প্রচ্ছদ / প্রশ্নোত্তর / মেয়ের অমতে তাবীজ করে বিবাহ দিলে উক্ত বিয়ে ভেঙ্গে ফেলা ঠিক হবে কি?

মেয়ের অমতে তাবীজ করে বিবাহ দিলে উক্ত বিয়ে ভেঙ্গে ফেলা ঠিক হবে কি?

প্রশ্ন

জনাব

আসসালামুআলাইকুম

দয়া করে উত্তর দিলে অনেক খুশি হবো এবং অাল্লাহ এর উত্তম প্রতিদান আপনাকে প্রদান করবেন মেয়ের অমতে জোর করে বা তাবিজ-কবজ করে বিয়েতে রাজি করানো হলে বিয়ে সহি হবে কিনা?

​কিছুদিন পূর্বে আমার এক নিকট আত্নীয়ের মেয়ের বিয়ের জন্য এক ইতালি প্রবাসি ছেলে ঠিক করা হয়েছিলো, কিন্তু ছেলে দেখার পর মেয়ে জোরালো ভাবে জানালো সে এই ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি নয়। কিন্তু এর পূর্বে একটি ছেলে তার পরিবারের কাছে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল যার পরিবারের (মা-ভাই বোন) সাথে মেয়ে বিভিন্ন সময় যোগাযোগ রক্ষা করে এসেছিলো যাকে সে বিয়ে করতে রাজি।​ কিন্তু মেয়ের বাবা-মা এই কথার বিরোধীতা করে মেয়েকে জানায় ইতালি প্রবাসী ছেলের সাথেই তাকে বিয়েতে রাজি হতে হবে। এই অবস্থায় কোনভাবেই যখন মেয়েকে রাজি করানো গেলনা তখন একজন মাওলানা যিনি জ্বীন দ্বারা বিভিন্ন চিকিৎসা করেন মেয়ের বাবা তার শরনাপন্ন হন এবং তার মেয়ে যেনো পূর্বের ঐ ছেলের প্রস্তাবের সব বিষয় এবং তার পরিবারের (মা-ভাই বোন) সাথে মেয়ে বিভিন্ন সময় যোগাযোগের বিষয় গুলো ভুলে যায় সে জন্য তদবির চান। ঐ মাওলানা এই বিষয়ে ঐ মেয়েকে তদবির দিলে মেয়ে ইতালী থেকে আগত ঐ ছেলের ব্যাপারে রাজি হয় এবং যাচাই করে দেখা গেলো মেয়ে আসলেই পূর্বের ছেলের সব বিষয় ভুলে গেছে। কিছুদিনের মধ্যে মেয়েটির সাথে ​ইতালী থেকে আগত ছেলেটির বিয়ে হয়।

আমার প্রশ্ন হলো এই বিয়েটি সহি হয়েছে কিনা? এবং জ্বীন দ্বারা এই ভাবে চিকিৎসা করানো যায় কিনা, করলে এই ভাবে মত পাল্টানো কতটুকু যুক্তিযুক্ত? এই চিকিৎসার নির্দিষ্ট কোন মেয়াদ থাকে কি? মেয়াদের পর মেয়েটি র্পূবের ঐ ছেলেটিকে বিয়ে করতে চাইলে কিভাবে সম্বব?

​আপনার উত্তরের অাশায় রইলাম।​

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

উপরোক্ত প্রশ্নে মূল বিষয় হল, দু’টি। যথা-

১- প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের অমতে তার বিবাহ দেয়ার হুকুম কী?

২- পিতামাতা বিবাহ দেয়ার পর মেয়েটি বিবাহ ভেঙ্গে দিবে কি না?

প্রথম বিষয়ের সমাধান হল, প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের অমতে তাকে কোথাও বিবাহ দেয়া ইসলাম সমর্থন করে না। একাজ থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। তবে এভাবে জোরপূর্বক বিবাহ হলেও বিবাহ শুদ্ধ হয়ে যায়।

বরং বিবাহের সময় মেয়ের সম্মতি নেয়া জরুরী।


عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبَّاسٍ؛ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم، قَالَ: «الْأَيِّمُ أَحَقُّ بِنَفْسِهَا مِنْ وَلِيِّهَا.

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, মেয়ে তার ব্যক্তিগত বিষয়ে অভিভাবকের চেয়ে অধিক হকদার। {মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং-৮৮৮, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৪২১, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৮৮৮, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২০৯৮, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-২২৩৪, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-১১০৮, সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং-৩২৬০, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৪০৮৪, সুনানে দারাকুতনী, হাদীস নং-৩৫৭৬}

عَنْ أَبِي سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ قَالَ: ” جَاءَتِ امْرَأَةٌ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَتْ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنَّ أَبِي وَنِعْمَ الْأَبُ هُوَ، خَطَبَنِي إِلَيْهِ عَمُّ وَلَدِي فَرَدَّهُ، وَأَنْكَحَنِي رَجُلًا وَأَنَا كَارِهَةٌ. فَبَعَثَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى أَبِيهَا، فَسَأَلَهُ عَنْ قَوْلِهَا، فَقَالَ: صَدَقَتْ، أَنْكَحْتُهَا وَلَمْ آلُهَا خَيْرًا. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا نِكَاحَ لَكِ، اذْهَبِي فَانْكِحِي مَنْ شِئْتِ

হযরত সালামা বিনতে আব্দুর রহমান রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক মেয়ে রাসূল সাঃ এর কাছে এল। এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা! কতইনা উত্তম পিতা! আমার চাচাত ভাই আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল আর তিনি তাকে ফিরিয়ে দিলেন। আর এমন এক ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইছেন যাকে আমি অপছন্দ করি। এ ব্যাপারে রাসূল সাঃ তার পিতাকে জিজ্ঞাসা করলে পিতা বলে, মেয়েটি সত্যই বলেছে। আমি তাকে এমন পাত্রের সাথে বিয়ে দিচ্ছি যার পরিবার ভাল নয়। তখন রাসূল সাঃ মেয়েটিকে বললেন, “এ বিয়ে হবে না, তুমি যাও, যাকে ইচ্ছে বিয়ে করে নাও”। {সুনানে সাঈদ বিন মানসূর, হাদীস নং-৫৬৮, মুসন্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদীস নং-১০৩০৪, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-১৫৯৫৩, দিরায়া ফী তাখরীজি আহাদিসীল হিদায়া, হাদীস নং-৫৪১}


عَنِ ابْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: جَاءَتْ فَتَاةٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَتْ: ” إِنَّ أَبِي زَوَّجَنِي ابْنَ أَخِيهِ، لِيَرْفَعَ بِي خَسِيسَتَهُ، قَالَ: فَجَعَلَ الْأَمْرَ إِلَيْهَا، فَقَالَتْ: قَدْ أَجَزْتُ مَا صَنَعَ أَبِي،وَلَكِنْ أَرَدْتُ أَنْ تَعْلَمَ النِّسَاءُ أَنْ لَيْسَ إِلَى الْآبَاءِ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ

হযরত বুরাইদা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক মহিলা নবীজী সাঃ এর কাছে এসে বলল, আমার পিতা আমাকে তার ভাতিজার কাছে বিয়ে দিয়েছে, যাতে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। রাবী বলেন, তখন রাসূল সাঃ বিষয়টি মেয়ের ইখতিয়ারের উপর ন্যস্ত করেন, [অর্থাৎ ইচ্ছে করলে বিয়ে রাখতেও পারবে, ইচ্ছে করলে ভেঙ্গেও দিতে পারবে] তখন মহিলাটি বললেন, আমার পিতা যা করেছেন, তা আমি মেনে নিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল, মেয়েরা যেন জেনে নেয় যে, বিয়ের ব্যাপারে পিতাদের [চূড়ান্ত] মতের অধিকার নেই্ {সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৮৭৪, মুসনাদে ইসহাক বিন রাহুয়াহ, হাদীস নং-১৩৫৯, সুনানে দারা কুতনী, হাদীস নং-৩৫৫৫}

এ সমস্ত হাদীস প্রমাণ করে, মেয়ের অমতে তাকে তাবীজ কবচ করে কোথাও বিবাহ দেয়া ইসলামী শরীয়ত সমর্থিত নয়। কিন্তু শরয়ী শর্ত মেনে সঠিক পদ্ধতিতে বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেলে বিবাহ শুদ্ধ হয়ে যায়।

দ্বিতীয় বিষয় হল, পিতা মাতা সন্তানের জন্য স্বাভাবিকভাবে কল্যাণকামী ফায়সালাই করে থাকেন। সন্তানের অমঙ্গল হোক তা স্বাভাবিকভাবে পিতামাতা চাননা। আর পিতা মাতা দুনিয়ার বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হওয়ায় তাদের নজরে এমন অনেক কিছু থাকে, যা বয়স কম থাকায় সন্তানের চোখে ধরা পড়ে না। তাই সন্তান অনেক সময়ই ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে, আর সন্তানদের বয়সের কমতির কারণে পিতামাতার সিদ্ধান্তকে ভুল মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে পিতামাতার সিদ্ধান্তই সঠিক হয়ে থাকে অনেক সময়। তাই সন্তানদের উচিত কল্যাণকামী পিতামাতার সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়া। পিতামাতাকে কষ্ট না দেয়া।

তা’ই উপরোক্ত পরিস্থিতিতে যেহেতু পিতা মাতা মেয়েকে এক পাত্রের সাথে বিবাহ দিয়েই দিয়েছে, তাই উপরোক্ত বিবাহকে কোন শরয়ী কারণ ছাড়া ভেঙ্গে ফেলা কিছুতেই উচিত হবে না। এর দ্বারা যেমন একদিকে পিতামাতাকে কষ্ট দেয়া হবে, অপরদিকে স্বামী নিরাপরাধ হলে তার উপর জুলুম করা হবে। তাই এ বিবাহ ভেঙ্গে ফেলা কিছুতেই ঠিক হবে না।

আর তাবীজ কবচের প্রতিক্রিয়া কতদিন থাকে, তা সংশ্লিষ্ট কবিরাজরা বলতে পারেন। এসবের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের জানা নেই।

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইমেইল- ahlehaqmedia2014@gmail.com

আরও জানুন

আট ভরি স্বর্নের উপর কতটুকু যাকাত আবশ্যক?

প্রশ্ন আচ্ছালামুয়ালাইকুম। মুহতারাম আমার একটা প্রশ্ন স্বর্ণের কত ভরি হলে যাকাত দিতে হবে। আর আমার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস