প্রচ্ছদ / অপরাধ ও গোনাহ / চোখের হিফাযত এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের হুকুম প্রসঙ্গে

চোখের হিফাযত এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের হুকুম প্রসঙ্গে

প্রশ্ন

আস্‌-সালামু আলাইকুম।

এক ব্যক্তি নামাজী এবং সুন্নাতের অনুসারী। বিভিন্ন কারণে তার ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়। যেমনঃ একাডেমিক/প্রফেশনাল প্রয়োজন, চাকুরী খোঁজা, তথ্যমূলক বিষয়াদি খোঁজা ইত্যাদি। সে ইন্টারনেটে হক্বপন্থী বিভিন্ন ইসলামিক সাইট থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে, এগুলো শেয়ার করে মানুষকে অবগত করে এবং বাতিলপন্থীদের বিভিন্ন বক্তব্যের শিক্ষণীয় জবাবও প্রদান করে। এতে তার নিজের এবং অন্যদের বেশ উপকার হয় বলে বাহ্যিকভাবে মনে হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, হঠাৎ হঠাৎ অল্প সময়ের জন্য তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না এবং সে ইচ্ছাকৃতভাবে চোখের খিয়ানত বা কু-দৃষ্টিতে লিপ্ত হয়। কিছুক্ষণ পর আবার তার চেতন ফিরে আসে, সে তওবা করে এবং লজ্জিত হয়। আবার কু-দৃষ্টি করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে। কিন্তু কিছু দিন পর ইচ্ছাকৃতভাবে আবার সেই গুনাহে লিপ্ত হয়। উল্লেখ্য, ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করে বৈধ ও প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্যে, কিন্তু হঠাৎ করে তা অন্য দিকে মোড় নেয়। সে নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং এরকম কু-দৃষ্টি এবং অনুতপ্ত হওয়ার ঘটনা কিছু দিন পর পরই তার সংঘঠিত হয়। গড়ে আনুমানিক সপ্তাহে/মাসে দুই/তিন বার বা তার কম-বেশী। এমতাবস্থায়, সে মাঝে মাঝে ইন্টারনেট ব্যবহার থেকেই একেবারে বিরত হতে চায়। কিন্তু এর উপকারী ও প্রয়োজনীয় দিকসমূহের কারণে আবার বিরত হয় না।

প্রশ্ন হলোঃ

(১) আলোচ্য ব্যক্তির জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারের হুকুম কি হবে?

(২) যদি হারাম/নাজায়েজ হয় তবে তা কত দিন/মাস/সময় পর্যন্ত বহাল থাকবে?

আশা করি, উত্তর দিয়ে উপকৃত করবেন।

Nazmul Kabir

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

প্রশ্নে উল্লেখিত সমস্যাটি শুধুমাত্র ইন্টারনেটের সাথেই খাস নয়। এটি একটি সামগ্রিক সমস্যা। আপনার উক্ত প্রশ্নটি বাজারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। হবে মসজিদে গমণের ক্ষেত্রেও। হবে হজ্ব সফরের ক্ষেত্রেও। বর্তমানে রাস্তায় বের হওয়া মানেই গোনাহ হবার প্রবল সম্ভাবনা। বিলবোর্ড জোরে নগ্ন অর্ধ নগ্ন নারীদের ছবি। যেদিকে তাকাবেন সেদিকে কোন না কোন নারীর ছবি সম্বলিত বিলবোর্ড পড়বেই। রাস্তার যেদিকে হাটা হোক চেহারা খোলা, বিভিন্ন উত্তেজক পোশাক পরিহিত নারী চোখে পড়বেই। এখন কথা হল আপনি কি বাজার করা ছেড়ে দিবেন? হজ্ব করা ছেড়ে দিবেন? মসজিদে গমণ ছেড়ে দিবেন? আপনি কি দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করা ছেড়ে দিবেন?

অবশ্যই নয়। এসব ক্ষেত্রে যেমন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখাই ঈমানের দাবি। মসজিদেও যেতে হবে। বাজারেও যেতে হবে। হজ্ব করতেও যেতে হবে। আবার স্বীয় চোখকেও হেফাযত করতে হবে। ঠিক তেমনি ইন্টারনেটের মাধ্যমে দ্বীনের কাজও চালাতে হবে। আর স্বীয় চোখও হিফাযত করতে হবে।

এক্ষেত্রে সর্বদা আল্লাহ তাআলা আপনাকে দেখছেন এমন মানসিকতা রাখলে চোখের হিফাযত হতে পারে। আর কোন আল্লাহওয়ালা বুজুর্গের সাথে সম্পর্ক রাখলেও অনেক সময় এসব গোনাহ থেকে বিরত রাখতে সহায়তা করে থাকে।

আর যদি পূর্ণাঙ্গ সতর্ক থাকার পরও এভাবে গোনাহ হয়ে যায়, তাহলে সাথে সাথেই তওবা করবে। আর যদি এটি হতেই থাকে। তাহলে কিছুদিন পর্যন্ত নেট ব্যবহার বন্ধ করে আত্মশুদ্ধি করে নেবার চেষ্টা করবে। তারপর নিজের উপর আস্থা হলে আবার ব্যবহার করবে। মোটকথা হল এখানে সময় নির্দিষ্ট নয়। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণটা হল মূল বিষয়। আর ইন্টারনেট এটি কোন হারাম বস্তু নয়। বাকি ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল এটি ব্যবহার জায়েজ ও নাজায়েজ হওয়া।

عَنْ ابْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” لَا تُتْبِعِالنَّظْرَةَ النَّظْرَةَ؛ فَإِنَّمَا  لَكَ الْأُولَى وَلَيْسَتْ لَكَ الْآخِرَةُ

হযরত বুরাইদা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাঃ  হযরত আলী রাঃ কে বলেন, হে আলী! [সহসা] একবার দেখার পর পুনরায় [কোন বেগানা নারীকে] দেখো না। কারণ, তোমার জন্য প্রথমবারে অনুমতি রয়েছে [যখন তা অনিচ্ছায় হয়ে যাবে], কিন্তু দ্বিতীয়বারের অনুমতি নেই। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২২৯৭৪, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-২৭৫১, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২১৪৯, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৭৭৭}

عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ” مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَنْظُرُ إِلَى مَحَاسِنِ امْرَأَةٍ أَوَّلَ مَرَّةٍ، ثُمَّ يَغُضُّ بَصَرَهُ إِلَّا أَحْدَثَ اللهُ لَهُ عِبَادَةً يَجِدُ حَلَاوَتَهَا

হযরত আবু উমামা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যে কোন মুসলমান কোন নারীর সৌন্দর্যের প্রতি হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যায়, অতঃপর সে নিজ চক্ষু নিচু করে নেয়, তবে আল্লাহ তাআলা তার জন্য এক ইবাদতের সুযোগ সৃষ্টি করেন, যাতে সে তার স্বাদ পায়। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২২২৭৮}

হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত।

فَالْعَيْنَانِ زِنَاهُمَا النَّظَرُ، وَالْأُذُنَانِ زِنَاهُمَا الِاسْتِمَاعُ، وَاللِّسَانُ زِنَاهُ الْكَلَامُ، وَالْيَدُزِنَاهَا الْبَطْشُ، وَالرِّجْلُ زِنَاهَا الْخُطَا، وَالْقَلْبُ يَهْوَى وَيَتَمَنَّى، وَيُصَدِّقُ ذَلِكَ الْفَرْجُ وَيُكَذِّبُهُ

রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন, চোখের জিনা হল [হারাম] দৃষ্টিপাত। কর্ণদ্বয়ের জিনা হল, [গায়রে মাহরামের যৌন উদ্দীপক] কথাবার্তা মনযোগ দিয়ে শোনা। জিহবার জিনা হল, [গায়রে মাহরামের সাথে সুড়সুড়িমূলক] কথোপকথন। হাতের জিনা হল, [গায়রে মাহরামকে] ধরা বা স্পর্শকরণ। পায়ের জিনা হল, [খারাপ উদ্দেশ্যে] চলা। অন্তর চায় এবং কামনা করে আর লজ্জাস্থান তাকে বাস্তবে রূপ দেয় [যদি জিনা করে] এবং মিথ্যা পরিণত করে [যদি অন্তরের চাওয়া অনুপাতে জিনা না করে]। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৬৫৭, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৮৯৩২}

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইমেইল- ahlehaqmedia2014@gmail.com

lutforfarazi@yahoo.com

আরও জানুন

আট ভরি স্বর্নের উপর কতটুকু যাকাত আবশ্যক?

প্রশ্ন আচ্ছালামুয়ালাইকুম। মুহতারাম আমার একটা প্রশ্ন স্বর্ণের কত ভরি হলে যাকাত দিতে হবে। আর আমার …

No comments

  1. মোঃ ফায়সাল

    এক্ষেত্রে আরও একটি কাজ করা যেতে পারে। সেটা হলঃ খাওয়ার মুজাহাদা। যদি প্রতিদিন রোজা রাখা যায়, সেক্ষেত্রে নফস নিয়ন্ত্রনে আসে। এটা একটা পরীক্ষিত আমল। নফস আমাকে গুনাহর দ্বারা ধ্বংস করার চেয়ে উত্তম হল আমি নফসকে খানা না দিয়ে দমিয়ে রাখব। যখন পেট ভরা থাকে, তখনি তার মধ্যে খায়েসাতের চিন্তা আসে।
    অনেক সাথি ভাইদের দেখেছি যে, চোখের গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য খানার মুজাহাদা করে। তবে রোজা রাখার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন ইফতারি বা সেহেরির সময় যেন খানা বেশি না হয়। অর্থাৎ পেটের মধ্যে সবসময় যেন ক্ষুধা থাকে, তাহলে নফস খায়েসাতের দিকে ধাবিত হয় না।
    আর যদি প্রতিদিন রোজা রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে তিন বেলার খানা খুব কমিয়ে খাওয়া যাতে নফস খায়েসাতের দিকে ধাবিত না হয়। এছাড়া বিবাহ করার দ্বারাও মানুষ গুনাহ থেকে দূরে থাকে। চিল্লা বা তিন চিল্লার জন্য আল্লাহর রাস্তায় বের হলে ও নফসের মধ্যে গুনাহের প্রতি ঘৃণা জন্মে।
    আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।

  2. সুন্দর উত্তর । আমি একজন Softwere Engineer . আমাকে নেটে কাজ করতে হয়। সেক্স ভিডিও দেখার আগ্রহ প্রবল। তওবা করি কিন্তু তওবার মেয়াদ থাকে ২/৪ ঘন্টা বা সবোচ্চ ১ দিন । আমার উপাই কি হবে এখন? যদি কো্ন বুজুরগ‍ো এর সাথে সম্পক রাখতে বলেন তবে কয়েক জনের নাম দিলে ভাল হয় যাতে এস্তেখারা করতে পারি। কার খলিফা উল্লেখ করলে ভাল হয়। উত্তর পাইলে খুব খুশি হব । আল্লাহ আপনাকে উত্তম জাঝা খায়ের দান করুন।

  3. ব্যক্তিগত কিছু পরামর্শঃ
    ১) আপনার স্ত্রী/ সন্তান/মা/বাবা কিংবা পরিচিত মানুষের উপস্থিতিতে ইন্টারনেট ব্যবহার করুন।
    ২) কম্পিউটারটি এমন জায়গায় রাখুন যাতে ঐ জায়গা দিয়ে পরিবারের মানুষ সব সময় চলাফেরা করে। এতে করে আপনার খারাপ দিকে মনযোগ যাবে না। সব সময় একটা ভয় কাজ করবে কেউ এসে পড়ে কিনা।
    ৩)একাকী নির্জনে ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
    ৪) কম্পিউটার ডেক্সের সামনে একটি কোরআন শরীফ রাখুন। এতে করে সব সময় একটা আল্লাহ ভীতি কাজ করবে।
    সর্বপরি আল্লাহর কাছে সাহায্য চান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস