প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / ওয়াসওয়াসাঃ হানাফী মাযহাব সহীহ হাদীস নির্ভর হলে অন্য মাযহাবকেও সঠিক বলা হয় কেন?

ওয়াসওয়াসাঃ হানাফী মাযহাব সহীহ হাদীস নির্ভর হলে অন্য মাযহাবকেও সঠিক বলা হয় কেন?

প্রশ্ন

আমার প্রশ্ন হলো যদি হানাফি মাজহাবের সকল মাসঅালা সহিহ হাদিস ভিত্তিক  হয় তাহলে এমন অনেক মাসআলা অন্য তিন মাজহাবে রয়েছে যেগুলো হানাফি মাজহাবের মাসঅালার সম্পূর্ন বিপরিত। এমন ক্ষেত্রে যেই মাজহাবের মাসআলা টি সহিহ তাই গ্রহন করতে হবে কিনা। যদি তাই হয় তাহলে কেন এই চার মাজহাবের যে কোনো একটা মাজহাব মানলেই হবে বলেন? কেন শুধু হানাফি মাজহাব মানতে বলেন না?  এই মাজহাবের সকল মাসআলা সহিহ না তাহলে তো শুধু মানতে হবে তাই নয় কি?

প্রশ্নকর্তা-মেহেদী।

মেইল- mehedibd95@gmail.com>

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

আপনার প্রশ্নটির সারমর্ম আমরা যা বুঝেছি তা হল, যদি হানাফী মাযহাবের মাসায়েল সহীহ হাদীস নির্ভর হয়, তাহলে কেন আমরা চার মাযহাবের একটি মাযহাব মানতে বলি? অথচ অন্য মাযহাবে অনেক মাসআলা হানাফী মাযহাবের বিপরীত আছে। তারপরও আমরা কেন শুধু হানাফী মাযহাব মানতে বলি না?

এইতো আপনার প্রশ্ন?

আসলে মূলত আপনার মনে উক্ত প্রশ্নটি উদয় হয়েছে “ইজতিহাদ” ও ‘মুজতাহিদ” সম্পর্কে না জানার কারণে।

যখন কোন বিষয় ইজতিহাদী হয়। তখন উক্ত বিষয়ে ইজতিহাদ করার নির্দেশ আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে মুজতাহিদগণকে প্রদান করেছেন।

কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِّنَ الْأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُوا بِهِ ۖ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَىٰ أُولِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنبِطُونَهُ مِنْهُمْ ۗ وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ لَاتَّبَعْتُمُ الشَّيْطَانَ إِلَّا قَلِيلًا [٤:٨٣

আর যখন তাদের কছে পৌঁছে কোন সংবাদ শান্তি-সংক্রান্ত কিংবা ভয়ের,তখন তারা সেগুলোকে রটিয়ে দেয়। আর যদি সেগুলো পৌঁছে দিত রসূল পর্যন্ত কিংবা সিদ্ধান্ত প্রদানে উপযুক্ত ব্যক্তিদের পর্যন্ত,তখন তাদের মাঝে যারা অনুসন্ধানে যোগ্য তারা সে বিষয়টি সম্পর্কে জেনে যেতো; বস্তুতঃ আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা যদি তোমাদের উপর বিদ্যমান না থাকত তবে তোমাদের অল্প কতিপয় লোক ব্যতীত সবাই শয়তানের অনুসরণ করতে শুরু করত! [সূরা নিসা-৮৩]

উক্ত আয়াতে কারিমায় কোন ভীতিকর যেমন আখেরাত সম্পর্কে সতর্কবাণী, বা সুসংবাদ যেমন কোন সওয়াবের বিষয় বা দুনিয়াবী ভাল-মন্দ বিষয় সম্পর্কে কোন কিছু শুনলেই ছড়াতে শুরু না করে নবীর জমানায় হলে নবীর কাছে, আর নবীকে না পেলে অনুসন্ধানী তথা মুজতাহিদ ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিষয়টি সম্পর্কে জেনে নিতে বলা হচ্ছে।

আর হাদীসে এসব মুজতাহিদরা সঠিক করলে একটি সওয়াব আর ভুল করলে দু’টি সওয়াব হবে মর্মে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে-

عَنْ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ فَأَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ فَأَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ

হযরত আমর বিন আস রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেনঃ যখন কোন হাকেম হুকুম বলতে গিয়ে ইজতিহাদ করে, আর তার ইজতিহাদ সঠিক হয়, তাহলে তার জন্য রয়েছে দু’টি সওয়াব। আর যদি ইজতিহাদে ভুল হয়, তাহলে তার জন্য রয়েছে একটি সওয়াব। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৬৯১৯, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৪৫৮৪, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৩৫৭৬}

তাহলে আয়াত দ্বারা আমরা বুঝতে পারলাম যে সকল বিষয় ইজতিহাদী। সেসব বিষয়ে মুজতাহিদগণ ইজতিহাদ করবে। আর হাদীস বলছে মুজতাহিদ সঠিক বললেও সওয়াব। আবার ভুল বললেও সওয়াব।

আর যারা সাধারণ মুসলিম তথা ইজতিহাদের যোগ্যতা নেই। তাদের কাজ হল  ইজতিহাদী বিষয়ে তাদের নিকটস্থ মুজতাহিদের অনুসরণে আল্লাহর শরীয়ত মান্য করা।

যেমন পবিত্র কুরআনের এক আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে-

وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنفِرُوا كَافَّةً ۚ فَلَوْلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَائِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ [٩:١٢٢]

আর সমস্ত মুমিনের অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না,যাতে দ্বীনের বিষয়ে ফক্বীহ হতে পারে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে,যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে,যেন তারা বাঁচতে পারে। [সূরা তওবা-১২২]

এ আয়াতে দেখুন আল্লাহ তাআলা গুটি কতক মানুষকে দ্বীনের বিষয়ে ফক্বীহ হতে নির্দেশ দিচ্ছেন। আর উক্ত ফক্বীহ ব্যক্তি তার স্বীয় স্বজাতিকে এসে সতর্ক করার জন্য বলা হচ্ছে। দূরের কাউকে বলা হয়নি। বরং সে যে এলাকায় থাকে, তাদের সতর্ক করতে বলা হচ্ছে।

আর গায়রে ফক্বীহ ব্যক্তিরা উক্ত মুজতাহিদ ফক্বীহের নির্দেশনা মানার কথাও পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে এ আয়াত দ্বারা।

তাছাড়া আরো অন্যান্য আয়াতও এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে থাকে। যেমন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنكُمْ ۖ [٤:٥٩]

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর,নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা ফায়সালা প্রদানে সক্ষম তাদের। [সূরা নিসা-৫৯]

এ সংক্রান্ত সব ক’টি আয়াত ও হাদীস সামনে রাখলে এ বিষয়টি পরিস্কার হচ্ছে যে, ইজতিহাদী মাসআলায় মুজতাহিদের দায়িত্ব হল ইজতিহাদ করা এবং তা তার নিজস্ব এলাকায় বলে বেড়ানো। আর গায়রে মুজতাহিদ আম মুসলমানদের দায়িত্ব হল ইজতিহাদী বিষয়ে তার এলাকায় প্রচলিত মুজতাহিদের ইজতিহাদ অনুপাতে আমল করা।

আর যেহেতু বিষয়টি ইজতিহাদী। সুনিশ্চিতভাবে একটিকে চূড়ান্ত সুন্নাহ, আরেকটি বাতিল বলার সুযোগ নেই। তাই সকল মুজতাহিদ অনুসারী তথা  সকল মাযহাবের অনুসারীদেরই মূল বক্তব্য হল-

“আমাদের মুজতাহিদের ইজতিহাদকৃত মাসআলাটি সঠিক, তবে ভুল হবার সম্ভাবনা আছে, আর অন্য মাযহাবের মুজতাহিদের মাসআলাটি ভুল, তবে সঠিক হবার সম্ভাবনা আছে”।

এ কারণে যে এলাকায় যে মুজতাহিদের মাযহাব প্রচলিত সে এলাকায় সে মাযহাব মানবে কুরআনের কারীমের সূরা তওবার ১২২ নং আয়াতের নির্দেশনা অনুপাতে।

বাকি যেহেতু বিষয়টি ইজতিহাদী। তাই অন্য মুজতাহিদের ইজতিহাদকৃত বিষয়টি একদম ভুল বলতে পারবে না। সেই সাথে বাতিল বলার কোন প্রয়োজনও নেই, কারণ মুজতাহিদ ভুল করলেওতো একটি সওয়াব পাচ্ছে। তাই যেখানে রাসূল সাঃ ই সর্বাবস্থায় সওয়াবের নিশ্চয়তা ঘোষণা করে রেখেছেন, সেখানে অন্য কারো ইজতিহাদকে বাতিল বলার কোন যৌক্তিকতাও থাকে না।

বাকি প্রতিটি গায়রে মুজাতাহিদ আম মুসলমানগণ তার স্বীয় এলাকার মুজতাহিদের মাযহাব তথা ইজতিহাদকৃত মাসায়েলকে সঠিক মনে করেই আমল করবে।

যেমন এ উপমহাদেশে আমরা হানাফী মাযহাব অনুপাতেই আমল করছি। এ পদ্ধতি এ উপমহাদেশে ইসলাম আসার পর থেকেই চলে এসেছে। যেদিন থেকে এ জমিনে ইসলাম প্রবেশ করছে, সেদিন থেকে ইজতিহাদী বিষয়ে যে মুজতাহিদের আমল জারি আছে, সেভাবেই জারি থাকবে। সেই হিসেবেই এ উপমহাদেশের মাদরাসাগুলোর সিলেবাস প্রবর্তিত হয়েছে। লাখো মুফতী, মুহাদ্দিস, শাইখুল হাদীস, কোটি উলামা তৈরী হচ্ছে। হাজারো কিতাব সংকলিত হয়েছে। তাই এ উপমহাদেশে হানাফী মাযহাবকেই অনুসরণ করা হবে।

আর যেসব এলাকায় ইসলাম আগমণ করেছে শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারীদের মাধ্যমে, সেখানে ইজতিহাদী বিষয়ে শাফেয়ী মাযহাব অনুপাতে আমল করবে।

তাহলে কোন দ্বন্ধ বিবাদ ও ফিতনা বাকি থাকবে না।

ঠান্ডা মাথায় লেখাটি পড়লে আশা করি বিষয়টি আপনার কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

মাযহাব ও তাকলীদ বিষয়ে আরো জানতে হলে দেখুন

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইমেইল- ahlehaqmedia2014@gmail.com

lutforfarazi@yahoo.com

আরও জানুন

আট ভরি স্বর্নের উপর কতটুকু যাকাত আবশ্যক?

প্রশ্ন আচ্ছালামুয়ালাইকুম। মুহতারাম আমার একটা প্রশ্ন স্বর্ণের কত ভরি হলে যাকাত দিতে হবে। আর আমার …

No comments

  1. Thank you for your valued post.

  2. জাযাকাল্লাহ,‌অথ্যন্ত খু‌শি হলাম,অাল্লাহ অাপনা‌দের হায়াতে বরকত দিন

  3. উত্তম পর্যালোচনা । জাযাকাল্লাহু খইরন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস