাদা) দুর্বল হয় তখন সাধারণ মানুষের কিতাব ও সুন্নাহরঅনুসরণও দুর্বল হয়ে যায়।’

ঘ. ‘যারা আলিমদের অমর্যাদায় লিপ্ত বাস্তবে তারা সুন্নাহর আবরণ ছিন্ন করার কাজে লিপ্ত।’

ঙ. ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মন ও মুখকে সুস্থ ও সংযত রাখা।’

চ. ‘আলিম ও দায়ীগণের নিন্দা-সমালোচনাকারী উম্মতকে আলিম ও দায়ীদের প্রতি বিরূপ করেথাকে। উম্মত আলিম ও দায়ীদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। তখন দ্বীন-শরীয়তের প্রতিও তাদেরআস্থা থাকে না।

‘সমালোচিতদের প্রতি আস্থা নষ্ট হওয়ার পর সমালোচনাকারীদের প্রতিও লোকের আস্থা থাকে না।আর এতে আনন্দিত হয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী (ইসলামের দুশমনেরা)’।-আদদাওয়াতু ইলাল জামাআতিওয়াল ইতিলাফ পৃষ্ঠা : ১০১

. . নাসির ইবনে আবদুল কারীম আলআকল

তিনি জামিআতুল ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সাউদ আলইসলামিয়া রিয়াদের প্রফেসর। তিনি‘আলইফতিরাক : মাফহূমুহু, আসবাবুহূ, সুবুলুল বিকায়াতি মিনহু’ নামে একটি সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভপুস্তিকা লিখেছেন। তাতে তিনি এ কথাও বলেছেন যে, জেনে বুঝে সচেতনতার সাথে ইমামগণেরঅনুসরণ করা হলে একেও তাকলীদ নামে আখ্যায়িত করা হয়! বলা হয়, মাশাইখের অনুসরণ হচ্ছেতাকলীদ আর তা নাজায়েয! আমাদের কাছে কিতাব আছে, জ্ঞানের বিভিন্ন মাধ্যম আছে, এখন কেনআলিমদের কাছে যেতে হবে? এই ভুল চিন্তা খন্ডন করে তিনি বলেন, ইমাম, মাশাইখ ও আলিমগণেরঅনুসরণ করা ওয়াজিব …।

‘শরীয়তের দৃষ্টিতে (আহলে ইলমের) ইত্তিবা ও অনুসরণ অপরিহার্য। কারণ আম মুসলিম জনসাধারণ;বরং ইলম চর্চায় নিয়োজিত অনেকেই ইজতিহাদ তথা সঠিক পন্থায় দলীল-প্রমাণ গ্রহণে ও বিশ্লেষণেপারদর্শী নয়। তো এরা কাদের নিকট থেকে ইলম হাসিল করবে? এবং কীভাবে ইলম অর্জনের পদ্ধতি,সুন্নাহর নিয়ম এবং সালাফে সালেহীন ও ইমামগণের নীতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে? এ তো আহলেইলমের অনুসরণ ছাড়া সম্ভব নয়। একে (নিন্দিত ও বর্জনীয়) তাকলীদ বলে না। নতুবা প্রত্যেকেইনিজের ইমাম হবে এবং যত ব্যক্তি তত দলের উদ্ভব ঘটবে। এটা নিঃসন্দেহে ভুল। সুতরাং সঠিকপন্থায় ইমামদের অনুসরণ (নিন্দিত) তাকলীদ নয়। নিন্দিত তাকলীদ হচ্ছে অন্ধ অনুসরণ। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, (তরজমা) ‘যদি না জান তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর।’

‘উলামা মাশায়েখ ও দ্বীনদার মুবাল্লিগদের থেকে বিমুখ হয়ে শুধু বইপত্রের মাধ্যমে ইলম অর্জনেরচেষ্টা করা এবং মনে করা যে, এখন বইপত্র আছে, ক্যাসেট আছে, প্রচারমাধ্যম আছে, ইলম অর্জনেরজন্য এগুলোই যথেষ্ট, এটা ইলম অন্বেষণের একটা মারাত্মক ভুল পদ্ধতি।’

তিনি আরো বলেন, ‘বিভেদের আরেকটি কারণ ‘ফিকহুল খিলাফ’ তথা মতপার্থক্যের প্রকার, বিধান ওনীতি সম্পর্কে এবং ‘ফিকহুল জামাআতি ওয়াল ইজতিমা’ তথা ঐক্য ও মতৈক্যের নীতি ও বিধানসম্পর্কে সঠিক উপলব্ধির অভাব। কোন মতপার্থক্য বৈধ, কোন মতপার্থক্য বৈধ নয় অপর পক্ষকেকোন ক্ষেত্রে মাযূর মনে করা হবে, কোন ক্ষেত্রে মনে করা হবে না, তেমনি জামাআ ও ইজতিমার অর্থকী, বিভেদ-অনৈক্যের ক্ষতি ও অনিষ্ট কী-এসব বিষয় সঠিকভাবে বোঝা উচিত।

আমার সামনে এ কিতাবের ইন্টারনেট সংস্করণ রয়েছে।

. শায়খ আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন ছালিহ আলমুতায

তিনি ‘আদদাওয়াতু ইলাল জামাআতি ওয়াল ইতিলাফ ওয়ান নাহয়ু আনিত তাফাররুকি ওয়ালইখতিলাফ’ নামে একটি ছোট পুস্তিকা লিখেছেন। তাতে ঐক্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা এবং বিদ্বেষ-অনৈক্যপরিহারের আহবান জানিয়েছেন।

এ কিতাবে শায়খ ড. সালিহ ইবনে ফাওযান আলফাওযানের অভিমতও রয়েছে। পুস্তিকাটিতে অনেকউদ্ধৃতি ও দলিলের সাথে বারবার বলা হয়েছে যে, ফুরূয়ী মাসআলায় মতভেদের পরও আমাদেরকেঐক্য ও সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। সকল মতভেদ কিন্তু বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতাকে অপরিহার্য করে না। কোনো মতপার্থক্যের বিষয়ে যদি সংশয় হয় যে, তা সহনীয় কি না তাহলে এর সমাধান বড় বড়আলিমরা করবেন।

. মাওলানা মুহাম্মাদ তকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম

হযরত তার সফরনামা ‘সফর দর সফর’ এ কিরগিজিস্তানের বিবরণে লেখেন, ‘এখন সেখানকারপরিস্থিতি কতকটা এমন যে, একদিকে সাধারণ মুসলমান সোভিয়েত ইউনিয়নের চলমান মতবাদ ওকৃষ্টি-কালচারে প্রভাবিত হয়ে দ্বীনের প্রাথমিক বিষয়গুলো সম্পর্কেও অজ্ঞ এবং পশ্চিমা সংস্কৃতিতেমেতে ইসলামের বিধিনিষেধ থেকে সম্পূর্ণ উদাসীন; রাস্তাঘাটে চলাচলকারী  নারীদের পোশাক থেকেবোঝার উপায় নেই যে, ইসলামী জীবনধারার সাথে তাদের ন্যূনতম যোগাযোগ আছে। অপর দিকেধর্মীয় অভিভাবকদের মাঝে দ্বিতীয় জামাত করা, জুমার সাথে সতর্কতামূলক যোহর আদায় করা আরসালাফী বন্ধুদের উপস্থিতির সুবাদে ‘আরশে সমাসীন হওয়া’র মত জটিল জটিল মাসআলা গুরুত্বপূর্ণহয়ে উঠেছে।

‘আলোচনার মূল বিষয় ছিল কিরগিজিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্বীনী মেহনতকে কীভাবে এগিয়েনেওয়া যায় এবং এ ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনী ব্যক্তিবর্গের করণীয় কী হওয়া উচিৎ। এ প্রসঙ্গেশ্রোতাদের কাছে সবিনয় নিবেদন করি যে, শাখাগত মাসআলায় ইখতিলাফ থেকে আপনাদেরমনোযোগ ফিরিয়ে নিন। আপনারা নজর দিন উম্মাহর মৌলিক ও স্বতঃসিদ্ধ বিষয়গুলোর শিক্ষা ওপ্রচার প্রসারে, অধিকাংশ জনসাধারণ যে সম্পর্কে বেখবর ও অজ্ঞ।

‘আলহামদু লিল্লাহ এ সম্মেলন শ্রোতাদের একথার উপর শেষ হয়েছে যে, আল্লাহর রহমতে কিছুইখতিলাফ তো মিটে গেছে। বাকিগুলোর ব্যাপারে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, এগুলোকেআলোচনার বিষয় বানাব না। বরং এখন আমাদের সর্বাত্নক চেষ্টা হবে দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলোরদাওয়াত ও তালীমে  মনোযোগ দেওয়া। (পৃ : ১৩৬- ১৩৮)

রাশিয়ার সফরের বিবরণে লেখেন-

‘রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের কিছু তরুণ আরব ভার্সিটি থেকে কম বেশি পড়াশোনা করে এসেছে। তারাকট্টর সালাফী হয়ে দেশে ফিরেছে। যেহেতু দাগিস্তানের অধিকাংশ আলিম শাফেয়ী মাযহাবেরঅনুসারী, তাঁদের মাঝে দীর্ঘকাল থেকে তাসাওউফের সিলসিলা অব্যাহতভাবে চলে আসছে আরশাফেয়ী মাযহাবের (পরবর্তী কিছু আলিমের মধ্যে কোনো কোনো) বিদআতের ব্যাপারে কিছু ছাড়আছে-এ কারণে ঐসব তরুণ এখানে এসে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-এর তাকলীদএবং তাসাওউফের বিরুদ্ধে তারা কঠোরভাবে বিরোধিতা শুরু করেছে। কেউ কেউ তো এখানকারপ্রবীণ আলেমদের মুশরিক পর্যন্ত বলেছে। এর ভিত্তিতে এখানকার মুসলমানদের মাঝে অস্থিরতা দেখাদিচ্ছে।

‘এ প্রেক্ষাপটে আমার আলোচনার মূল বিষয়বস্ত্ত ছিল, কমিউনিজমের আধিপত্য ও নির্যাতন থেকেস্বাধীনতা অর্জনের পর রাশিয়ার মুসলমানদের কর্মপদ্ধতি কী হওয়া উচিৎ। এ প্রসঙ্গে আমি বললাম যে,আজ রাশিয়ার মুসলমানদের মাঝে যদি ইসলাম ও ইসলামী জীবনপদ্ধতির কোন চিহ্ন বাকি থেকেথাকে তা কেবল প্রবীণ উলামায়ে কেরামের মেহনতের ফসল। যারা কমিউনিস্ট শাসনের অন্ধকাররাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইলমে দ্বীনের আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন এবং যারা জীবন ও জীবিকারসকল সুযোগ-সুবিধা ও আরাম-আহার ত্যাগ করে ভবিষ্যত প্রজন্মের দ্বীন ও ঈমানের হেফাযতকরেছেন। তাই আজকের তরুণসমাজের কর্তব্য, ঐসকল মহীরূহ উলামায়ে দ্বীনের যথার্থ মূল্যায়ন ওসম্মান করা। পাশাপাশি এটা কখনো ভোলা উচিৎ নয় যে, শাখাগত মাসআলায় ইখতেলাফ সব যুগেইছিল। এ ইখতিলাফকে কেন্দ্র করে একপক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে কাফের মুশরিক বলে ফতোয়াদেওয়া হলে এতে কেবল ইসলামের শত্রুরাই লাভবান হবে। আজ তো রাশিয়ার অবস্থা এই যে,ইসলাম ও ইসলামের বিধি-বিধান সম্পর্কে দমনপীড়নের কারণে সাধারণ মুসলমানদের কাছে দ্বীনেরমৌলিক শিক্ষাই অস্পষ্ট হয়ে গেছে। এ মুহূর্তে তাদের কাছে দ্বীনের মৌলিক জ্ঞান পৌঁছানোঅবশ্যকর্তব্য। মুসলমানদের এমন অসহায় পরিস্থিতিতে ‘আরশে সমাসীন হওয়া’, ‘তাকলীদ চলবে,না গাইরে তাকলীদ’-এ জাতীয় মাসআলায় ইখতিলাফ করা হলে দ্বীনের ক্ষতিসাধনে এর চেয়ে বড়কোনো ফেতনা আর হতে পারে না। তাই সাধারণ মুসলমানের কর্তব্য এটাই যে, তারা প্রবীণআলেমদের সাথে জুড়ে থাকবেন। কোনো বিষয়ে সন্দেহ হলে আপোসে সমাধা করে নেবেন। কলহ ওকোন্দলের দিকে যাবেন না।  (পৃ :১৭৯১৮০)

আমি নিবেদন করছিলাম যে, বর্তমান সময়ে এটি গোটা মুসলিম জাহানের সমস্যা। এজন্য বিষয়টিরসংশোধন অতি প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। তবে এর জন্য শর্ত হচ্ছে ইখলাস ওহিম্মত।

নামাযের পদ্ধতিতে সুন্নাহর বিভিন্নতা বা সুন্নাহ অনুধাবন কেন্দ্রিক মতপার্থক্য

নামায ঐক্যের চিহ্ন, একে বিবাদের কারণ বানাবেন না

(এ শিরোনামের আলোচনা মাসিক আলকাউসারে এবং নবীজীর নামাযের ভূমিকায় প্রকাশিত হয়েছে।তাই এখানে নির্বাচিত কিছু অংশ তুলে দেওয়া হল।)

উম্মতের উপর ফকীহগণের বড় অনুগ্রহ এই যে, তারা শরীয়তের বিধি-বিধানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যেমনকরেছেন তেমনি তা সংকলনও করেছেন। বিশেষত ইবাদতের পদ্ধতি ও তার পূর্ণাঙ্গ কাঠামোস্পষ্টভাবে পেশ করেছেন, যা হাদীস, সুন্নাহ ও ‘আমলে মুতাওয়ারাছ’ (যা সুন্নাহর এক গুরুত্বপূর্ণপ্রকার) থেকে গৃহীত। এর বড় সুবিধা এই যে, কেউ মুসলমান হওয়ার পর সংক্ষেপে তাকে নামাযেরপদ্ধতি বুঝিয়ে দেওয়া হয় আর সে সঙ্গে সঙ্গে নামায পড়া আরম্ভ করে। শিশুদেরকে শেখানো হয়, সাতবছর বয়স থেকেই তারা নামায পড়তে থাকে। সাধারণ মানুষ, যাদের দলীলসহ বিধান জানার সুযোগনেই এবং শরীয়তও তাদের উপর এটা ফরয করেনি, তাদেরকে শেখানো হয় আর তারা নিশ্চিন্ত মনেআল্লাহ তাআলার ইবাদত করতে থাকে।

যদি অমুসলিমকে ইসলাম গ্রহণের পর এবং শিশুকে বালেগ হওয়ার পর বাধ্য করা হত যে, তোমরানামায আদায়ের পদ্ধতি হাদীসের কিতাব থেকে শেখ, কারো তাকলীদ করবে না, দলীল-প্রমাণেরআলোকে সকল বিষয় নিজে পরীক্ষা করে নামায পড়বে তাহলে বছরের পর বছর অতিবাহিত হবে,কিন্তু তার নামায পড়ার সুযোগ হবে না। একই অবস্থা হবে যদি সাধারণ মানুষকে এই আদেশ করাহয়।

খুব ভালো করে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন যে, কুতুবে ছিত্তা (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী,তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীস-গ্রন্থের সংকলক ইমামগণও প্রথমে নামায শিখেছেনফিকহে ইসলামী থেকেই, এরপর পরিণত হয়ে হাদীসের কিতাব সংকলন করেছেন। অথচ হাদীসেরকিতাব সংকলন করার পর তারা না ফিকহে ইসলামীর উপর কোনো আপত্তি করেছেন, আর নামানুষকে ফিকহ সম্পর্কে আস্থাহীন করেছেন। বরং তারা নিজেরাও ফকীহগণের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন।তবে যেখানে ফুকাহায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ হয়েছে সেখানে তারা নিজেদের বিচার-বিবেচনামোতাবেক কোনো এক মতকে অবলম্বন করেছেন এবং অন্য মত সম্পর্কে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন।

মোটকথা, হাদীসের কিতাবসমূহের সংকলক এবং হাদীসশাস্ত্রের ইমামগণের যেমন বড় অবদানউম্মতের প্রতি রয়েছে তেমনি ফিকহে ইসলামীর সংকলক ও ফিকহের ইমামগণেরও বড় অবদানরয়েছে। উম্মাহর অপরিহার্য কর্তব্য, কিয়ামত পর্যন্ত উভয় শ্রেণীর মনীষীদের অবদান স্বীকার করা এবংউভয় নেয়ামত : হাদীস ও ফিকহকে সঙ্গে রেখে চলা।

নামাযের পদ্ধতিগত কিছু বিষয়ে খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকেই বিভিন্নতাছিল। এটা খাইরুল কুরূনেও ছিল এবং পরের যুগগুলোতেও ছিল। এর কারণ সম্পর্কেও ইতিপূর্বে কিছুআলোচনা হয়েছে। এই ধরনের  ক্ষেত্রে উম্মতের করণীয় কী তা শরীয়তের দলীলের আলোকে ফিকহেইসলামীতে বলা হয়েছে। হাদীস মোতাবেক নামায পড়ার জন্য
ওই নির্দেশনা অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই।

এ ধরনের বিষয়ে উম্মাহর যে নীতি ‘খাইরুল কুরূন’ তথা সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীন-এর যুগথেকে অনুসৃত তা সংক্ষেপে এই :

যে অঞ্চলে যে সুন্নাহ প্রচলিত সেখানে তা-ই চলতে দেওয়া উচিত। এর উপর আপত্তি করা ভুল। কেননাআপত্তি ঐ বিষয়ে করা হয়, যা বিদআত বা সুন্নাহর পরিপন্থী। এক সুন্নাহর উপর এজন্য আপত্তি করাযায় না যে, এটা আরেক সুন্নাহর মোতাবেক নয়।

এ প্রসঙ্গে ইসমাঈল শহীদ রাহ.-এর ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। তিনি একবার রুকু ইত্যাদিতে ‘রাফয়েইয়াদাইন’ করতে আরম্ভ করেছিলেন। অথচ সে সময় গোটা ভারতবর্ষের সর্বত্র (ক্ষুদ্র কিছু অঞ্চলব্যতিক্রম ছিল, যেখানে ফিকহে শাফেয়ী অনুযায়ী আমল হত) নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য কোনো স্থানেরাফয়ে ইয়াদাইন না-করার সুন্নতটি প্রচলিত ছিল। শাহ শহীদ রাহ.-এর বক্তব্য ছিল, মৃত সুন্নত জীবিতকরার ছওয়াব অনেক বেশি। হাদীস শরীফে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে-

من تمسك بسنتي عند فساد أمتي فله أجر مأة شهيد

‘উম্মতের ফাসাদের মুহূর্তে যে আমার সুন্নাহকে ধারণ করে সে একশত শহীদের মর্যাদা পাবে।’

তখন তাঁর চাচা হযরত মাওলানা আবদুল কাদের দেহলবী রাহ. (শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ.-এর পুত্র,তাফসীরে মূযিহুল কুরআন-এর রচয়িতা) তার এই ধারণা সংশোধন করেন। তিনি বলেন, ‘‘মৃতসুন্নাহকে জীবিত করার ফযীলত যে হাদীসে এসেছে সেখানে বলা হয়েছে যে, উম্মাহর ফাসাদের যুগেযে ব্যক্তি সুন্নাহকে ধারণ করে তার জন্য এই ফযীলত। তো কোনো বিষয়ে যদি দু’টো পদ্ধতি থাকেএবং দু’টোই মাসনূন (সুন্নাহভিত্তিক) হয় তাহলে এদের কোনো একটিকেও ‘ফাসাদ’ বলা যায় না।সুন্নাহর বিপরীতে শিরক ও বিদআত হল ফাসাদ, দ্বিতীয় সুন্নাহ কখনও ফাসাদ নয়। কেননা, দু’টোইসুন্নাহ। অতএব রাফয়ে ইয়াদাইন না-করাও যখন সুন্নাহ, তো কোথাও এ সুন্নাহ অনুযায়ী আমল হতেথাকলে সেখানে রাফয়ে ইয়াদাইনের সুন্নাহ ‘জীবিত’ করে উপরোক্ত ছওয়াবের আশা করা ভুল। এটাওই হাদীসের ভুল প্রয়োগ। কেননা এতে পরোক্ষভাবে দ্বিতীয় সুন্নাহকে ফাসাদ বলা হয়, যা কোনোমতেই সঠিক নয়।’

এই ঘটনাটি আমি বিশদ করে বললাম। মূল ঘটনা মালফূযাতে হাকীমুল উম্মত খ. ১, পৃ.  ৫৪০-৫৪১,মালফুয : ১১১২৬ খ. ৪, পৃ. ৫৩৫, মালফুয : ১০৫৬ এবং মাজালিসে হাকীমুল উম্মত পৃ. ৬৭-৬৯ তেউল্লেখিত হয়েছে।

সারকথা, সালাফে সালেহীন বিদআত থেকে দূরে থাকতেন এবং বিদআতের বিরোধিতা করতেন। আরসুন্নাহ অনুযায়ী আমল করতেন এবং সুন্নাহকে জীবিত করতেন। কিন্তু কখনও তাদের নীতি ‘ইবতালুসসুন্নাহ বিসসুন্নাহ’ বা ‘ইবতালুস সুন্নাহ বিলহাদীস’ ছিল না। অর্থাৎ তারা এক সুন্নাহকে অন্য সুন্নাহরমোকাবেলায় দাঁড় করাতেন না। তদ্রূপ ‘সুন্নতে মুতাওয়ারাছা’ দ্বারা প্রমাণিত আমলের বিপরীতেরেওয়ায়েত পেশ করে তাকে বিলুপ্ত করার চেষ্টা করতেন না। এক সুন্নাহর সমর্থনে অন্য সুন্নাহকেখন্ডন করা  আর একে ‘মুর্দা সুন্নত জিন্দা করা’ বলে অভিহিত করা তাদের নীতি ছিল না। এটা  ভুলনীতি, যা খাইরুল কুরূনের শত শত বছর পরে জন্মলাভ করেছে।

২. কয়েক বছর আগের ঘটনা। তখনও শায়খ আলবানী মরহুমের কিতাব ‘ছিফাতুস সালাহ’ তার পুরোনাম-

صفة صلاة النبي صلى الله عليه وسلم من التكبير إلى التسليم كأنك تراها

-এর বাংলা তরজমা প্রকাশিত হয়নি, আমার কাছে একজন জেনারেল শিক্ষিত ভাই এসেছিলেন, যাকেবোঝানো হয়েছিল কিংবা তাদের বোঝানোর দ্বারা তিনি বুঝে নিয়েছিলেন যে, এই দেশের অধিকাংশমুসলমান যে পদ্ধতিতে নামায পড়ে তা হাদীস মোতাবেক হয় না। তিনি আমার কাছে অত্যন্ত আনন্দেরসঙ্গে ‘সুসংবাদ’ দিলেন যে, আলবানী মরহুমের কিতাব বাংলায় অনুদিত হয়েছে! শীঘ্রই তা প্রকাশিতহতে যাচ্ছে! জিজ্ঞাসা করলেন, এ কিতাব সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা আছে কি না! জানা নেই, তিনিমাসআলা জানার জন্য এসেছিলেন, না ‘হেদায়েত’ করার জন্য। আমি শুধু এটুকু আরজ করেছিলামযে, আপনি আপনার শিক্ষকদের কাছ থেকে তিন-চার জন  সাহাবীর নাম নিয়ে আসুন যাদের নামাযশুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আলবানী মরহুমের কিতাবে উল্লেখিত নিয়ম অনুযায়ী ছিল! তিনি ওয়াদা করেগিয়েছিলেন, কিন্তু সাত-আট বছর অতিবাহিত হল আজও তাঁর দেখা পাইনি!

একটু চিন্তা করুন। তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া নামাযের অন্য কিছু তাকবীরের মধ্যে রাফয়ে ইয়াদাইনকরা যদি আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও অন্য কিছু সাহাবীর আমল হয়ে থাকে তাহলে রাফয়ে ইয়াদাইননা-করা তাঁর পিতা খলীফায়ে রাশেদ হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা-এর আমল। তদ্রূপ চতুর্থখলীফায়ে রাশেদ হযরত আলী ইবনে আবু তালিব রা. ও প্রবীণ সাহাবীদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনেমাসউদ রা.সহ সাহাবীদের এক জামাত এই নিয়মেই নামায পড়েছেন। তো এদের মধ্যে কারনামাযকে আপনি খেলাফে সুন্নত বলবেন?

আমাদের যে বন্ধুরা শুধু রাফয়ে ইয়াদাইনকেই সুন্নত মনে করেন এবং রাফয়ে ইয়াদাইন না করাকেভিত্তিহীন বা খেলাফে সুন্নত মনে করেন তারা ফাতিহা পাঠ সম্পর্কে বলে থাকেন যে, ইমামের পিছনেজোরে ও আস্তে সব কিরাতের নামাযে মুকতাদীর জন্য ফাতিহা পড়া ফরয, না পড়লে নামায হবে না।কোনো কোনো কট্টর লোক তো এমনও বলে যে, ফাতিহা ছাড়া যেহেতু নামায হয় না তো যারাইমামের পিছনে ফাতিহা পড়ে না তারা সব যেন বে-নামাযী। আর বে নামাযী হল কাফির!! (নাউযুবিল্লাহ)

আমাদের এই বন্ধুরা যদি চিন্তা করতেন যে, যে আবদুল্লাহ ইবনে উমরের রা. বর্ণনাকৃত হাদীসমোতাবেক তারা রফয়ে ইয়াদাইন করে থাকেন তিনিও তো ইমামের পিছনে কুরআন (ফাতিহা এবংফাতিহার সঙ্গে আরো কিছু অংশ) পড়তেন না। মুয়াত্তায় সহীহ সনদে এসেছে, তিনি বলেন-

إذا صلى أحدكم خلف الإمام فحسبه قراءة الإمام، وإذا صلى وحده فليقرأ

‘যখন তোমাদের কেউ ইমামের পিছনে নামায পড়ে তখন ইমামের কিরাতই তার জন্য যথেষ্ট। আরযখন একা পড়ে তখন সে যেন (কুরআন) পড়ে।’

আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর বিশিষ্ট শাগরিদ নাফে রাহ. তাঁর এই ইরশাদ বর্ণনা করে বলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে উমর ইমামের পিছনে পড়তেন না।’ (মুয়াত্তা পৃ. ৮৬)

ওই বন্ধুদের ‘নীতি’ অনুযায়ী তো আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এরও নামায হত না! আর যখন তাঁরনামায হত না তাহলে রাফয়ে ইয়াদাইন বিষয়ে কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে তাঁর বর্ণনাকৃত হাদীস দ্বারাপ্রমাণ দেওয়া যাবে কি? কেননা (তাদের কথা অনুযায়ী আল্লাহ মাফ করুন) ‘বেনামাযীর’ হাদীসকীভাবে গ্রহণ করা যাবে!

অথচ শরীয়তের দলীল দ্বারা ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা প্রমাণিত যে, তাঁর হাদীস অবশ্যই গ্রহণযোগ্য।তাহলে এটা কি প্রমাণ করে না যে, এ ধরনের বিষয়ে কারো নিন্দা-সমালোচনা করা কিংবা গোমরাহ ওফাসেক আখ্যা দেওয়া নাজায়েয ও অবৈধ?

আমীন জোরে বলা হবে না আস্তে-এ নিয়ে আমাদের এই বন্ধুরা ঝগড়া-বিবাদ করে থাকেন। হাদীস ওআছারের গ্রন্থসমূহ তারা যদি সঠিক পন্থায় অধ্যয়ন করতেন তবে জানতে পারতেন যে, সুফিয়ান ছাওরীরাহ., যাঁর রেওয়ায়েতকৃত হাদীসের ভিত্তিতে এরা জোরে আমীন বলে থাকেন স্বয়ং তিনিই আমীনআস্তে বলতেন। (আলমুহাল্লা, ইবনে হায্ম ২/৯৫)

যদি বিষয়টা ‘সুন্নাহর বিভিন্নতা’ না হত কিংবা অন্তত ‘মুজতাহাদ ফীহ’ না হত তাহলে এই প্রশ্ন কিআসত না যে, যে ব্যক্তি নিজের রেওয়ায়েতকৃত হাদীসের উপর নিজেই আমল করে না তাররেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণগ্রহণ জায়েয কি না?

এভাবে অন্যান্য বিষয়েও যদি চিন্তা করতে থাকেন তাহলে এইসব ক্ষেত্রে সাহাবা-যুগ থেকে চলে আসামতভেদ আপনাকে বিচলিত করবে না। আর একে বিবাদ-বিসংবাদের মাধ্যম বানানোর প্রবণতাও দূরহয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ।

হাদীস অনুযায়ী আমল করারও নির্ধারিত পন্থা রয়েছে। এই পন্থার বাইরে গেলে তা আর হাদীসঅনুসরণ থাকে না, যা শরীয়তে কাম্য। ইত্তেবায়ে সুন্নতেরও মাসনূন পদ্ধতি রয়েছে। ঐ পদ্ধতি পরিহারকরে সুন্নতের অনুসরণ করতে গেলে তা একটা অসম্পূর্ণ ও সংশোধনযোগ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

কেউ যদি রাফয়ে ইয়াদাইনের সুন্নত অনুযায়ী আমল করে তবে এতে অসুবিধার কী আছে? শাফেয়ী ওহাম্বলী মাযহাবের লোকেরাও তো এই সুন্নত মোতাবেক আমল করে থাকেন। হারামাইনের অধিকাংশইমাম হাম্বলী মাযহাবের সাথে যুক্ত। তারাও এই সুন্নতের উপর আমল করে থাকেন। কিন্তু তারা তোরাফয়ে ইয়াদাইন না-করার সুন্নতকে প্রত্যাখ্যান করেন না। যারা এই সুন্নত অনুযায়ী আমল করেনতাদের সঙ্গে বিবাদ-বিসংবাদে লিপ্ত হন না, তাদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জবাজি, লিফলেটবাজি করেন না।তারা অন্যের নামাযকে বাতিল বলা তো দূরের কথা খেলাফে সুন্নতও বলেন না। তারা হাদীসঅনুসরণের ক্ষেত্রে নিজেদের বিদ্যা-বুদ্ধির উপর নির্ভর না করে ‘আহলুয যিকর’ ফিকহের ইমামগণেরউপর নির্ভর করেন।

এখানে ঐ ঘটনাটি উল্লেখ করা যায়, যা হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-এর মালফূযাতে রয়েছে। ঘটনারসারসংক্ষেপ এই যে, এক জায়গায় আমীন জোরে বলা নিয়ে হাঙ্গামা হয়ে গেল এবং বিষয়টা মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়াল। ঘটনার তদন্তের জন্য যাকে দায়িত্ব দেওয়া হল তিনি তদন্ত শেষে রিপোর্টেলিখলেন যে, ‘আমীন বিলজাহর’ অর্থাৎ ‘আমীন জোরে বলা’ হাদীস শরীফে আছে এবং মুসলমানদেরএক মাযহাবে তা অনুসরণ করা হয়। তদ্রূপ ‘আমীন বিছছির’ অর্থাৎ ‘আস্তে আমীন বলা’ও হাদীসশরীফে আছে আর মুসলমানদের এক মাযহাবে তা অনুসৃত। আরেকটি হল ‘আমীন বিশশার’ অর্থাৎহাঙ্গামা সৃষ্টির জন্য উচ্চ আওয়াজে আমীন পাঠ। এটা উপরোক্ত দুই বিষয় থেকে ভিন্ন। প্রথম দুইপ্রকার অনুমোদিত আর তৃতীয়টা নিষিদ্ধ হওয়া চাই।-মালফূযাতে হাকীমুল উম্মত, খ- : ১, কিসত : ২,পৃষ্ঠা : ২৪০-২৪১; খ- : ২, কিসত : ৫, পৃষ্ঠা : ৫০৬, প্রকাশনা দেওবন্দ

বলাবাহুল্য, আস্তে আমীন বলাকে ভুল বা হাদীস পরিপন্থী আখ্যা দিয়ে একমাত্র নিজেদেরকে সুন্নতেরঅনুসারী দাবি করে উচ্চ স্বরে আমীন পাঠ করা ঐ আমীন বিলজাহর নয়, যা হাদীস শরীফে এসেছেএবং সালাফে সালেহীনের এক জামাত যার অনুসরণ করতেন।

৩. যদি সাধারণ মানুষের কাছে উলামা-মাশায়েখের আমলের বিপরীত কোনো দাওয়াত পৌঁছে তাহলেতাদের জন্য যা করণীয় তা এই যে, তারা পরিষ্কার বলে দিবেন, ভাই, আমরা সাধারণ মানুষ।আমাদের নিজেদের পক্ষে গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা সম্ভব নয়, আপনাদের কথা যদি মানতে হয়তাহলে আপনাদের উপরই নির্ভর করে মানতে হবে, সেক্ষেত্রে ওলামা-মাশায়েখের কথার উপর নির্ভরকরতে অসুবিধা কী?

আর যদি এ বিষয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতেই হয় তাহলে তারপদ্ধতি এই :

১. কেউ যদি আপনাকে বলে, (উদাহরণস্বরূপ) ভাই, তুমি যে রাফয়ে ইয়াদাইন করছ না-এ তো হাদীসবিরোধী! আপনি আদবের সঙ্গে বলুন, সব হাদীসের বিরোধী, না রফয়ে ইয়াদাইন না-করারও কোনোহাদীস আছে? তারা বলবে, হ্যাঁ, হাদীস তো কিছু আছে, কিন্তু সব জয়ীফ বা ভিত্তিহীন। আপনি প্রশ্নকরুন, এটা কি আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, না হাদীস বিশারদদের ফয়সালা? এরপর সব হাদীস-বিশারদের ফয়সালা, না তাঁদের কারো কারো? একজন ইমামও কি রফয়ে ইয়াদাইন না-করারহাদীসকে ‘সহীহ’ বলেননি? যদি তার মধ্যে সততা থাকে তাহলে বলতে বাধ্য হবে যে, জ্বী, একাধিকইমাম ঐ হাদীসকেও সহীহ বলেছেন।

আপনি বলুন, আমার জন্য এই যথেষ্ট। যখন সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের একটি জামাতরাফয়ে ইয়াদাইন না-করার হাদীস মোতাবেক আমল করেছেন তো আপনি তার বিশেষ কোনোসনদকে জয়ীফ বললে কী আসে যায়? সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে প্রজন্ম পরম্পরায় চলে আসাএবং উম্মাহর উলামা-মাশায়েখের মাঝে স্বীকৃত বিষয়কে শুধু সংশ্লিষ্ট একটি হাদীসের সনদের দুর্বলতাদ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ করা কি মারাত্মক ভুল নয়!

আর সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হল, আপনি তাকে হিকমতের সাথে কোনো বিশেষজ্ঞ আলিমের কাছে নিয়েযাবেন, যার হাদীস ও সীরাতের কিতাবসমূহের উপর এবং ফিকহে মুদাল্লাল ও ফিকহে মুকারানেরকিতাবসমূহের উপর দৃষ্টি রয়েছে। ইনশাআল্লাহ সকল ভুল ধারণার অবসান ঘটবে এবং কটুকথা,নিন্দা-সমালোচনার ধারাও বন্ধ হবে।

৪. যারা খতীব বা মুদাররিস-এর দায়িত্বে রয়েছেন কিংবা দ্বীনী বিষয়ে সাধারণ মানুষ যাদের শরণাপন্নহয় তাদের খিদমতে নিবেদন, যদিও আম মানুষ ও জেনারেল শিক্ষিত মানুষের পক্ষে দলীল ও দলীলদ্বারা দাবী প্রমাণের পদ্ধতি বোঝা কঠিন তবুও তাদেরকে  এই প্রশ্ন না করাই ভালো যে, দলীল জানতেচাওয়ার অধিকার তাদের আছে কি না। বরং রাহমাতান বিইবাদিল্লাহ তাদের সঙ্গে কোমল আচরণকরুন এবং অনুগ্রহপূর্বক তাদের কথাবার্তা-যদিও তা উল্টাসিধা হোক না কেন-শুনুন। তারা যদি দলীলজানতে চায় তাহলে অন্তত দু’একটি স্পষ্ট দলীল তাদেরকে জানিয়ে দিন। তবে এর জন্য প্রস্ত্ততিরপ্রয়োজন আছে। আপনাকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি অধ্যয়ন করতে হবে এবং সকলবিষয়ের সর্বাধিক সহজ ও সবচেয়ে বিশুদ্ধ দলীল  সহজভাবে উপস্থাপনের যোগ্যতা অর্জন করতেহবে।

সাথে সাথে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে খেয়াল রাখুন যে, এ সকল ইখতিলাফী বিষয়ে অন্যরা যেমনপ্রান্তিকতার শিকার আপনি যেন তা না হন। যেমন আপনি বলবেন না রাফয়ে ইয়াদাইন মানসূখ হয়েগেছে; বরং এমন বলুন, রাফয়ে ইয়াদাইন আছে, কিন্তু রাফয়ে ইয়াদাইন না করার সুন্নাহ আমাদেরইমামের দৃষ্টিতে অগ্রগণ্য। আপনি অন্যের রফয়ে ইয়াদাইন করা ও জোরে আমীন বলার উপর আপত্তিকরবেন না, তেমনি আপনার মুসল্লিদেরকেও তাদের সাথে ঝগড়া করার অনুমতি দিবেন না। নতুবাআপনার ও তাদের অবস্থা এক হয়ে যাবে। আপনি তাদেরকে হিকমতের সাথে বোঝান যে, ‘আপনাদের তো এক সুন্নাহ থেকে অন্য সুন্নাহর দিকে বা অন্য মোবাহ তরীকার দিকে যাওয়ারপ্রয়োজন নেই। আর যদি যেতেই হয় তাহলে অন্যকে হাদীসবিরোধী মনে করার কোনো সুযোগ নেই।তেমনি এই
চিন্তারও সুযোগ নেই যে, আহা! এতদিন পর হেদায়েত পেলাম! আর অন্যের সাথে কলহ-বিবাদের তোপ্রশ্নই আসে না। সেটা যদি করেন তাহলে নিঃসন্দেহে আপনি সুন্নাহ পরিপন্থী রাস্তায় চলে গেলেন!অথচ যে বিষয়ে তাদের  সাথে বিবাদে অবতীর্ণ হবেন তাতে তারা সুন্নাহর উপর আছেন। তাহলে কীলাভ হল? আপনি এমন একটি সুনণতের সমর্থন করতে গিয়ে, যার বিপরীতটিও সুন্নাহ, এমন পথঅবলম্বন করলেন, যা সর্ববাদীসম্মত সিদ্ধান্ত অনুসারে সুন্নাহ পরিপন্থী!!’ এভাবে খুলে খুলে এবংদলিলের সাথে বোঝান। ভৎর্সনা উচিতও নয়, ফায়েদাও নেই।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

ফুরূয়ী ইখতিলাফের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি বাড়াবাড়ির কারণ

সব যামানার আলিমগণ ফুরূয়ী বা শাখাগত মাসাইলের মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে যে ভারসাম্যপূর্ণ কর্মপন্থা নির্দেশকরেছেন বর্তমান মুসলিমসমাজে, বিশেষত এ উপমহাদেশে তা মর্মান্তিকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। সম্প্রীতি,উদারতা ও নম্রতার পরিবর্তে এ ধরনের মতভেদের ক্ষেত্রগুলোতে বাড়াবাড়ি ও কড়াকড়ি করা হচ্ছে। এরকারণ কী? এ বিষয়েও আলিমগণ লিখেছেন। বর্তমান প্রবন্ধে এ বিষয়েও কিছু আলোকপাত করা মুনাসিব মনেহচ্ছে।

বাড়াবাড়ির কারণ অনেক। আমি এখানে কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করব ইনশাআল্লাহ।

. একমুখী অধ্যয়ন অসম্পূর্ণ অধ্যয়ন

ইখতিলাফী বিষয়ে যিনি মত প্রকাশ করতে চান, নিজের পথ ও পন্থার দিকে আহবান করতেই চান এবংঅন্যের পথ ও পন্থার উপর আপত্তি করতেই চান, তার প্রথম কর্তব্য, বিষয়টি গভীরভাবে অধ্যয়ন করা । এবিষয়ে পক্ষে বিপক্ষে যা কিছু লেখা হয়েছে তা গভীর মনযোগ ও পূর্ণ ন্যায়নিষ্ঠার সাথে অধ্যয়ন করা। কিন্তুদেখা যায়, এ ক্ষেত্রে আমরা চরম উদাসীন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের অধ্যয়ন একমুখী। সেও অসম্পূর্ণ ওপরনির্ভর অধ্যয়ন। অথচ এ অধ্যয়নের ভিত্তিতে আমরা মত প্রকাশ করি সম্পূর্ণ মুহাক্কিক; বরং মুজতাহিদসুলভভঙ্গিতে!

 

কিছু উদাহরণ

১. অতি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে দেওয়া হয় যে, ‘বিতরের নামায তিন রাকাত পড়া ভিত্তিহীন। কিংবা তা কেবলজয়ীফ হাদীসে আছে!’

অথচ একাধিক সহীহ হাদীস, অনেকগুলো আছারে সাহাবা এবং মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের কর্মগতইজমার দ্বারা তিন রাকাত বিতরের পদ্ধতি প্রমাণিত।

আরো বলা হয় যে, ‘তিন রাকাত যদি পড়তে হয় তাহলে দ্বিতীয় রাকাতে বসবে না। তিন রাকাত এক জলসায়পড়বে!’

যারা এ ধরনের কথা বলেন তারা যদি বিতরের প্রসঙ্গটি ‘শরহু মাআনিল আছার’ ও ‘শরহু মুশকিলিল আছার’থেকেও অধ্যয়ন করতেন এবং নসবুর রায়ার হাশিয়া ‘বুগয়াতুল আলমায়ী’ ও ‘কাশফুস সিত্র আনমাসআলাতিল বিত্র’ (মাওলানা মুহাম্মাদ আনওয়ার শাহ কাশ্মিরি) পাঠ করতেন, অন্তত মাওলানা ইউসুফলুধিয়ানবী রাহ.-এর কিতাব ‘‘ইখতিলাফে উম্মত আওর সিরাতে মুসতাকীম’’ থেকেই পাঠ করতেন তাহলেওতাদের এ ধরনের কথা বলতে দ্বিধা হত।

যেখানে সহীহ মুসলিমসহ অনেক হাদীসের কিতাবে সহীহ হাদীসে এই সাধারণ মূলনীতি বলা হয়েছে যে, ‘নামাযের প্রতি দুই রাকাতে আত্তাহিয়্যাতুর বৈঠক আছে’ সেখানে দলীল ছাড়া এই ফতোয়া দেওয়ার দুঃসাহসকীভাবে হয়, উপরন্তু হাদীস অনুসরণের নামে?!

‘বিতরের নামাযকে মাগরিবের মত বানিও না’-এই হাদীসের পূর্বাপর না দেখেই কেউ ব্যাখ্যা করেছে, ‘বিতরের নামাযে প্রথম বৈঠক করবে না, করলে সালাম ফেরাও।’ এরপর এ ব্যাখ্যারই তাকলীদ করা হচ্ছে।অথচ এ হাদীসের ব্যাখ্যাও হাদীসের মধ্যেই আছে। তা হচ্ছে বিতরের আগে দু’ চার রাকাত নফল নামাযঅবশ্যই পড়বে। মাগরিবের মত শুধু তিন রাকাত পড়বে না। দেখুন : শরহু মাআনিল আছার ও হাশিয়া নাসবুররায়া।

দুই জলসা ও এক সালামে তিন রাকাত বিতর সম্পর্কে হাদীস ও আছারের দলিল জানার জন্য মাসিকআলকাউসারের জুমাদাল উলা ’৩১ হি. (মে ’১০ ঈ.) সংখ্যা থেকে যিলকদ-যিলহজ্ব ’৩১ হি. (নভেম্বর ’১০ঈ.) পর্যন্ত সংখ্যাগুলো দেখা যায়।

২. বলা হয়ে থাকে, ‘কুনূতের বিভিন্ন দুআ আছে তবে اللهم إنا نستعينك الخ দুআটি নেই।’

অথচ তা মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক (খন্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ১০৫-১২০); মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা (খন্ড : ৪,পৃষ্ঠা : ৫১৮, খন্ড : ১৫, পৃষ্ঠা :  ৩৪০-৩৪৪); কিয়ামুল লায়ল, মুহাম্মাদ ইবনে নাসর আলমারওয়াযী (পৃষ্ঠা :২৯৬-৩০২) এবং আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকীসহ (খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ২১০) একাধিক হাদীসের কিতাবেআছে। আদ্দুররুল মানসুরের পরিশিষ্টেও কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া আছে।

৩. বলা হয়ে থাকে, ‘দুআ কুনূতের আগে তাকবীরের দলীল হাদীসের কিতাবে নেই।’

অথচ ‘শরহু মুশকিলিল আছার’ তাহাবীতে (খন্ড : ১১, পৃষ্ঠা : ৩৬৫-৩৭৮) দুইজন বড় সাহাবীর আমল বর্ণিতহয়েছে।

৪. বলা হয়ে থাকে, ‘মেয়েদের নামাযের পদ্ধতিও পুরুষের মতোই। উভয়ের নামাযের পদ্ধতি আলাদা হওয়ারকথা ভিত্তিহীন। এটা শুধু হানাফিদের মাযহাব।’

অথচ বাস্তবতা এই যে, নারী-পুরুষের নামায আদায়ের পদ্ধতি অভিন্ন হওয়ার বিষয়ে আমাদের জানামতেকোনো দ্ব্যর্থহীন সহীহ হাদীস বা আছার নেই। অথচ কিছু সাহাবী ও অনেক তাবেঈ থেকে বিভিন্ন বিষয়েউভয়ের নামাযের পদ্ধতি আলাদা হওয়া প্রমাণিত। একটি মারফূ মুরসাল হাদীসও আছে, যাকে একাধিকআহলে হাদীস আলিম শাওয়াহিদ ও সমর্থক বর্ণনার কারণে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। এ প্রসঙ্গে নবাব সিদ্দিকহাসান খানের ‘‘আউনুল বারী’’ও দেখা যেতে পারে (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৫২০, দারুর রশীদ হলব, সুরিয়া; খন্ড :২, পৃষ্ঠা : ১৮৪-১৮৫, দারুন নাওয়াদির, বৈরুত, হাদীস : ২৫২)

এরপর তা শুধু হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত নয়, চার মাযহাবের ফকীহগণ এ বিষয়ে একমত। আহলে হাদীসআলেমদেরও অনেকে এই ফতোয়া দিয়েছেন। কেউ কেউ এ বিষয়ে আলাদা পুস্তিকাও  লিখেছেন।

যেমন দেখুন, মাওলানা আবদুল হক হাশেমী মুহাজিরে মক্কী-এর পুস্তিকা-

نصب العمود في تحقيق مسألة تجافي المرأة في الركوع والسجود والقعود

এ বিষয়ে মাসিক আলকাউসারের রবিউস সানী ’২৬ হিজরী (জুন ’০৫ ঈ.) সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিতহয়েছে। প্রবন্ধটি নবীজীর নামায (মাকতাবাতুল আশরাফ বাংলাবাজার ঢাকা থেকে প্রকাশিত)-এর পরিশিষ্টেওযুক্ত হয়েছে।

আমি শুধু ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর বক্তব্য উল্লেখ করছি। তিনি বলেছেন-

وقد أدب الله تعالى النساء بالاستتار وأدبهن بذلك رسوله صلى الله عليه وسلم، وأحب للمرأة أن تضم بعضا إلى بعض، وتلصق بطنها بفخذيها وتسجد كأسترما يكون لها، وهكذا أحب لها في الركوع والجلوس وجميع الصلاة أن تكون فيها كأستر ما يكون لها.

আল্লাহ তাআলা মহিলাদেরকে পুরোপুরি আবৃত থাকার শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর রাসূলও (সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম) অনুরূপ শিক্ষা দিয়েছেন। তাই আমার নিকট পছন্দনীয় হল, সিজদা অবস্থায় মহিলারা এক অঙ্গেরসাথে অপর অঙ্গকে মিলিয়ে রাখবে, পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখবে এবং সিজদা এমনভাবে করবে যাতেসতরের পূর্ণ হেফাযত হয়। অনুরূপ রুকু, বৈঠক ও গোটা নামাযে এমনভাবে থাকবে যাতে সতরের পুরাপুরিহেফাযত হয়।-কিতাবুল উম্ম, শাফেয়ী ১/১৩৮

ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর বক্তব্যটি যেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর বাণীরই ব্যাখ্যা। নারীরনামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন- تجتمع وتحتفز খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়েনামায আদায় করবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৭৯৪

৫. বলা হয়ে থাকে, ‘বুকের উপর হাত বাঁধার কথাই সহীহ হাদীসে আছে আর তা বুখারীর হাদীস দ্বারাওপ্রমাণিত।’

অথচ সহীহ বুখারীর কোনো হাদীস দ্বারা তা প্রমাণ হয় না। ইবনে খুযায়মার যে হাদীসে বুকের উপর হাতবাঁধার কথা আছে তাতে মুআম্মাল ইবনে ইসমাইল নামক একজন রাবী আছেন, যাকে স্বয়ং ইমাম বুখারী রহ. ‘মুনকারুল হাদীস’ বলেছেন।

পাঠকবৃন্দকে মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহর দুটি প্রবন্ধ পাঠ করার আবেদন করব, যা তিনি এ বিষয়েইলিখেছেন। দুটো প্রবন্ধই মাসিক আলকাউসার যিলহজ্ব ’৩২ হি. (নভেম্বর ’১১ হি.) ও মুহাররম ’৩৩ হি. (ডিসেম্বর ’১১ ঈ.) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

৬. বলা হয়ে থাকে, ‘জোরে আমীন বলার হাদীস সহীহ বুখারীতে আছে।’

অথচ সহীহ বুখারীতে ইমাম বুখারী শিরোনাম দিয়েছেন জাহর বা জোরে আমীনের, কিন্তু তাতে এমন একটিহাদীসও নেই, যাতে জাহরের কথা আছে।

ওখানে যে হাদীসগুলো আছে তাতে আমীন বলার ফযীলত উল্লেখিত হয়েছে এবং এ কথা আছে যে, ইমাম-মুকতাদী উভয়েরই আমীন বলা উচিত। কিন্তু জোরে বলার কথা নেই।

৭. বলা হয়ে থাকে, ‘ইমামের পেছনে মুক্তাদির ফাতিহা পড়া ফরয-এই হাদীস সহীহ বুখারীতে আছে।’

অথচ সহীহ বুখারীতে ইমাম বুখারী এ ধরনের শিরোনাম যদিওবা লিখেছেন, কিন্তু তাতে এমন কোনো হাদীসনেই, যাতে মুক্তাদিকে ফাতিহা পড়ার আদেশ করা হয়েছে।

হাঁ, لا صلاة إلا بفاتحة الكتاب (ফাতিহা ছাড়া কোনো নামায নেই) হাদীসটি আছে, কিন্তু এতে তো মুক্তাদির কথানেই। এই হাদীসের ব্যাপকতায় মুক্তাদি শামিল কি না-তা একটি ইজতিহাদী বিষয়। ইমাম বুখারী ও কোনোকোনো ইমামের ইজতিহাদ অনুসারে মুক্তাদিও শামিল। আবার অন্য অনেক ইমামের মতে অনেক দলিলেরভিত্তিতে মুক্তাদির বিধান আলাদা।

৮. বলা হয়ে থাকে যে, ‘তারাবী আট রাকাত হওয়ার দলীল সহীহ বুখারীতে আছে।’

অথচ সহীহ বুখারীতে আছে ‘সালাতুল লায়ল’ সংক্রান্ত হাদীস। এর ব্যাখ্যা তারাবীর দ্বারা করা ঐসকল বন্ধুরনিজস্ব ইজতিহাদ। তাদের যুক্তি, তারাবী ও তাহাজ্জুদ একই নামাযের দুই নাম। এগারো মাসের তাহাজ্জুদরমযান মাসে তারাবী হয়ে যায়। এই দাবির পক্ষে তাদের কাছে কোনো আয়াত, হাদীস বা আছারে সাহাবানেই। এটা তাদের একান্ত  নিজস্ব ইজতিহাদ, যা ইমাম বুখারীর ইজতিহাদ থেকেও আলাদা।

ইমাম বুখারী রাহ. প্রথম রাতে তারাবী পড়তেন এবং শেষ রাতে তাহাজ্জুদ। তারাবীর প্রতি রাকাতে বিশআয়াত পড়তেন এবং পুরা কুরআন খতম করতেন। এবার হিসাব করে দেখুন তারাবী যদি আট রাকাত করেপড়া হয় তাহলে প্রতি রাকাতে বিশ আয়াত করে পড়ে পুরা রমযানে, তা ত্রিশ দিনের হলেও, খতম করা সম্ভবকি না।

৯. যে বিনা ওজরে সময়মত ফরয নামায পড়েনি তার উপর কাযা জরুরি হওয়া স্বীকৃত ও সর্বজনবিদিত। এবিষয়ে জুমহুর উম্মতের ইজমাও রয়েছে। কিন্তু অনেক বন্ধুকে অতি জোড়ালোভাবে বলতে দেখা যায়, ‘ঐব্যক্তির কাযা আদায়ের বিধান নেই।’

আমি মনে করি, এটা হাদীস অনুসরণের নামে শায ও বিচ্ছিন্ন মত এবং দলিলবিহীন; বরং দলিলবিরোধীমতামত প্রচার করা ছাড়া আর কিছুই নয়।

তাদের খেদমতে আরজ, তারা যেন এই মাসআলাটি অন্তত ইমাম ইবনে আব্দিল বার (৪৬৩ হি.)-এরআলইসতিযকার কিতাবে (খন্ড ১, পৃষ্ঠা : ৩০০-৩০১, باب النوم عن الصلاة) পাঠ করেন। আর আদবের সাথেআরজ করব যে, এ বিষয়ে কি শুধু এ হাদীসটি যথেষ্ট নয়-

اقضوا الله، فالله أحق بالوفاء

আল্লাহকে (তাঁর পাওনা) পরিশোধ কর। কারণ আল্লাহই সর্বাধিক হকদার (তাঁর) পাওনা পরিশোধের।

এবং فدين الله أحق أن يقضى

তাহলে আল্লাহর ঋণ তো পরিশোধের অধিক হকদার।

মাসিক আলকাউসারের উদ্বোধনী সংখ্যায় (মুহাররম ১৪২৬ হি., ফেব্রুয়ারি ’০৫ ঈ.) এ বিষয়ে মাশাআল্লাহএকটি সারগর্ভ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

১০. কেউ তো চরম দুঃসাহস প্রদর্শন করে বলেছেন, ‘বিনা অযুতে কুরআন স্পর্শ করা সম্পূর্ণ জায়েয।’ তাদেরদাবি, এটা নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস নেই। অথচ

لا يمس القرآن إلا على طهر

(পবিত্র হওয়া ছাড়া কুরআন স্পর্শ করবে না)-এই হাদীস শুধু সহীহই নয়, অর্থের দিক থেকে মুতাওয়াতির।আর এ বিষয়ে জুমহুর উম্মতের ইজমা আছে। ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ. এ বিষয়েও সংক্ষেপে অতিসারগর্ভ আলোচনা করেছেন। আলইসতিযকারে (খন্ড ৮, পৃষ্ঠা : ৯-১৩, باب الأمر بالوضوء لمن مس القرآن)তাঁর আলোচনাটি দেখে নেওয়া যায়।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমর ইবনে হাযম রা.কে যে পত্র দিয়েছিলেন তাতে অন্যঅনেক বিধানের সাথে এই বিধানও ছিল যে, অযুহীন কেউ কুরআন স্পর্শ করবে না। পত্রের এ অংশ মুয়াত্তামালিকেও রয়েছে। ইবনে আবদিল বার রাহ. এই পত্রখানা সম্পর্কে লেখেন-

وكتاب عمرو بن حزم هذا قد تلقاه العلماء بالقبول والعمل، وهو عندهم أشهر وأظهر من الإسناد الواحد المتصل، وأجمع فقهاء الأمصار الذين تدور عليهم الفتوى وعلى أصحابهم بأن المصحف لا يمسه إلا الطاهر.

অর্থাৎ আলিমগণ আমর ইবনে হাযমের এই পত্র সাদরে বরণ করেছেন এবং এ অনুযায়ী আমল করেছেন। এটিতাঁদের কাছে একটি মুত্তাসিল সনদের চেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ও প্রকাশিত। ইসলামী জনপদসমূহের ফতোয়ার স্তম্ভযেসব ফকীহ (মুজতাহিদ) ও তাঁদের শীষ্যগণ তাঁরা একমত যে, পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কেউ কুরআনকে স্পর্শকরবে না।-আলইসতিযকার ৮/১০

মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহ এ বিষয়েও মাশাআল্লাহ অতি উত্তম ও প্রামাণিক প্রবন্ধ লিখেছে, যাআলকাউসারের সফর ’২৭ হি. (মার্চ ২০০৬ ঈ.) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকবৃন্দের কাছে অনুরোধ,তাঁরা যেন এই প্রবন্ধগুলো অবশ্যই পাঠ করেন।

১১. কেউ কেউ রুকুর সময় এবং রুকু থেকে ওঠার সময় রাফয়ে ইয়াদাইনের সুন্নতের উপর এত জোরদিয়েছেন যে, এই সুন্নতের সমর্থনে রাফয়ে ইয়াদাইন না করার (এইসব জায়গায় হাত না তোলার) সুন্নতবাতিল করাকে জরুরি মনে করেছেন। তারা নির্দ্বিধায় বলে দিয়েছেন যে, রাফয়ে ইয়াদাইন না করার বিষয়েকোনো সহীহ হাদীস নেই; কোনো সাহাবী থেকেও এর কোনো প্রমাণ নেই। অথচ খলীফায়ে রাশেদ ওমরইবনুল খাত্তাব রা., খলীফায়ে রাশেদ আলী ইবনে আবী তালিব রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.সহকয়েকজন সাহাবী থেকে হাত না তোলার সুন্নত প্রমাণিত। অনেক তাবেয়ীর আমলও এটি ছিল।

জনৈক ব্যক্তি ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.-এর সামনে ওয়াইল ইবনে হুজর রা.-এর হাদীস পেশ করেছিল যে, তিনিআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাফয়ে ইয়াদাইন করতে দেখেছেন। তখন ইবরাহীম নাখায়ীরাহ. বলেছিলেন, যদি ওয়াইল রা. (যিনি ছিলেন একজন আগন্তুক সাহাবী) একবার রাফয়ে ইয়াদাইন করতেদেখেন তাহলে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. (যিনি ছিলেন সফরে-হযরে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম-এর খাদিম এবং ফকীহ সাহাবী) পঞ্চাশ বার রফয়ে ইয়াদাইন না করতে দেখেছেন।

(দেখুন : আলমুয়াত্তা, মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, পৃষ্ঠা : ৯২; কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনা ইমামমুহাম্মাদ ১/৭৫; শরহু মাআনিল আছার তহাবী ১/১৬১; নসবুর রায়াহ লি আহাদীসিল হিদায়া, জামালুদ্দীনযায়লায়ী ১/৩৯৭)

খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত এবং আছারে সাহাবা শরীয়তের উল্লেখযোগ্য দলিল, বিশেষত নামাযের পদ্ধতিরক্ষেত্রে। উপরন্তু এ বিষয়ে সহীহ বা হাসান সনদে একাধিক মারফূ হাদীস রয়েছে।

মুসনাদে আহমদ ও জামে তিরমিযীতে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর সূত্রে যে মারফূ হাদীসটি আছে তাকেখোদ ইমাম তিরমিযী রাহ. ‘হাসান’ বলেছেন। ইবনে হাযম জাহেরী রাহ. ‘সহীহ’ বলেছেন। নিকট অতীতেরমশহূর মুহাদ্দিস আহমদ শাকির রাহ. জামে তিরমিযীর হাশিয়ায় লিখেছেন-

هذا الحديث صححه ابن حزم وغيره من الحفاظ وهو حديث صحيح، وما قالوا في تعليله ليس بلعة.

ইবনে হাযম এবং আরো কোনো কোনো হাফিযুল হাদীস এই হাদীসকে ‘সহীহ’ বলেছেন। আর একে ‘মা’লূল’সাব্যস্ত করার জন্য আপত্তিকারীরা যা কিছু বলেছেন বাস্তবে সেগুলো ইল্লত নয়।-জামে তিরমিযী ২/৪১

১২. ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার নামাযে তাকবীর বিষয়ে এক মাসনূন তরীকা এই যে, অতিরিক্ত তাকবীরবারোটি । দ্বিতীয় মাসনূন তরীকা (যা আমাদের মতে অধিক শক্তিশালী), অতিরিক্ত তাকবীর ছয়টি। প্রথমরাকাতে তাকবীরে তাহরীমার পর তিন তাকবীর, অর্থাৎ তাকবীরে তাহরীমাসহ চার তাকবীর। আর দ্বিতীয়রাকাতে কিরাআতের পর তিন তাকবীর, এরপর রুকুর তাকবীর, অর্থাৎ রুকুর তাকবীরসহ চার তাকবীর।

কোনো কোনো বন্ধুকে বলতে শোনা যায়, হাদীসে শুধু বারো তাকবীরের আমল পাওয়া যায়। দ্বিতীয় তরীকাকোনো সহীহ হাদীসে পাওয়া যায় না। কেউ কেউ তো এমনও লিখেছেন যে, ঐ বিষয়ে কোনো হাদীসই নেই।

বুঝতে পারছি না, এ জাতীয় অবাস্তব দাবি সম্পর্কে কী বলা যায়। পাঠকবৃন্দকে শুধু এই অনুরোধ করব, তাঁরাযেন দ্বিতীয় মাসনূন তরীকার দলিল, হাদীস ও আছার জানার জন্য মাসিক আলকাউসার রমযান-শাওয়াল ’২৬হি. সংখ্যায় (২০০৫-এর ভলিউমে) প্রকাশিত ঈদের নামাযের অতিরিক্ত তাকবীর বিষয়ক প্রবন্ধটিমনোযোগের সাথে পাঠ করেন। প্রবন্ধটি মাকতাবাতুল আশরাফ, বাংলাবাজার, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘নবীজীরনামাযে’র পরিশিষ্টেও যুক্ত আছে।

এ ধরনের অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। নমুনা হিসাবে এগুলোই যথেষ্ট। এখানে দেখানো উদ্দেশ্য যে, অনেকবন্ধু এ সকল বিষয় এমনভাবে পেশ করে থাকেন যে, ফিকহে হানাফীর অনুসারীদের কাছে এসব বিষয়েকোনো দলীল নেই। পক্ষান্তরে  তাদের কাছে আছে প্রচুর সহীহ হাদীস!

তাছাড়া উপরে উল্লেখিত ৯, ১০ ও ৪ নম্বর মাসআলাটি তো শুধু ফিকহে হানাফীর নয়, জুমহূরে উম্মতেরইজমায়ী মাসআলা। অন্যান্য মাসআলাতেও হানাফী ফকীহগণের সাথে অন্য অনেক ফকীহ একমত। আরপ্রত্যেক মাসআলায় ফকীহ সাহাবী ও তাবেয়ীগণের হাওয়ালা তো এখনই উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণেইআমি নিবেদন করে থাকি যে, আমার এই বন্ধুরা যদি তাদের অধ্যয়নের পরিধি বিস্তৃত ও গভীর করতেনতাহলে এই বাড়াবাড়ি তাদের মধ্যে থাকত না।

অন্তত এটুকু চিন্তা তো অবশ্যই হতো যে, ওদের কাছেও দলীল আছে; আর আমাদের দলীলগুলোর প্রধান্য ওঅগ্রগণ্যতাও এত সুস্পষ্ট নয় যে, একদম মুতাওয়াতির ও অকাট্য বিষয়ের মত এতে ভিন্নমতের কোনোঅবকাশই নেই।

. আংশিক অস্বচ্ছ ধারণার উপর পূর্ণ প্রত্যয়

অনেক সময় এমন হয় যে, কোনো কোনো বন্ধুর উসূলে হাদীস ও উসূলে ফিকহের কিছু নীতি ও ধারা সম্পর্কেখুব অগভীর ধরনের জানাশোনা থাকে। নীতিটির স্বরূপ ও তাৎপর্য এবং ভাষ্য ও বিস্তারিত অনুষঙ্গের জ্ঞানথাকে না। উসূলের উপর মুতাকাদ্দিমীনের কিতাবসমূহ গভীর মনোযোগের সাথে পাঠ করার বিষয়ে সচেতনতাথাকে না। শুধু অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ ধারণার উপর ভিত্তি করে বিপরীত পথ ও পন্থা সম্পর্কে কটুক্তি ওসমালোচনার বিরাট সৌধ নির্মাণ করে ফেলা হয়। এরপর ইলমী আলোচনাতেও তাদের মুখে আম লোকেরভাষা ও যুক্তি প্রকাশিত হতে থাকে। যেমন তাদের এ সকল কথা :

. সহীহ বুখারী বা সহীহ মুসলিমে নেই

অনেকের মনে দৃঢ় প্রত্যয় আছে যে, ‘যেসকল হাদীস সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিমে নেই তা হয়তো সহীহনয় কিংবা সহীহ হলেও এই দুই কিতাবের সহীহ হাদীসের সমপর্যায়ের নয়।’ এ কারণে কোনো বিষয়ে হাদীসপেশ করা হলে  বলে, বুখারীতে দেখান, মুসলিমে দেখান। কিংবা বলে, বুখারী-মুসলিমে এর বিপরীত যেহাদীস আছে তা অধিক সহীহ। সুতরাং ঐ হাদীসের উপর আমল করা উচিত এবং এটা বাদ দেওয়া উচিত!

যাদের উসুলুল ফিকহ ও উসুলুল হাদীসের পোখতা ইলম আছে তারা বোঝেন এটা কেমন স্থূল কথা। কারণ :

. ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম দু’জনই পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন যে, তাঁরা তাঁদের ‘কিতাবুস সহীহ’তে যেহাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন তা সব সহীহ। তবে সকল সহীহ হাদীস তাঁরা তাঁদের কিতাবে বর্ণনা করেননি এবংবর্ণনার ইচ্ছাও করেননি। এ কথাটি উভয় ইমাম থেকে সহীহ সনদে প্রমাণিত।

ইমাম বুখারী রহ. বলেছেন-

ما أدخلت في كتابي “الجامع” إلا ماصح، وتركت من الصحاح لحال الطول.

অর্থাৎ আমি আমার কিতাবুল জামি’তে শুধু সহীহ হাদীস এনেছি। তবে গ্রন্থের কলেবর বড় হয়ে যাবে এইআশঙ্কায় (অনেক) সহীহ হাদীস ত্যাগ করেছি।-আলকামিল, ইবনে আদী ১/ ২২৬; তারীখে বাগদাদ ২/৮-৯

‘‘শুরূতুল আইম্মাতিল খামছা’’য় (পৃ. ১৬০- ১৬৩) ইমাম ইসমাঈলীর সূত্রে ইমাম বুখারীর বক্তব্যের আরবীপাঠ এই-

لم أخرج في هذا الكتاب إلا صحيحا، وما تركت من الصحيح أكثر.

আমি এই কিতাবে শুধু সহীহ হাদীস এনেছি। আর যে সহীহ হাদীস আনিনি তার সংখ্যা বেশি।

খতীব বাগদাদী রাহ. ‘‘তারীখে বাগদাদে’’ (১২/২৭৩ তরজমা : আহমদ ইবনে ঈসা আততুসতরী) এবংহাযেমী ‘‘শুরূতুল আইম্মাতিল খামসা’’য় (পৃ. ১৮৫) বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম আবু যুরআ রাযী রহ. (যিনিইমাম মুসলিম রহ. এর উস্তাদ) একবার সহীহ মুসলিম সম্পর্কে বললেন, এর দ্বারা তো আহলে বিদআর জন্যপথ খুলে দেওয়া হল। তাদের সামনে যখন কোনো হাদীস দ্বারা দলীল দেওয়া হবে তখন তারা বলবে, এ তোকিতাবুস সহীহতে নেই!

তেমনি ইমাম ইবনে ওয়ারা রাহ.ও সরাসরি ইমাম মুসলিম রাহ.কে সম্বোধন করে এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন।তখন ইমাম মুসলিম রাহ. বলেছেন, আমি এই কিতাব সংকলন করেছি এবং বলেছি, এই হাদীসগুলো সহীহ।আমি তো বলিনি যে, এ কিতাবে যে হাদীস নেই তা জয়ীফ! ….

তখন ইবনে ওয়ারা তার ওজর গ্রহণ করেন এবং তাঁকে হাদীস শুনান।

এই ঘটনা থেকে যেমন বোঝা যায়, ইমাম মুসলিম রাহ. সকল সহীহ হাদীস সংকলনের ইচ্ছাও করেননিতেমনি এ কথাও বোঝা যায় যে, কোনো সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীস পেশ করা হলে ‘এ তো সহীহ মুসলিমেনেই’ বলে তা ত্যাগ করা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর তরিকা হতে পারে না। একই কথা সহীহ বুখারীরক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

২. ইমাম আবু বকর ইসমায়িলী রহ. (৩৭১ হি.) ‘আল মাদখাল ইলাল মুসতাখরাজ আলা সহীহিল বুখারী’তেহাম্মাদ ইবনে সালামা থেকে ইমাম বুখারীর রেওয়ায়েত না করার প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘বুখারী তো তাঁর মানদন্ডেউত্তীর্ণ অনেক সহীহ হাদীসও বর্ণনা করেননি। তবে তা এ জন্য নয় যে, তাঁর দৃষ্টিতে হাদীসগুলো জয়ীফ কিংবাসেগুলোকে তিনি বাতিল করতে চান। তো হাম্মাদ থেকে রেওয়ায়েত না করার বিষয়টিও এরকমই।’-আননুকাত আলা মুকাদ্দিমাতি ইবনিস সালাহ, বদরুদ্দীন যারকাশী ৩/৩৫৩

৩. ইমাম আবু নুয়াইম আসপাহানী রাহ. (৪৩০ হি.) ‘আলমুসতাখরাজ আলা সহীহি মুসলিম’’-এ একটিহাদীসের মান সম্পর্কে  আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-

“فإنهما رحمهما الله قد تركا كثيرا مما هو بشرطهما أولى و إلى طريقتهما أقرب”

অর্থাৎ বুখারী মুসলিম এমন অনেক হাদীস ত্যাগ করেছেন, যেগুলো তাদের সংকলিত হাদীস থেকেও তাঁদেরনীতি ও মানদন্ডের অধিক নিকটবর্তী।-আলমুসতাখরাজ ১/৩৬

৪. এটি একটি সহজ ও বাস্তব কথা যে, বুখারী-মুসলিমে বর্ণিত হাদীসসমূহের সমপর্যায়ের হাদীস এবং ঐ দুইকিতাবের মানদন্ডে উত্তীর্ণ সহীহ হাদীসের সংখ্যা অনেক। শুধু মুসতাদরাকে হাকিমেই এ পর্যায়ের হাদীস,হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ী হাজারের কাছাকাছি।-আননুকাত আলা কিতাবিইবনিস সালাহ

মুসনাদে আহমদ এখন ৫২ খন্ডে বিস্তারিত তাখরীজসহ প্রকাশিত হয়েছে। টীকায় শায়েখ শুআইব আরনাউতও তার সহযোগীরা সনদের মান সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। আমাদের প্রতিষ্ঠানের উচ্চতর হাদীসবিভাগের একজন তালিবে ইলম শুধু প্রথম চৌদ্দ খন্ডের রেওয়ায়েতের হিসাব করেছেন। দেখা গেছে, সহীহবুখারী, সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ-এই ছয় কিতাবে নেই এমন হাদীসগুলোরমধ্যে : বুখারী ও মুসলিম উভয়ের শর্ত অনুযায়ী ৪০১টি, শুধু বুখারীর শর্ত অনুযায়ী ৬৪টি, শুধু মুসলিমের শর্তঅনুযায়ী ২১৫টি হাদীস রয়েছে।

এছাড়া সহীহ লিযাতিহী বা সহীহ লিগায়রিহী হাদীসের সংখ্যা ১০০৮টি ও হাসান লিযাতিহী বা হাসানলিগায়রিহী হাদীস ৬১৫টি। এসব সংখ্যা স্বতন্ত্র-অতিরিক্ত হাদীসসমূহের, অর্থাৎ যেগুলোর কোনো মুতাবি বাশাহেদ তাখরীজের বিবরণ অনুযায়ী ছয় কিতাবে নেই।

ইমাম তহাবী রহ. এর ‘শরহু মুশকিলিল আছার’ও তাখরীজসহ ১৬ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে নমুনাহিসাবে শুধু দুই খন্ডের হাদীস ও আছার দেখা হয়েছে তো বুখারী-মুসলিম উভয়ের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হাদীসপাওয়া গেছে ২২২টি, বুখারী-মুসলিম কোনো একজনের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হাদীসসংখ্যা ১৪৬টি। এর মধ্যে ৪৬টি এমন যে, তাখরীজের বিবরণ অনুযায়ী বুখারী-মুসলিমে তার কোনো মুতাবি-শাহিদ (সমর্থক বর্ণনাও) নেই।এ ছাড়া এই দুই খন্ডে সহীহ লিযাতিহী হাদীস ২৬৪ টি, সহীহ লিগায়রিহী ১২১টি, হাসান লিযাতিহী ৯৪টি ওহাসান লিগায়রিহী
রয়েছে ১৩টি।

শায়েখ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. ‘সিফাতুস সালাহ’র (নবীজীর নামাযের পদ্ধতি) উপর যে কিতাব লিখেছেনতাতে ছয় কিতাবের বাইরে ৮৬ টি হাদীস রয়েছে এবং সহীহ বুখারী-সহীহ মুসলিমের বাইরে সুনানেরকিতাবের হাদীস রয়েছে ১৫৬ টি।

৫. স্বয়ং ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম রহ. তাদের অন্যান্য কিতাবে এমন অনেক হাদীসকে সহীহ বলেছেনবা দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যেগুলো তাঁদের এই দুই কিতাবে নেই। কারো সন্দেহ হলে ‘জুযউলকিরাআতি খালফাল ইমাম’ এবং ‘জুযউ রাফইল ইয়াদাইন’ ইত্যাদি খুলে দেখতে পারেন। জামে তিরমিযীখুললেও দেখতে পাবেন, ইমাম তিরমিযী রাহ. ইমাম বুখারীর উদ্ধৃতিতে এমন অনেক হাদীসকে সহীহবলেছেন, যা সহীহ বুখারীতে নেই।

তো এই সকল নিশ্চিত ও চাক্ষুষ প্রমাণ থাকার পরও কোনো নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রহণ করতে শুধু এ কারণেদ্বিধাগ্রস্ত হওয়া যে, তা বুখারী, মুসলিমে নেই, অতি সত্হী ও অগভীর চিন্তা নয় কি?

৬. সপ্তম শতাব্দীতে তৈরিকৃত ‘তাকসীমে সাবয়ী’*-এর কারণে যদি কারো সন্দেহ হয় তাহলে  তাদের জেনেরাখা উচিত, ঐ ‘তাকসীম’কারীগণই লিখেছেন-

أما لو رجح قسم على ما فوقه بأمور أخرى تقتضي الترجيح، فإنه يقدم على ما فوقه، إذ قد يعرض للمفوق ما يجعله فائقا

অর্থাৎ অগ্রগণ্যতার অন্যান্য কারণে কোনো প্রকার যদি তার উপরস্থ প্রকারের চেয়ে অগ্রগামী হয় তাহলে তাকেতার উপরের প্রকারের চেয়ে অগ্রগণ্য করা হবে। কারণ এই বিন্যাসে উল্লেখিত নীচের প্রকারের বর্ণনার সাথেকখনো কখনো এমন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়, যা তাকে উপরের পর্যায়ের বর্ণনার সমকক্ষ বা অগ্রগণ্য করে।

এ কথাটি হাফেয ইবনে হাজার রাহ. (৭৫২ হি.) শরহু নুখবাতুল ফিকারে (পৃ. ৩২ ) পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন।তাঁর শাগরিদ মুহাদ্দিস শামসুদ্দীন সাখাভী রাহ.ও (৯০২ হি.) ‘‘ফাতহুল মুগীছে’’ তা আরো খুলে খুলে বয়ানকরেছেন। মুহাদ্দিস বদরুদ্দীন যারকাশী রাহ. (৭৯৪ হি.) ‘‘আন নুকাত আলা মুকাদ্দিমাতি ইবনিস সালাহ’’ তে(খন্ড ১, পৃষ্ঠা : ২৫৬-২৫৭) এবং জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ. ‘‘তাদরীবুর রাবী’’তে (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৮৮)পরিষ্কার লিখেছেন যে, সহীহ মুসলিমের তুলনায় সহীহ বুখারী অধিক সহীহ হওয়ার অর্থ সমষ্টিগত বিচারেঅধিক সহীহ হওয়া; এই নয় যে, সহীহ বুখারীর প্রতিটি হাদীস সহীহ মুসলিমের প্রতিটি হাদীসের চেয়ে অধিকসহীহ। যারকাশী রাহ. আরো লিখেছেন, অগ্রগণ্যতার কারণ-বিচারে মুহাদ্দিসগণ কখনো কখনো মুসলিমেরহাদীসকে বুখারীর হাদীসের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।

সুতরাং তাঁদের কাছেও ‘তাকসীমে সাবয়ী’ সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য অটল নীতি নয়।

. অধিকতর সহীহ বর্ণনাই কি অগ্রগণ্য?

অনেকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, ‘যে হাদীস সনদের বিচারে বেশি সহীহ তা-ই শ্রেষ্ঠ ও অগ্রগণ্য, বিপরীতহাদীসটি সহীহ হলেও।’

অথচ এটা নিয়ম নয় যে, হাদীসের মাঝে বাহ্যত বিরোধ দেখা দিলে অন্য কোনো বিবেচনা ছাড়াই অধিক সহীহহাদীসটি গ্রহণ করা হবে এবং বিপরীতটি বর্জন করা হবে। বরং স্বীকৃত নিয়ম এই যে, এই বিরোধের ক্ষেত্রেজমা, তারজীহ ও নাসখ তথা সমন্বয় সাধন, অগ্রগণ্য বিচার ও নাসিখ-মানসূখ নির্ণয়ের নিয়ম কার্যকর করতেহবে। তারজীহ বা অগ্রগণ্য বিচারের প্রসঙ্গ যদি আসে তাহলে ‘উজূহুত তারজীহ’ বা অগ্রগণ্যতার কারণসমূহেরভিত্তিতে যে হাদীস রাজিহ বা অগ্রগণ্য হবে সে হাদীসের উপরই আমল হবে। অগ্রগণ্যতার অনেক কারণআছে।** সনদের বিচারে অধিক সহীহ হওয়া একটিমাত্র কারণ। তো অগ্রগণ্যতার অন্য সকল কারণ ত্যাগকরে শুধু এক কারণের ভিত্তিতে সব জায়গায় সমাধান দিয়ে যাওয়া নিয়ম পরিপন্থী।

স্বয়ং ইমাম বুখারী রাহ. কিতাবুস সালাহ-এর দ্বাদশ অধ্যায়ে باب ما يذكر في الفخذ উরূ সতরের অন্তর্ভুক্ত কি না-এ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

সেখানে তিনি বলেছেন-

وحديث أنس أسند وحديث جرهد أحوط، حتى يخرج من اختلافهم

অর্থাৎ আনাস রা.-এর হাদীস, (যার দ্বারা উরূ সতর না হওয়া প্রমাণ হয়) সনদের বিচারে অধিক সহীহ হলেওজারহাদের হাদীস (যাতে উরূ সতর হওয়ার কথা আছে) সতর্কতার বিচারে অগ্রগণ্য। যাতে ইখতিলাফের মধ্যে থাকতে না হয়।

ফাতহুল বারীতে (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৫৭১) আছে, ইমাম বুখারী রাহ. ‘আততারীখুল কাবীরে’ জারহাদেরহাদীসকে ইযতিরাবের কারণে জয়ীফ বলেছেন। তাহলে দেখুন, সহীহর বিপরীতে যয়ীফের উপর আমলকরাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। কারণ এটাই সতর্কতার দাবি। যে মাযহাবে উরূ সতর সেই মাযহাব অনুসারেও যেনগুনাহগার হওয়ার আশঙ্কা না থাকে।

এ কারণে অগ্রগণ্যতার একটিমাত্র কারণকে সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্যের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা এবং সনদেরবিচারে যেটি শ্রেষ্ঠ সেটিকেই চূড়ান্তভাবে শ্রেষ্ঠ মনে করা আর  তা-ও বিনা তাহকীকে, শুধু এ কারণে যে,বিপরীত হাদীসটি বুখারী-মুসলিমে নেই-এই চিন্তা মোটেও সঠিক নয়। সুতরাং অগ্রগণ্যতার অন্যান্য দিক ওবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং বিবেচনায় রাখা জরুরি। যেমনটা আমরা স্বয়ং ইমাম বুখারীর কাছেদেখলাম।

আরো মনে রাখা উচিত, যে সহীহ হাদীস মোতাবেক সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগ থেকে আমল হচ্ছে, যার উপরইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের উস্তাদের উস্তাদরা আমল করেছেন, ফিকহ ও হাদীসের ইমামগণ যার উপরমাসআলার ভিত্তি রেখেছেন তাকে শুধু এই ছুতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে নিয়ে আমলের গন্ডি থেকে বের করে দেওয়াযে, হাদীসটি বুখারী-মুসলিমে কেন আসেনি-এ কি ন্যায় ও যুক্তির কথা হতে পারে? হাদীস-সুন্নাহর কোনোদলিল এমন করতে বলে কি না তা চিন্তা করা কি প্রয়োজন নয়?

. সহীহর মোকাবেলায় হাসান কি গ্রহণযোগ্য নয়?

উপরের উদাহরণ থেকে পরিষ্কার হয়েছে যে, এক বিষয়ে যদি দুইটি মুখতালিফ হাদীস বিদ্যমান থাকে, যারএকটি সহীহ, অন্যটি হাসান, তাহলে সহীহ সর্বাবস্থায় হাসানের চেয়ে অগ্রগণ্য হবে তা অপরিহার্য নয়। কেউকেউ মনে করে, সহীহ-হাসানে তাআরুয (বিরোধ) মনে হলে সর্বাবস্থায় সহীহকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।ইনসাফের কথা এই যে, এখানেও ইখতিলাফুল হাদীসের মূলনীতি প্রয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ দুই হাদীসেরমধ্যে ইখতিলাফ (বাহ্যত বিরোধ) মনে হলে বিরোধ নিষ্পত্তির যে মূলনীতি আছে, অর্থাৎ জমা (সমন্বয়)তারজীহ (অগ্রগণ্যতা বিচার) নাসখ (নাসিখ-মানসূখ নির্ণয়) সে অনুযায়ী নিষ্পত্তি করতে হবে। যদি তারজীহ বাঅগ্রগণ্যতার প্রসঙ্গ আসে তাহলে যে হাদীস অগ্রগণ্য সাব্যস্ত হবে তার উপর আমল করা হবে।

অগ্রগণ্য হাদীস ঐ হাদীসকে বলে, যাতে এক বা একাধিক অগ্রগণ্যতার কারণ বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাংসহীহর বিপরীতে হাসান হাদীসে যদি এক বা একাধিক শক্তিশালী কারণ অগ্রগণ্যতার থাকে তাহলে তাকেইঅগ্রগণ্য করতে হবে।

যারা বলেছেন, ‘আসাহ’ (অধিক সহীহ) সহীহর চেয়ে অগ্রগণ্য, সুতরাং এখানে সমন্বয় চেষ্টার প্রয়োজন নেই,তাদের মতকে হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ‘‘ইনতিকাযুল ইতিরায’’ গ্রন্থে (খন্ড ১, পৃষ্ঠা : ৫৮) খন্ডন করেছেন।

তিনি লেখেন-

وأما دعوى أن الجمع لا يكون إلا في المتعارضين، وأن شرط المتعارضين أن يتساويا في القوة، فهو شرط لا مستند له، بل إذا صح الحديثان وكان ظاهرهما التعارض وأمكن الجمع فهو أولى من الترجيح.

অর্থাৎ এই দাবি করা যে, সমন্বয় শুধু দুই মুতাআরিযের (বাহ্যত বিরোধপূর্ণ) মাঝে হয়ে থাকে আর মুতাআরিযতখনই হয়, যখন দুটোই শক্তির দিক থেকে সমান হয়-এটি দলিলহীন শর্ত। বরং দুই হাদীস সহীহ হলে এদেরমাঝে যদি বাহ্যত বিরোধ পরিলক্ষিত হয় এবং সমন্বয় সাধন সম্ভব হয় তাহলে সেটিই তারজীহের চেয়ে উত্তম।

হাফেয ইবনে হাজার রাহ. এ কথা বলেছেন মুসতাদরাকে হাকিম ও সহীহ বুখারীর দুটো হাদীসের উপরআলোচনা করতে গিয়ে, যে দুই হাদীসের মাঝে বাহ্যত বিরোধ দেখা যাচ্ছিল। কেউ এখানে সহীহ বুখারীরহাদীস ‘আসাহ’ (অধিক সহীহ) হওয়ার যুক্তিতে মুসতাদরাকের হাদীস প্রত্যাখ্যানের প্রস্তাব করেছিলেন। এইপ্রস্তাব ভুল সাব্যস্ত করে ইবনে হাজার উপরের কথা বলেন।

তদ্রূপ তিনি তার কিতাব ‘শরহু নুখবাতিল ফিকারে’র দরসে বলেছেন, সহীহ ও হাসানের মাঝেও তাআরুয(বিরোধ) দাঁড়াতে পারে। সুতরাং মানসূখ (রহিত) রেওয়ায়েত সহীহ পর্যায়ের আর নাসিখ (রহিতকারী)রেওয়ায়েত হাসান পর্যায়ের হওয়া খুবই সম্ভব।-আলইয়াওয়াকীতু ওয়াদ দুরার আলা শরহি নুখবাতিল ফিকার,আবদুর রউফ আলমুনাভী খন্ড ১, পৃষ্ঠা : ৩০৬; হাশিয়া কাসিম ইবনে কুতলুবুগা পৃষ্ঠা : ১০৯; হাশিয়াতুলকামাল ইবনে আবী শারীফ আলা শরহি নুখবাতিল ফিকার পৃষ্ঠা : ৭৩

যদি সহীহর বিপরীতে হাসানের কোনো গুরুত্বই না থাকে তাহলে তা সহীহর জন্য নাসিখ কীভাবে হয়?

. সুন্নাহকে সনদভিত্তিক মৌখিক বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করা

শরীয়তের সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে বড় দলীল হল কুরআন কারীম। এরপর  সুন্নাহর স্থান। কিন্তু সুন্নাহেরব্যাপারে কতিপয় মানুষের এই ধারণা আছে যে, যেসব হাদীস সুস্পষ্টভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লামের কথা বা কাজ হিসেবে সহীহ বর্ণনা-পরম্পরায় এসেছে শুধু তাই সুন্নাহ। এই ধারণা ঠিক নয়।সুন্নাহ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা ও নির্দেশনাবলির নাম। এই শিক্ষা ও নির্দেশনাআমাদের কাছে সাধারণত মৌখিক বর্ণনা সূত্রে পৌঁছে থাকে এবং সাধারণ পরিভাষায় এইসব মৌখিকবর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত রেওয়ায়েতগুলোকেই ‘হাদীস’ বলে। কিন্তু অনেক সময় এমন হয় যে, রাসূলে কারীমসাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ কোনো শিক্ষা বা নির্দেশনা আমাদের কাছে মৌখিক বর্ণনার স্থলেকর্মের ধারাবাহিকতায় পৌঁছায়। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম নবীজী থেকে কর্মের মাধ্যমে তা গ্রহণ করেছেন;তাদের নিকট থেকে তাবেয়ীগণ গ্রহণ করেছেন। এভাবে প্রত্যেক উত্তরসূরি তার পূর্বসূরি থেকে কর্মের মধ্যদিয়ে নবীজীর সেই শিক্ষাকে গ্রহণ করেন। নবী-শিক্ষার এই প্রকারটিকে পরিভাষায় ‘আমলে মুতাওয়ারাস’ বা‘সুন্নতে মুতাওয়ারাসা’ বলে।

নবী-শিক্ষা ও নবী-নির্দেশনার অনেক বিষয় এই পথেই পরবর্তীদের হাতে পৌঁছেছে। এইসব শিক্ষা-নির্দেশনাযদি মৌখিক বর্ণনাসমূহের মধ্যেও তালাশ করা হয় তাহলে অনেক সময় এমন হয় যে, হয়ত এ ব্যাপারেকোনো মৌখিক বর্ণনা পাওয়া যায় না অথবা পাওয়া গেলেও সনদের দিক থেকে তা হয় যয়ীফ। এখানে এসেস্বল্প-জ্ঞান কিংবা স্বল্প-বুঝের লোকেরা বিভ্রান্ত হয়। তারা যখন বিশুদ্ধ মৌখিক বর্ণনাসূত্রে বিষয়টি খুঁজে পায়না তো নবীজীর এই শিক্ষাটিকেই অস্বীকার করে বসে। অথচ মৌখিক সাধারণ বর্ণনা-সূত্রের চেয়ে অনেক বেশিশক্তিশালী সূত্র তাওয়ারুস তথা ব্যাপক ও সম্মিলিত কর্মধারার মাধ্যমে বিষয়টি সংরক্ষিত।

তদ্রূপ নবী-শিক্ষার একটি অংশ হল যা আমাদের কাছে সাহাবায়ে কেরামের শিক্ষা-নির্দেশনার মধ্য দিয়েসংরক্ষিত আছে। সাহাবায়ে কেরামের অনেক নির্দেশনা এমন আছে যার ভিত্তি শরীয়তসম্মত কিয়াস ওইজতিহাদ। এগুলো শরীয়তের দলীল হিসেবে স্বীকৃত। আবার তাদের কিছু নির্দেশনা ও কিছু ফাতওয়া এমনআছে যা তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো কথা বা কাজ থেকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তুঅন্যকে শিখানোর সময় এর উদ্ধৃতি দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। কেননা প্রেক্ষাপট থেকে এ কথা স্পষ্টছিল যে, তাঁরা নবীজীর শিক্ষা ও নির্দেশনার ভিত্তিতেই তা শিক্ষা দিচ্ছেন। এজন্য দ্বীনের ইমামগণের সর্বসম্মতনীতি হল, সাহাবায়ে কেরামের যে ফাতাওয়া বা নির্দেশনার ব্যাপারে এটা সুনির্দিষ্ট যে, এটি নবীজী সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা-নির্দেশনা থেকেই গৃহীত, এতে সাহাবীর ইজতিহাদ বা কিয়াসের কোনোপ্রভাব নেই তা মারফূ হাদীসেরই অন্তর্ভুক্ত। কোনো মাসআলায় এর মাধ্যমে প্রমাণ দেওয়া মারফূ হাদীসেরদ্বারা প্রমাণ দেওয়ার শামিল। পরিভাষায় একে মারফূ হুক্মী বলে। নিঃসন্দেহে এর ভিত্তি কোনো মারফূ হাকীকীবা স্পষ্ট মারফূ। তবে এটা জরুরি নয় যে, হাদীসের কিতাবসমূহে সেই স্পষ্ট মারফূ হাদীসটি সহীহ সনদেবিদ্যমান থাকবে। এখানেও স্বল্প-বুঝের লোকেরা পদস্খলনের শিকার হয় এবং নবীজীর শিক্ষাটিকেই অস্বীকারকরে বলতে থাকে যে, এর কোনো ভিত্তি পাওয়া গেল না, অথচ মারফূ হুকমীর সূত্রে প্রমাণিত হওয়াও দলীলহিসাবে যথেষ্ট।

উদাহরণস্বরূপ ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রাহ.-এর হাওয়ালা উল্লেখ করা যায়। তিনি তাকবীরে তাশরীকেরউপর আলোচনা করে লেখেন, তাকবীরে তাশরীক মশরূ হওয়ার বিষয়ে আলিমগণ একমত। কিন্তু এ বিষয়েকোনো সহীহ মরফূ হাদীস নেই। শুধু সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের পরবর্তী ব্যক্তিদের থেকে কিছু আছর বর্ণিতহয়েছে এবং এর উপর মুসলমানদের আমল রয়েছে। এরপর লেখেন-

وهذا مما يدل على أن بعض ما أجمعت الأمة عليه لم ينقل إلينا فيه نص صريح عن النبي صلى الله عليه وسلم، بل يكتفي بالعمل به.

অন্য কিছু হুকুমের সাথে এই হুকুমটিও প্রমাণ করে যে, যেসব বিষয়ে উম্মতের ইজমা হয়েছে তন্মধ্যে কিছুবিষয় এমনও আছে, যে সম্পর্কে আমাদের কাছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে স্পষ্ট কোনো নসবর্ণিত হয়ে আসেনি; বরং এ বিষয়ে শুধু আমলে (মুতাওয়ারাছ-এর) উপরই নির্ভর করতে হয়।-ফাতহুল বারীফী শরহি সহীহিল বুখারী, ইবনে রজব হাম্বলী (৭৩৬হি.-৭৯৫হি.) খ. ৬, পৃ. ১২৪

সহীহ হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন সুন্নাতের পাশাপাশি খুলাফায়ে রাশেদীনেরসুন্নতকে অনুসরণ করার এবং তাকে মজবুতভাবে অবলম্বন করার আদেশ করেছেন। ইরশাদ করেছেন-

انه من يعش منكم بعدي فسيرى اختلافا كثيرا، فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين، تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ … وإياكم ومحدثات الأمور، فإن كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة.

‘‘মনে রেখো! আমার পরে তোমাদের যারা জীবিত থাকবে তারা বহু মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন আমারসুন্নত ও আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নতকে আকড়ে রাখবে। একে অবলম্বন করবে এবং মাড়ির দাঁতদিয়ে কামড়ে রাখবে … এবং তোমরা (ধর্মীয় বিষয়ের) নবআবিস্কৃত বিষয়াদি থেকে খুব সতর্কতার সাথেবেuঁচ থাকবে। কেননা প্রতিটি নবআবিস্কৃত বিষয় বেদআত। আর প্রতিটি বিদআত গোমরাহী।’’-সুনানে আবুদাউদ, হাদীস : ৪৬০৭; জামে তিরমিযী  ৫/৪৩, হাদীস : ২৬৭৬; মুসনাদে আহমদ ৪/১২৬, হাদীস : ১৬৬৯২;সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস : ৪২; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৫

জামে তিরমিযীর ২২২৬ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পরে খেলাফতেরমেয়াদ ত্রিশ বছর হওয়ার ভবিষ্যৎবাণী খোদ নবীজীই করে গেছেন। সে হিসেবে নবী-পরিভাষায় খুলাফায়েরাশেদীন চারজন- ১. আবু বকর রা. ২. উমর রা. ৩. উসমান রা. ৪. আলী রা.। তাঁর শাহাদত ৪০ হিজরীররমযানে হয়েছে।

যেহেতু খুলাফায়ে রাশেদীনের ব্যাপারে ওহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জেনেছিলেনযে, তাঁদের জারিকৃত সুন্নতসমূহ নবী-শিক্ষার উপরই ভিত্তিশীল হবে, তাঁদের সুন্নতসমূহ নবী-সুন্নতেরইঅনুগামী হবে এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি মোতাবেক হবে এজন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম উম্মতকে ব্যাপক ঘোষণা দিয়ে বলে যান যে, তোমরা খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে মজবুতভাবেঅাঁকড়ে রাখবে।

সুতরাং যখন উম্মতের সামনে কোনো বিষয়ে প্রমাণ হবে যে, এটি চার খলীফার কোনো একজনের সুন্নত তখনতার অনুসরণের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপরোক্ত আদেশই যথেষ্ট। আমাদেরজন্য আরো অগ্রসর হয়ে এটা ভাবার প্রয়োজন নেই যে, তাঁদের এই সুন্নতের ভিত্তি কী ছিল এবং তাঁরা এইসুন্নত কোন নবী-শিক্ষা থেকে গ্রহণ করেছেন। এখানেও স্বল্প জ্ঞান ও স্বল্প বুঝের লোকদের অভ্যাস হল,খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতের ভিত্তি হাদীসের কিতাবসমূহে খুঁজতে থাকা। এরপর সহীহ সনদে নবীজীর স্পষ্টকোনো বাণী যদি বিশেষ এই ব্যাপারে তারা না পায় তখন তাকে অস্বীকার করে বসে এবং অত্যন্ত
মর্মান্তিকভাবে একে বিদআত আখ্যা দিয়ে দেয়। অথচ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিন্দিতইখতিলাফ থেকে বাঁচার এই পথই দেখিয়েছেন যে, আমার সুন্নত ও আমার খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকেমজবুতভাবে অবলম্বন কর। এরপর বলেছেন, বিদআত থেকে বেঁচে থাক। একটু চিন্তা করুন, যদি খুলাফায়েরাশেদীনের সুন্নত বিদআতই হত তাহলে নবীজীর এই ইরশাদের কোনো অর্থ থাকে কী?

সুন্নাহর পরে শরীয়তের তৃতীয় বুনিয়াদী দলিল হল ইজমা। এর বিভিন্ন ধরন এবং অনেক পর্যায় আছে। এরমধ্যে সর্বপ্রধান ও সর্বশ্রেষ্ঠ হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুহাজির-আনসার এবং অন্যান্যসাহাবীগণের ইজমা। এই ইজমা যদি ব্যাপকভাবে এবং অবিচ্ছিন্ন ও সম্মিলিতরূপে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছায়তবে তা শরীয়তের অনেক বড় অকাট্য দলিল। এ দলিল থাকা অবস্থায় অন্য কোনো দলিলের প্রয়োজন নেই।

আর ইজমাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করার জন্য এরও প্রয়োজন নেই যে, এই ইজমা কীসের ভিত্তিতে সম্পন্নহয়েছে তার অনুসন্ধানে অবতীর্ণ হওয়া। কেননা শরীয়ত নিজেই ইজমাকে দলিল সাব্যস্ত করেছে এবং যাঁদেরমাধ্যমে ইজমা সম্পন্ন হয় তাঁদের ব্যাপারে আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছে যে, এঁরা কখনো গোমরাহীর বিষয়েএকমত হতে পারে না। কুরআন মজীদে তো সুস্পষ্টভাবে মুহাজির ও আনসারী সাহাবীগণের অনুসরণেরআদেশ করা হয়েছে এবং সাবীলুল মুমিনীন (মুমিনদের অনুসৃত পথ) থেকে বিমুখ হওয়াকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্তহওয়ার কারণ বলা হয়েছে।

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর মত, পথ ও রুচির সাথে একাত্মতা পোষণ করে না এমন ব্যক্তিদের অভ্যাসহল তারা কোনো মাসআলায় শুধু উম্মতের ফকীহবৃন্দ নয়, উম্মাহর শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ-সাহাবায়ে কেরাম, বিশেষতমুহাজির ও আনসারের ঐকমত্য থাকা অবস্থায় ভিন্ন দলিল তালাশ করতে থাকে। অথচ শরীয়ত এই ইজমাকেদলিল সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু ওইসব বন্ধু যদি শরীয়তের এই দলিলের সমর্থনে অন্য কোনো সহীহ সনদওয়ালাস্পষ্ট হাদীস না পায় তাহলে এই মাসআলাটিকে অস্বীকার করে দেয়। কেউ তো আরো এক ধাপ বেড়ে অত্যন্তদুঃসাহসিকতার সাথে শরীয়তের দলিল ইজমাকেই অস্বীকার করে বসে।

মনে রাখবেন, এসব হচ্ছে মূর্খতা ও শরীয়তের প্রতি অনাস্থা প্রকাশের সমার্থক। যদিও তা অসচেতনভাবেইহোক না কেন। অর্থাৎ শরীয়ত যে বিষয়টিকে দলিল সাব্যস্ত করেছে তারা তাকে মেনে নিতে পারছেন না।

এ বাস্তবতা সম্পর্কে যাঁদের চিন্তা ভাবনার সুযোগ হয় না তারা বিনা দ্বিধায় ঐ সকল সুন্নতকে ইনকার করে, যাতারা সনদ ভিত্তিক বা মৌখিক বর্ণনা সূত্রে সরাসরি قال رسول الله صلى الله عليه وسلم বা فعل رسول الله صلى الله عليه وسلم শব্দে কোনো সহীহ হাদীসে পান না। একারণে খুব সহজেই তারা খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহএবং আমলে মুতাওয়ারাছকে ইনকার করেন। বিশ রাকাআত তারাবী, জুমার নামাযের প্রথম আযান,তারাবীতে কুরআন খতম, জুমার খোৎবা আরবীতে হওয়া, কালেমায়ে তাওহীদের উভয় অংশ একসাথে বলারবৈধতা لا إله إلا الله محمد رسول الله. ইত্যাদি অনেক বিষয়, যেগুলোর বড় দলীল বা প্রসিদ্ধ দলিল হচ্ছেখোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত, মুসলিম উম্মাহর আমলে মুতাওয়ারাছ কিংবা আছারে সাহাবা ও তাবেয়ীন,এসব কিছুকে তারা এই বলে অস্বীকার করেন যে, এগুলো সহীহ হাদীসে নেই! তো উপরে উল্লেখিত বাস্তবতাসম্পর্কে চিন্তা করলে অনুমান করতে পারবেন, তাদের নীতি কতটা ভুল ও মারাত্মক নীতি! অথচ খোলাফায়েরাশেদীনের সুন্নাহ এবং আছারে সাহাবা ও তাবেয়ীন যে শুধু সুন্নতে নববীর সাথে যুক্ত তাই নয়, সনদ ভিত্তিকবর্ণনা সূত্রে বর্ণিত অনেক সহীহ হাদীসের (কওলী সুন্নতের) প্রকৃত অর্থ বোঝা ও তার প্রায়োগিক রূপ উপলব্ধিকরাও এর উপর নির্ভরশীল। আলোচনা দীর্ঘ হওয়ার আশংকা না হলে এখানে কিছু উদাহরণও উল্লেখ করাযেত। আহলে ইলম যদি মুহাদ্দিস হায়দার হাসান খান টুংকী রাহ.-এর রিসালা ‘‘আততাআমুল’’ও অধ্যয়নকরেন তাহলেও ইনশাআল্লাহুল আযীয চিন্তার পথ খুলে যাবে। এই রিসালা ‘আলইমাম ইবনু মাযাহ ওয়াকিতাবুহুস সুনানে’র হাশিয়ায় রয়েছে।

. ‘সহীহসুন্নতকে সমার্থক মনে করা

সহীহ বা হাসান পর্যায়ের প্রতিটি রেওয়ায়েত অবশ্যই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরহাদীস। কারণ তা তাঁর থেকে প্রমাণিত। কেউ কেউ মনে করেন, হাদীসে যা কিছু প্রমাণিত তা অবশ্যই সুন্নত বা
মুস্তাহাব। অথচ সঠিক কথা হল, হাদীস দ্বারা যা প্রমাণিত তা শরীয়তের বিধান বটে, কিন্তু তা কোন প্রকারেরএবং কোন পর্যায়ের বিধান; তা কি সুন্নত-মুস্তাহাব, না মোবাহ; সাধারণ বিধান না বিশেষ অবস্থার বিধান; সু্ন্নতহিসেবে করা হয়েছিল, না ওযরের কারণে বা শুধু বৈধতা বর্ণনার জন্য করা হয়েছিল অথবা শুধুঅভ্যাসগতভাবে*** করা হয়েছিল-ইত্যাদি অনেক সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম দিক আছে যেগুলোর গভীরে পৌঁছা ও সমাধানদেওয়া মুজতাহিদ ও ফকীহগণের কাজ। এজন্য আমাদের কর্তব্য, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লামের এই হাদীস সব সময় মনে রাখা-

نضر الله امرء سمع منا حديثا فحفظه، حتى يبلغه غيره، فرب حامل فقه إلى من هو أفقه منه، ورب حامل فقه ليس بفقيه

অর্থাৎ আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে সজীব করুন, যে আমার নিকট থেকে কোনো হাদীস শুনেছে, অতপর তা মুখস্থকরেছে এবং অন্যের নিকট পৌঁছে দিয়েছে। কারণ ফিকহের অনেক বাহক তার চেয়ে অধিক ফকীহর নিকট তাপৌঁছে দিবে এবং ফিকহের অনেক বাহক নিজে ফকীহ নয়।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৮৪৭; সুনানে আবুদাউদ, হাদীস : ৩৬৫২; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৬৭ ও ৬৮০

হাদীস বোঝার ক্ষেত্রে যারা শুধু অনুবাদের উপর নির্ভর করে, না হাদীস বোঝা ও হাদীস-ব্যাখ্যার প্রাথমিক ওস্বীকৃত নিয়মনীতি জানা আছে, না জানার ইচ্ছা আছে আর না এ বিষয়ে আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও ফুকাহায়েউম্মতের জ্ঞান-গবেষণার সহায়তা নেওয়াকে বৈধ মনে করে, এরা তো বুঝতেই পারবে না যে, হাদীসঅনুসরণের নামে অজান্তেই তারা সুন্নাহ বিরোধিতায় লিপ্ত হবে।

এদের কেউ মনে করবে, সব লোক আহাম্মক, এরা মসজিদের বাইরে বা জুতার বাক্সে জুতা রাখে অথচ সুন্নতহল, জুতা পায়ে দিয়ে নামায পড়া! তবে মাথায় না টুপি থাকবে, না পাগড়ি। খালি মাথায় জুতা পায়ে নামাযপড়া সুন্নত!

কেউ মনে করবে, (নাউযুবিল্লাহ) পশ্চিমাদের রীতিই তো সঠিক। পেশাব তো দাঁড়িয়ে করাই সুন্নত!

কেউ বলবে, নামাযে নাতনিকে কাuঁধ তুলে নেওয়া সুন্নত!

কেউ ফরয নামাযের আগে পরের সুন্নতে রাতিবা (সুন্নতে মুয়াক্কাদা) এবং বিতরকে আম নফলের মতো মনেকরে অবহেলা করবে, কিন্তু অতি উদ্যম প্রদর্শন করবে মাগরিবের আগের দুই রাকাত নফলের বিষয়ে!

কেউ জুমআর আগের চার রাকাআত সুন্নতকে অস্বীকার করবে, জুমার পরের সুন্নত ত্যাগ করার বিষয়েওকোনো আফসোস হবে না, অথচ খোৎবা চলা অবস্থায় তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়তে ভুল করবে না।

কেউ মিসওয়াকের সুন্নত সম্পর্কে উদাসীন থাকবে, কিন্তু পাগড়ি বাঁধার বিষয়ে ভুল করবে না!

কেউ শোয়ার সময় চোখে সুরমা দিতে ভুলবে না, কিন্তু শোয়ার সময় দুআ ও যিকিরের কথা চিন্তাও করবে না!

কেউ তো দস্তরখান বিছানোর ক্ষেত্রে সামান্য শিথিলতাও করবে না, কিন্তু খাবারের কোনো দানা, তরকারিরটুকরা পড়ে গেলে তা উঠিয়ে খাওয়ার ধারে কাছেও যাবে না!

কেউ মৌলিক বিষয়াদিতে সালাফ ও আকাবিরের তরীকা থেকে সরে যাবে, কিন্তু ব্যবস্থাপনাগত ওপরিবর্তনশীল বিষয়াদি অবস্থা ও চাহিদার পরিবর্তনের পরও আকাবিরের তরীকা আখ্যা দিয়ে তাতে জমেথাকবে আর এই ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করবে যে, আকাবিরের তরীকায় আছি!

কেউ নিজের সংশোধনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে সমাজের সংশোধনকে!

কেউ নিজের সন্তানের চিন্তার চেয়ে বেশি জরুরি বলবে উম্মতের চিন্তাকে!

কেউ দ্বীনের উপর আমল করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে দ্বীনের খেদমত ও দাওয়াতকে!

কেউ দ্বীনের বিধানের উপর আমল করার চেয়ে বেশি তৎপর থাকবে হুকুমতে ইসলামিয়া কায়েম করার ক্ষেত্রে।

মোটকথা, এই ধরনের এবং এর চেয়েও মারাত্মক ধরনের চিন্তাগত ও কর্মগত প্রান্তিকতার, যা আমাদের প্রায়সকল ঘরানায় কমবেশি বিস্তার লাভ করছে, এর কারণ এছাড়া আর কী যে, আমরা আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ওফুকাহায়ে উম্মতের জ্ঞান-গবেষণা থেকে কুরআন বোঝা, হাদীস বোঝা এবং হাদীস মোতাবেক আমল করারবিষয়ে হয়তো সহায়তা নেই না কিংবা সঠিক পন্থায় নেই না।

আমার এই অনুযোগ শুধু ঐ বন্ধুদের সম্পর্কেই নয়, যারা-আল্লাহ মাফ করুন-ফিকহের মাযহাব ও মুজতাহিদইমামদের সম্পর্কে বিদ্বেষ বা অপ্রসন্নতা পোষণ করেন কিংবা তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও ভালোবাসা দিতে প্রস্ত্ততনন; আমার অনুযোগ ঐ ভাইদেরও প্রতি, যারা ফিকহের মাযহাব এবং আকাবির ও আসলাফের নাম নিয়েওالفقه العام للدين (দ্বীনের সাধারণ প্রজ্ঞা) এবং فقه الوسطية والاعتدال  (মধ্যপন্থা ও ভারসাম্য সম্পর্কে প্রজ্ঞা)অর্জনের বিষয়ে উদাসীন। এই ফিকহ ও প্রজ্ঞা তো আহলে ফিক্হ ও আহলে দিলের সোহবত ছাড়া এবং এ দুইবিষয়ে লিখিত প্রতি যুগের আহলে ফিক্হ ও আহলে দিল ব্যক্তিদের নির্বাচিত কিতাবাদি পাঠ করা ছাড়া অর্জনকরা সহজ নয়।

. দলিলের শুধু সনদ দেখা। দলিল দ্বারা বিষয়টি কীভাবে প্রমাণ হয় এবং মূল আলোচ্য বিষয়ে তাপ্রযোজ্য কি না সম্পর্কে চিন্তা না করা।

কোনো হাদীস বা আছার দ্বারা কোনো বিধান প্রমাণ করতে হলে অনেকগুলো বিষয় দেখা জরুরি। তন্মধ্যেসবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুটি :

১. ঐ হাদীস বা আছর নির্ভরযোগ্য কি না। তার সনদের মান এমন কি না, যা প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করাযায়।

২. বাস্তবিকই তা আলোচিত বিধানের উপর দালালত করে কি না (অর্থাৎ আলোচিত বিধানকে নির্দেশ করে কিনা)। করলে সেটি কোন প্রকারের এবং কোন পর্যায়ের দালালত।

কোনো হাদীস বা আছর দ্বারা মাসআলা প্রমাণ করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিষয়টির গুরুত্ব প্রথম বিষয় থেকে কোনোঅবস্থাতেই কম নয়। উসূল ও মাবাদিয়াতের ইলম হাসিল করা ছাড়া শুধু অনুবাদের উপর নির্ভর করে যারাগবেষণার প্রাসাদ নির্মাণ করতে চান তারা দ্বিতীয় বিষয়ে থাকেন সম্পূর্ণ উদাসীন।

যেমন কারো দাবি যদি এই হয় যে, ‘রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকুর তাকবীরের সময়,রুকু থেকে উঠে এবং দুই রাকাত থেকে উঠে সর্বদা রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন, কখনো এইসব জায়গায়রাফয়ে ইয়াদাইন ছাড়তেন না’ এরপর সহীহ বুখারীর এই হাদীস দ্বারা তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে,আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. যখন নামায শুরু করতেন তখন আল্লাহু আকবার বলতেন এবং দুই হাত উঠাতেন,যখন রুকু করতেন তখন দুই হাত ওঠাতেন, যখন سمع الله لمن حمده বলতেন তখন দুই হাত ওঠাতেন এবংযখন দুই রাকাতের পর দাঁড়াতেন তখন দুই হাত ওঠাতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. এই আমল আল্লাহররাসূল সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাওলায় বলতেন (মারফু হিসেবে বর্ণনা করতেন)।-সহীহ বুখারী খ.১ পৃ : ১৮০

নামাযের তিন জায়গায় সর্বদা রাফয়ে ইয়াদাইনের দাবি করে শুধু এই হাদীস দেখে যদি মনে করা হয় যে, তারপুরো দাবি প্রমাণ হয়ে গেছে তাহলে ভুল হবে। কারণ এই হাদীসে তো শুধু এটুকু আছে যে, আল্লাহর রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন। কিন্তু সব সময় করতেন তা তো এই হাদীসে বলাহয়নি। তেমনি একথাও বলা হয়নি যে, তিনি কখনো রাফয়ে ইয়াদাইন ছাড়া নামায পড়তেন না। উপরন্তু যখনঅন্য হাদীসে রাফয়ে ইয়াদাইন না করাও প্রমাণিত তখন তা অস্বীকার করার উপায় কী?

তেমনি কারো দাবি যদি এই হয় যে, রাফয়ে ইয়াদাইন সুন্নাতে মুআক্কাদা এবং রাফয়ে ইয়াদাইন না করাখেলাফে সুন্নত; এরপর দলিল হিসেবে ঐ হাদীসটি পেশ করেন তাহলে যদিও তিনি সহীহ হাদীসই পেশকরেছেন, কিন্ত হাদীসটি তার দাবি প্রমাণ করে না। এই হাদীসে রাফয়ে ইয়াদাইন করা প্রমাণিত হয়, কিন্তু তামোবাহ, না বিভিন্ন সুন্নাহর একটি; সুন্নত হলে তা মুআক্কাদা, না মুস্তাহাব ও যীনাত-এসব বিষয়ে এই হাদীসনিশ্চুপ। এসবের জন্য অন্যান্য দলীল ও করীনার প্রয়োজন, যা ফকীহগণের দৃষ্টিতে থাকে, কিন্তু অদূরদর্শীলোকেরা দাবি ও দলিলের মাঝে সামান্য মিল দেখলেই মনে করে, আমাদের গোটা দাবি প্রমাণ হয়ে গেছে।

আরেকটি উদাহরণ : কেউ যদি দাবি করে যে, আযানের আগে আযানের মতো উঁচু আওয়াজে দরূদ পড়াসুন্নত; এরপর দলীল হিসেবে এই হাদীসটি পেশ করে-

من صلى علي واحدة، صلى الله عليه عشرا

যে আমার উপর একবার দরূদ পরে তার প্রতি আল্লাহ দশটি রহমত নাযিল করেন।-সহীহ মুসলিম, হাদীস :৪০৮

তাহলে হাদীস তো সহীহ, কিন্তু এর দ্বারা তার দাবি প্রমাণ হয়নি। কিন্তু তিনি যদি জিদ করেন যে, এ হাদীসেতো সময় নির্ধারণ করা নেই, আস্তে পড়ারও শর্ত নেই, সুতরাং জোরে পড়লেও এই ছওয়াব পাওয়া যাবে।কাজেই আমি আযানের আগে তা জোরে জোরে পড়ব। এরকম জোরাজুরি করলে তাকে তো শুধু এটুকুই বলাযাবে যে, আপনি হাদীসের তরজমা পড়ার সাথে সাথে কিছুটা উসূলে ফিকহ এবং সুন্নত-বিদআত সংক্রান্তশরীয়তের মূলনীতি সম্পর্কেও পড়াশোনা করুন তাহলে বুঝতে পারবেন, আপনি সহীহ হাদীস তিলাওয়াতকরেছেন বটে, কিন্তু তা আপনার দাবির পক্ষে দলিল নয়। একে ঐ দাবির দলিল মনে করা ভুল।

আরেকটি উদাহরণ : কেউ যদি দাবি করেন যে, প্রত্যেক ফরয নামাযের পর ইমাম-মুকতাদী সবাই মিলে হাততুলে জোরে জোরে দুআ করা দায়েমী সুন্নত; এরপর দলীল হিসেবে তিরমিযী শরীফের হাদীস পেশ করে যে,এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন,

أي الدعاء أسمع

কোন দুআ বেশি কবুল হয়? বললেন

جوف الليل ودبر الصلوات المكتوبة

মধ্য রাতের দুআ এবং ফরয নামাযের পরের দুআ। -জামে তিরমিযী, হাদীস : ৩৪৯৯

তাহলে এটা হবে দাবি প্রমাণের অসম্পূর্ণ প্রয়াস। কারণ হাদীস থেকে শুধু এটুকু প্রমাণ হয় যে, ফরয নামাযেরপর দুআ কবুল হয়। এতে এই সময় দুআ করার উৎসাহ তো পাওয়া যায়, কিন্তু হাত তুলে সম্মিলিতভাবেজোরে জোরে দুআ করা এবং একে দায়েমী সুন্নত সাব্যস্ত করার বিষয়টি এই হাদীস দ্বারা প্রমাণ হয় না।

মোটকথা, এটি একটি দীর্ঘ প্রসঙ্গ। দাবি ও দলীলের মাঝে দূরত্বের এই ত্রুটি এবং তদজনিত বিভ্রান্তি থেকেমুক্ত থাকার জন্যই শুধু হাদীসের অনুবাদ পড়ে দাবি-দলিলের ময়দানে নেমে পড়তে নিষেধ করা হয়।

. আলিমের পরিবর্তে বিভিন্ন মাধ্যমকেই যথেষ্ট মনে করা।

ইলম শেখার স্বাভাবিক পদ্ধতি হচ্ছে আহলে ইলম, আহলে ফিক্হ ও আহলে দিল ব্যক্তিদের সাহচর্য অবলম্বনকরা। হাদীস শরীফে আছে-

تعلموا، إنما العلم بالتعلم، والفقه بالتفقه، ومن يرد الله به خيرا يفقهه في الدين.

তোমরা শেখো, ইলম তো শেখার দ্বারা আসে এবং ফিকহ আসে ফিকহের চর্চা ও শেখার দ্বারা। আর আল্লাহযার সম্পর্কে কল্যাণের ইচ্ছা করেন তাকে দ্বীনের ফিকহ দান করেন।-ইবনে আবী আসিম, তবারানী-ফাতহুলবারী খ. ১ পৃ. ১৯৪

সাহবায়ে কেরাম ইলম ও ফিকহ অর্জন করেছেন সাহচর্যের দ্বারা। এরকম তাবেয়ীগণ সাহাবায়ে কেরামেরসাহচর্যের দ্বারা, তাবে তাবেয়ীন তাবেয়ীনের সাহচর্য দ্বারা, এভাবেই এই ধারা চলে আসছে। যখনই আহলেফিকহের সাহচর্য ত্যাগ করে শুধু কিছু উপায়-উপকরণকে ইলম হাসিলের পক্ষে যথেষ্ট মনে করা হয়েছে তখনইইফরাত-তাফরীত (প্রান্তিকতা); বরং তাহরীফ-তাবদীলের (বিকৃতির) দরজা খুলেছে।

এ প্রসঙ্গে ড. নাসির আল-আকলের বক্তব্য ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। এর অনেক আগে ইমাম আবু ইসহাকশাতিবী রাহ. (৭০৯ হি.) তাঁর কিতাব ‘আলমুয়াফাকাত’ খ. ১ পৃ. ৯১-৯২ (বারো নাম্বার মুকাদ্দিমায়) এ বিষয়েবিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং দলিলসহ পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, আদব, তাহকীক ও তাফাককুহ-এগুলো শুধু বই পড়ে হাসিল করা যায় না। এগুলোর জন্য সাহচর্য জরুরি।

গ্রন্থ পাঠ করে, আলোচনা শুনে কিংবা সিডি দেখে তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ করা যায়, কিন্তু ফাকাহাত ও বসীরত তথাপ্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি, ইতিদাল ও ভারসাম্য, আদব ও নীতি এবং বিনয় ও তাওয়াজু হাসিল করতে হলে আহলেফিকহ ও আহলে দিলের সোহবত জরুরি।

. উসূলুল ফিকহ, কাওয়াইদুল ফিকহ, মাকাসিদুশ শরীয়া, আসবাবুল ইখতিলাফ, আদাবুল ইখতিলাফ আলফিকহুল আম লিদ্দীন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান প্রজ্ঞা না থাকা।

এই সকল ইলম ও ফন অতি গুরুত্বপূর্ণ। কুরআন-সুন্নাহর সঠিক ও মানসম্মত বুঝের জন্য এই শাস্ত্রগুলোঅপরিহার্য। মনে করুন, একজন ব্যক্তির কাছে এ সকল ইলমের কোনো সঞ্চয় নেই, তিনি তাফসীরেতাওযীহুল কুরআনের সাহায্যে কুরআন বোঝার চেষ্টা করছেন এবং সাধ্যমত উপদেশ গ্রহণের চেষ্টা করছেনকিংবা মাআরিফুল হাদীস পাঠ করছেন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী হেদায়েত ও নির্দেশনা গ্রহণের  চেষ্টা করছেন তোএতে কোনো অসুবিধা নেই, কোনো আপত্তিও নেই (তবে তাফসীরে তাওযীহুল কুরআনের তৃতীয় খন্ডেরভূমিকায় যে কথাগুলো আরজ করা হয়েছে সেগুলোর দিকে খেয়াল রাখা জরুরি)

আপত্তি তখনই হবে যদি তিনি তাওযীহুল কুরআনের লেখক হতে চান, মাআরিফুল হাদীসের লেখক হতে চান,কিংবা এই কিতাগুলোর উপর পর্যালোচনা বা এই কিতাবের লেখকদের উপর আপত্তি করতে চান অথচউপরোক্ত ইলম ও ফনের কোনো সঞ্চয় তার নেই। নস বোঝা ও তার ব্যাখ্যা-উপস্থাপনার প্রাথমিকবিষয়গুলোর সাথেও তার পরিচয় নেই, দ্বীন ইসলামের সাধারণ বুঝ ও প্রজ্ঞাও তার নেই, এরপরও তিনিতাহকীক ও গবেষণার ময়দানে প্রবেশ করেন এবং নির্দ্বিধায় নিজের মতামত প্রকাশ করতে থাকেন, এমনকিতা অন্যের উপর আরোপেরও চেষ্টা করতে থাকেন!!

এ পদ্ধতি কোথাও কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। উপরোক্ত ইলম ও ফনে পূর্ণ পারদর্শিতা বিপুল জ্ঞান ওপ্রজ্ঞার অধিকারী আলিমদেরই হয়ে থাকে। যাদের এসব বিষয়ে প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়েরও জানাশোনাআছে তারাও তো নিজের পরিধির বাইরে পা রাখা এবং আইম্মায়ে মুজাতাহিদীন ও উলামায়ে উম্মতের বিরুদ্ধেমুখ খোলা থেকে বিরত থাকবেন।

. স্বীকৃত বিষয়কে সাধারণ প্রচলনের মতো মনে করে বিরোধিতা বিচ্ছিন্নতায় আগ্রহী হওয়া।

এক হচ্ছে الشائعات والمروجات যার অর্থ প্রচলিত। এতে দু ধরনের বিষয় আছে : এক. যা প্রচলিত এবং দলীলদ্বারা প্রতিষ্ঠিত দুই. যা প্রচলিত তবে ভিত্তিহীন। আহলে ইলম, বিশেষত যাদেরকে আল্লাহ তাআলা তাজদীদী ওসংস্কারমূলক কাজের তাওফীক দিয়েছেন তারা ভিত্তিহীন বিষয়গুলোর সম্পর্কে সাবধান করেন। এগুলোই হচ্ছেবিদআতের খন্ডন এবং রসম-রেওয়াজের ইসলাহ সংক্রান্ত কিতাবাদির বিষয়বস্ত্ত। হাকীমুল উম্মত মাওলানাআশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর কিতাব اصلاح الرسوم-এর বাংলা তরজমা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রিসালাأغلاط العوام-এরও বাংলা তরজমা হয়েছে। তাজুদ্দীন ফাযারী রাহ. فقه العوام وانكار امور اشتهرت بين الأنام নামেকিতাব লিখেছেন।

ইলমে হাদীস, ইলমে তাফসীর সহ অন্যান্য ইলমের লেখকেরাও এই-দায়িত্ব পালন করেছেন।

এ তো গেল প্রচলন সম্পর্কে কিছু কথা। আরেকটি বিষয় আছে, المسلمات والاجماعيات অর্থাৎ ঐসকল আকীদা,চিন্তা, মত, বিধান ও মাসআলা, যা ইলমের ধারক-বাহকদের কাছে মুসাল্লাম ও স্বীকৃত এবং তার উপর সকলআহলে ইলম বা জুমহুর ও সংখ্যাগরিষ্ঠ আহলে ইলমের ইজমা রয়েছে। কোনো কোনো মানুষ তাদের জ্ঞানেরস্বল্পতা ও আত্মগরিমার কারণে এইসব স্বীকৃত ও সর্বসম্মত বিষয়কেও সাধারণ প্রচলনের মতো মনে করেএবং এগুলোর দলিল খুঁজতে থাকে। বলাবাহুল্য, সীমিত অধ্যয়ন ও সীমাবদ্ধ দৃষ্টিতে প্রত্যেক বিষয়ের দলিলকীভাবে পাওয়া যাবে? তো নিজের অনুসন্ধান অনুযায়ী যখন ঐসব স্বীকৃত কোনো বিষয়ের সুস্পষ্ট দলিল পায়না তখন তা পরিষ্কার ইনকার করে দেয়। তাদের জানা নেই যে, আহলে ইলমের মাঝে সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃতবিষয়াদির উপর আপত্তি করে ভিন্ন রাস্তা অবলম্বন করা হচ্ছে শুযূয। এটা ঐ শুযূযের অন্তর্ভুক্ত, যে সম্পর্কেহাদীস শরীফে এসেছে-

من شذ شذ في النار

যারা বলে অর্থ না বুঝে কুরআন তিলাওয়াতে কোনো ফায়েদা বা ছওয়াব নেই, অযু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করাজায়েয, বিনা ওজরে ত্যাগ করা নামাযের কাযা নেই … ইত্যাদি, তারা এই ভ্রান্তিরই শিকার। তারা স্বীকৃতবিষয়াদিকে সাধারণ প্রচলনের অন্তর্ভুক্ত করে নিজেরাও গোমরাহীর শিকার হয়, অন্যদেরও গোমরাহ করে।

. যে বিষয়ে পারদর্শিতা নেই তাতে অনুপ্রবেশ করা।

ডাক্তার হোক, ইঞ্জিনিয়ার হোক, কিছু কিতাবের তরজমা পাঠ করে সহীহ-জয়ীফের ফতোয়া এবং কোন নামাযহাদীসের মোতাবেক আর কোন নামায হাদীসবিরোধী-এ জাতীয় কঠিন কঠিন ফতোয়া দিতে থাকা।

এ কাজ যেকোনো বিবেকবানের দৃষ্টিতেই অন্যায়, কিন্তু আজকাল এটারই সয়লাব চলছে। এখানে আমি শুধুশিরোনামটুকুই বললাম। মাসিক আলকাউসারের উদ্বোধনী সংখ্যায় প্রকাশিত ‘গবেষণা : অধিকার ওনীতিমালা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পাঠ করার জন্য অবশ্য অনুরোধ করব।

. অন্যকে বিনা দলিলে অজ্ঞ মনে করা কিংবা সুন্নাহ বা সুন্নাহওয়ালার প্রতি অনুরাগী নয় মনে করা।

এটা সরাসরি কুধারণা, যা কুরআন হারাম করেছে। কারো সাথে মতভেদ হলে তার সম্পর্কে কুধারণা পোষণকরাও জায়েয-এই ধারণা ঠিক নয়। কারো সম্পর্কে না জেনে শুধু অনুমান করে কোনো কিছু বলা দুরস্ত নয়।

. আসাবিয়ত অন্যায় পক্ষপাত এবং তাকাববুর অহংকার।

হাদীস শরীফে তাকাববুরের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে-

بطر الحق وغمط الناس

সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ মনে করা।

এই সংজ্ঞার আলোকে প্রত্যেকের কর্তব্য, নিজ নিজ অবস্থা বিচার করা। আসাবিয়ত ও অন্যায় পক্ষপাত শুধুইমামের প্রতিই হয় না; নিজের চিন্তা ও পছন্দের প্রতিও হয়। আর এটাই বেশি খতরনাক।

১০. মুহাসাবার অভাব

অন্য পক্ষের দলিল সম্পর্কে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে এই মুহাসাবা ও আত্মজিজ্ঞাসা জরুরি যে, ঐ পক্ষের কোনোগবেষক আলিম আমার সামনে থাকলে আমি কি এরূপ পর্যালোচনা করতে পারতাম।

আর প্রকৃত মুহাসাবা এই যে, আখিরাতের আদালতে আহকামুল হাকিমীনের সামনে (যদি আমাকে প্রশ্ন করাহয়) আমি কি আমার এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করতে পারব?

এভাবে মুহাসাবা করা হলে বিনা গবেষণায় বা অসম্পূর্ণ গবেষণার ভিত্তিতে পর্যালোচনা বা না-ইনসাফীর সাথেপর্যালোচনা বন্ধ হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাকে ও আমাদের সকলকে নিজের মুহাসাবা করারতাওফীক দান করুন। আমীন।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

এই পরিচ্ছেদে বিক্ষিপ্ত কিছু বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা। তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।

১. রুচির পার্থক্য ও কর্মক্ষেত্রের বিভিন্নতা বিভেদ নয়

তিনটি বিষয় বৈচিত্র ও বিভিন্নতার বড় প্রশস্ত ক্ষেত্র : ১. নফল ২. মোবাহ ৩. দ্বীনের খিদমতের বিভিন্ন শাখা।

ফরয ইবাদত ও ফরয দায়িত্ব পালনের পর অবশিষ্ট সময় নফল কাজে ব্যয় করা উচিত। নফল কাজ অনেক। একেক জনের আগ্রহ একেক কাজের দিকে থাকে। কেউ নফল নামায বেশি পড়েন, কেউ নফল রোযা বেশি রাখেন। কারো আগ্রহ যিকিরের দিকে, কারো আগ্রহ ইলম বাড়ানোর দিকে। কেউ নফল হজ্ব, নফল ওমরা বেশি করেন, কেউ দান-সদকা বেশি করেন। তো যার যে কাজে আগ্রহ হয় করুন। এ হচ্ছে বৈচিত্র ও বিভিন্নতা। একে ঝগড়া-বিবাদ তো দূরের কথা, প্রশ্ন ও আপত্তির কারণও বানানো যায় না।

এটা ঠিক যে, পারিপার্শ্বিকতার বিচারে একেক জনের জন্য একেক রকম আমল বেশি উপযোগী হয়। এজন্য উত্তম হল, কোনো আলিমকে নিজের অবস্থা জানিয়ে পরামর্শ নেওয়া, নিজের শায়খের (দ্বীনী পরামর্শদাতার) কাছে জিজ্ঞাসা করা।

এখানে ইমাম মালিক রাহ.-এর একটি ঘটনা আমাদের মনে রাখা উচিৎ। ঐ যামানার বুযুর্গ আব্দুল্লাহ আলউমারী রাহ. ইমাম মালিক রাহ.কে লিখলেন, ‘আপনি নির্জনতায় আসুন এবং ইনফিরাদী আমলে মশগুল হোন (ইমাম মালিক রাহ.-এর মূল ব্যস্ততা ছিল ফিকহ ও হাদীসের শিক্ষাদান)।’ ইমাম তাঁকে লিখলেন, ‘আল্লাহ তাআলা যেমন রিযক বন্টন করেছেন তেমনি কর্মও বণ্টন করেছেন। কারো জন্য নফল নামায সহজ করেছেন, কিন্তু রোযা রাখা সহজ করেননি। আবার কারো জন্য সদকা আসান করেছেন, কিন্তু রোযা রাখা আসান করেননি। কারো জন্য জিহাদের আমলকে সহজ করেছেন।

ইলমের প্রচার প্রসারও একটি নেক আমল। আল্লাহ তাআলা এটি আমার জন্য সহজ করেছেন। এরই উপর আমি সন্তুষ্ট। আপনি যে কাজে আছেন (অর্থাৎ নির্জন সাধনা), আমার ধারণা আমার পছন্দের আমলটি তার চেয়ে অনুত্তম নয়। আশা করি, দুজনই আমরা কল্যাণ ও পুরস্কারের পথে আছি।’-সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী ৭/৪২৪

একই কথা মোবাহ বিষয়াদির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একেক জনের একেক খাবার পছন্দ, একেক জনের একেক কাপড়; কারো গোল টুপি পছন্দ, কারো লম্বা টুপি; কারো এই জামা পছন্দ, কারো ঐ জামা। আল্লাহ তাআলা যে ক্ষেত্রকে মোবাহ রেখেছেন তাতে প্রত্যেকে নিজ নিজ রুচি ও স্বভাব অনুযায়ী যেকোনোটা অবলম্বন করতে পারে। এতে প্রশ্ন-আপত্তি ঠিক নয়। হ্যাঁ, কখনো পারিপার্শ্বিক কারণে একজনের জন্য একটি মোবাহ বিষয় বা পদ্ধতি উপযোগী হয়, তো অন্যজনের জন্য অন্যটি। এসব ক্ষেত্রেও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করা চাই। যার কোনো মুরবিব বা দায়িত্বশীল আছেন তার সাথেও অবশ্যই পরামর্শ করবে। তবে মনে রাখতে হবে, মোবাহ বিষয়ে নিজের রুচি, স্বভাব, পছন্দ বা নিজের শায়খ ও মুরবিবর রুচি ও পছন্দকে অন্য সবার উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা যাবে না। কেউ এমন করলে তাকে হাদীসের ভাষায় বলা হবে-

لقد لقد حجرت واسعا

একটি প্রশস্ত ক্ষেত্রকে তুমি সংকুচিত করেছ।

আরো বলা হবে, মোবাহের অর্থই হচ্ছে এতে বাধ্যবাধকতা নেই। এরপরও কেন বাধ্যবাধকতা আরোপ করছেন?

ব্যবস্থাপনার বিষয়ও বৈচিত্রের এক বিস্তৃত ক্ষেত্র। ওখানেও অধিক উপযোগী নির্ধারণের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য হতে পারে। একেও লোকেরা দ্বীনী ইখতিলাফ মনে করে। এটা ঠিক নয়। শরীয়ত ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ে ঐক্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টি ও তা রক্ষার জন্য মশোয়ারা, আমীরের আনুগত্য ও সবরের উৎসাহ দিয়েছে। শান্তি চাইলে আমাদেরকে এই পথই অনুসরণ করতে হবে। নিন্দা-কটূক্তি জায়েযও নয়, এর কোনো সুফলও নেই।

দ্বীনী খিদমতের বিভিন্ন শাখা

দ্বীনের প্রচার প্রসারের জন্য, দ্বীনের হেফাযত ও সংরক্ষণের জন্য, দ্বীনের নুসরত ও খিদমতের জন্য এবং সমাজের সর্ব­স্তরে ও জীবনের সকল অঙ্গনে দ্বীনের আহকাম বাস্তবায়নের জন্য অনেক কাজের প্রয়োজন। প্রতিটি কাজ দ্বীনের নুসরতের এক-একটি ক্ষেত্র। দাওয়াত-ওয়াজ, তাবলীগ-তা’লীম, তারগীব-তারহীব, আমর বিল মা’রূফ-নাহী আনিল মুনকার, জিহাদ-তাযকিয়া, রাষ্ট্রের কর্ণধারদের অন্যায় ও গর্হিত কর্ম থেকে বিরত রাখার জন্য সাংগঠনিক তৎপরতা এবং এ ধরনের আরো যত বৈধ কাজ আছে সবগুলো দ্বীনের খিদমতের এক-একটি শাখা। প্রতিটি শাখার সাথে ছোট ছোট  অনেক প্রশাখা আছে। এখন দ্বীনের এই সকল বিভাগের কাজ একজন বা একশ্রেণীর  মানুষের পক্ষে সম্পন্ন করা কাম্যও নয়, সম্ভবও নয়। সুতরাং কর্মবণ্টনের নীতি অনুসরণ ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু আফসোস, কিছু মানুষ কর্মের বিভিন্নতাকেও ইখতিলাফ মনে করে এবং যে যেই শাখার সাথে যুক্ত তাকেই হক্ব এবং অন্য বিভাগকে অন্তত অপ্রয়োজনীয় মনে করে। অথচ প্রতি যুগের আকাবির কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফের জীবন ও কর্মের আলোকে এ কথাই বলে এসেছেন যে, ‘রফীক বনো, ফরীক না বনো।’অর্থাৎ সতীর্থ হও, প্রতিপক্ষ হয়ো না। দ্বীনের প্রত্যেক খাদিম, যে বিভাগেই সে নিয়োজিত থাকুক, দ্বীনের খিদমত করছে। কোনো নাজায়েয কাজে লিপ্ত না হলে এবং ভুল আকীদা, ভ্রান্ত চিন্তার প্রচার না করলে তিনি আমাদের মোবারকবাদ পাওয়ার উপযুক্ত। তিনিও তো আমাদেরই কাজ করছেন। তিনি আমাদের সঙ্গী ও সতীর্থ; শত্রু ও প্রতিপক্ষ নন। বন্ধুকে শত্রু মনে করা কত মারাত্মক ভুল!

হাদীসে আছে, একদিন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে এলেন। সেখানে দুটি হালকা ছিল : এক হালকায় দুআ ও তেলাওয়াত হচ্ছিল, অপর হালকায় তা’লীম ও তাআল্লুম (শেখা-শেখানো)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘উভয় হালকা নেক আমলে আছে।’ এরপর তিনি তালীম-তা’আল্লুমের হালকায় বসলেন একথা বলে যে, ‘আল্লাহ আমাকে শিক্ষক বানিয়ে পাঠিয়েছেন।’-সুনানে ইবনে মাজাহ ১/৮৩; সুনানে দারিমী পৃ. ৫৪; আলফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ ১/১০-১১-আররাসূলুল মু’আল্লিম ওয়া আসালীবুহু ফিত তালীম পৃ. ৯

যারা কর্মের বৈচিত্রকে বিধানের ইখতিলাফ সাব্যস্ত করেন কিংবা নিজের ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রের দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকান না তাদের জন্য-যদি তারা চিন্তা করেন-এই একটি হাদীসই যথেষ্ট।

কিছু লোক আছে, যারা এক মসজিদে একাধিক দ্বীনী কাজ পছন্দ করেন না কিংবা একই সময়ে মসজিদের দুই কোণে দুইটি হালকা, একে অপরের অসুবিধা করা ছাড়া, দুটি আলাদা কাজে মশগুল থাকাকেও সহ্য করতে পারেন না তাদের জন্যও এই হাদীসে চিন্তার উপকরণ আছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনের বুঝ দান করুন এবং দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা-ন্যায় ও ভারসাম্য রক্ষার তাওফীক নসীব করুন। আমীন।

২. সকল ইখতিলাফকে নিন্দিত মনে করা এবং ইখতিলাফের দায় আলিমদের উপর চাপানো

সম্পূর্ণ প্রবন্ধটি মনোযোগের সাথে পড়া হয়ে থাকলে সম্ভবত পরিষ্কার হয়েছে যে, সকল ইখতিলাফ নিন্দিত নয়। একশ্রেণীর মানুষ সকল ইখতিলাফকে নিন্দিত মনে করে। অথচ তাদের নিজেদের মাঝেও আছে হাজারো ইখতিলাফ। এরপর কোথাও কোনো ইখতিলাফ দেখলে অতি সহজে এর দায়-দায়িত্ব আলিমদের উপর চাপিয়ে দেয় এবং আলিমদেরকে অভিযুক্ত করে।

কেউ কোনো বাতিল আকীদা প্রচার করল, কেউ শরীয়তের কোনো হুকুমের তাহরীফ করল, কেউ আল্লাহর বিধানের জায়গায় মাখলুকের আইনকে প্রধান্য দিল, কেউ জরুরিয়াতে দ্বীনের কোনো কিছুকে ইনকার করল এখন আহলে হক আলিমগণ যদি এর প্রতিবাদ করেন তাহলে এটাও ইখতিলাফ হয়ে যায় এবং এক্ষেত্রেও ‘মতভেদে’র জন্য আলিমদেরকে অভিযুক্ত করা হয়!

এদের ভালো করে বোঝা উচিত, সকল ইখতিলাফ নিন্দিত নয়। যে ইখতিলাফ নিন্দিত তাতেও ইখতিলাফের দায় তার উপরই বর্তাবে, যে হক পথ ছেড়ে ভুল পথে গেল। তাওহীদ হক, শিরক বাতিল। সকলের কর্তব্য, তাওহীদের আকীদা গ্রহণ করে তাওহীদপন্থী হওয়া। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তাওহীদের দ্বীন ইসলাম থেকে বিমুখ হয়ে বিভিন্ন ধরনের শিরকে লিপ্ত, এমনকি কোনো কোনো কালিমা পাঠকারীও এই বিষয়ে অজ্ঞ এবং অজ্ঞতা বা হঠধর্মিতার কারণে শিরকে জলীতে লিপ্ত। তাহলে তাওহীদের ক্ষেত্রেও ইখতিলাফ হয়ে গেল, কিন্তু এই ইখতিলাফের জন্য দায়ী কে? যে তাওহীদের উপর আছে সে, না যে তাওহীদের বিরোধিতা করে শিরকে লিপ্ত হয়েছে সে?

সুতরাং মনে রাখতে হবে, ইখতিলাফের জন্য ঐ ব্যক্তিই দায়ী, যে হক্ব ত্যাগ করে বাতিল পথে যায় কিংবা শরীয়তসম্মত ইখতিলাফের ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি ত্যাগ করে ভুল পদ্ধতি অবলম্বন করে। যারা হক্বের উপর আছে, সঠিক নিয়মের উপর আছে তাদেরকে ইখতিলাফের জন্য অভিযুক্ত করা জায়েয নয়; বরং এমন করাটাই হচ্ছে নিন্দিত ইখতিলাফ।

এ বিষয়ে হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর রিসালা ‘ইহকামুল ই’তিলাফ ফী আহকামিল ইখতিলাফ’ পাঠ করা উচিত। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিলে এ
পুস্তিকার সারসংক্ষেপ সহজ ভাষায় আলকাউসারে প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে।

৩. আলিমদের মাঝে মতভেদ হলে আম মানুষ কী করবে?

এই প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে। আমল থেকে গা বাঁচানোর জন্য এবং ভুল থেকে ফিরে আসার সংকল্প না থাকলে অতি নিরীহভাবে এই অজুহাত দাঁড় করানো হয় যে, আমাদের কী করার আছে? আলিমদের মাঝে এত মতভেদ, আমরা কোন দিকে যাব? কার কথা ধরব, কার কথা ছাড়ব?

আমার আবেদন এই যে, আমরা যেন এই অজুহাত দ্বারা প্রতারিত না হই। এটি একটি নফসানী বাহানা এবং শয়তানের ওয়াসওয়াসা। নিচের কথাগুলো চিন্তা করলে এটা যে শয়তানের একটি ধোঁকামাত্র তা পরিষ্কার বুঝে আসবে।

১. জরুরিয়াতে দ্বীন, অর্থাৎ দ্বীনের ঐ সকল বুনিয়াদী আকীদা ও আহকাম এবং বিধান ও শিক্ষা, যা দ্বীনের অংশ হওয়া স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত, যেগুলো মুসলিম উম্মাহর মাঝে সকল যুগে সকল অঞ্চলে ব্যাপকভাবে অনুসৃত, যেমন আল্লাহর উপর ঈমান, তাওহীদে বিশ্বাস, আখিরাতের উপর ঈমান, কুরআনের উপর ঈমান, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর হাদীস ও সুন্নাহর উপর ঈমান, মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আখেরী নবী ও রাসূল হওয়ার উপর ঈমান; পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায, জুমার নামায, যাকাত, রোযা, হজ্ব ও পর্দা ফরয হওয়া, শিরক, কুফর, নিফাক, কাফির-মুশরিকদের প্রতীক ও নিদর্শন বর্জনীয় হওয়া, সুদ, ঘুষ, মদ, শূকর, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, মিথ্যাচার ইত্যাদি হারাম হওয়া এবং এ ধরনের অসংখ্য আকীদা ও বিধান, যা জরুরিয়াতে দ্বীনের মধ্যে শামিল তাতে আলিমদের মাঝে তো দূরের কথা, আম মুসলমানদের মাঝেও কোনো মতভেদ নেই। যারা দ্বীনের এই সকল স্বতঃসিদ্ধ বিষয়কেও বিশ্বাস ও কর্মে অনুসরণ করে না তারাও বলে; বরং অন্যদের চেয়ে বেশিই বলে যে, আলিমদের মাঝেই এত মতভেদ তো আমরা কী করব!

২. অসংখ্য আমল, আহকাম ও মাসাইল এমন আছে, যেগুলোতে আলিমদের মাঝে কোনো মতভেদ নেই। এগুলোকে ইজমায়ী আহকাম বা সর্বসম্মত বিধান হিসেবে গণ্য করা হয়। কিছু মানুষ এসব বিষয়েও নতুন মত ও পথ আবিষ্কার করে, এরপর আলিমদের অভিযুক্ত করে যে, তারা এখানে দ্বিমত করছেন!

৩. আল্লাহ তাআলা যাকে বিচার-বিবেচনার সামান্য শক্তিও দিয়েছেন তিনি যদি আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে সত্য অন্বেষণের নিয়তে জরুরিয়াতে দ্বীন (স্বতঃসিদ্ধ বিষয়াদি) এবং মুজমা আলাইহ (সর্বসম্মত বিষয়সমূহ) সামনে নিয়ে চিন্তা করেন তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারবেন যে, বাতিলের পক্ষাবলম্বনকারীরা ‘আলিম’ (জ্ঞানী) নন; বরং হাদীসের ভাষায় عليم اللسان اللسان ‘বাকপটু’। এই শ্রেণীর লোকদের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকলে আহলে হক্ব আলিমদেরকে, যারা ‘আসসুন্নাহ’ ও‘আলজামাআ’র নীতি-আদর্শের উপর আছেন, চিনে নিতে দেরি হবে না। এরপর তাঁদের সাহচর্য অবলম্বন করলে তিনি তো নিন্দিত মতভেদ থেকে বেঁচেই গেলেন। আর বৈধ মতভেদপূর্ণ বিষয়াদিতে তিনি যদি তার দৃষ্টিতে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য আলিমদের নির্দেশনা অনুসরণ করেন তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। ইনশাআল্লাহ আখিরাতে তিনি দায়মুক্ত থাকবেন।

৪. কুরআন-হাদীসের বাণী ও ভাষ্য থেকে প্রাপ্ত কিছু চিহ্ন ও আলামত আছে, যেগুলোর সাহায্যে ঈমানদারির সাথে চিন্তা-ভাবনা করে কেউ কোনো আলিমকে নির্বাচন করতে পারেন, যার সাহচর্য তিনি গ্রহণ করবেন এবং যার সাথে দ্বীনী বিষয়ে পরামর্শ করবেন।

সময় করে আলিমদের মজলিসে যান, তাঁদের কাছে বসুন এবং লক্ষ করুন, যেসব আমল সর্বসম্মত, যে বিষয়গুলো সর্বসম্মতভাবে সুন্নত এমন বিষয়ের অনুসরণ আর যে বিষয়গুলো সর্বসম্মতভাবে নাজায়েয ও বিদআত তা বর্জনের বিষয়ে কে বেশি ইহতিমাম করেন, কার সাহচর্যের দ্বারা আখিরাতের ফিকির পয়দা হয়, ইবাদতের আগ্রহ বাড়ে, আল্লাহ তাআলার নাফরমানী সম্পর্কে অন্তরে ভয় ও ঘৃণা সৃষ্টি হয় এবং কার সঙ্গীদের অধিকাংশের অবস্থা এসব ক্ষেত্রে ভালো; কে পূর্ণ সতর্কতার সাথে গীবত থেকে বেঁচে থাকেন এবং প্রতিপক্ষের সাথেও ভালো ব্যবহারের আদেশ দেন; কার কথা থেকে বোঝা যায় কুরআন-হাদীসের ইলম তার বেশি, কার কথায় নূর ও নূরানিয়াত বেশি; তেমনি যে আলিমগণ সর্বসম্মতভাবে হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত তাঁরা কাকে সমর্থন করেন। এ ধরনের নিদর্শনগুলোর আলোকে বিচার করার পর কেউ যদি সালাতুল হাজত পড়েন, আল্লাহর দরবারে দুআ করেন, ইসতিখারা করেন, এরপর নেক নিয়তের সাথে কোনো আলিমকে নির্বাচন করেন তাহলে ইনশাআল্লাহু তিনি দায়মুক্ত হবেন।

তবে এক্ষেত্রেও জরুরি মনে করা যাবে না যে, সবাইকে ঐ আলিমের কাছেই মাসআলা জিজ্ঞাসা করা উচিত এবং তাঁরই কাছে পরামর্শ নেওয়া উচিত। তদ্রূপ মতভেদপূর্ণ বিষয়াদিতে ঐসব লোকদের সাথে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়া যাবে না, যারা অন্য আলিমের ফতোয়া ও নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করেন। অন্য কেউ যদি আল্লাহর রেযামন্দির জন্য চিন্তা-ভাবনা করে অন্য কোনো আলিমকে তার দ্বীনী রাহনুমা বানান তাহলে আপনার আপত্তি না থাকা উচিত, না তার সাথে আপনার তর্ক-বিতর্ক করা সমীচীন আর না আপনার সাথে তার।

যে আলিমদেরকে আপনি নির্বাচন করেননি তাদের সম্পর্কে কুধারণা পোষণ করা কিংবা তাঁদের সম্পর্কে কটূক্তি করা কোনোটাই জায়েয নয় এবং বিনা দলীলে তাদের কাউকে বাতিল মনে করাও বৈধ নয়। আপাতত এ কয়েকটি কথাই নিবেদন করলাম।

আরও জানুন

তাহাজ্জুদ পড়লে ইশার পর বিতর পড়া যাবে না?

প্রশ্ন আচ্ছা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়লে এশা নামাজের পর কী বিতরের নামাজ পড়া যাবে না তাহাজ্জুদ …

One comment

  1. এখানে কি বইয়ের বর্তমান সংস্করণের সবটুকু আছে ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস